বিএনপির কৃষি সংস্কার ভাবনা
বাংলাদেশের অর্থনীতির প্রাণ হচ্ছে কৃষি। এই কৃষির উন্নয়ন, আধুনিকায়ন এবং রফতানিমুখী কৃষিভিত্তিক শিল্প গড়ে তোলার যে প্রস্তাবনা বিএনপি এবং ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান তারেক রহমান দিয়েছেন, তা দেশের কৃষিজ অর্থনীতিতে এক বৈপ্লবিক পরিবর্তনের পথ নির্দেশ করছে। স্বাধীনতার ঘোষক, বাংলাদেশের কৃষি বিপ্লবের নায়ক শহীদ প্রেসিডেন্ট জিয়াউর রহমান যেভাবে খাল খনন করে বাংলাদেশের সেচ ব্যবস্থা ও কৃষি অবকাঠামোর ভিত্তি স্থাপন করেছিলেন, সেই ধারাবাহিকতাকে আধুনিক ও প্রযুক্তিসমৃদ্ধ করে নতুন যুগে প্রবেশ করাতে চায় বিএনপি।
শহীদ জিয়াউর রহমান ছিলেন বাংলাদেশের কৃষি বিপ্লবের রূপকার। তিনি নিজ হাতে খাল খনন করে সেচ ব্যবস্থার যে বুনিয়াদ গড়ে তুলেছিলেন, তা আজও বাংলাদেশের উৎপাদনের ভিত্তি। তাঁর শাসনামলে ১৪০০-এর বেশি খাল খনন হয়, যার মাধ্যমে লক্ষ লক্ষ একর জমিকে চাষোপযোগী করা সম্ভব হয়। তারই ধারায় দেশনেত্রী বেগম খালেদা জিয়া কৃষিকে সর্বোচ্চ গুরুত্ব দিয়ে কৃষকদের জন্য নানাবিধ সহায়তা কার্যক্রম গ্রহণ করেন। এখন, বিএনপির ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান তারেক রহমান কৃষিকে একবিংশ শতাব্দীর বাস্তবতা ও সম্ভাবনার সঙ্গে মিলিয়ে একটি ডিজিটাল, বিজ্ঞাননির্ভর এবং রফতানিমুখী খাতে রূপান্তরের পরিকল্পনা দিয়েছেন।
২০২৩ সালে বিএনপি ঘোষিত ৩১ দফা রাষ্ট্র মেরামতের রূপরেখার অন্তত সাতটি দফা সরাসরি কৃষি, কৃষক, উৎপাদন ও প্রক্রিয়াজাত শিল্পের সঙ্গে জড়িত। এর মধ্যে সবচেয়ে তাৎপর্যপূর্ণ দফা ২৭-এ বলা হয়েছে, কৃষিপণ্যের ন্যায্যমূল্য নিশ্চিত করা হবে এবং প্রতিটি ইউনিয়নে সরকারি ক্রয় কেন্দ্র স্থাপন করা হবে। মধ্যস্বত্বভোগীদের দৌরাত্ম্য কমিয়ে কৃষক যেন ন্যায্য মূল্য পায়, সে জন্য মূল্য সমর্থন ও উপকরণ ভর্তুকির সমন্বিত ব্যবস্থা নেওয়া হবে। এছাড়াও ইউনিয়নভিত্তিক ডেটাবেস গড়ে তুলে রাষ্ট্রীয় সহায়তার জন্য উপযুক্ত কৃষকদের তালিকা তৈরি করা হবে। উৎপাদন থেকে বাজারজাত পর্যন্ত সমবায় পদ্ধতিতে কৃষকের হাতেই থাকবে ফসলের সংরক্ষণ ও পরিবহণের নিয়ন্ত্রণ।
কৃষকদের সার-বীজ প্রদানের ক্ষেত্রে সরকারের পক্ষ থেকে ভর্তুকি দিয়ে হলেও কৃষিকাজকে টিকিয়ে রাখার দৃঢ় সংকল্প নিয়েছে বিএনপি। কারণ, কৃষক যদি আশাহত হন, তাহলে খাদ্য উৎপাদনে বিপর্যয় দেখা দেবে এবং দেশের সামগ্রিক অর্থনীতিও হোঁচট খাবে। এই বাস্তবতা মাথায় রেখে কৃষি খাতকে আধুনিকায়নের লক্ষ্যে ব্যাপক পরিকল্পনা নিয়েছেন বিএনপির ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান তারেক রহমান। তিনি ইতোমধ্যে বাংলাদেশের বিভিন্ন এলাকার কৃষিকাজের ধরণ, মাটি ও আবহাওয়ার উপযোগিতা এবং কোন এলাকায় কোন ফসল বেশি উৎপাদিত হয় তা নিয়ে বিশেষভাবে কাজ শুরু করেছেন। তাঁর বিভিন্ন বক্তৃতা ও লিখিত প্রস্তাবে সেসব ভাবনার প্রতিফলন স্পষ্টভাবে পাওয়া যায়। জনসংখ্যার ঘনত্ব এবং কৃষিজমির ক্রম সংকোচন বিবেচনায় রেখে উদ্ভাবনমূলক কৃষি কৌশল বাস্তবায়ন করা হবে। পাহাড়, হাওর-বাঁওড় ও সমতল অঞ্চলের ভিন্ন ভিন্ন বৈশিষ্ট্য অনুযায়ী বিশেষায়িত ফসল চাষে উৎসাহিত করতে ‘ক্রপ-জোনিং (Crop Zoning)’ কার্যক্রম জোরদার করা হবে। একইসঙ্গে কৃষকদের উচ্চফলনশীল এবং উচ্চমূল্যের ফসল চাষে উদ্বুদ্ধ করা হবে। উৎপাদনের পাশাপাশি কৃষক যেন বাজারে ন্যায্যমূল্য পান, তা নিশ্চিত করতে সঠিক বাজারজাতকরণ নীতি প্রণয়ন ও বাস্তবায়ন করা হবে।
প্রয়োজনে ভর্তুকি দিয়ে চালু করা হবে শস্য বিমা (Crop Insurance), পশু বিমা (Livestock Insurance), মৎস্য বিমা (Fishery Insurance) এবং পোলট্রি বিমা (Poultry Insurance)। কৃষিজমির অকৃষি ব্যবহার নিরুৎসাহিত করা হবে, এক্ষেত্রে গুচ্ছ পদ্ধতিতে কৃষকদের বসবাসের ব্যবস্থা গ্রহণ করার ব্যবস্থা করা হবে। এবং কৃষি, মৎস্য ও প্রাণিসম্পদ খাতের গবেষণা ও উন্নয়নে অগ্রাধিকার ভিত্তিতে কর্মকৌশল বাস্তবায়ন হবে। সেই সঙ্গে রফতানিমুখী কৃষি প্রক্রিয়াকরণ শিল্পকে (Export-Oriented Agro-Processing Industry) বিশেষ প্রণোদনা দেওয়ার প্রতিশ্রুতি দেওয়া হয়েছে।
একই রূপরেখার ২৯ নম্বর দফায় বলা হয়েছে, খাল পুনঃখনন, নদী সংস্কার, জলাবদ্ধতা ও খরা প্রতিরোধে কার্যকর উদ্যোগ নেওয়া হবে। এটি দেশের সার্বিক পানি ব্যবস্থাপনায় একটি নতুন দৃষ্টিভঙ্গির প্রতিফলন। এই দফাগুলোর বাস্তবায়ন হয়ে উঠবে খাদ্যনিরাপত্তা, কৃষকের অর্থনৈতিক নিরাপত্তা এবং বৈদেশিক মুদ্রা অর্জনের লক্ষ্যে সুস্পষ্ট নীতি নির্দেশনা।
তারেক রহমানের কৃষিনীতির একটি গুরুত্বপূর্ণ দিক হলো : আধুনিক প্রযুক্তির ব্যবহার ও উদ্ভাবনী চিন্তার প্রয়োগ। তিনি শুধু সমস্যার বর্ণনায় থেমে থাকেননি, বরং সমাধানের পথ দেখিয়েছেন নানা প্রযুক্তি ও কার্যকর পদ্ধতির মাধ্যমে। এর মধ্যে রয়েছে ব্যারেট লাইন টেকনোলজি (Barrett Line Technology), যা জমিতে সেচকালে পানির অপচয় রোধ করে সুষ্ঠু ব্যবস্থাপনার সুযোগ করে দেয়। রিসার্ভিওর (Reservoir) প্রযুক্তির মাধ্যমে বন্যার পানি ধরে রেখে তা পরবর্তীতে সেচ কাজে ব্যবহারের ব্যবস্থা গ্রহণের পরিকল্পনাও রয়েছে।
খাস জমির সঠিক ব্যবস্থাপনার মাধ্যমে ফসল মাড়াইয়ের ব্যবস্থা করা সম্ভব। ছোট ছোট প্রান্তিক কৃষকদের জন্য সমবায়ভিত্তিক কৃষি (Cooperative Farming) গড়ে তোলা হবে। এতে জমির অপব্যবহার কমবে এবং কৃষকগণ সম্মিলিতভাবে লাভবান হবেন। এছাড়াও এলাকাভিত্তিক কোল্ডস্টোরেজ স্থাপন করে কৃষিপণ্যের সংরক্ষণ, পরিবহণ ও প্রক্রিয়াজাত সহজতর করা হবে। বিএনপি কৃষকদের জন্য ‘ফার্মার্স কার্ড’ চালুর পরিকল্পনা করেছে, যার মাধ্যমে সার, বীজ ও ঋণ সহজে পাওয়া যাবে। উন্নত বীজ নিশ্চিত করতে প্রতিটি উপজেলায় বীজ প্রক্রিয়াকরণ খামার স্থাপন করা হবে। ফার্মার্স কার্ডের মাধ্যমে কৃষিপণ্য সংরক্ষণের সুবিধাও যুক্ত থাকবে, যাতে ন্যায্য মূল্য নিশ্চিত হয়।
এক ফসলি জমিকে তিন বা চার ফসলি জমিতে পরিণত করার কর্মসূচির মাধ্যমে উৎপাদন বৃদ্ধি করে অভ্যন্তরীণ চাহিদা মেটানোর পাশাপাশি বিদেশে রপ্তানির জন্য উদ্বৃত্ত উৎপাদন নিশ্চিত করা হবে। শস্য বৈচিত্র্যকরণ এবং গুণগতমান বৃদ্ধির মাধ্যমে রফতানিমুখী কৃষিপণ্যের বাজার সম্প্রসারণ হবে। আন্তর্জাতিক বাজারে শাকসবজি, ফলমূল, ফুল, মধু, মাছ ও হিমায়িত খাদ্যপণ্যের চাহিদার কথা মাথায় রেখে এই খাতের প্রক্রিয়াজাত শিল্প গড়ে তোলা হবে।
বিএনপির কৃষি ভাবনা কেবল প্রযুক্তিনির্ভর উন্নয়ন নয়, এটি একটি মানবিক, অন্তর্ভুক্তিমূলক এবং সামগ্রিক রূপরেখাভিত্তিক পরিকল্পনা। কৃষকদের জন্য নিরাপত্তা বিমা চালু, বাজারে সরাসরি সংযুক্তি, কৃষিশিক্ষা ও প্রশিক্ষণ, প্রাণিসম্পদ ও মৎস্য খাতের উন্নয়ন, গবেষণা ও উদ্ভাবনে বিনিয়োগ, এসব মিলিয়েই গড়ে উঠেছে একটি আত্মনির্ভর কৃষিনীতির কাঠামো। এই চিন্তার কেন্দ্রে রয়েছেন বিএনপির ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান তারেক রহমান, যিনি ভবিষ্যতের বাংলাদেশকে কৃষিতে আত্মনির্ভর, খাদ্যে স্বয়ংসম্পূর্ণ এবং রফতানি সক্ষম একটি জাতিতে রূপান্তরের স্বপ্ন দেখেন। তাঁর দৃষ্টিভঙ্গি অত্যন্ত বাস্তবভিত্তিক, যেমন, প্রান্তিক পর্যায়ের একজন খামারি যদি রেল, সড়ক বা নৌপথের মাধ্যমে সরাসরি পাইকারি বাজারে তার পণ্য পাঠানোর সুযোগ পায়, তাহলে সে আর মধ্যস্বত্বভোগীদের হাতে পণ্য তুলে দেবে না। এতে কৃষক যেমন : লাভবান হবে, তেমনি বাজারে মূল্যও থাকবে স্থিতিশীল। সড়ক পথে মালামাল পরিবহণের ব্যবস্থা হয় বলে সিন্ডিকেট, চাঁদাবাজি এবং বিভিন্ন অসাধু ব্যক্তিদের কারণে পণ্যের আসল দাম কমে আসে। এসব সমস্যা সমাধানে বিএনপি কৃষিপণ্যের পরিবহণে বিকল্প অবকাঠামো এবং ডিজিটাল বাজার সংযুক্তির পরিকল্পনা করেছে।
এছাড়া বিএনপি মনে করে, আধুনিক কৃষির মূল ভিত্তি হলো : গবেষণা ও উদ্ভাবন। তাই উচ্চফলনশীল বীজ, লবণাক্ততা সহনশীল বীজ, কম পানি চাহিদাসম্পন্ন ফসল, দ্রুত ফলদায়ী জাত, পোকামাকড় প্রতিরোধী বীজ এবং একই মৌসুমে একাধিক ফসল চাষযোগ্য জাত উদ্ভাবনে কৃষি গবেষণাকেন্দ্রগুলোকে শক্তিশালী করা হবে। জেনেটিক্যালি মডিফায়েড (GMO) ফসল নিয়ে নিবিড় গবেষণা করে পরিবেশবান্ধব ও জনকল্যাণমূলক নীতির আওতায় সেগুলোর ব্যবহার নিশ্চিত করা হবে। কৃষি গবেষণার জন্য জাতীয় বাজেটের একটি যৌক্তিক অংশ বরাদ্দ থাকবে। একইভাবে হাঁস-মুরগি, মাছ, গবাদিপশু এবং বনজ সম্পদ উন্নয়নে গবেষণা কার্যক্রম জোরদার করা হবে। ছাগল, গোরু ও মহিষের খামার গড়ে তুলতে ব্যক্তি খাতকে বিশেষ প্রণোদনা দেওয়া হবে। কৃষিপণ্য প্রক্রিয়াকরণ শিল্পেও বিশেষ সুবিধা প্রদান করে রফতানিমুখী শিল্প বিকাশ ঘটানো হবে। কৃষির মূল লক্ষ্য হবে খাদ্য ও পুষ্টির নিরাপত্তা নিশ্চিত করা, যাতে ক্যালরি, আমিষ, ভিটামিন, মিনারেলস ও ফ্যাটের চাহিদা পূরণ হয়। সেই সঙ্গে ক্ষতিকর সার ও কীটনাশকের ব্যবহার বন্ধ করে নিরাপদ খাদ্য উৎপাদনে জাতিকে উদ্বুদ্ধ করা হবে।
বাংলাদেশের উন্নয়নের মূল চাবিকাঠি লুকিয়ে আছে এর গ্রামীণ অর্থনীতি ও কৃষিতে। বিএনপি ও তারেক রহমান যে কৃষিভিত্তিক রাষ্ট্র মেরামতের রূপরেখা দিয়েছেন, তা কেবল একটি রাজনৈতিক কর্মসূচি নয়—এটি ভবিষ্যতের জন্য একটি বাস্তবভিত্তিক জাতীয় নীতি। এই নীতি বাস্তবায়িত হলে শুধু কৃষকই নয়, লাভবান হবেন ভোক্তা, রাষ্ট্র এবং দেশের অর্থনীতি। বাংলাদেশের উন্নয়নের শুরু হবে মাঠ থেকে, খাল থেকে, খেত থেকে আর তার নেতৃত্বে থাকবে একটি গণতান্ত্রিক ও মানবিক দল, যার নাম বাংলাদেশ জাতীয়তাবাদী দল-বিএনপি।
লেখক: কৃষিবিদ এবং রাজনৈতিক বিশ্লেষক