জ্বালানি তেল নিয়ে টালমাটাল বিশ্ব রাজনীতি
- মোঃ হাসান তারেক
- প্রকাশ: ২১ মে ২০১৯, ০১:২২ PM , আপডেট: ২১ মে ২০১৯, ০১:২২ PM
বিশ্ব রাজনীতির একটা বিরাট অংশ নিয়ন্ত্রণ করে পরিশোধিত বা অপরিশোধিত জ্বালানি তেল। যুগে যুগে এই জ্বালানি তেল নিয়ে বেঁধেছে সংঘাত। বিশ্বায়নের এই যুগেও মহাপরাক্রমশালী দেশগুলো তেলের বাজার নিয়ন্ত্রণ নিয়ে দৃশ্যমান ও অদৃশ্যমান প্রতিযোগিতায় অবতীর্ণ। বিশ্ব রাজনীতিবিদরা প্রতি মুহুর্তেই তেলের দাম এবং এর প্রাপ্যতা নিয়ে শঙ্কিত হয়ে থাকেন।
বর্তমান বিশ্বে যত সংঘাত দেখা যাচ্ছে, যেমন: ভেনিজুয়েলা সংকট, ইরানের উপর মার্কিন অবরোধ, লিবিয়ার চলমান গৃহযুদ্ধ, সিরিয়ার সংঘাত এগুলোর সঙ্গে প্রত্যক্ষ বা পরোক্ষভাবে তেলের বিষয় জড়িত। দ্য ইকোনমিস্টের একদল গবেষক এজন্য বলেছেন যে, ‘এই সম্পদরুপী অভিশাপ অর্থনীতিকে চাপে ফেলে, রাজনীতিকে দুর্নীতিগ্রস্ত করে ও যুদ্ধকে উসকে দেয়।’
গবেষকদের এই বক্তব্যের সত্যতা মিলেছে সময় অসময়ে। নতুন করে তেল নিয়ে রাজনীতি শুরু করেছে মার্কিন জোট। তারা ইরানে অবরোধ আরোপসহ তেহরানের বিরুদ্ধে অব্যাহত শক্তি ব্যবহারের হুমকি দিচ্ছে। মধ্যপ্রাচ্যে বিমানবাহী রণতরীর অবস্থানও তেহরানকে চাপে ফেলার জন্যই।
অপরদিকে, ভেনিজুয়েলায় মার্কিন বিরোধী নিকোলাস মাদুরোর সরকারকে উৎখাত করে ট্রাম্প প্রশাসন চাইছে হুয়ান গুয়াইদোকে ক্ষমতার কেন্দ্রবিন্দুতে আনতে। এই ঘটনাগুলোর সঙ্গে দৃশ্যমান ও অদৃশ্যমানভাবে তেলের রাজনীতি জড়িত। দক্ষিন আমেরিকার দেশগুলোর মধ্যে অপরিশোধিত জ্বালানি তেল উত্তোলনে ভেনিজুয়েলার অবস্থান দ্বিতীয়। অন্যদিকে, ভেনিজুয়েলা দক্ষিন আমেরিকার শীর্ষ জ্বালানি তেল রপ্তানিকারক দেশ। দেশটির রপ্তানি আয়ের ৯০ শতাংশের বেশি যোগান দেয় জ্বালানি তেল।
মার্কিন অবরোধের কারণে, বামপন্থী মাদুরোর সরকার অর্থনৈতিক সংকটে পড়েছে। এই সুযোগকে কাজে লাগিয়ে মার্কিনপন্থী হুয়ান গুয়াইদো দেশে আন্দোলনের ডাক দিয়েছেন। অপরদিকে, মাদুরোর পক্ষে রয়েছে চীন, রাশিয়া, তুরস্ক।
ওপেকের তথ্য অনুযায়ী, অপরিশোধিত তেলের বেশি মজুদ রয়েছে ভেনিজুয়েলায়। তারপরেই, সৌদি আরব ও চর্তুথে ইরান। শিয়া অধ্যূষিত রাষ্ট্র ইরান রিজার্ভ ও রপ্তানির দিক দিয়ে বিশ্বে চর্তুথ অবস্থানে রয়েছে, সৌদি আরব তেল রপ্তানিতে প্রথম। কিন্তু, ইরান ও ভেনিজুয়েলা হচ্ছে মার্কিন মতাদর্শ বিরোধী। এজন্য, সৌদি আরবের মতো আরব রাষ্ট্রগুলোকে ব্যবহার করতে চাইছে যুক্তরাষ্ট্র।
ইরানকে চাপে ফেলার জন্য মার্কিন প্রশাসন দেশটির উপর অবরোধ জারি করে এবং সৌদি আরবকে তেল উৎপাদন বাড়াতে বলে। একইভাবে, ইরান থেকে সর্বোচ্চ তেল আমদানিকারক এবং বিশ্বের দ্বিতীয় ও তৃতীয় বৃহত্তম তেল আমদানিকারক দেশ ভারত ও চীনের উপর ট্রাম্প প্রশাসন বিভিন্ন ব্যবস্থা নেয়ার উদ্যোগ নিয়েছে। এই উদ্যোগের আওতায় ভারতের জেনারালাইজড সিস্টেম অব প্রিফারেন্স (জিএসপি) সুবিধা বাতিল এবং চীনা পণ্যের আমদানি শুল্ক ১০% থেকে বাড়িয়ে ২৫% করার মতো কার্যক্রম আছে।
মার্কিন এই সিদ্ধান্তগুলোকে প্রতিহত করার জন্য বৈরী রাষ্ট্র ভারত ও চীন দক্ষিণ কোরিয়া, জাপানকে নিয়ে ইরানকে বাঁচানোর উদ্যোগ নিচ্ছে বলে বিভিন্ন মাধ্যমে জানা যাচ্ছে। এ ধরনের উদ্যোগ নিলে তা অবশ্যই প্রশংসনীয় হবে। মোটা দাগে বলতে গেলে, তেল নিয়ে বিশ্বে এক ধরনের স্নায়ুযুদ্ধ চলছে। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র এই গেমে জয়ী হওয়ার জন্য নতুন নতুন তেল উৎপাদনকারী দেশের সন্ধানেও ব্যস্ত।
এক্ষেত্রে দৃষ্টিতে রয়েছে, উগান্ডা, মোজাম্বিকের মতো দেশগুলো, যেগুলোকে তেল উত্তোলনের পূর্বেই দেনার দায়ে জর্জরিত করা হচ্ছে। তেলের রাজনীতির এক ভয়াবহ চিত্রের অবতারণা করেছেন ২০১৭ সালে জেমস কাস্ট ও ডেভিড মিলহালি নামের দুজন গবেষক। তারা ১৯৮৮ থেকে ২০১০ সালের মধ্যে বিশ্বজুড়ে আবিষ্কৃত হওয়া ২৩৬টি তেলের খনির বিষয়ে এই গবেষনা করেছিলেন।
তেলের সন্ধান পাওয়ার আগে আইএমএফ দেশগুলোর অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধির যে আভাস দিয়েছিল তা কতটুকু মিলেছিল তা যাচাই করাই উদ্দেশ্য ছিল। গবেষণার ফলে দেখা যায় যে, খনি আবিষ্কৃত হওয়ার পর প্রবৃদ্ধি কমেছে গড়ে শূণ্য দশমিক আট শতাংশ। এভাবে, ঋণের বৃত্তে পড়েছে দেশগুলো।
বিশ্বে তেল নিয়ে এই রাজনীতির শুরু হয়েছিল দৃশ্যমানভাবে, ১৯৭৩ সালের আরব-ইসরাইল যুদ্ধের সময় থেকে। ১৯৭৩ সালে তেল রপ্তানিকারী আরব দেশগুলো যুক্তরাষ্ট্রসহ কিছু শিল্পোন্নত দেশের বিরুদ্ধে তেল নিষেধাজ্ঞা জারি করে। আরব-ইসরায়েল যুদ্ধে ইসরায়েলকে সমর্থন দেয়ায় তারা এই পদক্ষেপ নিয়েছিল। ফলে, বিশ্বে তেলের দাম বেড়ে গিয়েছিল কয়েকগুন। যার প্রভাব পড়েছিল বিশ্ব রাজনীতি ও অর্থনীতিতে।
বিংশ শতাব্দীর শুরু থেকে অনেক সময় পর্যন্ত বিশ্ব তেলের বাজার নিয়ন্ত্রণ করেছিল বড় পশ্চিমা তেল কোম্পানীর একজোট। এদেরকে, সম্মিলিতিভাবে ‘সেভেন সিস্টার্স’ বলা হত। বিশ্বের ৮৫ শতাংশ তেলের রিজার্ভ নিয়ন্ত্রণ করত এরা। কিন্তু, ৫০ এর দশকে দৃশ্যপটে তেলের নায্য দাম আদায়ের উদ্দেশ্য তেল উৎপাদনকারী দেশগুলো চলে আসে এবং গঠন করে রপ্তানিকারক দেশগুলোর জোট ওপেক।
এই জোট বলিষ্ঠ ভূমিকা নেয় ১৯৭৩ সালের তেল অবরোধে। একদিকে, আরব-ইসরায়েল যুদ্ধ এবং অন্যদিকে তখন ভিয়েনায় তেল কোম্পানিগুলোর সঙ্গে ওপেকের বৈঠকে চলছে অচলাবস্থা। ১৯৭৩ সালের ১৬ই অক্টোবর তারা এক যুগান্তকারী পদক্ষেপ নিলেন। এই প্রথম তেল উৎপাদনকারী দেশগুলো তেল কোম্পানিগুলোকে বাদ দিয়ে একতরফাভাবে তেলের দাম ৭০ শতাংশ বাড়ানোর ঘোষণা দিল।
তাছাড়া, আরব-ইসরায়েল যুদ্ধে ইসরায়েলের পক্ষে মার্কিন সহায়তাকে প্রতিহত করার জন্য তেল উৎপাদনকারী দেশগুলোর তেল অবরোধ করলে বিশ্ব বাজারে তেল সংকট দেখা দেয়। এই পরিস্থিতি থেকে শিক্ষা নিয়ে মার্কিন প্রশাসন তেলের নতুন উৎস সন্ধান যেমন শুরু করে দেয়, তেমনিভাবে শুরু করে দেয় নোংরা রাজনীতি। এই মার্কিন তেল রাজনীতির শিকার হয় আফগানিস্তান, ইরাক, সিরিয়া, লিবিয়ার মতো দেশগুলো।
বিশ্ব তেল রাজনীতির ধ্বংসস্তূপে জন্ম নেয় আইএস নামক জঙ্গি সংগঠন। সারাবিশ্বে ছড়িয়ে পড়ে অস্থিতিশীলতার বিষ। তেল নিয়ে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র ও তার মিত্ররাষ্ট্রগুলোর এই নগ্ন রাজনীতির কারণে বিশ্ব শান্তি আজ বিঘ্নিত। তেল মজুদ ও উৎপাদনকারী দেশগুলো তা আরব হোক আর অনারব হোক কেউ নিস্তার পাচ্ছে না মার্কিন অপরাজনীতি থেকে। বিশ্বরাজনীতি ও শান্তি প্রতিষ্ঠার উদ্দেশ্য তাই তেলের বাজার নিয়ন্ত্রণ ও বিপণনকে আরো স্বচ্ছ, শক্তিশালী করার জন্য ওপেককে আরো বেশি সৃজনশীল পদক্ষেপ ও উদ্যোগ নিতে হবে।
লেখক:- মোঃ হাসান তারেক,
প্রভাষক, রাষ্ট্রবিজ্ঞান বিভাগ,
ডক্টর মালিকা কলেজ, ঢাকা