ফেসবুকে এমন ভাব করি— বিদেশে থেকে কি সুখেই না আছি!
ইউরোপ-আমেরিকায় থাকা আপনার বন্ধুবান্ধব কিংবা আত্মীয়স্বজনদের সুন্দর ছবি দেখে আপনারও নিশ্চয়ই বড্ড আলো ঝলমলে বিদেশ জীবন পাবার ইচ্ছে হয়। বিদেশের জীবনটা কি আসলেই এতটা আলো ঝলমলে রঙিন? বোধকরি আমরা যারা বিদেশে থাকি, এদের দায়টাই বেশি। আমরা এমন একটা ভাব করি- বিদেশে থেকে কি সুখেই না আছি!
আচ্ছা আপনারা যারা ইউরোপ-আমেরিকায় থাকেন, আপনারা কি আপনাদের প্রবাস জীবনে আসলেই সুখী? তা হলে আমি যে এত এত গবেষণা রিপোর্ট পড়লাম, সেগুলো কি সব মিথ্যে?
সেখানে তো বলা হচ্ছে- বেশিরভাগ প্রবাসী কিংবা মাইগ্রেন্ট তাদের বিদেশ জীবন নিয়ে সুখী না, নানা মানসিক সমস্যায় ভোগেন এবং জীবনের একটা বিশাল ও লম্বা সময় পর্যন্ত নানান বর্ণবৈষম্যের মাঝ দিয়ে যায়! এর পরও এত আলো ঝলমলে জীবনের একটা ছবি কেন আপনারা দেশে থাকা মানুষগুলোকে দেখান?
গবেষণা রিপোর্টের কথা বাদই দিলাম। আমি নিজেই তো ১৭ বছর ধরে বিদেশে আছি। আমি কি সুখী? এখন প্রশ্ন আসতে পারে, আমি কেন দেশে ফেরত যাচ্ছি না। সে এক ভিন্ন আলোচনা। সেই আলোচনায় এই লেখায় যেতে চাইছি না। এই যে আপনারা ইউরোপ-আমেরিকায় থেকে সুন্দর একটা রেস্টুরেন্টে খেতে বসে ছবি আপলোড করেন ফেসবুকে কিংবা চমৎকার একটা বাসার ড্রইংরুমের আড্ডার ছবি দেন; আপনার জীবন কি আসলে এমন? আপনারা কি আদৌ এত আনন্দের আর সুখী জীবন কাটান?
নাকি সপ্তাহের ছয় দিন হোটেল-রেস্টুরেন্টে হাড়ভাঙা খাটুনি খেটে, চারপাশের অন্য সহকর্মীদের বকাঝকা শুনে, আর কবে দেশে যাব, দেশের বন্ধুবান্ধব, পরিবার আর বর্ষার ঝনঝনানি শব্দ কিংবা কুয়াশা ঢাকা মেঠোপথের কথা মনে করতে করতে আপনাদের জীবন পার করেন? তা হলে কেন আপনারা বিদেশের জীবনের এই মিথ্যে সুখের ছবি তুলে ধরেন?
এই যে দুদিন আগে ৩৯ জন মানুষ নৌকায় করে ইউরোপে ঢুকতে চাইল, রঙিন জীবনের আশায়; তাদের মৃত্যুতে কি আপনাদের একটুও দায় নেই? এরা হয়তো আপনাদের এসব মিথ্যে রঙিন জীবনের স্বপ্নে বিভোর হয়ে যে করেই হোক ইউরোপে আসতে চেয়েছিল। হয়তো ভেবেছিল যে করেই হোক ইউরোপে ঢুকলেই জীবন রঙিন!
আসলেই কি তাই? এর পর যে কি কঠিন জীবন অপেক্ষা করছে, সেটি কি আপনারা কখনও তাদের বলেছেন? বলবেন কেন? আপনি নিজে তো এখানে লেবারের কাজ করছেন কিংবা রেস্টুরেন্টে বসে পেঁয়াজ কাটছেন; আর দেশে গিয়ে এই আপনিই আবার রেস্টুরেন্টে কাজ করা ছেলেটাকে তুই তুকারি করে বলছেন- ব্যাটা কাজ পারিস না!
শত হোক ইউরোপ ফেরত বলে কথা! রেস্টুরেন্ট বয়কে তো যা ইচ্ছেতাই বলাই যায়! যেই ৩৭ মানুষ ডুবে মারা গেল, এরা প্রত্যেকেই দালালদের ৮-১০ লাখ টাকা দিয়েছিল। এই টাকায় চাইলেই দেশে খুব সহজেই কিছু একটা করা যেত। বিদেশে আমরা যেই পরিশ্রম করি, সেই পরিশ্রমের অর্ধেক করলেও দেশে খুব ভালোভাবে বেঁচে থাকা সম্ভব।
সমস্যা হচ্ছে- যারা ইউরোপ-আমেরিকায় থাকেন, তারা আপনাদের সঠিক ছবিটা দেন না! তারা এমন একটা ছবি আপনাদের সামনে তৈরি করে দেন, দেখে মনে হবে- আহা কত সুখ ইউরোপে! আর পরিবার-পরিজনের কথা ভেবে নিজের জীবনবাজি রেখে ইউরোপে ঢুকতে চাইছেন?
আপনাদের জানিয়ে রাখি, সপ্তাহ দুয়েক আগে সাইপ্রাসে এক বাংলাদেশি অবৈধভাবে ঢুকে সেখানে মারা গেছে। তার ভাইবোন ইতালিতে থাকে অনেক দিন ধরে। সে নিজেও ইতালিতে যেতে চাইছিল। তার মৃত্যুর পর তার আপন ভাই-বোন, তার মরদেহ নিতে রাজি হয়নি। কারণ মরদেহ বাংলাদেশে ফেরত পাঠাতে অনেক খরচ।
নিজের জীবন নিয়ে আগে ভাবুন। নিজে বাঁচলেই কেবল অন্যদের নিয়ে চিন্তা করা যাবে। আর বিদেশের যেই মিথ্যে রঙিন জীবন ইউরোপে-আমেরিকায় বসে আমরা প্রবাসীরা আপনাদের সামনে উপস্থাপন করি, জেনে রাখুন- ৯০ ভাগ ক্ষেত্রে সেটা স্রেফ লোক দেখানো রঙিন জীবন। বাস্তবতা হচ্ছে- কেবলই ধূসর!’
লেখক: আমিনুল ইসলাম, ইউরোপে শিক্ষকতা করছেন;
সাবেক শিক্ষার্থী, শাহজালাল বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়