মোটিভেশনালে ইমোশনাল প্রজন্ম
আজকাল অমনোযোগী শিক্ষার্থী বলি কিংবা ক্যারিয়ার অসচেতনদের জন্য উন্নত ক্যারিয়ার তৈরিতে মোটিভেশনাল স্পীচ কিংবা কাউন্সিলিং খুবই ফলদায়ক ও বলদায়ক মনে হয়। বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তির আগে বড় ভাইদের সাফল্যগাথার গল্পের ফুলঝুড়ি। বিসিএস পরীক্ষার আগে সিনিয়র ভাই কিংবা অভিজাত ক্যাডারদের ঘুম নিদ্রাহীন সেই দিনগুলোর চমকপ্রদ গালগল্প। আমরা মন্ত্রমুগ্ধের মতো শ্রবণে পাই উন্নত ক্যারিয়ার তৈরির উন্মাদনা ও রসদ।
এরপর খাওয়া-নাওয়া ছেড়ে নেমে যাই অধ্যাবসায়। ফলাফল কেউ জিরো থেকে হিরো। কেউ জিরো থেকে জিরো। তবে এ পড়াশোনায় কিছু জ্ঞান গরীমা অর্জন হয়, যদি চাকরি নাও জোটে। বরং এসবের চেয়ে বড় শক্তি হলো নিজের আত্মবিশ্বাস ও কর্মস্পৃহা। পড়াশোনা না করে কেউ ক্যাডার বানিয়ে দেবে না। তারা শুধু আপনাকে পথ দেখাতে পারেন। স্বপ্ন দেখাতে পারেন । তারা হলেন স্বপ্ন বিক্রির ফেরিওয়ালা।
বাংলাদেশে বর্তমানে স্বপ্নের ফেরিওয়ালাদের ব্যবসা জমজমাট, রমরমা। শহুরে, গ্রামের সবাই এটি সমহারে গলধঃকরণে ব্যস্ত। ফলাফল যাই হোক না কেন, সফল মানুষেরা যখন তাদের গল্প বলেন আমরা তখন দুকান খাড়া করে শ্রবণ করে তৃপ্ত ও উদ্দীপ্ত হই। তাদের মতো সফল মানুষ হওয়ার স্বপ্নে বিভোর হই। কিন্তু সে বক্তব্য কখনো কখনো খাপছাড়া, অতিরঞ্জিত হলে ব্যক্তিত্বের যে হ্রাস ঘটে সেদিকে আমরা কেয়ারলেস।
এসব সাক্ষাৎকার, বক্তব্য তখন আমাদের জন্য হয় বিনোদনের খোরাক। বক্তব্য, ব্যক্তিত্বের স্বরুপ ফুটে তোলে। কিন্তু তা যদি হয় জগাখিচুড়ি ও তালগোল পাকানো, তখন বিদগ্ধ ব্যক্তির পান্ডিত্য হয় জিজ্ঞাসার সম্মুখীন। গত কয়েকদিন আগে ঢাবির একজন শিক্ষক যে বক্তব্য দিলেন, সেটি তো রীতিমতো দায়িত্বজ্ঞানহীন অপরিপক্ক বক্তব্য ও খোঁড়া যুক্তির। বিভিন্ন পত্র-পত্রিকা মারফত আমরা জানলাম যা।
ঘুষ না দেয়ায় বিশ্ব র্যাঙ্কিংয়ে নেই ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় (ঢাবি) এমন অভিযোগ তুুলে বিশ্ববিদ্যালয়ের বাণিজ্য অনুষদের ডিন প্রফেসর শিবলী রুবাইয়াত-উল ইসলাম বলেন, জরিপ পরিচালনাকারী সংস্থার আর্থিক দাবি মেটাতে না পারায় ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের নাম এশিয়ার সেরা বিশ্ববিদ্যালয়ের তালিকায় আসেনি। ঢাকা ইউনিভার্সিটি অ্যালামনাই ইউকের সঙ্গে মতবিনিময়কালে এসব কথা বলেন।
এ বক্তব্যের জন্য আমি মনে করি মন্তব্য নিষ্প্রয়োজন। পাঠকদের উপর প্রতিক্রিয়ার ভার অর্পণ করলাম। গতকালের বিভিন্ন পত্রিকায় একজন মন্ত্রীর ছোটবেলার কাহিনী পড়ে আঁতকে উঠলাম ও খানিকটা নিস্তব্ধ হলাম। খবরটা জেনে আসি। ‘পরিশ্রমই সফলতার মূল চাবিকাঠি। আজকের এখানে পর্যন্ত পৌঁছাতে আমাকেও অনেক পরিশ্রম করতে হয়েছে। ৪০ কিলোমিটার হেঁটে গিয়ে ক্লাস করে আবার ৪০ কিলোমিটার হেঁটে বাড়ি ফিরতাম। আমাদের সময়ে তো এত সুযোগও ছিল না।’
বয়স বাড়ার সাথে সাথে অনেকের বুদ্ধির ক্ষয় হতে থাকে। ডিমেনশিয়া নামক রোগের কারণে অনেকের স্মৃতিভ্রংশ ঘটে। আমাদের অনেক বড় বড় পদধারী ব্যক্তির বক্তব্য ও মন্তব্য শুনলে ব্যাপক হ্যাস্যরসের উপাদান জোগায়। আমাদের হার্টের স্পন্দন বৃদ্ধি পায় এবং মৃদু হাসির উদ্রেক করে। যা স্বাস্থের জন্য উত্তম বটে। ডাক্তাররা বলেন, ‘Laughter is the best medicine’, বিনে পয়সায় বেশিদিন বেঁচে থাকার সুস্থ বিনোদন পাচ্ছি মন্দ কি?
এখন আসি মন্ত্রী সাহেবের কথায় উনি প্রতিদিন হেঁটে ৮০ কিলোমিটার যাতায়াত করতেন স্কুল থেকে বাড়ি। উনি ঘুমাতেন কখন, পড়তেন কখন? আনুষঙ্গিক কাজ কর্ম করতেন কখন? অতিপ্রাকৃত সুপারম্যান ছাড়া হেঁটে এ দুরত্ব কি প্রতিনিয়ত অতিক্রম করা সম্ভব? কোনভাবেই এটি সরলীকরণ সূত্রে পড়ে না। এমন কার্য দুঃসাধ্য ও অবিশ্বাস্যও বটে।
শেকসপিয়রের একটি বাণী ক্লাসে শিক্ষক বলার পর শিক্ষার্থীদের প্রতিক্রিয়া যা হয়েছিল। ‘পৃথিবীটা রঙ্গমঞ্চ আমরা সবাই অভিনেতা-অভিনেত্রী।’ একথা বলার পর শিক্ষার্থীরা চিৎকার চেঁচামেচি শুরু করল। তাদের সবার প্রশ্ন, সবাই অভিনেতা-অভিনেত্রী হলে! দর্শক কে? টিকেট বেচবে কে? নাটক পরিচালনা করবে কে? বোঝে, না বোঝে যাই তারা বলুক ওদের কথার যুক্তি আছে। ছোট মানুষ হয়তো মর্মার্থ অনুধাবন করতে পারেননি।
কিন্তু এ ব্যাপারটি তাদের কচি মনে যথেষ্ট সন্দেহ ও সংশয় তৈরি করবে। ওরা প্রশ্ন করবে, উনি খেয়েছেন কখন? ঘুমিয়েছেন কখন? পড়েছেন কখন? অপশনাল প্রশ্ন করবে, উনি খেলেছেন কখন? ঈশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগর দামোদর নদী রাতে পাড়ি দিয়ে মাকে দেখতে গিয়েছিলেন এটি সত্য গল্প? হ্যাঁ, সত্য। তা সত্য হবার পেছনে যথেষ্ট যুক্তি আছে। উদ্ভট, অতিপ্রাকৃত কিছু এখানে যুক্ত নেই।
ইশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগর খবর পেলেন মা অসুস্থ। মাকে দেখতে যাবেন। বড়কর্তার কাছে ছুটি চাইলেন। আবেদন নাকচ হলে চাকরি ছেড়ে দিলেন ঈশ্বরচন্দ্র। চাকরি বড় কথা নয়। আকাশ ঘন অন্ধকার। দামোদর নদীর তীরে পৌঁছে দেখলেন এই দুর্যোগের রাতে খেয়া নৌকা বন্ধ হয়ে গেছে। তখন সাঁতরে পার হলেন অন্ধকার উত্তাল দামোদর নদী। এই হলো আগের দিনের মনীষীদের জীবনের গল্প। আর আমাদের একালের কিছু সফল মানুষের আষাঢ়ে গল্প শ্রবণে তৃপ্তির ঢেকুর তুলি আমরা।
লেখক: মো. আবু রায়হান,
শিক্ষক ও গবেষক