একজন সংগীতশিল্পীর মৃত্যুতে মানুষ এমন উন্মাদ হয়ে গেল কেন?
কয়েকদিন আগে সোশ্যাল মিডিয়ায় আসামের সংগীতশিল্পী জুবিন গার্গের মারা যাওয়ার খবর পড়লাম। এই নামের কাউকে চিনি বলে আমার মনে পড়ল না। পরে খবরের বিস্তারিত পড়তে গিয়ে দেখি, তিনি ২০০৬ সালে গ্যাংস্টার সিনেমার ‘ইয়া আলী’ গানের সেই বিখ্যাত শিল্পী। আমার খানিকটা মন খারাপ হলো। ব্যাস, এইটুকুই!
কিন্তু ফেসবুক অ্যালগরিদম কঠিন জিনিস। এরপর স্ক্রল করলেই জুবিন গার্গ বিষয়ক নানা খবর নিউজফিডে আসতে শুরু করল। এর মধ্যে একটা ভিডিও দেখে আমি নড়ে চড়ে বসলাম। জিপ টাইপের একটা গাড়িতে করে জুবিনের মৃতদেহ এয়ারপোর্ট থেকে গুয়াহাটি শহরের দিকে নিয়ে আসা হচ্ছে। রাস্তার দুই ধারে হাজার হাজার মানুষ দাঁড়িয়ে আছে! আর গাড়ির পেছনে পাগলের মতো দৌড়াচ্ছে আরও কয়েক হাজার মানুষ!
এরপর গত তিন দিন ধরে আমি জুবিন গার্গকে নিয়ে পড়াশোনা করার চেষ্টা করলাম। তাঁর দেওয়া নানা সাক্ষাৎকার পড়লাম, বিভিন্ন অনুষ্ঠানে তাঁর পারফর্ম্যান্স দেখলাম! বোঝার চেষ্টা করলাম, একজন সংগীতশিল্পীর মৃত্যুকে নিয়ে আসামের মানুষ এমন উন্মাদ হয়ে গেল কেন? বিশেষ করে এমন এক সময়ে, যখন কেউ মারা গেলেও তাকে নিয়ে ট্রল হয়, মৃত ব্যক্তি আমার পছন্দের না হলে তার মৃত্যু সংবাদে ‘হাহা রিয়েক্ট’ পড়ে, মতাদর্শের বিপরীতে পোশাক পরলে মোরাল পুলিশিং করতে একবিন্দু পিছপা হয় না অনেকেই।
মধ্যবিত্ত পরিবারে বেড়ে ওঠা জুবিনের মা ও বোনও সংগীতশিল্পী ছিলেন। মা ইলি অসমীয়া ভাষার ঐতিহ্যবাহী লোকসংগীত শিল্পী ছিলেন, বোনও অসমীয়া গান পরিবেশন করতেন। দুজনেই আঞ্চলিকভাবে পরিচিত ছিলেন। ওইটুকুই।
ছোটবেলায় মায়ের কাছে গান শিখেছেন জুবিন। স্কুল-কলেজে গান গাইতেন। ২০ বছর বয়সে, ১৯৯২ সালে এসেছে তাঁর প্রথম অ্যালবাম। এরপর গানের সাথেই লেগে ছিলেন। ২০০২ সালে সড়কদুর্ঘটনায় বোনের মৃত্যুর পর জুবিনের জীবন পাল্টে যায়। বিরহ এসে চিরস্থায়ীভাবে ভর করে তাঁর কণ্ঠে। এরপর দিনে দিনে তাঁর গানের সংখ্যা বেড়েছে। প্রায় ৪০টি ভাষায় অন্তত ৩৮ হাজার গান রেকর্ড করেছেন তিনি। গেয়েছেন সব বয়সী মানুষের জন্য গান।
২০০৬ সালে প্রথমবারের মতো বলিউডে ব্রেকথ্রু পান। অনুরাগ বসুর গ্যাংস্টার সিনেমায় ‘ইয়া আলী’ গানের মত হিট গান ও পরে ফিল্মফেয়ারের জন্য মনোনীত হওয়ায়, আর আসামে পড়ে থাকার কোনো কারণ ছিল না। কিন্তু গানের জন্য সারা দুনিয়া চষে বেড়ালেও মূলত আসাম ছেড়ে কোথাও যেতে চাননি জুবিন। বিভিন্ন স্টেজশোতে নিজেকে ‘পাহাড়ের সন্তান’ বলে পরিচয় দিতেন।
১০–১৫ বছর আগে কোলকাতার বাংলা সিনেমা যখন পুরনো ধাঁচ থেকে আধুনিক বাণিজ্য ও আর্ট ফিল্মের ঘরানায় বদলে যেতে শুরু করল, তখন জিৎ ও দেবের বিভিন্ন সিনেমায় একের পর হিট গান উপহার দিয়েছেন জুবিন। বিশেষ করে বিরহ ও বেদনার গানে জুবিন হয়ে উঠেন বিকল্পহীন! কোলকাতায় তাঁর অধিকাংশ গানের সংগীত পরিচালক ছিলেন জিৎ গাঙ্গুলি। আসাম থেকে রাতের শেষ ফ্লাইটে কোলকাতায় এসে গান রেকর্ডিং করে ভোরে আবার আসামে ফেরত যেতেন। জিৎ গাঙ্গুলি বিরক্তি প্রকাশ করলে উত্তরে নাকি বলতেন, ‘এমন দরদ আর বেদনার গান রাত গভীর না হলে গাওয়া যায়, দাদা?’ মূলত ওইসব গানের মধ্য দিয়েই জুবিন কোলকাতার বাংলাভাষী মধ্যবিত্তের জীবনে ঢুকে পড়েন। ঘটনাটা এমন দাঁড়ায় যে, ভাসান থেকে গায়ে হলুদ, ব্যাডমিন্টন টুর্নামেন্ট থেকে ট্রাকের পেছনে সাউন্ডবক্স ঝুলিয়ে পাড়া দাপানো—জুবিনের গান ছাড়া অসম্ভব!
কিন্তু প্রশ্ন হলো, গান তো আরও অনেকেই গান করে। জুবিনের চেয়ে ঢের ভালো শিল্পীও আছেন। কিন্তু জুবিনকে কেন মানুষ এত ভালোবাসত? তাও আবার এমন এক শিল্পী, যে গত ৫–৬ বছরে একটি হিট গান দিতে পারেননি, মদ ছিল তাঁর জীবনের সঙ্গী, মঞ্চে উঠে এলোমেলো গিটার বাজাতেন, কোনো সামাজিক ইস্যুতে রাজনীতিবিদদের এক হাত নিতে ছাড়তেন না। এমনও দিন ছিল, মঞ্চে উঠে মদের কারণে গানই গাইতে পারেননি, মঞ্চেই ঘুমিয়ে পড়েছেন।
ভাবেন তো, আমাদের দেশে হলে কি হতো? ঘাড় ধাক্কায় মঞ্চ থেকে নামিয়ে দেওয়া হতো না? আয়োজকদের হাতে মার খাওয়ার কথাও তো! এই ধরনের খবরই আমরা প্রায়ই পত্রিকায় পড়ি!
আসলে ঘটনা হলো, শুরু থেকেই ‘মানুষ-জুবিন’ আর ‘শিল্পী-জুবিন’কে ছাড়িয়ে গিয়েছিলেন তিনি। জুবিন ছিলেন সমাজসেবক। যখনই কোথাও কেউ বিপদে পড়তো, জুবিন সেখানে হাজির হতেন। কেউ তাঁর সাথে হাত মিলাতে আসলে জুবিন তাঁর দিকে হাসিমুখে বুক বাড়িয়ে দিতেন। রাজ্যের নানা জায়গায় ঘুরে ঘুরে গাছ লাগাতেন। বিজেপি সরকার যখন রাজ্যে নাগরিক সনদ (সিএএ/এনআরসি) প্রণয়ন শুরু করলো, জুবিন সেটা নিয়ে কথা বলেছেন। করোনা সময়ে নিজের বাড়ি ছেড়ে দিয়ে সেটি ‘কোয়ারেন্টাইন সেন্টার’ বানিয়েছিলেন।
পশু-পাখির প্রতি তাঁর ছিল গভীর প্রেম। তাই তাঁর মৃত্যুর পর তাঁর স্ত্রী যখন পালিত কুকুর চারটাকে নিয়ে গেলেন জুবিনকে শেষবারের মতো দেখতে, সেই কুকুরদের চোখে যে বিষাদ ঝরে পড়ল, সেই দৃশ্য দেখে বুকে মোচড় দিয়ে ওঠে।
দুই দশকের বিবাহিত জীবনে তাঁদের কোনো সন্তান ছিল না, কিন্তু জুবিন ও তাঁর স্ত্রী গরিমা ছিলেন ১৫ সন্তানের পিতা-মাতা—অর্থাৎ আশ্রয় দিয়েছেন ১৫ জনকে। গণধর্ষণের শিকার এক মেয়েকে তুলে এনে আশ্রয় দিয়েছেন তিনি। বাড়িতে ঝির কাজ করা কাজলি নামের এক মেয়ে যখন প্রবল নির্যাতনের শিকার হয়ে মৃত্যুর সঙ্গে লড়ছিলেন, তখন জুবিন তাঁকে তুলে এনেছিলেন, আদালতে মামলা লড়েছেন, সেই মামলায় জিতেছেনও! সেই খবর বিদ্যুৎবেগে ছড়িয়ে পড়েছে ঘরে ঘরে। ফলে সব জেনারেশনের মানুষের অন্তরমহলে জুবিন ঢুকে পড়েছিলেন। ‘ক্যারিয়ারে চারটা গান কম হোক, চারটা স্টেজ শো কম হোক—কিন্তু জীবন থেকে চারটা ভালোবাসার মুহূর্তকে ছেঁটে ফেলা যাবে না’—এই ছিল তাঁর জীবনদর্শন!
জুবিন এতিমদের ভরণপোষণ দিতেন। মুসলমান এতিম শিশুদের জন্য খুলেছিলেন মাদরাসা ও এতিমখানা; একটি ভিডিওতে দেখলাম, জুবিনের মৃত্যুর পর সেই এতিমখানার ছাত্র-শিক্ষকরা দাঁড়িয়ে তাঁর গান গাইছেন। রাস্তায় রাস্তায় তাঁর ছবি টানিয়ে শোক পালন করছে সব ধর্মের মানুষ। মুসলিম ইমামের মোনাজাতে প্রদীপ জ্বালিয়ে বসে আছে প্রবল ধর্মবিশ্বাসী হিন্দু নারী! এক মুসলিম ছেলে জুবিনের ঢাউস সাইজের ছবির সামনে বসে কোরআন খতম দিচ্ছেন।
জুবিনের একটা ডায়লগ খুব জনপ্রিয় ছিল, জনপ্রিয় শব্দটা আমি ইচ্ছা করে ব্যবহার করেছি। তিনি বলেছিলেন, ‘আমার কোনো ধর্ম নেই, আমার কোনো জাত নেই। আমার কোনো ভগবান নেই। আমি মুক্ত। আমি কাঞ্চনজঙ্ঘা।’ বলেছিলেন, ‘মৃত্যুর পর আমাকে পোড়াইও না। ব্রহ্মপুত্রে ভাসিয়ে দিও।’
তার মানে জুবিন নাস্তিক ছিলেন। মঞ্চে দাঁড়িয়ে এমন কথা বাংলাদেশের কেউ বললে তাঁর অবস্থা কিরকম হতো, ভাবা যায়? ২০১৩–১৪ সালের দিকে নাস্তিক ব্লগারদের মৃত্যুর কথা মনে পড়ে আমার। বর্তমান পরিস্থিতি কী ভিন্ন, সে কথা আমি বলি না।
জুবিন ভরা মঞ্চে টিশার্ট উপরে তুলে বলতেন, ‘আমার কোনো পৈত নেই’—মানুষ সেসবকে গায়েই মাখল না। আসাম কিন্তু ছোট একটা রাজ্য। গুয়াহাটিতে এখনো তথাকথিত নগরের ছোঁয়া লাগেনি! মানুষজন তত শিক্ষিতও নন। অথচ সেই রাজ্যের প্রায় ‘গেঁয়ো’, ‘অশিক্ষিত’ লাখ লাখ মানুষ একটি ধর্মহীন লোককে ভগবানের কাতারে বসিয়ে দিলেন!
একটি ভিডিও দেখলাম, আসামে মহালয়ার প্রস্তুতি চলার কথা; দূর্গাপূজার উৎসব শুরু হওয়ার কথা। কিন্তু কোনো রাস্তায় মানুষ নেই। স্কুল বন্ধ, অফিস-আদালত বন্ধ হয়ে গেছে। ব্যবসা-বাণিজ্য স্থবির। তিন দিনের রাষ্ট্রীয় শোক চলল আসামে! আসামের মুখ্যমন্ত্রী বাকি সবার সাথে রাস্তায় হেঁটেছেন, হাঁটতে হাঁটতে জুবিনের গান গেয়েছেন, আর চোখ মুছেছেন।
এক ঘরোয়া আড্ডায় জুবিন মজার ছলে বলেছিলেন, ‘কেউ মরলে মুম্বাই বন্ধ হয় না, চেন্নাই বন্ধ হয় না। কিন্তু আমি মরলে আসাম সাত দিনের জন্য বন্ধ হয়ে যাবে। কারণ আমি লেজেন্ড!’ আসামবাসী যেন জুবিনের কথাকে বাস্তবে রূপ দিতে বদ্ধপরিকর।
মানুষ এক জীবনে টাকা-পয়সা, সোনা-দানা, হীরা-জহরত—কত কী জমায়! গত তিন দিনে আমার মনে হলো, জুবিন মানুষ জমাতে চেয়েছেন। যতগুলো ভিডিও আমি দেখেছি, দেখেছি যে, এই মানুষের চোখে অসম্ভব প্রেম। যখনই কারো দিকে তাকান, সেই দৃষ্টি প্রেম আর আকুতিতে ভরা। একেবারে পিউর। ফলে ৫২ বছরের জীবনে আসামের মত এক ছোট শহরের শিল্পী একশো কোটি টাকার মালিক হলেও, রাস্তার পাশের ঝুপড়িতে বাবু সেজে বসে ভাত খেতে পারতেন। পকেট থেকে টাকা বের করে গুণে গুণে কয়েকটা নোট পাশে বসা দরিদ্র মানুষটির হাতে তুলে দিয়ে বাকিটা আবার নিজের পকেটে রাখতেন। না, সেই দেয়ায় কোনো স্টারডম ছিল না, কোনো লোক দেখানো ভেল্কি ছিল না।
ফলে আসামের মানুষ এক সামান্য জনদরদি গায়ককে ভালোবেসে ফেলেছে! রবিন শর্মার একটা বইয়ের নাম—‘Who Will Cry When You Die?’ এটি আমার খুব প্রিয় একটি বই। গত তিন দিন ধরে সেই বইটির কথা বারবার মনে হচ্ছে আমার।
মৃত্যুর পর সবার জন্যই অনেক মানুষকে দলবেঁধে কাঁদতেই হবে—এমন কোনো কথা নেই। এটা ব্যক্তিগত পছন্দ! কিন্তু এক অসমিয়া শিল্পীর মৃত্যুর পরে যখন তাঁর শেষযাত্রার অনুষ্ঠানে ১৭ লক্ষ মানুষ জড়ো হয়ে একসাথে তাঁর গান গায়, চিৎকার করে কাঁধে, তখন ছাই হয়ে বাতাসে লীন হতে থাকা শরীরের প্রতিটি ইঞ্চি কেমন বোধ করে—সেটা ভেবে শিহরিত না হয়ে উপায় কী?
রাজু নূরুল: লেখক, অনুবাদক, গবেষক; যোগাযোগ: raju_norul@yahoo.com