আমার তো চাঁদাবাজি করার কথা ছিল, কিন্তু অক্ষরজ্ঞানহীন মায়ের জন্য...
আমার তো এতদিনে রাস্তায় ভিক্ষে করার কথা কিংবা কে জানে হয়ত চাঁদাবাজি! আচ্ছা, আমার কি আদৌও এতোদিন বেঁচে থাকার কথা ছিল? স্কুলে ভর্তি হবার পর যখন একদিন কাঁদতে কাঁদতে বাসায় ফিরে বললাম-
-আমি আর স্কুলে যাবো না।
আমার মা হেসে বললেন
-কি হয়েছে?
-সবাই আমাকে দেখে হাসে। কেউ আমার সঙ্গে ভালো করে কথা বলে না।
আমার মা বললেন,
-সবাই হাসলে হাসুক। তুমি ওদের কথায় কিছু মনে করবে না। ওদের সঙ্গে খারাপ ব্যাবহারও করবে না। দেখবে একদিন ওরা ঠিকই আর হাসবে না।
আমি এরপরও স্কুলে যেতে রাজি হলাম না। শেষ পর্যন্ত আমার ইমিডিয়েট বড় বোন আমাকে স্কুলে নিয়ে গিয়েছিল। আমার এই বোন ক্লাস ফাইভ পর্যন্ত আমাকে স্কুলে নিয়ে গিয়েছে। শুধু তাই না, আমি ক্লাসের কোন পড়া ঠিক মতো বুঝতাম না, লিখতেও পারতাম না।
আমি পড়তাম ছেলেদের স্কুলে। মেয়েদের ঢুকার নিয়ম নেই। এরপরও আমার বোনকে ঢুকার অনুমতি দেয়া হয়েছিল। আমার বোন জানালার পাশে দাঁড়িয়ে থাকতো আর আমি জানালার কাছে বসে থাকতাম। আমার সব পড়া আমার বোনই খাতায় টুকে নিয়ে আসত।
আমার মা’র পক্ষে সেটাও সম্ভব ছিল না। কারন তিনি ছিলেন অক্ষর জ্ঞানহীন। তিনি জীবনে স্কুলে যাননি। সেবার যখন ডাক্তাররা বলে দিলো,
-আপনার এই ছোট ছেলেকে স্কুলে পাঠিয়ে লাভ নেই। ওর পক্ষে স্কুলে গিয়ে লেখাপড়া করা সম্ভব হবে না।
আমার মা বাসায় এসে আমার বাবাকে বললেন,
-আমি আমার ছেলেকে স্কুলে পাঠাবোই।
আমার বাবা বললেন,
-ও তো আর দশজনের মতো স্বাভাবিক না। থাক স্কুলে পাঠালে দেখা যাবে অন্যরা ওকে নিয়ে হাসাহাসি করছে।
আমার অক্ষরজ্ঞানহীন মা বললেন,
-দরকার হয় আমি ওকে প্রতিদিন স্কুলে নিয়ে যাবো।
সেই থেকেই আমার যুদ্ধ শুরু। স্কুলে ক্লাস মেটরা আমাকে নিয়ে হাসাহাসি করে। বাসায় এসে মাকে বলি। মা বলেন,
-কিছু হবে না। তুমি কারো সঙ্গে খারাপ ব্যাবহার করবে না। সবাইকে ভালবাসবে। তাহলে দেখবে ওরা এক সময় ঠিকই তোমাকে পছন্দ করবে। স্কুল পাশ করে কলেজে ভর্তি হলাম, তখনও সব কিছু স্বাভাবিক হয়নি। কলেজের এক স্যার তো একদিন বলেই বসলেন-
-তোমার সমস্যা কি?
বাসায় এসে মা’কে বললাম।
মা বললেন,
-সে হয়ত বুঝতে পারেনি। তুমি মন খারাপ করো না। ঠিকমতো পড়াশুনা করো। দেখবে এক সময় তোমার স্যারও তোমাকে পছন্দ করবে।
ক্লাসমেটদের কথা না হয় আর নাই বললাম। ছোটবেলা থেকেই জোরে কোন আওয়াজ হলে আমি ভয় পেতাম; কেউ একটু জোরে কথা বললে আমি লাফিয়ে উঠতাম; আমার কথা বলার ধরণও ছিল খানিক আলাদা। এই নিয়ে আমার বিশ্ববিদ্যালয়ের সহপাঠীদের সেকি হাসাহাসি।
একবার তো আমার বন্ধু'রা আমাকে ইচ্ছে করে ভুতের ভয় পর্যন্ত দেখাল। এক সন্ধ্যায় ঘুমিয়ে আছি। অন্ধকার হয়ে এসেছে। হঠাৎ শুনি জানালার পাশে কি যেন নড়ছে আর অদ্ভুত এক আওয়াজ!
আমি তো ঘুম থেকে লাফ দিয়ে উঠেছি! বুক ধরফর করছে! এরপর আবিষ্কার করলাম আমার বন্ধুরা সবাই মিলে ছাদে উঠে এই কাজ করেছে! আমি যেহেতু যে কোন কিছুতেই ভয় পাই, তাই ওরা আমাকে ভয় দেখিয়ে আনন্দ পেয়েছে।
আমি প্রায় প্রতি সপ্তাহে কিংবা দুই সপ্তাহ পরপর সিলেট থেকে ঢাকায় যেতাম। কারন মার সঙ্গে কথা না বললে আমার ভালো লাগত না। মা ছাড়া এই পৃথিবীতে কথা বলার আমার আর কোন মানুষ ছিল না।
কারণ অন্য আর কেউ আমাকে বুঝতেই পারত না। কিংবা বুঝলে সেটা নিয়েও হয়ত হাসাহাসি করবে। তাই জগতের সমুদয় সকল কথা আমি আমার মার সঙ্গে ভাগাভাগি করতাম।
সেবার যখন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে চান্স পেয়েও সিলেটে পড়তে যেতে চাইলাম, আমার বাবা বললেন,
- ওর সিলেটে গিয়ে কাজ কি? ও ঢাকায় থেকে কোনভাবে পড়াশুনা করলেই তো হয়েছে। ওর এতো পড়াশুনারই কি দরকার। ও আমাদের সঙ্গে বাসায় থাকুক। তাহলেই তো হয়েছে। এটাই ওর জন্য ভালো।
আমার মা, কঠিন ভাষায় আমার বাবাকে বললেন,
-আমার ছয় ছেলে-মেয়ে। ওরা যদি ওদের নিজেদের ইচ্ছায় যেকোন কিছু করতে পারে; তাহলে আমার ছোট ছেলেও পারবে। ওর জন্মের উপর তো ওর কোন হাত নেই। আপনি ওকে সিলেটে যেতে দিন।
গেলাম সিলেটে পড়তে। সেটাও এক কঠিন অধ্যায়। আমাদের সময় মোবাইল সেই অর্থে ছিল না। আমাদের বাসায় একটা ল্যান্ডফোন ছিল। আমি সিলেট থেকে প্রতিদিন দোকানে গিয়ে টাকা দিয়ে আমার মা’র সঙ্গে কথা বলতাম।
খুব সামনাসামনি কথা বলতে ইচ্ছে করত, তাই প্রতি সপ্তাহ না হলেও দুই-তিন সপ্তাহ পরপর তো ঢাকায় চলে আসতামই। মা এবং তার পুত্র মিলে সেকি আড্ডা। কারণ কথা বলার মতো আর কোন মানুষ আমার ছিল না। কাউকে ভালো লেগেছে, প্রথম গিয়ে মাকে বলেছি। মা’ই বলে দিয়েছে,
-সোজা গিয়ে বলে দেও তোমার তাকে ভালো লেগেছে। কে কি মনে করল তাতে কি যায় আসছে। সে যদি তোমাকে পছন্দ না করে তাহলে তো আর কিছু করার নেই। কিন্তু বলে দিতে সমস্যা কোথায়।
কাউকে ভালোলাগা, ভালোবাসা, কারো প্রতি রাগ, অভিমান সব কিছু আমি আমার মা’র সঙ্গে ভাগাভাগি করতাম। যে আমার স্কুলে ভর্তি হবারই কথা ছিল না। সেই আমি স্রেফ আমার অক্ষরজ্ঞানহীন মায়ের জন্য স্কুল, কলেজ বিশ্ববিদ্যালয়ের সর্বচ্চ ডিগ্রী নিয়েছি, এখন নিজেই পড়াচ্ছি।
অথচ আমার হয়ত আজ রাস্তায় ভিক্ষে কিংবা চাঁদাবাজি করার কথা ছিল। আমার মা জীবনের প্রতিটা পর্যায়ে আমাকে প্রতিমুহূর্তে বলেছেন- সকল মানুষকে স্রেফ মানুষ হিসেবে দেখবে। অন্য আর কোন কিছু হিসেবে নয়। বাসার কাজের মানুষটা যেমন মানুষ, বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষকরাও মানুষ। সবাইকে এক হিসেবে দেখবে; সবাইকে ভালবাসবে; দেখবে তাহলে অন্যরাও তোমাকে তোমার সীমাবদ্ধতা ও অক্ষমতা সত্ত্বেও ভালবাসবে।
আমি আমার মায়ের কথা অক্ষরে অক্ষরে পালন করেছি জীবনের প্রতিটা পর্যায়ে। আমার সেই মাকে নিয়ে দেশে একবার এক পার্টিতে গিয়েছিলাম। আমার এক সহকর্মী আমার মায়ের সামনেই বলে বসলেন,
-আপনার মা পড়াশুনা জানে না! এই যুগেও এটা সম্ভব!
আমার মা বোধকরি বুঝতে পারছিলেন আমার খারাপ লাগছে। সঙ্গে সঙ্গেই বললেন,
-তুমি কিছু মনে করো না। তুমি তোমার সহকর্মীকে এজন্য কখনো ঘৃণা করবে না। সে হয়ত না বুঝেই বলেছে।
না, আমি সেই সহকর্মীকে ঘৃণা করতে যাইনি। তাকে এই নিয়ে একটা কথাও বলনি। এইতো এই শহরেই তো এমন মানুষ আছে যারা আমার সম্পর্কে কতো রকম গল্প বানিয়ে বেড়িয়েছে, এমনকি ফেইসবুকেও লিখে বেড়িয়েছে। না, আমি তাদের ঘৃণা করতে যাইনি। উল্টো চেষ্টা করেছি ভালোবাসার।
একদিন হঠাৎ করে আমার মা’র ক্যান্সার ধরা পড়লো। আমি বিদেশে। চারদিকে অন্ধকার দেখছিলাম। কি করবো কিছুই বুঝতে পারছি না। দেশের ডাক্তাররা প্রায় আশা'ই ছেড়ে দিয়েছেন।
শেষমেশ মা’কে বিদেশে আমার এখানে নিয়ে আসলাম। আমি আর আমার অসুস্থ মা। মা’র চিকিৎসা, দেখভাল, রান্না, খাওয়া, অফিস সব এক হাতেই করছি। অথচ এক মুহূর্তের জন্য ক্লান্তি এসে ভর করেনি।
মা’কে নিয়ে গেলাম এখানকার এক অফিসে। মা যেহেতু ইংরেজি বোঝে না, তাই এক ট্রান্সলেটর আনা হলো। সেই অফিসের অফিসার মা’র সঙ্গে ইন্টারভিউ শেষে উঠে এসে আমাকে বললেন,
-তুমি তোমার মা’কে বলে দিও, সে তার সন্তানদের মানুষ করতে পেরেছে।
আমি তাকে জিজ্ঞেস করলাম,
-তুমি হঠাৎ এই কথা বলছ কেন?
ভদ্রলোক বললেন,
-আমি তোমার মা’কে জিজ্ঞেস করেছিলাম আপনি লেখাপড়াটা পরবর্তীতে শিখে নেননি কেন?
তোমার মা আমার দিকে তাকিয়ে বলেছেন,
-আমার সেটার দরকার হয়নি। কারন আমি আমার সন্তানদের চোখ দিয়ে পড়তে পারি।
আমার অক্ষরজ্ঞানহীন মা নিজে পড়াশুনা করতে পারেননি কিন্তু তিনি তার সবগুলো সন্তানকে পড়াশুনা করেছিয়েন, বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়তে পাঠিয়েছেন।
পাঁচ সন্তান জন্মের পর ষষ্ঠ সন্তান যখন জন্মাল; ততদিনে আমার মা’র খানিক বয়েস হয়ে গিয়েছে; পাঁচ সন্তানের দেখভাল করতে করতে হাঁপিয়ে উঠেছেন; মাত্র ১৩ বছর বয়েসে বিয়ে হওয়া সেই মা’র শেষ সন্তান যখন আর দশজন মানুষের মতো স্বাভাবিক ভাবে জন্মায় না; তখন যে কারোই হাল ছেড়ে দেওয়ার কথা।
আমার মা হাল না ছেড়ে ঘোষণা করলেন, আমার এই ছেলেই একদিন অন্য আর দশ জনের চাইতে ভালো কিছু করবে। সেই মা আসলেন তার ক্যান্সারের চিকিৎসা করতে বিদেশে ছোট ছেলের কাছে!
মা’র চিকিৎসা হলো। খানিকটা সুস্থ হলেন তিনি। বাংলাদেশে ফরত যাবার সময় এয়ারপোর্টে আমাকে বললেন,
-সব কাজ তুমি একা কি করে করলে! উপরওয়ালা তোমাকে অনেক কিছু দিয়ে পাঠায়নি। কিন্তু ধৈর্য্য দিয়ে পাঠিয়েছে। তুই একই সঙ্গে আমার ছেলে এবং মেয়ে। সেই শেষ কথা। এরপর আর সরাসরি কথা হয়নি। টেলিফোনে কথা হতো।
আমার মা পৃথিবী ছেড়ে চলে গিয়েছেন মাস দশেক হয়। আমি তখন পর্তুগালে গিয়েছি একটা বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়াতে। আগের দিন ফোন করেছিলাম মা’কে। শুনেছি মা খানিকটা অসুস্থ। ফোন করে জিজ্ঞস করলাম,
-মা, কেমন আছো?
মা আমার গলা শুনে বললেন,
- তুমি কেমন আছো? তোমার গলা এমন শুকনা শোনাচ্ছে কেন? খাওয়া-দাওয়া ঠিকমতো করবে। আর আমাকে নিয়ে একদম চিন্তা করবে না।
আমি মা’কে বললাম,
-মা, তুমি এই শরীরেও আমার কথা চিন্তা করছ?
লাইনটা কেটে গিয়েছিল। এরপর আর কথা হয়নি।
মা সব সময় আমাকে বলতেন,
- আমি চলে গেলে তুই কার সঙ্গে কথা বলবি?
মা, আমিত এখনও প্রতিটা মুহূর্ত তোমার সঙ্গেই কথা বলি। আমার যে কথা বলার আর কেউ নেই মা! তুমি কি শুনতে পাও?
এখনো গভীর রাতে কোন আওয়াজ শুনে লাফিয়ে উঠি, কেবল সঙ্গে সঙ্গে ফোন দেবার জন্য তুমি নেই মা। একটুও বিরক্ত না হয়ে গভীর রাতে ফোন ধরে বলতে, কী, ভয় পেয়েছিস? এইতো আমি সঙ্গেই আছি।
এইতো সেদিনও কে যেন হাসাহাসি করছিল আমাকে নিয়ে। খুব ইচ্ছে করছিল তোমার সঙ্গে কথা বলাতে মা। সব কিছু তো সেই আগের মতো এখানেই আছে। কেবল তুমি নেই মা। তাই মনে হয়- কিছুই নেই আমার সাথে।
লেখক: আমিনুল ইসলাম,
ইউরোপে শিক্ষকতারত এবং সাবেক শিক্ষার্থী, শাহজালাল বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়