কফি পান করার আগে জেনে নিন এর ক্ষতিকর দিক!
কফি, বর্তমান সময়ে দিনের শুরুর এক অপর নাম। অন্তত সমাজের উচ্চবিত্তদের ক্ষেত্রে তো বটেই! উন্নত দেশগুলোতে কফি কোন বিত্ত মানে না। একরকম অবাধেই বিচরণ ওর সব জায়গায়। গরম ধোঁয়া তোলা এক কাপ কফি যেন কোটি প্রাণে চাঞ্চল্য এনে দেয়। ইন্টারনেটের এই যুগে কফির সর্বজনস্বীকৃত উৎস ও বহুবিদ গুণাবলীর কথা এক রকম সবার হাতেই বলতে হবে।
ক্যাফেইনের পাশাপাশি কফির অন্য যতগুলো উপাদান নিয়ে সবচেয়ে বেশী গবেষণার তথ্য মেলে তা হলো— ক্যাফেইক এসিড, ক্লোরোজেনিক এসিডস, কাফেস্টল, কাউয়েওল ও ফেরুলিক এসিড। বিভিন্ন গবেষণায় প্রাপ্ত তথ্য অনুযায়ী উপরোক্ত উপাদানগুলোর যে কার্যকারিতা মেলে তা হল— এন্টিওক্সিড্যান্ট বা সাইটোপ্রটেক্টিভ, প্রদাহরোধী, ইমুনোমডুলেটরি, অণুজীব ধ্বংসকারী, ক্যান্সাররোধী, এন্টি-ডায়াবেটিক, মস্তিষ্ক-, হৃদপিণ্ড ও যকৃৎ প্রতিরক্ষাকারী গুন সাথে রয়েছে বিভিন্ন সিস্টেমের সাথে ইন্ট্রাকশনও। আর সে কারণেই ক্যাফেইনের উপকারিতার পাশাপাশি বহুবিদ ক্ষতিকর কার্যকারিতাও দেখা যায়। তবে অধিকাংশ মানুষই কফির স্বাদ নেয়, এর নিউরো-স্টিমুলান্ট ক্যাফেইনকে টার্গেট করেই। এটি ৯৯% বায়োএভেইলেভেল। যদিও কার্যকারিতা মাত্র ৩-৬ ঘণ্টা স্থায়ী হয়।
ক্যাফেইনের মূল উৎস Coffea arabica। অদ্যাবধি প্রায় ৬০টি উদ্ভিদে ক্যাফেইন পাওয়া গেছে এবং তন্মধ্যে coffee beans-ই প্রধান। বাড়ীতে তৈরিকৃত এক কাপ কফিতে সাধারণত ৩০ থেকে ১৭৫ মিগ্রা ক্যাফেইন থাকে, এছাড়া বাজারে যে সব ক্যাফেইন সমৃদ্ধ প্রোডাক্ট পাওয়া যায় তা হল—
• চকোলেট (১-১২০ মিগ্রা)
• এনার্জি ড্রিংকস্ (৩৩-৪০০ মিগ্রা)
• কার্বনেটেড বেভ্যারেজ (২২-৬৯ মিগ্রা)
• এলকোহলিক বেভ্যারেজ (৩-৯ মিগ্রা)
• ফাস্ট-ফুডস (১-৪৯ মিগ্রা)
• ক্যাফেইনেটেড ওয়াটার (৪২-১২৫ মিগ্রা)
• ক্যাফেইনেটেড সফট ড্রিংকস্ (৩০-৪৮ মিগ্রা)
• ডি-ক্যাফেইনেটেড কফি (১-৫ মিগ্রা)
• এসপ্রেসো (৫০-১৫০ মিগ্রা)
• টি-ব্যাগ (২-১৩০ মিগ্রা)
• ব্রেওয়েড/পার্কোলেটেড, ডি-ক্যাফেইনেটেড (৩ -১২ মিগ্রা)
• ইন্সটান্ট/রেগুলার ড্রিপ (৩০-৩৩০ মিগ্রা)
ক্যাফেইন ভ্যাগাল ভ্যাসোমোটরকে স্টিমুলেট করে; ফলে শ্বাস-প্রশ্বাস দ্রুততর, হার্টবিট বেড়ে যায় ও রক্তনালী সংকুচিত হয়। এটি স্টিমুলেটরি নিউরো-ট্রান্সমিটার যেমন— মনো-অ্যামাইন ও অ্যাসিটাইলকোলিন রিলিজে সহায়তা করে। অপর এক গবেষণায় পাওয়া গেছে যে— ক্যাফেইন অ্যাসিটাইলকোলিনকে প্রতিহত করতে পারে। উল্লেখ্য অ্যাসিটাইলকোলিন এর কার্যকারিতা প্রতিহত হলে নিউরো-ট্রান্সমিশন ব্যাহতসহ পেশীর-পক্ষাঘাত, খিঁচুনি, শ্বাস-নালী সংকোচন ও শ্বাসরোধজনিত কারণে মৃত্যু পর্যন্ত ঘটতে পারে।
তাছাড়া উচ্চমাত্রার ক্যাফেইন (১০০০-১৫০০ মিগ্রা/দিন) কাফেইনিজম সৃষ্টি করে। প্রতিনিয়ত ক্যাফেইন ব্যবহারে ডোপামিন রিলিজ ক্যাপাসিটি কমে যায়, ফলে শরীরে ক্যাফেইন টলারেন্স উদ্ভব হয়। ক্যাফেইনের আছে ফসফোডাইএস্টারেজ, টিউমার নেক্রোসিস ফ্যাক্টর-আলফা ও লিউকোট্রাইন সিন্থেসিসরোধী ক্ষমতা। তাছাড়া এটি ইন্ট্রাসেলুলার সাইক্লিক-এএমপি ও প্রোটিন-কাইনেজ-এ কে এক্টিভেট করতে পারে। সর্বতভাবে ক্যাফেইন শরীরের প্রদাহ ও রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা কমিয়ে ফেলে। মূলত স্বল্প প্রদাহ শরীরের জন্য উপকারী কেননা তা রোগ প্রতিরোধে প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষভাবে ভূমিকা রাখে।
উচ্চমাত্রার ক্যাফেইনের জানা ক্ষতিকর দিকগুলো হল— অনিদ্রা (insomnia), ক্যাফেইন ডিপেন্ডেন্সি (মাইল্ড ২৩৫ মিগ্রা/দিন ও উচ্চ), উইথড্রল সিম্পটমস (ঘুম ঘুম ভাব, মাথা ধরা, অস্বস্তি, অবসাদ গ্রস্থতা, উচ্চ রক্তচাপ ও অনিয়মিত বর্ধিত হার্ট রেট, অতিরিক্ত মূত্রত্যাগ ও পরিমাণ, মুড কমে যাওয়া, মনোযোগে ব্যাঘাত ঘটা, ঝাপসা দেখা, পাকস্থলী ও গেঁটে ব্যথা ইত্যাদি), হাড়ের ক্ষয়, গ্যাস্ট্রিক মটিলিটি ও এসিড সিক্রেশনে ব্যাঘাত ঘটা, পানিশূন্যতা, এক্সাইটি ও প্যানিক ডিসঅর্ডার, লো বার্থ-ওয়েট, কলোরেক্টাল ক্যান্সার, ইন্ট্রা-ওকুলার প্রেসার (গ্লুকোমা রোগীদের ক্ষেত্রে) বেড়ে যাওয়া, নার্ভাসনেস, তাড়নজাত, পাল্পিটেশন, চিন্তা ও কথায় কনফিউশন, ম্যানিয়া, অনুধাবনে বাঁধাগ্রস্ত, মাথাঘোরা, অবাধ্যতা, হ্যালুসিনেশন, সাইকোসিস, রাবডোমায়োলাইসিস ও অন্যান্য।
এমনকি ক্যাফেইন আধিক্যে মৃত্যু পর্যন্তও ঘটতে পারে। যে সকল রোগীদের কাফেইন মেটাবোলিজমে সমস্যা রয়েছে, তাদের ক্ষেত্রে ক্যাফেইন লিভার সিরোসিস সৃষ্টি করতে পারে। বিভিন্ন পরীক্ষায় এর এলডি৫০ (যে পরিমাণ ডোজ পরীক্ষাগারে ৫০% এনিম্যালকে মেরে ফেলতে সক্ষম) ধার্য করা হয়েছে ১৫০ - ২০০ মিগ্রা/কেজি (প্রায় ৭৫ থেকে ১০০ কাপ কফি একজন ৭০ কেজি ওজনের মানুষের মৃত্যু ঘটাতে পারে)।
যকৃতের সাইটোক্রোম-পি৪৫০ সিস্টেম-এর সহায়তায় ক্যাফেইনের প্রধান তিনটি ডাই-মিথাইল জান্থিন মেটাবোলাইট পাওয়া যায় এইগুলো হলো— paraxanthine (৮৪%), theobromine (১২%) ও theophylline (৪%)। প্রথমটির কার্যকারিতায় লাইপো লাইসিসের ফলে রক্তে ফ্যাটি এসিড ও গ্লিসারলের পরিমাণ বেড়ে যায়। উল্লেখ্য রক্তে এগুলোর পরিমাণ বেড়ে গেলে, রক্তনালীর প্রাচীরে জমে কলা-কোষের অপরিহার্য অক্সিজেন ও পুষ্টিউপাদান সরবারহে ব্যাঘাত ঘটাতে পারে। এক কথায়, ‘এথারো-থ্রম্বসিস’ যা কিনা হার্টস্ট্রোকের অন্যতম মূল কারণ। অপরদিকে দ্বিতীয়টি (theobromine) রক্তচাপ কমালেও বাড়িয়ে দেয় মূত্রের পরিমাণ এবং শেষোক্তটি (theophylline) মসৃণ পেশী ও শ্বাসনালীকে প্রসারিত করে।
সর্বশেষ গবেষণায় প্রাপ্ত তথ্যের ভিত্তিতে যা বলেছে হয় তা হলো— ক্যাফেইন কার্ডিওমায়োসাইট হাইপারট্রপি, সেক্স-ডিপেন্ডেন্ট স্টিমুলেটরি (মহিলাদের বেশী), স্টেরইডোজেনেসিস কমিয়ে দেয়া, শুক্রাণু উৎপাদন কমিয়ে দেয়া, গর্ভ জনিত ও প্রসব জটিলতা (প্রি-টার্ম বার্থ ও গর্ভপাত), এলাকা ভিত্তিক ব্রেইন কার্যকারিতা, ইন্সুলিন রেসিস্টান্ট, নিউরো-এন্ডোক্রাইন ডিজরেগুলেশন এর মত মারাত্মক ক্ষতি সাধন করতে পারে।
তাছাড়া ক্যাফেইনকে একই ফার্মাকোকাইনেটিক গুণ সম্পন্ন ড্রাগের সাথে ইন্ট্রাকশন করতে দেখা গেছে। সম্প্রতি ক্যাফেইনকে ধূমপানের সাথে সিজোফ্রেনিয়া ও অ্যালকোহলের সাথে ‘ক্যাফেইন স্টপ’ (ক্যাফেইন অকার্যকারিতা) সৃষ্টি করতে দেখা গেছে। ক্যাফেইনের সাথে অন্যান্য আর যেসব ড্রাগ ইন্ট্রাকশন পাওয়া গেছে তারা হল — nicotine, oral contraceptives , antidepressant (যেমন fluvoxamine) ও চেতনা নাশক (ketamine/xylazine)।
ক্যাফেইনের ক্ষতিকর প্রভাব সবচেয়ে বেশী পরিলক্ষিত হয় ১) কফিতে অনভ্যস্ত, ২) নিম্ন রক্ত-চাপের রোগী, ৩) হাইপার-একটিভ শিশু ও কিশোর, ৪) গর্ভবতী, প্রসূতি ও দুগ্ধ দানকারী মা এবং ৫) যারা গ্রোথ ফেইজে আছে (বিশেষ করে শিশু ও কিশোর)-এর ক্ষেত্রে। বিভিন্ন গবেষণায় ক্যাফেইনের ব্রেইন ও শরীরের ডেভেলপমেন্টে ক্ষতি সাধন (সান্টেড বা কম গ্রোথ) করতে দেখা গেছে।
বিশেষ করে শিশু, কিশোর ও গর্ভবতী মায়েদের ক্যাফেইন ও ক্যাফেইনেটেড প্রোডাক্ট থেকে দূরে থাকার নির্দেশ পাওয়া যায়। সুপার প্রভেদ্যতার জন্য ক্যাফেইন খুব দ্রুতই প্লাসেন্টা পর্দা পেরিয়ে মায়ের ও গর্ভের শিশুর শরীরে সমান মাত্রা অ্যাটেন করতে। যে সকল নারী গর্ভবতী হওয়ার অপেক্ষায় আছে অথবা হয়েছে তাদের জন্য ক্যাফেইনের মাত্রাকে অত্যন্ত সচেতনতার দৃষ্টিতে দেখা উচিৎ; কোন মতেই যেন মাত্রা ২০০ থে ৩০০ মিগ্রা/দিন এর বেশী না হয়। কেননা ওই সময়ে বিভিন্ন হরমোনাল পরিবর্তন ক্যাফেইসেনর মেটাবোলিজমকে ব্যাহত করতে। বেশীরভাগ গবেষণায়ই ক্যাফেইনকে গর্ভপাত ও ফেটাস এর ওজন কমাতে দেখা যায়। এটা মূলত ক্যাফেইনের লিউটিনাইজিং হরমোন সিক্রেশন এর উপর স্টিমুলেটরি এক্টিভিটির কারণেই হয়ে থাকে। কারণ মাত্রাতিরিক্ত লিউটিনাইজিং হরমোন সিক্রেশন প্রিম্যাচিউর মেনোপোজ, গোনাডাল ডিসজেনেসিস, টার্নার সিন্ড্রোম, ক্যাস্ট্রাশন, সৈয়ার সিন্ড্রোম, পলিসিস্টিক ওভারি সিন্ড্রোম, কঞ্জেনিটাল এড্রেনাল হাইপারপ্লাসিয়া, টেস্টিকুলার ফেইলুরের মত ক্ষতিকর রোগের অন্যতম কারণ।
সম্প্রতি মানুষের উপর করা এক গবেষণায় জানা গেছে, দিনে ১০০ মিগ্রা এর কম ক্যাফেইন ঘুমের জন্য কোন ক্ষতিকর নয়। তবে বয়স, শরীর ও জাতিভেদে মাত্রায় তারতম্য আসতে পারে। মজার ব্যাপার হল আমরা কেউই জানি না যে আমাদের চা কিংবা কফি কাপে সত্যিকার অর্থে কতটুকু ক্যাফেইন আছে। কেননা কফির উপাদান সমূহের তারতম্য ও পরিমাণ মূলত নির্ভরশীল উৎস ও পরিবেশগত, এবং বয়েলিং প্রসেস (তাপমাত্রা ও সময়) এর উপর। তাছাড়া কাপের সাইজ তো রয়েছেই!
লেখক: গবেষক ও সহকারী অধ্যাপক ফার্মেসি বিভাগ,
বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়, গোপালগঞ্জ