বাঙালির জিনে সৃষ্টিশীলতা, অথচ সিস্টেমের গেঁড়াকলে হারানো প্রজন্ম
বাঙালি জাতি এক অনন্য সংকর জাতিসত্তা। হাজার বছরের ইতিহাসে এই ভূখণ্ডে নানা জাতি, সংস্কৃতি, ভাষা ও ধর্মের সংমিশ্রণে গঠিত হয়েছে এক বৈচিত্র্যময় মানবগোষ্ঠী। অস্ট্রিক, দ্রাবিড়, আর্য, তুর্কি, আফগান, পারসিক, আরব ও ইউরোপীয়—সব জাতিসত্তার রক্ত মিশে গড়ে উঠেছে এই জাতি। এই সংকরায়ন বাঙালিকে দিয়েছে অসাধারণ মেধা, অভিযোজনশক্তি, সহনশীলতা ও সৃষ্টিশীলতা। আমাদের জিনে যেমন মিশ্র রক্ত, তেমনি মিশে আছে এক অদম্য সৃষ্টিশীল প্রাণশক্তি, যা বারবার প্রতিকূলতার মধ্যেও আমাদের নতুনভাবে দাঁড় করিয়েছে, জাগিয়েছে প্রতিভা, সাহিত্য, শিল্প ও চিন্তার আলো।
কিন্তু আজকের বাস্তবতা এক গভীর বৈপরীত্যের প্রতিচ্ছবি। এই সৃষ্টিশীল জাতি আজ যেন নিজেই নিজের সিস্টেমে বন্দী। রাষ্ট্র পরিচালনার ব্যর্থতা, শিক্ষার গুণগত অবক্ষয় এবং মূল্যবোধের সংকট আমাদের পরবর্তী প্রজন্মকে এমন এক দুর্বল ভিত্তির ওপর দাঁড় করিয়েছে, যেখান থেকে তাদের পক্ষে উড়ে যাওয়া কঠিন। আজকের শিশুরা— যাদের মস্তিষ্কে থাকা উচিত অনুসন্ধান, কৌতূহল ও স্বপ্নের বীজ— তারা শিখছে শর্টকাটের দর্শন: না পড়েই ভালো রেজাল্ট, না জেনেই সার্টিফিকেট, না পরিশ্রম করেই সাফল্য। এই মনস্তত্ত্ব তাদের তৈরি করছে ভেতর থেকে ফাঁপা, দায়িত্বহীন, মেধার চর্চা থেকে বিচ্ছিন্ন এক প্রজন্মে।
আমরা প্রায়ই তাদের দোষ দিই, বলি— এই প্রজন্ম অলস, মোবাইল-আসক্ত, মনোযোগহীন। কিন্তু প্রকৃত দোষ তো তাদের নয়, দোষ আমাদের ব্যবস্থার। আমরা এমন এক শিক্ষাব্যবস্থা নির্মাণ করেছি, যেখানে জ্ঞানচর্চা নয়, বরং পরীক্ষার নম্বরই সবকিছু। যেখানে শিক্ষকরা ক্লাসের চেয়ে কোচিংয়ে বেশি আন্তরিক, আর পাঠ্যপুস্তক হয়ে উঠেছে মুখস্থ করার তালিকা। এর ফলে শিশুরা শেখে না কীভাবে ভাবতে হয়, শেখে না কীভাবে প্রশ্ন করতে হয়— যে ক্ষমতাগুলো একসময় বাঙালিকে সৃষ্টিশীল জাতি হিসেবে বিশ্বদরবারে তুলে ধরেছিল।
আরও পড়ুন: বেসরকারি এমপিওভুক্ত শিক্ষকদের দুরবস্থা: জাতির মেরুদণ্ড কতটা ভঙ্গুর?
বাঙালির ইতিহাস বলছে, আমরা কখনোই চিন্তাশূন্য জাতি ছিলাম না। আমরা ছিলাম কৌতূহলী, তর্কপ্রিয়, মানবতাবাদী ও সৃষ্টিশীল। পাল, সেন, সুলতানি কিংবা ঔপনিবেশিক আমলে— যে জাতি সংস্কৃতিকে আত্মস্থ করে নতুন রূপ দিতে পারত, সে জাতি আজ নিজের সাংস্কৃতিক বুদ্ধিমত্তা হারাচ্ছে। কারণ আমাদের শিক্ষাব্যবস্থা এখন আর মেধা গঠন করে না, বরং মেধাকে স্তব্ধ করে রাখে কৃত্রিম সাফল্যের মোড়কে।
এই অবস্থার সবচেয়ে বড় ট্র্যাজেডি হলো— আমরা একটি ‘জিনগতভাবে সৃষ্টিশীল জাতি’ হয়েও ক্রমে হয়ে উঠছি ‘সিস্টেমেটিকভাবে নিষ্ক্রিয়’। আমাদের রক্তে মিশে থাকা সেই সৃষ্টিশীলতার জিন আজ এক ভুল সিস্টেমের ভেতরে বন্দী। আমরা সন্তানদের শেখাচ্ছি প্রতিযোগিতা, কিন্তু শেখাচ্ছি না সততা; শেখাচ্ছি সাফল্যের শর্টকাট, কিন্তু শেখাচ্ছি না সংগ্রামের সৌন্দর্য। ফলে তাদের চোখে ভবিষ্যৎ স্বপ্ন নয়, বরং বিভ্রান্তির প্রতিচ্ছবি।
একটি জাতির সবচেয়ে বড় শক্তি তার মানুষ— বিশেষ করে তার নতুন প্রজন্ম। কিন্তু আমরা সেই প্রজন্মকে এমন এক শিক্ষা ও প্রশাসনিক কাঠামোর হাতে তুলে দিয়েছি, যা তাদের চিন্তাশক্তি নষ্ট করছে। এই ব্যর্থতার দায় শিশুদের নয়, পুরো জাতির। রাষ্ট্র, পরিবার, শিক্ষক— সবার সম্মিলিত অবহেলা ও ভুল নীতির ফলেই আমরা তৈরি করছি এক হারানো প্রজন্ম, যারা জানে না কীভাবে ভাবতে হয়, কীভাবে নিজের ভেতরের সৃজনশীলতাকে জাগিয়ে তুলতে হয়।
তবুও আশা হারানোর কিছু নেই, কারণ বাঙালির ইতিহাসই বলে— আমরা ধ্বংসের ভেতর থেকেও নতুন সৃষ্টি করতে পারি। আমাদের রক্তে আছে পুনর্জাগরণের জিন। শুধু দরকার একটি দিকনির্দেশিত, সৎ ও জ্ঞানভিত্তিক শিক্ষা-সংস্কার। দরকার এমন এক রাষ্ট্রনীতি, যা সন্তানদের জাগ্রত করবে অনুসন্ধানের আনন্দে, শেখাবে কৌতূহল ও সততার শক্তি।
যেদিন আমরা সিস্টেমের গেঁড়াকল ভেঙে আবার সেই মিশ্র রক্তের সৃষ্টিশীল জাগরণ ফিরিয়ে আনতে পারব, সেদিনই নতুন প্রজন্ম হবে এই জাতির সত্যিকারের উত্তরাধিকারী— যাদের মেধা ও মনন একত্রে গড়বে ভবিষ্যৎ বাংলাদেশকে। এখন প্রশ্ন একটাই— আমরা কি সেই পুনর্জাগরণের জন্য প্রস্তুত?
লেখক
শিক্ষাবিদ ও গবেষক
ডিন, ফ্যাকাল্টি অব সায়েন্স এবং ফ্যাকাল্টি অব টেক্সটাইল ইঞ্জিনিয়ারিং,
বিজিএমইএ ইউনিভার্সিটি অব ফ্যাশন অ্যান্ড টেকনোলজি, ঢাকা।