স্কুল–কলেজ পড়ুয়াদের প্রেম করা কি ঠিক, জেনে নিন ৭টি জরুরি তথ্য
আমার বয়স যখন পনের তখন মনে প্রেমভাব জাগ্রত হয়েছিল। উড়ুউড়ু প্রেমরোগ। এ রোগ ঝেঁটিয়ে দূর করেছিল, যাকে ভালো লাগত সে। কঠিন হৃদয়ের মেয়েটি ঠান্ডা গলায় বলেছিল, ‘তুমি কি আমাকে পছন্দ করো?’
লজ্জিত চেহারা নিয়ে মাথা নাড়লাম।
সে মৃদু হেসে বলল, ‘তোমাকে একটি কথা বলি। মেয়েদের কলেজ/ইউনিভার্সিটি গেলেই বিয়ে হয়ে যায়। আমারও সম্ভবত তাই হবে। তুমি তখনও ছাত্র। বিয়ে করার ক্ষমতা হবে না। নিজেই চলতে পারবা না। আবার বিয়ে! বউকে কী খাওয়াবা? ঘাস? কী বলছি বুঝছ?’
তারপর কিছুটা ঝাঁঝালো গলায় বলল, ‘আচ্ছা যাও, আর বিরক্ত করো না। বাসার নিচে হা করে দাঁড়িয়ে থেকে আমার দাঁত মাজা দেখার দরকার নাই।’
সেখানেই আমার বাল্যপ্রেমের সমাপ্তি। আমি খুব সৌভাগ্যবান কারণ মেয়েটি ছিল বুদ্ধিমতি। তাই আমার প্রেমের ডানায় আগুন ঢেলে দিয়েছিল। নয়ত নিশ্চিত বিপদে পড়তাম। কেন বিপদে পড়তাম? বিপদে পড়তাম, কারণ টিনএইজ প্রেমের সমস্যা অনেক। এটি এমন একটি সরল অঙ্ক যার ফলাফল অধিকাংশ ক্ষেত্রে শূন্য এবং এ প্রেম ব্যাকফায়ার করার সম্ভাবনা প্রায় শতভাগ। কীভাবে? নিচে ব্যাখ্যা করলাম।
১। পড়াশোনার সর্বনাশ: ঘোর কেটে গেলে অন্ধকার
টিনএইজে প্রেমভাব অস্বাভাবিক নয়। এটি এ বয়সের অন্যতম বৈশিষ্ঠ্য। বয়সটিই রঙিন। তাই সবকিছু রঙিন লাগে। সমস্যা হচ্ছে, জীবন আসলে রঙিন নয়। সাদা-কালো বাস্তব। সেই বাস্তবতায় টিকতেব হলে ভুল করা যাবে না। এ বয়সের প্রেম একটি বড়ো ভুল। তা জীবনকে অধিকাংশ ক্ষেত্রে থমকে দেয়। কারণ প্রেমের ভুবনে থাকে ঘোর। সে ঘোর সবার আগে পড়ার টেবিল থেকে বিচ্ছিন্ন করে ফেলে। ঘাড় সোজা হওয়ার আগেই সেটিকে কুঁজো করে ফেলে। শেষ পর্যন্ত জীবনটাই কুঁজো হয়ে যায়। তখন কেবল ‘চারিদিকে অন্ধকার অমানিশার নিশা।’
২। জীবন গল্প-উপন্যাস নয়
টিনএইজে জীবনটাকে গল্প-উপন্যাস মনে হয়। কিন্তু জীবন বইয়ের পাতার মতো রোমান্টিক নয়। কঠিন শিলাপাথর। গল্প-উপন্যাসে লেখকের কলমের খোঁচায় সব সমস্যার সমাধান হয়। প্রেমিক ফার্স্ট ক্লাস ফার্স্ট হয়, ভালো চাকুরি পেয়ে গাড়ি হাঁকায়, প্রেমিকাকে বিয়ে করে সুইজারল্যান্ডে হানিমুনে যায়। বাস্তবে প্রেমিক হয়ত পাস করে, কিন্তু চাকুরি পায় না, টেম্পুতে চড়ে, বাসে ঝুলে, সুইজারল্যান্ড তো দূরের কথা, ঈদে চাঁদে ভাড়ার টাকা না থাকায় গ্রামের বাড়ি যেতে পারে না। তাই জীবনকে গল্প-উপন্যাস না ভেবে এ বয়সে প্রেমফ্রেম না করে পড়ালেখা করলে একদিন হয়ত সুইস আল্পসে সত্যিই হানিমুনে যাওয়া হবে।
৩। খিটিমিটি মেজাজ
টিনএইজ প্রেমের কারণে মন থাকে অস্থির। ব্যক্তিগত টানাপোড়েন, মান-অভিমান এসব কারণে মেজাজ হয়ে যায় খিটমিট। যার কারণে তারা সবার সাথে দুর্ব্যবহার করে। ফলে সবার সাথে দূরত্ব তৈরি হয় এ দূরত্ব পরে কোনো সেতু দিয়েই অতিক্রম করা যায় না।
৪। শারিরীক সমস্যা
টিনএইজ প্রেম মনে বড় ধরনের প্রভাব ফেলায় খাওয়াদাওয়া, ঘুম, ডেইলি রুটিন সবকিছুতে উল্টাপাল্টা হয়ে যায়। যার অনিবার্য পরিণতি হচ্ছে শারীরিক সমস্যা। কিছুদিন আগে এক মা জানিয়েছিলেন, এ সমস্যার পড়ে তাঁর মেয়ে সারাদিন বন্ধ ঘরে দিন কাটায়। কখনো ইচ্ছে হলে খায়, নয়ত ঘণ্টার পর ঘণ্টা না খেয়ে থাকে। রাত জেগে মোবাইল ফোনে কথা বলে। কোনো শাসন মানে না। একমাসে নাকি তার ওজন কমেছে দশ কেজি! দাঁড়ালে শরীর কাঁপে।
৫। সাপকে রশি ভাবা
সবচে ভয়াবহ হচ্ছে, এসময় সাপকে রশি ভেবে মারাত্মক ভুল করা হয়। কারণ এ বয়সে ম্যাচুউরিটি থাকে কম। তাই চিন্তাভাবনার ক্ষমতাও থাকে কম। সেজন্য মানুষ চিনতে ভুল হয়। এর পরিণতি হয় ভয়াবহ। ব্যক্তিগত অভিজ্ঞতায় আমি অনেককে সাপকে রশি ভাবার কারণে ধুঁকতে দেখেছি। মাসদুয়েক আগেই এ ভুলের কারণে পরিচিত একটি মেয়ে মারা গেছে। শারীরিক ও মানসিক অত্যাচারে অসুস্থ হয়ে তার মারা যাওয়াটাকে স্লো পয়জনের সাথে তুলনা করা যায়।
৬। ব্ল্যাকমেইল
এ বয়সে প্রেম ভেঙে গেলে বিশেষ করে মেয়েরা ব্ল্যাকমেইলের শিকার হতে পারে। তাদের মেসেজ, চিঠি, কল রেকর্ড, এগুলো ব্যবহার করে জীবন দুর্বিষহ করে তুলতে পারে। আর ভুল করে আরেকটু এগুলে তো বিপদের সীমা থাকে না। ‘কালো হাতে’ বন্দি হয়ে জীবন বরবাদ হয়ে যায়।
৭। মাদকের নীল ছোবল
অনেক সময় টিনএইজ প্রেমের অন্যপ্রান্তে অপেক্ষা করে মাদকের ছোবল। বিশেষ করে ছেলেরা প্রেমে ব্যর্থ হলে এ ফাঁদে পা দেয়।আর মাদকের কবলে পড়া মানে দুনিয়াকে জাহান্নাম বানিয়ে ফেলা। আমি অনেককেই ব্যর্থ প্রেমের পরবর্তী ধাপে মাদকাসক্ত হিসেবে আবিষ্কার করেছি। তারা কখনোই বিপর্যয় কাটিয়ে উঠতে পারেনি। ভেঙেচুরে খান খান হয়ে গেছে। আমি নিজের চোখে একজন খুবই প্রতিশ্রুতিশীল খেলোয়াড়কে প্রেমে ব্যর্থ হয়ে মাদকাসক্ত হয়ে অকালে প্রাণ হারাতে দেখেছি।
আমি জানি না আমার এ লেখা টিনএজাররা পড়বে কি না? পড়লেও অবশ্যই পছন্দ করবে না। ভাববে, বয়স্ক মানুষ, আবোলতাবোল কথা বলে। তাদের বলি, আমি আবোলতাবোল বলছি না। ঠিক কথা বলছি। কারণ তোমার বয়স আমি পার হয়ে এসেছি। তাই ওই বয়সের ভুলগুলো আমি বুঝি। তুমি বুঝো না। আমার বয়স হলে বুঝবে। তখন হয়ত একদিন এ ব্যাপারে আমার মতো তুমিও লিখবে। এভাবেই ইতিহাসের পুনরাবৃত্তি ঘটবে। সমস্যা হলো, ইতিহাস থেকে কেউ শিক্ষা নেয় না। সর্বনাশটা নাভির নিচে ঘুষি মারলে শিক্ষা নেয়। ‘কাঙালের কথা বাসী হলে ফলে’- কথাটি তো আর এমনি এমনি আসেনি।
পাদটীকা: ভালো কথা, আমার বাল্যপ্রেমে আগুন জ্বালানো মেয়েটি এখন নামকরা চিকিৎসক। আমরা প্রায়ই সেদিনের ঘটনা নিয়ে হাসাহাসি করি। তবে তাকে কখনো কৃতজ্ঞতা জানানো হয়নি। আজ জানিয়ে দিলাম। সে অতি কঠিন না হলে হয়ত আমারও সর্বনাশ হতো।
বাদল সৈয়দ: কথাসাহিত্যিক ও সরকারি কর্মকর্তা