২৫ সেপ্টেম্বর ২০২৫, ১০:৫৫

বাংলাদেশের ক্রিকেট বদলাচ্ছে, দর্শক মানসিকতা কি বদলাবে?

নওশাদ জামিল  © টিডিসি সম্পাদিত

বাংলাদেশের ক্রিকেট যারা ভালোবাসেন, তাদের অধিকাংশই টাইগারদের জয়ে যেমন উল্লাসে ফেটে পড়েন, তেমনি পরাজয়ে মুষড়ে পড়েন। এশিয়া কাপের সুপার ফোরের ম্যাচে ভারতের কাছে হারার পর সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে লক্ষ্য করেছি, অনেকেই হতাশ হয়েছেন, আবার অনেকে ক্রিকেটারদের গালাগালও করেছেন। ক্রিকেটের বিভিন্ন ক্ষেত্রে অগ্রগতি হয়েছে, কিন্তু দর্শকদের মানসিকতার তেমন কোনো পরিবর্তন হয়নি বলেই মনে হয়।

বাংলাদেশের ক্রিকেটকে দুই যুগেরও বেশি সময় ধরে নিবিড়ভাবে পর্যবেক্ষণ করছি, দেখার চেষ্টা করছি টাইগারদের অধিকাংশ ম্যাচ। পাশাপাশি ক্রিকেট নিয়ে দেশ-বিদেশের গুণীজনের লেখাপত্র পড়তেও পছন্দ করি, মাঝেমধ্যে ক্রিকেট নিয়ে নিজেও কিছু লেখার চেষ্টা করি। ক্রিকেট নিয়ে দীর্ঘ অভিজ্ঞতা ও সুগভীর ভালোবাসা থেকে দর্শকদের বলি, বাংলাদেশের ক্রিকেট নিয়ে হতাশার কিছু নেই। পরিকল্পনা অনুসারেই ধীরে ধীরে হলেও বদলাচ্ছে ক্রিকেটারদের মানসিকতা ও ট্যাকটিক্যাল নানা দিক। পাল্টাচ্ছে দেশের ক্রিকেট অবকাঠামো। এখন দর্শকদের মানসিকতারও পরিবর্তন জরুরি মনে করি।

ভারতের বিরুদ্ধে হেরে যাওয়ার পর যারা হতাশা ঝেড়েছেন, তাদের উদ্দেশ্যে বলি, আপনি কি বুঝতে পেরেছিলেন আসলে ম্যাচটি বাংলাদেশের জন্য এক ধরনের ওয়ার্ম-আপ ছিল? অধিকাংশ দর্শক তা হয়তো বুঝতে পারেননি মনে হয়।

ভারতের বিরুদ্ধে ম্যাচটি ওয়ার্ম-আপ কিংবা প্রস্তুতি ম্যাচ হিসেবে খেলার কারণ ছিল বেশ কিছু। এখন অনেকে হইচই করতে পারেন, বলতে পারেন এশিয়া কাপের সুপার ফোরের আন্তর্জাতিক ম্যাচকে আপনি প্রস্তুতি ম্যাচ বলছেন? তাদের উদ্দেশ্যে বলব, হ্যাঁ, এটা প্রস্তুতি ম্যাচই ছিল বটে।

প্রস্তুতি ম্যাচে জয়-পরাজয় গুরুত্বপূর্ণ নয়, ক্রিকেটারদের কেমন প্রস্তুতি হয়েছে সেটাই অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ বিষয় মনে করি। তো, ভারতের বিরুদ্ধে বাংলাদেশের ওয়ার্ম-আপ শেষে সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে অসংখ্য দর্শকের হতাশা দেখে আমার মনে হয়—আমাদের ক্রিকেট ফ্যানবেজ এখনো নিজেদের ক্রিকেট সেন্সের যথেষ্ট উন্নতি করতে পারেননি, দর্শকরা এখনো পরিণত ও সুশিক্ষিত হতে পারেননি। খেলোয়াড়রা যেমন ধীরে ধীরে পরিণত হচ্ছেন, তেমনি দর্শকদেরও বোঝাপড়ায় উন্নতি প্রয়োজন মনে করি।

প্রকৃতপক্ষে ওয়ার্ম-আপ ম্যাচে অসাধারণ খেলেছে বাংলাদেশ। যে দল একসময় জিম্বাবুয়ের বিপক্ষেও পূর্ণ শক্তির একাদশ নামাত, সেই দল ভারতের মতো প্রতিপক্ষের বিপক্ষে চারটি পরিবর্তন এনে মাঠে নেমেছে। আগের ম্যাচে যারা বেঞ্চে ছিল, তাদের মধ্যে চারজনকে সুযোগ দেওয়া হয়েছে। এ সিদ্ধান্ত প্রমাণ করে, বাংলাদেশ এখন টুর্নামেন্টকে ট্যাকটিক্যালি হ্যান্ডল করতে শিখেছে, বুঝেছে কখন কী করতে হবে।

এশিয়া কাপে সুপার ফোর শুরুর প্রথম দিনেই দুর্দান্ত ক্রিকেট খেলে শ্রীলঙ্কাকে হারিয়েছে লিটন দাসের দল। মোটামুটি এক পা দিয়ে রেখেছে ফাইনালে। তবে দুটো বড় সমস্যায় পড়েছে বাংলাদেশ। প্রথম সমস্যা, দুবাইয়ের অত্যন্ত গরম আবহাওয়া। দ্বিতীয় সমস্যাটি হলো, টানা দুই দিনে দুই ম্যাচ। টানা দুই দিন হাইভোল্টেজ দুটি ম্যাচ খেলাটা সহজ ব্যাপার নয়। মোটামুটি প্রতিকূল পরিবেশে কঠিন ব্যাপার। এটা কি আমাদের দর্শকরা বুঝতে পারেন?

সুপার ফোরে বাংলাদেশই একমাত্র দল যারা টানা দুটি ম্যাচ খেলবে। যে কারণে সুপার ফোরের সূচি নিয়ে সন্তুষ্ট নন বাংলাদেশের প্রধান কোচ ফিল সিমন্স। এ ছাড়াও সন্তুষ্ট হননি বোদ্ধা দর্শকরাও। সিমন্স তো আগেই বলেছেন, ‘টানা দুটি টি-টোয়েন্টি কিংবা ওয়ানডে খেলা খুবই কঠিন। এটা কোনো ভালো বিষয় নয়, টানা দুই দিনে দুটি টি-টোয়েন্টি খেলা ন্যায্যও নয়। মানুষ যেমনটা ভাবে, কাজটা তার চেয়ে অনেক কঠিন।’

এ কারণে কোচ ও ম্যানেজমেন্ট ভারতের বিরুদ্ধে লিটন দাস, তাসকিন আহমেদসহ চারজন গুরুত্বপূর্ণ ক্রিকেটারকে বিশ্রাম দিয়েছেন, আক্ষরিকভাবে আজ বৃহস্পতিবার (২৫ সেপ্টেম্বর) পাকিস্তানের বিরুদ্ধে সেমিফাইনালের জন্য প্রস্তুত রেখেছেন। এখন কেউ কেউ বলতে পারেন, তাহলে কি ভারতের সাথে ইচ্ছাকৃতভাবেই হেরেছে বাংলাদেশ। উত্তরে বলব, ‘না’, বাংলাদেশ ইচ্ছা করেই হারেনি ম্যাচটি, বরং ইতিবাচক নানা দিক পেয়েছে লাল-সবুজের দল।

শারীরিক ও মানসিকভাবে ক্লান্ত না হয়ে পাকিস্তানের বিরুদ্ধে গুরুত্বপূর্ণ নকআউট ম্যাচের জন্য তৈরি হয়েছে বাংলাদেশ। যদিও পাকিস্তানের বিরুদ্ধে কী ফলাফল হবে তা বলা যাচ্ছে না, তবে অন্তত সাম্প্রতিক পরিসংখ্যান ও খেলোয়াড়দের ফর্ম থেকে বোঝা যায় পাকিস্তানকে হারিয়েই এশিয়া কাপের ফাইনাল খেলতে চায় বাংলাদেশ, পাশাপাশি এশিয়া কাপের শিরোপা ঘরে তুলতে চায় লিটন দাসের দল। সুদূরপ্রসারী পরিকল্পনার অংশ হিসেবেই নানা ট্যাকটিক্যাল সিদ্ধান্ত নেন কোচ, স্টাফ ও ক্রিকেটাররা। এ জন্যই ভারতের বিরুদ্ধে চার পরিবর্তন নিয়ে মাঠে নামে বাংলাদেশ।

এবার বলি, ভারতের বিরুদ্ধে মাঠের পারফরম্যান্সে। বেঞ্চ থেকে গড়া একাদশ ভারতের পূর্ণ শক্তির দলের বিপক্ষে দুবাইয়ের পিচে ১৬৮ রানে থামিয়ে রাখতে পেরেছে, এটা নিছক সাফল্য নয়, বরং বড় এক ইতিবাচক অর্জন।

অনেকে লক্ষ্য করেছেন নিশ্চয়ই, প্রথম ৬ ওভার শেষে ভারত যখন রানের ফোয়ারা শুরু করেছিল, তখন অধিকাংশ দর্শক মনে করেছিলেন তারা অন্তত ২০০ থেকে ২২০ রান করবে। তারপর সেখান থেকে আবার ঘুরে দাঁড়িয়েছিল বাংলাদেশ। রিশাদ হোসেন শুধু বোলিং নয়, ফিল্ডিংয়েও হয়ে উঠেছিলেন দলের ত্রাতা। পাওয়ার প্লের পর তার ২ উইকেট বাংলাদেশকে ম্যাচে ফেরাল। জাকের আলী ক্যাচ ছেড়ে দেওয়ার পর অভিষেক শর্মা মাত্র ২৫ বলে তুলে নিলেন হাফ সেঞ্চুরি। শেষ পর্যন্ত ৩৭ বলে ৭৫ রানে রানআউট হয়ে থামলেন রিশাদের দুর্দান্ত থ্রোতে। শেষ দিকে বাংলাদেশের বোলাররা সবাই ভালো করেছেন।

ব্যাটিং অর্ডারের কিছু ভুল অবশ্যই ছিল, একমাত্র সাইফ হাসান ছাড়া আর কেউ পরিণত ব্যাটিং করতে পারেননি। যার ফলে মহাপরাক্রমশালী ভারতের বিরুদ্ধে হার স্বীকার করতে হয় বাংলাদেশের। তবে হার থেকে বাংলাদেশ নিশ্চয়ই শিখেছে, কোথায় ভারতের দুর্বলতা আর কোথায় নিজেদের ঘাটতি। সেমিফাইনালে ও ফাইনালে তা হয়তো কাজে দেবে দারুণভাবে। পাশাপাশি পাকিস্তানের বিরুদ্ধে একাদশ সাজাতেও ভূমিকা রাখবে।

পাকিস্তানকে হারিয়ে বাংলাদেশ যদি এশিয়া কাপের ফাইনালে পৌঁছে যায়, এমনকি ভারতকে হারিয়ে চ্যাম্পিয়নও হয়ে যায়, এটাতে অবাক হওয়ার কিছু নেই। এটাকে অঘটন বলারও কিছু নেই।

আরও পড়ুন: বাংলাদেশের বড় পরাজয়ে বিদায়ঘণ্টা বাজল শ্রীলঙ্কার

অনেকে জানেন, বাংলাদেশ একবার নয়, তিনবার এশিয়া কাপের ফাইনাল খেলেছে, দুর্ভাগ্যজনকভাবে কাছে গিয়েও জিততে পারেনি শিরোপা। এবার যদি বাংলাদেশ চ্যাম্পিয়ন হয়, তাহলে বলব এটার পেছনে গুরুত্বপূর্ণ অবদান আছে ভারতের বিরুদ্ধে প্রস্তুতি ম্যাচটির। দর্শকদের আবেগ থাকা অবশ্যই জরুরি, তবে আবেগ ও ভালোবাসার সঙ্গে যুক্তি, বিবেচনা এবং কৌশল বোঝাও জরুরি মনে করি।

আজ সেমিফাইনালে পাকিস্তানের বিপক্ষে ম্যাচটাই আসল পরীক্ষা বাংলাদেশের। বিশ্বাস করি, পরীক্ষায় গোল্ডেন জিপিএ-৫ পাবে বাংলাদেশ, পাশাপাশি ফাইনাল খেলবে লিটন দাসের দল। কিছুদিন আগেই পাকিস্তানের বিরুদ্ধে সিরিজ জিতেছে বাংলাদেশ। এশিয়া কাপের সুপার ফোরের ম্যাচেও জয়ের পাল্লা বাংলাদেশের দিকে হেলে আছে মনে করি। অতীতে এশিয়া কাপে পাকিস্তানকে হারিয়ে বাংলাদেশের ফাইনাল খেলার ইতিহাসও আছে, এটা হয়তো অনেকে ভুলে গেছেন।

প্রিয় দর্শক, স্মৃতি হাতড়ে দেখুন ২০১৮ সালের এশিয়া কাপেও একই ঘটনা ঘটেছিল। ভারত আগেই ফাইনাল নিশ্চিত করেছিল, আর সুপার ফোরে বাংলাদেশ-পাকিস্তান ম্যাচ কার্যত হয়ে উঠেছিল সেমিফাইনাল। সাকিব-তামিমবিহীন চোটজর্জর দল তখন সেই ম্যাচ জিতে ফাইনালে পৌঁছেছিল। ইতিহাস বলছে, সেই ম্যাচ হয়েছিল ২৬ সেপ্টেম্বর, আর এবারের লড়াই ২৫ সেপ্টেম্বর। কী কাকতালীয় মিল, না?

দর্শকদের বলি, অতিরিক্ত হতাশার কোনো কারণ নেই। বরং বোঝা দরকার, ক্রিকেট শুধু মাঠের ১১ জন খেলোয়াড়ের খেলা নয়, বরং দল নির্বাচনের সাহস, ট্যাকটিক্যাল ম্যানেজমেন্ট, আর সঠিক সময়ে সঠিক সিদ্ধান্ত নেওয়ার বিষয়ও বটে। বাংলাদেশ প্রমাণ করেছে, তারা ধীরে ধীরে সেই জায়গাটায় পৌঁছাচ্ছে। এখন শুধু দরকার দর্শকেরও পরিণত ও সুশিক্ষিত হওয়া, যাতে আমরা সবাই মিলে এই রেঁনেসার অংশ হতে পারি। ধীরে ধীরে হয়ে উঠতে পারি ক্রিকেটের এক নতুন পরাশক্তি।

লেখক: কবি, কথাসাহিত্যিক ও সাংবাদিক
(মতামত লেখকের নিজস্ব)