আবরার ফাহাদকে নিয়ে লেখা প্রথম কবিতা ও জরুরি কিছু প্রশ্ন
শিল্প-সাহিত্য, সংস্কৃতি ও রাজনীতির যাঁরা খোঁজখবর রাখেন, আবরার ফাহাদকে নিয়ে এখন যাঁরা মাতামাতি করেন, তাঁদের সবার উদ্দেশে একটা ছোট প্রশ্ন রাখতে চাই। বলুন তো, আবরার ফাহাদকে নিয়ে প্রথম কবিতা কে লিখেছিলেন?
এ প্রশ্নের উত্তর হয়তো অনেকেরই জানা নেই। বুয়েটের ছাত্র আবরার ফাহাদকে মধ্যযুগীয় নিষ্ঠুরতায় পিটিয়ে হত্যা করা হয়েছিল, নির্মম ও ভয়ঙ্কর সেই মৃত্যুসংবাদ জেনে অনেকেই আহত হয়েছিলেন। আবরার ফাহাদের মৃত্যুসংবাদ পড়ে যিনি প্রথম কবিতা লিখেছিলেন, কবিতার মাধ্যমে প্রতিবাদ জানিয়েছিলেন, তিনি নওশাদ জামিল। বিনয়ের সঙ্গে বলি, হ্যাঁ, আমি-ই সেই মানুষ; সেদিন এক অব্যক্ত ব্যথায়, ক্ষোভে, গভীর মানবিক মমতায় লিখে ফেলেছিলাম কবিতাটি।
স্পষ্ট মনে করতে পারি, সেদিন প্রথম আলো অনলাইনে আবরার ফাহাদ হত্যাকাণ্ডের সংবাদটি পড়েছিলাম। পুরো শরীর কেঁপে উঠেছিল। যেন বুকের ভেতর কেউ এক মুঠো আগুন ছুড়ে মেরেছিল। ভীষণ অস্থিরতার মুহূর্তেই লিখেছিলাম কবিতাটি। নিটোল মাত্রাবৃত্ত ছন্দে, ১৬ পঙ্ক্তির একটি ছোট কবিতা। শিরোনাম দিয়েছিলাম ‘আবরার’।
সেদিন (৮ অক্টোবর, ২০১৯) রাতে নিজের ব্যক্তিগত ফেসবুক অ্যাকাউন্টে কবিতাটি প্রকাশ করেছিলাম। এখনো কেউ খুঁজলেই আমার ফেসবুকের দেয়ালে তা পাবেন। ফেসবুকে প্রকাশের পর অনেকেই জানিয়েছিলেন তাঁদের মুগ্ধতা ও সংবেদনশীল প্রতিক্রিয়া। অনেকেই বলেছিলেন, ‘এটি শুধু একটি কবিতা নয়, একটি কান্না, একটি প্রতিবাদ, একটি আর্তনাদ।’
সেদিন ( ৮ অক্টোবর, ২০১৯) বিকেলে বিডিনিউজ২৪ ডটকমে কবিতাটি প্রথম প্রকাশিত হয়। কবিতাটি প্রকাশের পেছনে ছিলেন বিশিষ্ট অনুবাদক ও গবেষক রাজু আলাউদ্দিন, তিনি বিডিনিউজের সাহিত্য বিভাগের প্রধান। রাজু ভাই ফেসবুকে কবিতাটি পড়েই আমাকে ফোন করেছিলেন। বলেছিলেন, ‘নওশাদ, আপনার কবিতাটি বিডিনিউজে প্রকাশ করতে পারি?’
রাজু আলাউদ্দিন অত্যন্ত প্রিয় মানুষ, তাঁকে কৃতজ্ঞচিত্তে সম্মতি দিয়েছিলাম। বিডিনিউজে আগেও আমার কয়েকবার গুচ্ছ কবিতা প্রকাশিত হয়েছিল, বিভিন্ন লেখাপত্র প্রকাশিত হয়েছিল। তবে আবরারকে নিয়ে কবিতাটি যেন অন্য এক স্তরে পৌঁছে গিয়েছিল। তখন যেন এটি এক মানবিক প্রতিবাদের ভাষা হয়ে উঠেছিল।
স্পষ্ট মনে করতে পারি, সেদিন কবিবন্ধু আলতাফ শাহনেওয়াজের সঙ্গে কবিতাটি নিয়ে অনেকক্ষণ কথা হয়েছিল। তাঁকে আমিই পরামর্শ দিয়েছিলাম, বলেছিলাম, ‘নয়ন, তোমার সাহিত্য পাতায় আবরার ফাহাদকে নিয়ে সংখ্যা করতে পারো।’ আলতাফ শাহনেওয়াজের ডাকনাম নয়ন, সে তখন দৈনিক প্রথম আলোর সাহিত্যবিভাগের প্রধান হিসেবে কাজ করত। সেদিন নয়ন বলেছিল, ‘সংখ্যা করার মতো সময় তো নেই। আজ (মঙ্গলবার), পাতা বের হবে শুক্রবার। বৃহষ্পতিবার পাতার মেকাপ। এখন আর কেউ কি লিখতে পারবেন?’ নয়নকে সাহস দিয়ে বলেছিলাম, ‘চেষ্টা করে দেখতে পারো।’
তখনকার সময়টা ছিল আওয়ামী লীগের প্রভাবশালী শাসনকাল। সংবেদনশীল ও ঝুঁকিপূর্ণ বিষয়ের ওপর বিশেষ সংখ্যা করা সহজ ছিল না। নয়ন তার সব সাহস, মানবিকতা আর সাংবাদিকসত্তা এক করে চমৎকার কাজ করেছিল। মাত্র দুই দিনের মধ্যে আবরার ফাহাদকে নিয়ে একটি ছোট কিন্তু হৃদয়গ্রাহী সংখ্যা প্রকাশ করেছিল।
দুইদিন পর শুক্রবার (১১ অক্টোবর ২০১৯) প্রথম আলোর সাহিত্যপাতা অন্য আলো আবরার ফাহাদকে নিয়ে প্রকাশ করেছিল ছোটখা্টো একটা সংখ্যা। ‘সময়ের পদাবলি’ শিরোনাম ছোট একটি ভূমিকা ছিল, সেখানে লেখা ছিল ‘বুয়েটের শিক্ষার্থী আবরার ফাহাদ হত্যাকাণ্ডের প্রতিবাদে মুখর হয়েছে দেশবাসী। কবি-সাহিত্যিকেরাও প্রতিবাদ জানাচ্ছেন তাঁদের কলমে। এখানে থাকল সময়ের উত্তাপ ধারণকারী কয়েকটি কবিতা।’
সেদিন সাহিত্য পাতার ওপরের দিকে এক পাশে, সবার ওপরে ছাপা হয়েছিল আমার লেখা কবিতা ‘আবরার’। তার ঠিক পাশে ছিল কবি ঠোকন ঠাকুরের কবিতা ‘সমান্তরাল’, আর নিচে ছিল আমার প্রিয় বন্ধু তামিম ইয়ামীনের কবিতা ‘কালসন্ধ্যা’। তামিম বিসিএস প্রশাসন ক্যাডারের একজন কর্মকর্তা। সরকারি চাকরিতে থেকেও সে সাহস নিয়ে কবিতাটি লিখেছিল, সত্যি বলতে আমি বিস্মিত হয়েছিলাম। ঠোকন ভাইয়ের মতো কবিও তখন কোনো দ্বিধা না করে কলম ধরেছিলেন।
প্রথম আলো-তে আবরার ফাহাদকে নিয়ে আমার কবিতাটি প্রকাশের পর পরই সেটি রীতিমতো ভাইরাল হয়ে গিয়েছিল। কবিতাটি অসংখ্য মানুষ শেয়ার দিয়েছিল, কবিতাটির প্রশংসা করেছিল। কবিতাটির প্রশংসা যারা করেছিলেন, তাদের নাম বললে অনেকেই অবাক হবেন। এখন যখন অসংখ্য মানুষ আবরার ফাহাদকে স্মরণ করে, তার জন্য ন্যায়বিচার চায়, তখন আমি ভাবি কবিতাটি লেখার সেই মুহূর্তে আমি যেন একা ছিলাম। তবে আমার কলমে কাঁপছিল হাজারো বিবেকবান মানুষের বেদনা, এক আহত আর্তনাদ।
নিজের ঢাকাঢোল পেটানো বন্ধ করে কিছু জরুরি কথা বলি। আবরার ফাহাদকে নিয়ে কবিতা লেখার জন্য অসংখ্য মানুষ যেমন প্রশংসা করেছিলেন, তেমনই অনেকে অবাকও হয়েছিলেন। সেদিন কেন কবিতাটি লিখেছিলাম?
আমরা সবাই জানি বুয়েটে যারা পড়াশোনা করেন, নিঃসন্দেহে তারা মেধাবী। আবরার ফাহাদকে যারা নির্মমভাবে পিটিয়ে হত্যা করেছিলেন, তারাও মেধাবী। আবরার ফাহাদের হত্যাকাণ্ডের সংবাদ শুনে সেদিন আমার মনে কিছু প্রশ্ন উদয় হয়েছিল। মনের ভেতর ঘুরপাক খেয়েছিল আবরারের ওপর একের পর এক লাঠির আঘাত যখন পড়ছিল, হত্যাকারীদের বিবেক কি একবারও কেঁপে উঠেনি? মনুষ্যত্ব কি এক মুহূর্তের জন্যও জেগে ওঠেনি?
আমরা প্রায়ই মনে করি কেউ যদি বুয়েট, মেডিকেল, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় কিংবা অন্য কোনো উচ্চশিক্ষা প্রতিষ্ঠানে পড়েন, তবে তিনি নিশ্চয়ই ভালো মানুষ হবেন। আলোকিত মানুষ হবেন, সত্য ও সৌন্দর্যের পথে হাঁটবেন। কিন্তু বাস্তবতা বলছে অন্য কথা। বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়লেই যে কেউ ভালো মানুষ হবেন, তার কোনো নিশ্চয়তা নেই। বিশ্ববিদ্যালয়গুলোয় মানবিকতা, সংবেদনশীলতা, মূলবোধ, সংস্কৃতিবোধ, ন্যায়পরায়ণতা, অসাম্প্রদায়িক চেতনা, উদারতা, দেশপ্রেম ইত্যাদি মহৎ গুণাবলীর চর্চাকে কতটুকু আর উৎসাহ দেওয়া হয়? বিশ্ববিদ্যালয়গুলো মেধাবী তৈরি করে, চমৎকার পেশাজীবী গড়ে তোলে; কিন্তু তারা সত্যিকার মানুষ তৈরি করতে পারে কি?
প্রকৃতপক্ষে চারদিকে যখন মনুষত্বহীনতার চর্চা, বিচারহীনতার সংস্কৃতি, অবৈধ ক্ষমতা ও বিত্তের আস্ফালন, তখনই সমাজে দানব তৈরি হয়। মেধাবী হয়েও মানুষরূপী কুলাঙ্গার তৈরি হয়। মেধাবী দানবের চেয়ে বড় শয়তান আর কেউ নেই। কেননা তারা পরিকল্পনার মাধ্যমেই হত্যা, খুন, ধর্ষণ, দুর্নীতিসহ নানা অপকর্ম করে।
আমরা এখন এক দানবময়, অদ্ভুত এক সমাজে বাস করছি। আমাদের সমাজে যেন ভালো মানুষের মূল্যায়ন নেই, মনুষত্বের কোনো দাম নেই, সততার কদর নেই। আমরা মানুষকে বিচার করি তার অর্থবিত্ত, গাড়ি-বাড়ি, পদ-পদবি বা সাফল্যের মাপকাঠিতে। বাহ্যিক সৌন্দর্য, সামাজিক প্রভাব কিংবা ক্ষমতার জৌলুসেই যেন নির্ধারিত হয় একজন মানুষের মর্যাদা।
যার ফলে সাফল্য অর্জনের জন্য, ক্ষমতা পাওয়ার জন্য, প্রভাব বিস্তারের জন্য মানুষ যতটা মরিয়া, ভালো মানুষ হওয়ার জন্য ততটা নয়। অথচ ভালো মানুষ হওয়াটাই সবচেয়ে কঠিন, সবচেয়ে জরুরি, সবচেয়ে মূল্যবান বিষয়।
এজন্য সবসময়ই মনে হয়, মেধাবী ও দক্ষ হওয়ার পাশাপাশি একজন ভালো মানুষ হওয়াও সমান গুরুত্বপূর্ণ, বরং আরও বেশি। প্রকৃত মানুষ তৈরির পেছনে পরিবার, সমাজ ও শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের ভূমিকা অপরিসীম। দুর্ভাগ্যের বিষয়, আমাদের অধিকাংশ প্রতিষ্ঠান সেই মানবিক শিক্ষা দিতে পারছে না, পর্যাপ্ত ভালো মানুষ তৈরি করতে পারছে না। কেন পরিবার, সমাজ ও শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান পর্যাপ্ত ভালো মানুষ তৈরি করতে পারছে না, এ প্রশ্নের উত্তর কে দেবে?
পাশাপাশি এটাও মনে হয়, ‘ভালো মানুষ’ হওয়া শুধু একটি গুণ নয়, এটি মানুষের অনন্ত পরিচয়। যে সমাজ এই সত্য ভুলে যায়, তার সভ্যতা যত উঁচুতেই উঠুক না কেন, তার মানুষ ততটাই অপূর্ণ থেকে যায়। এ সত্যটি আমরা কবে বুঝব? আমাদের রাষ্ট্রই বা কবে বুঝবে?
আবরার
নওশাদ জামিল
এ কেমন ঢেউ? ভালোবাসা ভেসে যায়
ঘৃণার সাগরে ডুবে যায় আবরার
ক্ষোভের তুফানে চুরমার সব কিছু
মানবদরদি কোথাও কি নেই আর?
ঘৃণার সাগরে উঠেছে মরণ ঢেউ
তুমুল আঘাতে মানবতা বরবাদ
মানুষ মরছে, পৃথিবী কাঁদছে আজ
এ ঢেউ রুখবে আছে কি প্রেমের বাঁধ?
দানব পেতেছে কাঁটার করুণ ফাঁদ
মানব কীভাবে চুপচাপ আছে বসে?
পশুরা হাসছে, শিশুরা কাঁদছে আজ
বন্ধু, দাঁড়াও মানুষকে ভালোবেসে।
মানুষ বাঁচাও, বাঁচাও সবুজ গ্রহ
বন্ধু, প্রেমের পথে নিশিদিন রহো।
নওশাদ জামিল: কবি, কথাসাহিত্যিক ও সাংবাদিক