০২ ডিসেম্বর ২০২৫, ১৩:৪২

গভীর উদ্বেগ-উৎকণ্ঠায় বাংলাদেশ: সকলের প্রার্থনায় বেগম খালেদা জিয়া

খালেদা জিয়া ও ড. সাইফুল ইসলাম  © টিডিসি সম্পাদিত

‘মা’ শব্দটি  পৃথিবীর সকল শব্দের মধ্যে মধুর। মার সঙ্গে সন্তানের যে সম্পর্ক সেটা অন্য সম্পর্কের সঙ্গে তুলনা হয় না। একজন মা যখন শারীরিকভাবে অসুস্থ ও বিশেষভাবে সংকটাপন্ন ও জীবন-মৃত্যুর সন্ধিক্ষণে থাকেন সেটি জানার পর সন্তান অবশ্যই তার শিয়রে ছুটে যেতে যান।  তারেক রহমান একটি বাস্তবতায় পরিপূর্ণ হৃদয়স্পর্শী পোস্টে লিখেছেন—“এমন সংকটকালে মায়ের স্নেহস্পর্শ পাওয়ার তীব্র আকাঙ্ক্ষা যেকোনো সন্তানের মতো আমারও রয়েছে। তবে এ বিষয়ে নিজের একক সিদ্ধান্ত গ্রহণের সুযোগ অবারিত ও একক নিয়ন্ত্রণাধীন নয়।’’ এই শেষোক্ত একটি বাক্যই যেন বাংলাদেশের রাষ্ট্রীয় বাস্তবতার গভীরতম অব্যবস্থাপনা প্রকাশ করে দেয়। একজন নাগরিক তাঁর অসুস্থ মা জননীকে দেখার জন্য দেশের মাটিতে ফিরতে চান—তাহলে কোন অদৃশ্য শক্তি তাঁর জন্মগত মানবিক অধিকারটুকু কেড়ে নিচ্ছে?

বাংলাদেশের রাজনৈতিক ইতিহাসের এক অনন্য নাম—বেগম খালেদা জিয়া। জীবন-মৃত্যুর সীমানায় দাঁড়িয়ে থাকা এই নারীর পাশে আজ পুরো জাতির অদৃশ্য ভিড়। কেউ মুসুল্লি হয়ে মসজিদে, কেউ নিভৃতে ঘরের কোণে, কেউ কিংবা হাজার মাইল দূরের প্রবাসে—সবাই এক সুরে প্রার্থনা করছে, তাঁর সুস্থতা কামনায়। গভীর উদ্বেগ-উৎকণ্ঠায় বাংলাদেশের মানুষ। প্রকৃতঅর্থে খালেদা জিয়া এখন আছেন মানুষের প্রার্থনায়। এ প্রার্থনা কেবল একজন অসুস্থ মানুষের জন্য মুনাজাত নয়; এ যেন একটি অর্ধশতকব্যাপী সংগ্রামী ইতিহাসকে বাঁচিয়ে রাখার আর্তি।

এ দেশের রাজনীতিতে খালেদা জিয়ার আবির্ভাব কোনো পরিকল্পিত রাজনৈতিক ক্যারিয়ারের ফল নয়। তিনি প্রথমে ছিলেন একেবারে নিভৃত, অনাড়ম্বর, গৃহবধূ পরিচয়ে। ১৯৬০ সালে তরুণ সেনা অফিসার জিয়াউর রহমানকে বিয়ে করে নতুন জীবনে পা রাখেন—পরিচিত হন খালেদা খানম পুতুল থেকে বেগম খালেদা জিয়া নামে। স্বামী রাষ্ট্রপতি হওয়ার পরও তিনি রাজনীতির আড়ালে—শালীন, সংযত, পরিবারের প্রতি নিবেদিত ছিলেন। কেউ তখন কল্পনাও করতে পারেনি, এই নীরব গৃহবধূ একদিন পুরো জাতির সামনে দাঁড়িয়ে “স্বৈরাচারবিরোধী আন্দোলনের প্রতীক” হয়ে উঠবেন। ১৯৮১ সালের ৩০ মে—সেই ভয়াল রাতটি বদলে দিলো সবকিছু। প্রেসিডেন্ট জিয়াউর রহমান শহীদ হলেন চট্টগ্রামে। পরিবার হারাল স্বজনকে; বাংলাদেশ হারাল এক বীরোত্তম মুক্তিযোদ্ধা দেশপ্রেমিক রাষ্ট্রনায়ককে; আর খালেদা জিয়া হারালেন স্বামী, আশ্রয় ও স্বাভাবিক জীবন। শোকের গভীর অতল থেকে তাঁকে ডেকে তুলল রাজনীতি, দলের কর্মীরা ভরসা খুঁজল তাঁর মুখে, আর দেশ দেখল—এই নীরব নারীর চোখে আগুনের ভাষা।

সামরিক শাসনের আঁধারে তখন বাংলাদেশ। ১৯৮২ সালের মার্চে এরশাদ ক্ষমতা দখল করলে শুরু হয় দীর্ঘ স্বৈরতান্ত্রিক অধ্যায়। ঠিক এই সময়েই খালেদা জিয়াকে নেতাকর্মীরা নিয়ে আসেন বাংলাদেশ জাতীয়তাবাদী দলের হাল ধরতে। মাত্র ক’ বছরের মধ্যে তিনি হয়ে ওঠেন স্বৈরাচারবিরোধী আন্দোলনের কেন্দ্রীয় মুখ—রাস্তায়, মিছিলে, কারাগারে, অবরোধে, কর্মসূচিতে সর্বত্র তাঁর কণ্ঠস্বর গর্জে উঠতে থাকে। জেল-জুলুম, গৃহবন্দিত্ব, লাঠিচার্জ, কাঁদানে গ্যাস—কোনো কিছুতেই তিনি পিছু হটেননি। “আপসহীন নেত্রী” অভিধাটি তখনই, রক্তাক্ত রাজপথের ধুলো থেকে উঠে আসে তাঁর নামের সঙ্গে।

আশির দশকের বাংলাদেশ আসলে দু’টি শব্দে সংক্ষেপ করা যায়—‘স্বৈরতন্ত্র’ ও ‘প্রতিরোধ’। আর এই প্রতিরোধের সামনের সারিতে দাঁড়িয়ে ছিলেন খালেদা জিয়া। তিনি একদিকে বিএনপিকে সংগঠিত করেছেন, অন্যদিকে বহু-দলীয় জোট গড়ে তুলেছেন। সাতদল, পরে ১৫ দল—এইসব ঐক্যজোটের পেছনে ছিল গণতন্ত্র পুনরুদ্ধারের একমাত্র লক্ষ্য। রাজপথের কঠিন বাস্তবতায়, পুলিশের গুলির সামনে, ছাত্র-জনতার স্লোগানের মাঝে তিনি ঠোঁট কামড়ে, চোখের জল লুকিয়ে এগিয়ে চলেছেন এক অজানা গন্তব্যের দিকে—যার নাম স্বাধীন দেশের মুক্ত গণতন্ত্র। ১৯৯০ সালের ছাত্র-জনতার অভ্যুত্থানে যখন স্বৈরাচারী শাসকের পতন হলো, সেই বিজয়ের ভিড়েও কেউ ভুলে যেতে পারেনি—এই দীর্ঘ লড়াইয়ে বারবার গ্রেফতার, নিপীড়ন, অপমান সত্ত্বেও যে নারী হার মানেননি, তিনি বেগম খালেদা জিয়া। সেই থেকেই জন্ম নেয় আরেকটি অভিধা—“দেশনেত্রী”—একটি জাতির গণতান্ত্রিক স্বপ্নের প্রতীকী উচ্চারণ হিসেবে।

১৯৯১ সালের নির্বাচনে বিএনপির জয় এবং খালেদা জিয়ার প্রধানমন্ত্রী হিসেবে শপথ গ্রহণ—বাংলাদেশের রাজনৈতিক ইতিহাসে এক মাইলফলক। দীর্ঘ সামরিক শাসনের পর আবার ফিরে আসে সংসদীয় গণতন্ত্রের শাসনব্যবস্থা, যা তাঁর সরকারের আমলেই সংবিধান সংশোধনের মাধ্যমে পুনঃপ্রতিষ্ঠিত হয়। শহীদ প্রেসিডেন্ট জিয়াউর রহমানের ১৯ দফাকে সামনে রেখে প্রথম মেয়াদে তাঁর সরকার অর্থনীতিকে স্থিতিশীল করার পাশাপাশি গ্রামীণ অবকাঠামো, রাস্তা-ঘাট, যোগাযোগ, কৃষি ও প্রবাসী আয়ের ক্ষেত্রগুলোতে উল্লেখযোগ্য অগ্রগতি ঘটায়। শিক্ষা ক্ষেত্রে নতুন দিগন্ত খুলে যায়; প্রাথমিক পর্যায়ে উপবৃত্তি, নারী শিক্ষায় উৎসাহ, গ্রামে গ্রামে স্কুলের বিস্তারে তিনি অভিনব পদক্ষেপ নেন। 

দ্বিতীয় দফা (২০০১–২০০৬) প্রধানমন্ত্রিত্বকালে বিশ্বায়নের স্রোতে বাংলাদেশের প্রবেশ আরও দৃশ্যমান হয়। টেলিকমিউনিকেশন ও মোবাইল ফোনের ব্যাপক বিস্তার, বেসরকারি টেলিভিশন চ্যানেলের যুগ, সড়কপথের আধুনিকায়ন, বিদ্যুৎ উৎপাদনের প্রসার—সব মিলিয়ে এক ধরনের ডিজিটাল রূপান্তরের ভোর শুরু হয়। একই সঙ্গে আন্তর্জাতিক অঙ্গনে তিনি সৌদি আরব, চীন, ভারত, যুক্তরাষ্ট্র, ইউরোপসহ বিশ্বের গুরুত্বপূর্ণ শক্তিগুলোর সঙ্গে কূটনৈতিক সম্পর্ক সুদৃঢ় করেন। এই দুই মেয়াদকালেই তিনি ছিলেন বিশ্বের অন্যতম প্রভাবশালী নারী রাষ্ট্রনায়কদের একজন। 

২০০৬-পরবর্তী সময়টি বাংলাদেশের রাজনীতিতে আবারও অস্থিরতায় ভরপুর। জরুরি সরকার, ১/১১, রাজনৈতিক নেতাদের বিক্ষিপ্ত দলবদল, গ্রেপ্তার—সব কিছুর কেন্দ্রবিন্দুতে থেকেও খালেদা জিয়া হারাননি তাঁর রাজনৈতিক দৃঢ়তা। তাঁর বিরুদ্ধে একের পর এক মিথ্যা ও রাজনৈতিক উদ্দেশ্যপ্রণোদিত হয়রানিমূলক মামলা দায়ের হয়; দীর্ঘসূত্রতায় ঝুলে থাকা এসব মামলার বিচার, গ্রেপ্তার, কারাবাস—সবকিছুর মধ্যেই তাঁকে বারবার অপমান ও অবমাননার মুখোমুখি হতে হয়েছে। ২০১৮ সালে মিথ্যা মামলায় তাঁর দণ্ড ও কারাগারে প্রেরণ—বাংলাদেশের রাজনৈতিক ইতিহাসে এক বিতর্কিত অধ্যায় হয়ে আছে। বহু আন্তর্জাতিক মানবাধিকার সংস্থা ও পর্যবেক্ষক এই মামলাগুলোকে রাজনৈতিক প্রতিহিংসার প্রেক্ষাপটে দেখেছে। এসব সত্ত্বেও তিনি ভেঙে পড়েননি। কারাবন্দি থাকার সময় গণমানুষের চোখের মণি হয়ে উঠেন তিনি। তিনি জাতীয় ঐক্যের প্রতীক হয়ে উঠেন।

২০২৪ সালের ৫ আগস্ট ছাত্র-জনতার গণ-অভ্যুত্থানের মাধ্যমে নতুন বাংলাদেশে ড. ইউনূস সরকার গঠনের প্রথম শর্ত ছিল তাঁর মুক্তি। তিনি মুক্তি পেলেও গৃহবন্দি, একাকীত্ব ভোগ করেছেন দীর্ঘদিন, তাঁর কলিজার টুকরো প্রিয় পুত্র আরাফাত রহমান কোকোকে হারিয়েছেন। চিকিৎসা সুবিধা বঞ্চিত বাংলাদেশের মানুষের ভালোবাসার প্রাণস্পন্দন এই মানুষটি নানা ধরনের রোগ ব্যাধিতে আক্রান্ত হন। পরিবারের পক্ষ থেকে বারবার বিদেশে তার সুচিকিৎসার আবেদন- অনুরোধ করা হলেও ফ্যাসিস্ট শেখ হাসিনা সুচিকিৎসার পরিবর্তে তাঁর সম্পর্কে ব্যঙ্গ-বিদ্রূপ অব্যাহত রেখেছিল। সঙ্গত কারণে নেতা-কর্মী সাধারণ মানুষের মনে প্রশ্ন উঠেছিল- বেগম খালেদা জিয়াকে স্লো পয়জনিং করা হয়েছে কিনা? এ প্রশ্নের উত্তর এখনও অজানা। 

বিগত দশকগুলোতে শুধু বাংলাদেশের ভেতরেই নয়, আন্তর্জাতিক অঙ্গনেও খালেদা জিয়ার নেতৃত্ব প্রশংসিত হয়েছে বিভিন্ন সময়ে। নিউ জার্সি স্টেট সিনেট ২০১১ সালে তাঁকে “Fighter for Democracy” উপাধিতে সম্মানিত করে—গণতন্ত্র, নারীর ক্ষমতায়ন ও সন্ত্রাসবিরোধী অবস্থানের স্বীকৃতিস্বরূপ। Canadian Human Rights International Organisation (CHRIO) ২০১৮ সালে তাঁকে দেয় “Mother of Democracy” সম্মাননা। এই সম্মাননা বাংলাদেশে গণতন্ত্র, মানবাধিকার ও আইনের শাসনের পক্ষে অবিচল থাকার স্বীকৃতি হিসেবে। এগুলো কোনো দলীয় প্রচারণা নয়; এগুলো ইতিহাসের নথিবদ্ধ প্রমাণ—একজন নারী নেত্রীর দীর্ঘ সংগ্রামের বৈশ্বিক স্বীকৃতি। কিন্তু তিনি একা নন। তাঁর শয্যাপাশে অদৃশ্যভাবে দাঁড়িয়ে আছে—জেলখানার স্যাঁতসেঁতে সেলে কাটানো বহু নিঃসঙ্গ রাত, মিছিলে গুলিবিদ্ধ তরুণদের রক্তমাখা স্লোগান, স্বৈরাচারের বিরুদ্ধে প্রতিবাদের ইতিহাস, তিনবার প্রধানমন্ত্রী হিসেবে রাষ্ট্র পরিচালনার সাফল্যের মিশ্র স্মৃতি, এবং কোটি কোটি মানুষের আশীর্বাদ ও প্রার্থনা। 

দেশের সর্বজন শ্রদ্ধেয় নেত্রী- যিনি সারাজীবন দেশের মানুষের অধিকার রক্ষায় লড়েছেন, আজ তাঁর জীবনের অধিকারটুকু আমরা অন্তত সম্মিলিত প্রার্থনায় রক্ষা করার চেষ্টা করি। মসজিদে কোরআনখানি, গির্জায় মোমবাতি, মন্দিরে প্রসাদ আর প্রদীপ, বৌদ্ধবিহারে প্রার্থনা— যে যেভাবে পারেন, যার যে বিশ্বাস আছে, সেই বিশ্বাসের মাটিতে দাঁড়িয়ে অনুগ্রহ করে একটিবার প্রার্থনা করুন বেগম খালেদা জিয়ার জন্য। রাজনীতিতে তিনি কার পক্ষে, কার বিপক্ষে—এ প্রশ্ন আজ গৌণ। প্রধান প্রশ্নটি আজ—তিনি একজন মানুষ, একজন মা, একজন বিশ্বস্বীকৃত নেত্রী। তবে বিশ্বজুড়ে নেত্রীর রোগ মুক্তির জন্য সৃষ্টিকর্তার কাছে প্রার্থনা শুরু হয়েছে অনেক আগে।

বস্তুত আজ হাসপাতালের সেই সাদা বিছানায় শুয়ে থাকা মহিয়সী নারীটির জন্য প্রার্থনায়রত বাংলাদেশের মানুষ—নারী-পুরুষ-আবাল বৃদ্ধ বনিতা কারো কাছে তিনি “ম্যাডাম”, কারো কাছে “গণতন্ত্রের মা”, কারো কাছে “বিশ্বের অনন্য নেত্রী”, কেউ কেবল “আমার মা” বলে ডেকে তার সুস্থতার জন্য চোখের পানি ফেলছেন। নিশ্চয় সৃষ্টিকর্তা ছোটবড় গরিব দুখী ধর্মবর্ণ সকল মানুষের বুক ফাটা আর্তনাদের ফরিয়াদ শুনবেন এবং তিনি বেগম খালেদা জিয়াকে জনগণের মাঝে সুস্থ শরীরে ফিরিয়ে দিবেন। মহান সৃষ্টিকর্তা পরম করুণাময় আল্লাহ সুবানহাতালা দয়াময়। তিনি সব কিছু করতে পারেন। 

লেখক: সাবেক চেয়ারম্যান, থিয়েটার এন্ড পারফরমেন্স স্টাডিজ বিভাগ, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়