কী ঘটেছিল ৭ নভেম্বর?
মুক্তিযুদ্ধে ১১ নম্বর সেক্টরের সেক্টর কমান্ডার কর্নেল তাহের। মুক্তিযুদ্ধের একেবারে শেষ দিকে এসে কামালপুরে একটি অভিযান পরিচালনার সময় অ্যান্টি পার্সোনেল মাইন বিস্ফোরণে আহত হয়েছিলেন। পরে চিকিৎসাধীন অবস্থায় ভারতের একটি হাসপাতালে তাঁর একটি পা কেটে ফেলতে হয়েছে। পা হারানোর পর থেকে যেন আরো জেদি আর একগুঁয়ে হয়ে উঠেছেন তাহের। সমাজতন্ত্রের আদর্শে অনুপ্রাণিত তাহের একসময় মরিয়া হয়ে উঠেছিলেন সেনাবাহিনীকে ব্যবহার করে ক্ষমতায় যাওয়ার জন্য। পরে যখন বুঝতে পেরেছেন এটা সম্ভব নয়, তখন সেনাবাহিনীর চাকরি থেকে অবসর নিয়ে সরকারের সাথে দেন-দরবার করে হয়েছেন নারায়ণগঞ্জে ড্রেজার সংস্থার পরিচালক। চাকরির বাইরেও আবার চুপেচাপে করছেন রাজনীতি।
১৯৭৪ সালে মেজর জলিলের নেতৃত্বে কয়েকজন সাধারণ সৈনিককে নিয়ে গড়ে তুলেছেন ‘বিপ্লবী সৈনিক সংস্থা’। সৈনিক সংস্থা গড়ে তোলার পর সবসময় তাঁর চেষ্টা থাকে সেনাবাহিনীর বাকিদের কীভাবে তিনি এই সংস্থায় নিয়ে আসবেন। তাহের কয়েকবার মেজর হাফিজকেও নিজ দলে টানার চেষ্টা করেছেন। হাফিজ খুব একটা পাত্তা দেননি। তাহেরকে সরাসরিই বলেছেন, ‘সেনা অফিসারদের মধ্যে সমাজতন্ত্রী লোক খুব একটা খুঁজে পাবেন না আপনি। খামোখা কাউকে এসবের ভেতর টানাটানি করে বিপদে ফেলিয়েন না। লেফটেন্যান্ট কর্নেল আকবর ইউপিপিতে (ইউনাইটেড পিপলস পার্টি) যোগ দিয়েছেন। তিনি আবার মাঝে মাঝে জিয়াউর রহমানকে চাকরি ছেড়ে রাজনীতিতে জয়েন করার ব্যাপারে ফুসলান। আপনি বরং জেনারেল জিয়ার সাথে একবার যোগাযোগ করে দেখতে পারেন।’
মেজর হাফিজের কথায় কিছুটা হতাশ হলেও জিয়ার ব্যাপারটা একেবারে উড়িয়ে দেননি তাহের। খানিকটা ভেবে বলেছেন, ‘ওনার ব্যাপারটা আমার ওপর ছেড়ে দাও। সেটা নিয়ে তোমার না ভাবলেও চলবে।’
মেজর জলিল আর কর্নেল তাহেরের বিপ্লবী সৈনিক সংস্থা খুব গোপনেই সবসময় তাদের কাজকর্ম চালিয়ে এসেছে। সত্যি কথা হলো, এরকম কোনো সংস্থা যে আছে, বলতে গেলে সেটার অস্তিত্ব পঁচাত্তরের নভেম্বর পর্যন্ত সেনাবাহিনীর কেউ আঁচই করতে পারেনি।
আসন্ন বিপ্লবের জন্য সভায় ৭টি লক্ষ্য নির্ধারণ করা হল
১। সৈনিকরা সম্মিলিতভাবে বিপ্লব করবে।
২। ষড়যন্ত্রকারী খালেদ মোশাররফকে উৎখাত করা হবে।
৩। সৈনিকরা সেনাবাহিনী ও জনজীবনে শৃঙ্খলা ফিরিয়ে আনবে।
৪। প্রাতিষ্ঠানিক সেনাবাহিনীর পরিবর্তে গণ-সেনাবাহিনী গঠিত হবে। সমাজ এই লক্ষ্যে পুনর্গঠিত হবে।
৫। বাকশাল ব্যতীত সকল দল সমন্বয়ে একটি অন্তর্বর্তীকালীন সর্বদলীয় সরকার গঠিত হবে।
৬। সব রাজবন্দীদের মুক্তি দেওয়া হবে।
৭। চূড়ান্ত লক্ষ্য হবে সাধারণ নির্বাচনের মাধ্যমে সংসদীয় গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠা।
এই লক্ষ্যগুলো অর্জনের জন্য কিছু চূড়ান্ত কর্মসূচি গ্রহণ করা হয়। বিপ্লবকালীন কর্মসূচি আর কি.
১। ৬ তারিখ রাত ঠিক ১২টায় অর্থাৎ 'জিরো আওয়ারে' বন্দুকের ফাঁকা আওয়াজের মাধ্যমে বিপ্লব শুরু হবে।
২। জীবন বাঁচানোর অনিবার্য প্রয়োজনেই কেবল কাউকে হত্যা করা যাবে।
৩। খালেদ মোশাররফকে গ্রেফতার করা হবে।
৪। জিয়াউর রহমানকে মুক্ত করা হবে। কিন্তু তাঁকে ঢাকা সেনানিবাসের বাইরে বিপ্লবী সৈনিক সংস্থার প্রত্যক্ষ তত্ত্বাবধানে রাখা হবে।
৫। সৈনিকরা ঢাকা শহর প্রদক্ষিণ করবে এবং বিপ্লবের পক্ষে স্লোগান দিবে।
৬। প্রতিটি ট্রাকে কমপক্ষে একজন বিপ্লবী সৈনিক সংস্থার লোক থাকবে। তিনি সাধারণ সৈনিকদের নিয়ন্ত্রণ ও পরিচালনা করবেন।
৭। ৭ নভেম্বর সকালে রেসকোর্সে সৈনিকদের সমাবেশ অনুষ্ঠিত হবে। এতে অন্তর্বর্তীকালীন সরকার ঘোষিত হবে।
৮। সফল বিপ্লবের পর রেডিয়ো, টিভি বিপ্লবী সৈনিক সংস্থা, বিপ্লবী গণবাহিনী এবং জাসদের কর্মসূচি এবং নেতাদের বক্তব্য প্রচার করবে।
৯। কোনো সৈনিক লুটপাটে অংশগ্রহণ করবে না। তারা জনগণের জীবন ও সম্পদ রক্ষা করবে। কাউকে অন্যায় করতে দেখলে কঠোর ব্যবস্থা গ্রহণ করা হবে।
১০। বিপ্লবের অব্যবহিত পরেই বিপ্লবী সৈনিক সংস্থার ইউনিট অধিনায়কদের সমন্বয়ে বিপ্লবী পরিষদ ‘Revolutionary Command Council’ গঠিত হবে।
১১। সামরিক অফিসারদের বিপ্লবকে সমর্থন জানানোর আহ্বান জানানো হবে। যারা বিপ্লবকে সমর্থন জানাবে না তাদের গ্রেফতার করা হবে।
১২। কর্নেল তাহের বিপ্লবের সর্বাধিনায়ক ঘোষিত হলেন। প্রতিটি সৈনিক তাঁর আদেশ পালনে বাধ্য থাকবে।
মিটিং থেকে সিদ্ধান্ত হয় যত দ্রুত সম্ভব লিফলেট ছাপিয়ে ঢাকা ক্যান্টনমেন্টের সৈনিকদের মধ্যে বিলি করতে হবে। নভেম্বর মাসের ৫ তারিখ গভীর রাতে বিপ্লবী সৈনিক সংস্থা ঢাকা ক্যান্টনমেন্টের বিভিন্ন ইউনিটে ১২ দফা দাবি সম্বলিত প্রচারপত্র বিলি করল। প্রচারপত্রটা এরকম
১. আমাদের বিপ্লব নেতা বদলানোর জন্য নয়। এই বিপ্লব গরিব স্বার্থের জন্য। এত দিন আমরা ছিলাম ধনীদের বাহিনী। ধনীরা তাদের স্বার্থে আমাদের ব্যবহার করেছে। ১৫ আগস্ট তার প্রমাণ। তাই এবার আমরা ধনীদের দ্বারা, ধনীদের স্বার্থে অভ্যুত্থান করিনি। আমরা বিপ্লব করেছি। আমরা জনতার সঙ্গে এক হয়ে বিপ্লবে নেমেছি। আমরা জনতার সঙ্গে থাকতে চাই। আজ থেকে বাংলাদেশে সেনাবাহিনী হবে গরিব শ্রেণির স্বার্থরক্ষার একটি গণবাহিনী।
২. অবিলম্বে রাজবন্দীদের মুক্তি দিতে হবে।
৩. রাজনৈতিক নেতাদের সঙ্গে আলোচনা না করে কোনো সিদ্ধান্ত দেওয়া যাবে না।
৪. অফিসার ও জওয়ানদের ভেদাভেদ দূর করতে হবে, অফিসারদের আলাদাভাবে নিযুক্ত না করে সামরিক শিক্ষা ও যোগ্যতা অনুযায়ী নির্ণয় করতে হবে।
৫. অফিসার ও জওয়ানদের একই রেশন ও একই রকম থাকার ব্যবস্থা করতে হবে।
৬. অফিসারদের জন্য আর্মির কোনো জওয়ানকে ব্যাটম্যান হিসেবে নিযুক্ত করা চলবে না।
৭. মুক্তিযুদ্ধ, গত অভ্যুত্থান ও আজকের বিপ্লবে যে-সব দেশপ্রেমিক ভাই শহীদ হয়েছেন, তাঁদের পরিবারের জন্য উপযুক্ত ব্যবস্থা গ্রহণ করতে হবে।
৮. ব্রিটিশ আমলের আইনকানুন বদলাতে হবে।
৯. সব দুর্নীতিবাজের সম্পত্তি বাজেয়াপ্ত করতে হবে। বিদেশে যারা টাকা জমিয়েছে, তাদের টাকা বাংলাদেশে ফেরত আনতে হবে।
১০. যে-সব সামরিক অফিসার ও জওয়ানকে বিদেশে পাঠানো হয়েছে, তাঁদের দেশে ফেরত আনার ব্যবস্থা করতে হবে।
১১. জওয়ানদের বেতন সপ্তম গ্রেড হতে হবে এবং ফ্যামিলি অ্যাকমডেশন ফ্রি হতে হবে।
১২. পাকিস্তান-ফেরত সামরিক বাহিনীর লোকদের ১৮ মাসের বেতন দিতে হবে।
নিবেদক, বাংলাদেশ সেনাবাহিনীর বিপ্লবী সৈনিকবৃন্দ
দাবিনামায় ভালো ভালো কথা লেখা। কিন্তু মিটিংয়ে তাহেরের মুখের কথা থেকে যেটুকু বোঝা গেল, সেনাবাহিনীর যে অফিসার শ্রেণি আছে, তারাই মূলত সব অপকর্মের হোতা। এই অপকর্মের হোতাদের নিয়ন্ত্রণ থেকে মুক্তি পেতে হলে অফিসারদের বিরুদ্ধে বিদ্রোহের কোনো বিকল্প নেই।
৫ তারিখ সন্ধ্যার পর তিন বাহিনীর প্রধান গেছেন সুপ্রিম কোর্টের প্রধান বিচারপতি আবু সাদাত মোহাম্মদ সায়েমের সরকারি বাসভবনে। উদ্দেশ্য- মোহাম্মদ সায়েমকে রাষ্ট্রপতির দায়িত্বভার নেওয়ার অনুরোধ করা। প্রস্তাব শুনে সায়েম জানালেন, সংবিধান মোতাবেক তাঁর তো রাষ্ট্রপতি পদে অভিষিক্ত হওয়ার কোনো সুযোগই নেই। এখানে আবার খালেদ মোশাররফ বেশ আশাবাদী মানুষ। তিনি প্রধান বিচারপতিকে আশ্বস্ত করলেন, রাষ্ট্রপতি খন্দকার মোশতাকই একটি অধ্যাদেশ জারি করে বিচারপতি সায়েমকে নতুন রাষ্ট্রপতি হিসেবে নিয়োগ দিয়ে যাবেন। তারপর নতুন রাষ্ট্রপতি একটি নির্দলীয়, নিরপেক্ষ সরকারের প্রধানরূপে সংসদ ভেঙে দিয়ে তিন মাসের মধ্যে নতুন নির্বাচন অনুষ্ঠানের ব্যবস্থা করবেন। বিচারপতি সায়েম সাথে সাথে সিদ্ধান্ত নিলেন না। পরিবারের সদস্যদের সঙ্গে মিনিট পাঁচেক আলোচনা করলেন। আলোচনা করে এসে জানালেন, রাষ্ট্রপতির পদ গ্রহণে তিনি রাজি।
এই সম্মতির পর গভীর রাতে তাঁকে বঙ্গভবনে নিয়ে আসা হয়। দ্রুত রাষ্ট্রপতি নিয়োগসংক্রান্ত একটা অধ্যাদেশ প্রস্তুত করা হলো। খন্দকার মোশতাক আর কোনো কথাবার্তা বললেন না। বিনা বাক্যব্যয়ে অধ্যাদেশে স্বাক্ষর করে দিলেন।
পরদিন অর্থাৎ নভেম্বর মাসের ৬ তারিখ বেলা ১১টায় বিচারপতি আবু সাদাত মোহাম্মদ সায়েম বঙ্গভবনে রাষ্ট্রপতি পদে শপথ গ্রহণ করলেন। প্রধান বিচারপতি রাষ্ট্রপতি হওয়াতে তখন অন্য আরেকজন বিচারপতি ভারপ্রাপ্ত প্রধান বিচারপতির দায়িত্ব নিয়েছেন। সেই ভারপ্রাপ্ত প্রধান বিচারপতির কাছেই তিনি শপথ নিলেন। বাংলাদেশের ইতিহাসে প্রথম নিরপেক্ষ, অন্তর্বর্তীকালীন সরকার প্রধানরূপে অভিষেক হয় বিচারপতি আবু সাদাত মোহাম্মদ সায়েমের। রেডিয়ো-টিভিতে তিন দিনের নীরবতা ভেঙে ঘোষণা দেওয়া হয়, ৬ নভেম্বর সন্ধ্যায় নতুন রাষ্ট্রপতি বেতার ও টেলিভিশনে জাতির উদ্দেশ্যে ভাষণ দেবেন।
রাষ্ট্রপতির ভাষণের আগেই, ৬ নভেম্বর বিকেলে বিপ্লবী সৈনিক সংস্থার সদস্যদের সঙ্গে মিটিং করে অভ্যুত্থানের কর্মপরিকল্পনা ঠিক করে ফেলেছেন কর্নেল তাহের। ঠিক হয়েছে- রাত ঠিক একটায় বিভিন্ন ইউনিটের সৈনিকেরা অস্ত্রাগার দখল করে আকাশে গুলিবর্ষণ করে অভ্যুত্থানের সূচনা করবে৷ এরপর তারা রাস্তায় বেরিয়ে আসবে এবং প্রথম সুযোগেই জেনারেল জিয়াকে বন্দিদশা থেকে মুক্ত করবে। তারপর সকালবেলা জেনারেল জিয়াকে শহীদ মিনারে নিয়ে আসা হবে। জিয়া ও তাহের একসাথে শহীদ মিনারে সেপাই ও সমবেত জনতার উদ্দেশ্যে ভাষণ দেবেন। এরপর যা করার করা হবে। তবে মূল কাজ হচ্ছে জিয়াকে মুক্ত করে তাঁকে বাগে নিয়ে আসে। এখন এই মুহূর্তে বিপ্লবী সৈনিক সংস্থার নেতাদের ক্ষমতায় আনার যদি একটা পথ খোলা থাকে, সেটা হচ্ছে সেনাপ্রধান জিয়াকে মুক্ত করে তার ঘাড়ের উপর দিয়ে ক্ষমতায় বসা।
১৯৭৫ সালের নভেম্বর মাসের ৫ তারিখটা বাংলাদেশের একটি ঘটনাবহুল দিন। এদিন রাজনৈতিক দল আর সেনা সদস্যদের বিভিন্ন গ্রুপ মিটিং-সিটিংয়ে ব্যস্ত সময় পার করেছে। অন্যদিকে সেনাপ্রধান খালেদ মোশাররফ অপ্রয়োজনীয় লোকদের সঙ্গে মিটিং করে মূল্যবান সময়গুলো নষ্ট করেছেন। সময় নষ্ট করার পর একপর্যায়ে তাঁর মাথায় ঢুকেছে, তাঁকে প্রধান সামরিক আইন প্রশাসক হতে হবে। নৌবাহিনী আর বিমানবাহিনীর প্রধান থাকবেন তাঁর একধাপ নিচে। অর্থাৎ তাঁরা হবেন ডেপুটি।
এদিকে ১৫ই আগস্টের অভ্যুত্থানে ফারুক-রশিদ-ডালিমের সাথে যে-সব সৈনিকরা যোগ দিয়েছিল তারা আছে জীবনশঙ্কায়৷ তাদের ধারণা, খালেদ সেনাপ্রধান হওয়ার পর নিশ্চিতভাবে বিদ্রোহের জন্য তাদের বিচার করা হবে। সেনা আইনে বিদ্রোহের শাস্তি মৃত্যুদণ্ড। খালেদ যতই ক্ষমা করে দেওয়ার আশ্বাস দিক না কেন, শেষ পর্যন্ত বিশ্বাসঘাতকতা করে কোনোভাবে গলায় ফাঁসির দড়ি পরিয়ে দিলে আর কিছু করার থাকবে না। তাই বিপ্লবী সৈনিক সংস্থার অভ্যুত্থানের খবর যখন তাদের কানে গেছে, এক রকম মরিয়া হয়েই তারা যোগাযোগের চেষ্টা শুরু করেছে কর্নেল তাহেরের সাথে। তাদের আশা, তাহেরের সাথে যোগ দিয়ে কোনোভাবে যদি খালেদ মোশাররফকে পদ থেকে নামানো যায়, তাহলে অন্তত তাদের জীবনটা বাঁচে। শেষ পর্যন্ত তাহেরের সাথে তারা যোগাযোগ করতে পেরেছে। তাদের যোগাযোগের মাধ্যম বেঙ্গল ল্যান্সারের হাবিলদার আব্দুল বারী। আব্দুল বারী নিজেও বিপ্লবী সৈনিক সংস্থার একজন সদস্য।
অনেকটা সময় পেরিয়ে গেলেও এত কিছু যে হয়ে যাচ্ছে, এসব কানে আসেনি মেজর হাফিজের। ৬ তারিখ বিকেলে প্রথম ইস্ট বেঙ্গলের সাহসী মুক্তিযোদ্ধা সুবেদার আবুল হাসেম বীর বিক্রম বেশ চুপেচাপে মেজর হাফিজের বাসায় এলেন। অসময়ে আবুল হাসেমকে দেখে মেজর হাফিজ অনেকটাই আশ্চর্য। যা কথোপকথন হল দুজনের, তাতে হাফিজের যেন গাঁয়ে কাঁটা দিয়ে ওঠার দশা।
আবুল হাসেম : স্যার, আজ রাত বারোটায় বিভিন্ন ইউনিটের সৈনিকদের একটা টিম বিদ্রোহ করবে। তাদের টার্গেট খালেদ মোশাররফসহ অন্য অফিসারদের খুন করে ফেলা।
মেজর হাফিজ : বল কী? এটা কি সত্যি নাকি?
আবুল হাসেম : স্যার, সৈনিক সংস্থা সৈনিকদের মধ্যে লিফলেট ছড়িয়েছে। লিফলেট পাওয়ার পর থেকে তারা বেশ উত্তেজিত হয়ে আছে। চারদিকে খালি গুজব আর গুজব। সাবধানে থাকবেন, স্যার। আর কোনো অসুবিধা দেখলে সাথে সাথে প্রথম বেঙ্গলে আমাদের জানাবেন।
আবুল হাসেমের কাছ থেকে সংবাদ পেয়ে মেজর হাফিজ সন্ধ্যাবেলা অফিসে গেলেন। সেখানে গিয়ে বোঝা গেল, কোন একটা ঝামেলা দলা পাকিয়ে উঠছে। সন্ধ্যার পরপরই ল্যান্সার ইউনিটে ঝামেলা হয়েছে। ঝামেলার খবর শুনে সাথে সাথে সেখানে গেছেন খালেদ মোশাররফ। খালেদ মোশাররফ সেখানে গিয়ে আশ্বাস দিয়ে এসেছেন, বিদ্রোহের জন্য কারো বিরুদ্ধে শাস্তিমূলক কোনো ব্যবস্থা নেওয়া হবে না। সবাই যেন ব্যক্তিগত অস্ত্র কোতে জমা দিয়ে পরদিন সকাল থেকে নরমাল ট্রেনিং প্রোগ্রাম ফলো করে। অস্ত্র জমা দেওয়ার ব্যাপারটা সেনা সদর থেকে একটি অর্ডার।
অর্ডার দিয়েই যেন খালেদ মোশাররফ খালাস। ফিরে এসে তিনি বঙ্গভবনে ব্যস্ত হয়ে পড়লেন নৌবাহিনী প্রধান আর বিমানবাহিনী প্রধানের সাথে। আলাপ-আলোচনা না, হলো বচসা? সেনাপ্রধান প্রধান সামরিক আইন প্রশাসক হতে চান। সে ব্যাপারে আবার বিমানবাহিনী আর নৌবাহিনী প্রধানের সায় নেই।
মেজর হাফিজ বাসায় এসে ঘুমানোর প্রস্তুতি নিচ্ছেন। রাত এগারোটার দিকে তাঁর বাসায় একটি ফোন এল। ফোন করেছেন ৪৬তম ব্রিগেডের ইঞ্জিনিয়ার কোম্পানির ওসি রাজিউদ্দিন। রাজিউদ্দিন অনেকটা ভয়ার্ত কণ্ঠেই মেজর হাফিজকে জানালেন, তাঁর ইউনিটের সৈনিকদের মধ্যে বেশ অস্থিরতা শুরু হয়েছে। তারা কোনোভাবেই কোতে অস্ত্র জমা দিতে রাজি হচ্ছে না। কয়েকটা সেকেন্ড মেজর হাফিজ কোনো কথা বললেন না। তারপর ডিসিপ্লিন আর চেন অফ কমান্ড ঠিক রাখার অর্ডার দিয়ে ফোনটা রাখলেন। এতক্ষণ মেজর হাফিজের একটা ধারণা ছিল, কোনোভাবে হোক শেষ পর্যন্ত এরকম কোনো কিছু হবে না। অভ্যুত্থানের নামে নতুন করে আর কোনো অশান্তি হবে না। কিন্তু এবার তাঁর মনের মধ্যে কেমন একটা ভয় ঢুকে গেল। তাহলে কি আবার এক সেনা বিদ্রোহ খুব কাছাকাছি এসে দরজায় কড়া নাড়ছে? মুহূর্তের মধ্যে তিনি সিদ্ধান্ত নিলেন, আজকে রাতের ঘুমটা নিজের বাড়িতে না, তিনি ঘুমাবেন প্রথম ইস্ট বেঙ্গলের সৈনিকদের সাথে। যেই ভাবা সেই কাজ, দ্রুত ইউনিফর্ম পরে বেরিয়ে গেলেন।
প্রথম ইস্ট বেঙ্গলে পৌঁছে ঘুমানোর প্রস্তুতি নিয়ে মেজর হাফিজ কেবল গা এলিয়ে দিয়েছেন। চোখে ঘুম ঘুম ভাব। ঠিক রাত বারোটায় তুমুল গোলাগুলির শব্দে যেন লাফ দিয়ে উঠে বসার দশা। একটু কান পাততেই শোনা গেল, দূর থেকে মিলিত কণ্ঠের স্লোগান ভেসে আসছে-‘সিপাই সিপাই ভাই ভাই। অফিসারের রক্ত চাই।’
স্লোগান শুনে মেজর হাফিজ যেন স্তম্ভিত হয়ে গেলেন। একটি স্বাধীন দেশের সামরিক বাহিনীতে বিদ্রোহ করে অফিসারের রক্ত চায় কারা? এও কি সম্ভব? বিছানা ছেড়ে তড়িঘড়ি করে উঠে মেজর হাফিজ সিও এবং অ্যাডজুটান্টের অফিস থেকে বিভিন্ন ইউনিটে ফোন করতে শুরু করলেন। অবাক কাণ্ড। কোথাও কোনো অফিসারের সাড়া-শব্দ নেই? বেশিরভাগ টেলিফোনে বসে আছে সেপাইরা। বিপ্লব সফল হওয়ার কারণে তারা প্রচণ্ড উচ্ছ্বসিত। কারণ অফিসাররা মোটামুটি পালিয়েছে। বিভিন্ন অফিসার্স মেস, এমনকি অনেক অফিসারের বাসায় পর্যন্ত তারা আক্রমণ চালিয়েছে। অনেক অফিসার লুঙ্গি-পায়জামা-পাঞ্জাবি পরে যে যেভাবে পেরেছে পালিয়েছে।
তখন প্রায় রাত দুইটা। মেজর মুহিউদ্দিনের নেতৃত্বে সেকেন্ড ফিল্ড আর্টিলারির একদল সৈনিক বিনা বাধায় জেনারেল জিয়াউর রহমানের বাসায় প্রবেশ করল। এ দৃশ্য দেখে আতঙ্কিত হয়ে বেরিয়ে এলেন বেগম খালেদা জিয়া। আতঙ্ক আর অনুনয় জড়ানো কণ্ঠে বললেন, ‘জেনারেল সাহেব তো রিজাইন দিয়েছেন। এখন আবার কী চান আপনারা? আমরা আর কোনো ঝামেলায় জড়াতে চাই না, ভাই।’
সৈনিকরা খালেদা জিয়ার কথায় খুব একটা পাত্তা দিল বলে মনে হল না। ‘জেনারেল জিয়া জিন্দাবাদ, সিপাই সিপাই ভাই ভাই’ স্লোগান দিয়ে বাসার ভেতরে ঢুকে পাজামা-পাঞ্জাবি পরিহিত জেনারেল জিয়াউর রহমানকে তারা কাঁধে তুলে নিল। জিয়াকে কাঁধে তুলেই তারা নিয়ে এল সেকেন্ড ফিল্ডের অফিসে। অনেকে ভেবে বসল, জিয়াকে উদ্ধারের এ কৃতিত্ব একমাত্র কর্নেল তাহেরের। তাহের না থাকলে জিয়ার উদ্ধার কোনোভাবেই সম্ভব ছিল না। কিন্তু সত্যি কথা হলো, এখানে কর্নেল তাহেরের তেমন কোনো হাতই নেই। মূলত ১৫ই আগস্টের অপারেশনে অংশগ্রহণকারী ল্যান্সার আর সেকেন্ড ফিল্ডের মরিয়া সৈনিকেরা নিজেদের বাঁচার তাগিদেই জেনারেল জিয়াউর রহমানকে মুক্ত করে। বাস্তবতাও অবশ্য তাই বলে। কারণ, তাহেরের অনুগত অর্ডন্যান্স সাপ্লাই আর সিগন্যাল কোরের অল্প কয়েকজন সদস্যের পক্ষে একক অভিযান চালিয়ে পদাতিক বাহিনীর বেষ্টনী থেকে জিয়াকে মুক্ত করা কোনোভাবেই সম্ভব নয়।
তবে কর্নেল তাহের ক্ষমতা দখলের যে আশায় এই অভ্যুত্থানের কুশীলব হয়েছিলেন, তা যেন জিয়া মুক্ত হওয়ার তিন ঘণ্টার মধ্যেই কোথায় যেন বিলীন হয়ে গেল। ষড়যন্ত্র বুঝতে পারার পর জিয়াউর রহমানের একটা ফুৎকারে বিপ্লবী সৈনিক সংস্থা আর সেই দলের নেতা যেন মুহূর্তে উড়ে চলে গেল!
লেখক: সাবেক ছাত্রদল নেতা ও রাজনৈতিক বিশ্লেষক