বঞ্চনার ভাইভা ও চট্টগ্রাম বন্দর কর্তৃপক্ষ
গত সোমবার (১৫ এপ্রিল) চট্টগ্রাম বন্দরে সহকারী প্রকৌশলী (টেলিযোগাযোগ) পদে ভাইভা দিলাম। একটি পদের বিপরীতে লিখিত পরীক্ষায় উত্তীর্ণ প্রার্থী তিনজন। বিজ্ঞপ্তি প্রকাশ ২০১৩ সালে আর লিখিত পরীক্ষা হয়েছিল ২০১৪ সালে। লিখিত পরীক্ষার ফল প্রকাশিত হয়েছিল গত ২৭ ফেব্রুয়ারি।
লিখিত পরীক্ষায় অংশগ্রহণকারী বন্দর কলেজের দুই রুম কানায় কানায় পূর্ণ ছিল। এ সংখ্যা ৬০ এর উপরে ছিল। দুই-তিন দফা মৌখিক পরীক্ষার তারিখ পরিবর্তনের পর সর্বশেষ ৯ এপ্রিল তাদের ওয়েবসাইটে নোটিশ প্রকাশিত হয়। ১৫ এপ্রিল ভাইভার তারিখ নির্ধারণ।
এদিন যথাসময়ে বন্দর ভবনে হাজির হয়ে দেখি আমার ভার্সিটির (ইউনিভার্সিটি অব সাইন্স এন্ড টেকনোলজি, চট্টগ্রাম) মেধাবী ছাত্র আজিজও ভাইভা দিতে এসেছে। অন্য আরেকজনের সাথে পরিচিত হলাম ভাইয়ার নামটা ভুলে গেলাম উনি আমেরিকান ইন্টারন্যাশনাল ইউনিভার্সিটি-বাংলাদেশ (এআইইউবি) থেকে পাশ করা।
সময় বেলা ১১.২৫। প্রথম রোল হিসেবে আমার ডাক আসলো, (তখন আমি ফুরফুরে মেজাজে ছিলাম কারণ এর আগে সহকারী প্রকৌশলী পদে আরেকটা ভাইভা দিয়েছিলাম, সে সময় ভাইভা দিয়ে খুব ভাল লেগেছিল, ভাইভাটা চমৎকার দিয়েছিলাম। যদিও চাকুরী হয়নি। চুয়েটের এক ভাই (সাজিদ হারুন) এর চাকুরী হয়েছে। সেবার চাকুরী না হওয়াতে কস্ট লাগেনি, রিটেনে টিকিয়েছিলেন ১০-১২ জন। আমার হয়ত রিটেনে মার্ক কম ছিল।)
ভাইভা বোর্ডে প্রথম প্রশ্ন চেয়ারম্যান স্যার-তোমার সম্পর্কে বলো, কোথায় আছো কি করো ইত্যাদি....। আমি খুব সাবলিলভাবে উপস্থাপন করলাম। আমার পড়াশুনা নিয়ে টুকটাক জিজ্ঞেস করলেন, স্টাডি গ্যাপ কেন জিজ্ঞেস করে তারপর টেকনিক্যাল প্রশ্ন শুরু। আমি বোর্ডের সকল সদস্য কে কি প্রশ্ন করেছেন তা সিরিয়ালি লিখছি -
১) চেয়ারম্যান স্যার: Sampling কিভাবে করে?
আমি উত্তর দিলাম: স্যাম্পলিং হলো এনালগ সিগনাল কে ডিজিটাল সিগনালে কনভার্ট করার প্রথম স্টেপ যেখানে Continuous Time signal কে Discreet Time signale convert শেষ না করতেই খুব রুঢভাবে সদস্য (প্রকৌশল) স্যার বললেন কিভাবে করা হয় সেটা বলো, আমি উনার ব্যবহারে একটু ভটকে গেলাম, আমি আবার ও রিপিট করলাম যে স্যাম্পলিং এ Continuous Time signal কে Discreet Time signale convert করা হয়। পরে চেয়ারম্যান স্যার ও বললেন যে কিভাবে করে সেটা বলো। আমি বলে ফেললাম এই মুহুর্তে মাথায় আসছেনা। আরেকজন বোর্ড সদস্য কড়াভাবে বলে দিলেন না পারলে পাস বলবা।
২) সদস্য প্রকৌশল স্যার: একটা সিগনাল কে কিভাবে এক জায়গা থেকে অন্য যায়গায় পাঠানো হয় বলো।
আমি উত্তর দিলাম: মডুলেশন এর মাধ্যম। উনি জিজ্ঞেস করলেন মডুলেশন আবার কি? এখানে মডুলেশন কেন? ( উনার কথা গুলো খুব কর্কস ও বাঝে) আমি বললাম একটি লো ফ্রিকুয়েন্সীর বেসব্যান্ড সিগনাল কে হাই ফ্রিকুয়েন্সির ক্যারিয়ারের সাথে সুপার ইমপোস করে সিগনাল কে প্রেরণ করা হয়। সাথে সাথে উনি প্রেরণ কি (তাও রাফলি)? টেকনিক্যাল ভাষা টেকনিক্যাল ভাষার মতো বলো। আমি আরো ভটকে গেলাম। ভটকে গেলাম এজন্যই যে আমাকে ডিপ্রেস করা হচ্ছে। যাহোক আমি ধরে নিলাম এটাই হয়ত উনার স্ট্রেটেজি ।
৩) একজন সদস্য: স্যাটেলাইট চিনেন? আমি স্যাটেলাইট সম্পর্কে বলতে গেলেই স্যাটেলাইট নিয়ে অন্য আরেকটা প্রশ্ন করেন যে, পৃথিবীতে কয়টা স্যাটেলাইট? এরকম মনে হয়েছে। আমি উত্তর দিলাম ২০০০০ এর উপরে। তখন বললেন যে কয়টা স্যাটেলাইট লাগবে পুরো পৃথিবীকে কাভার করতে সেটা জানতে চাচ্ছি? আমি জবাব দিলাম সেটির। পরে উনাদের একজন বললেন একটা আরেকজন বললেন তিনটা লাগবে।
৪) চেয়ারম্যান স্যার: আচ্ছা তুমি যে মাস্টার্স থিউরি কোর্স সম্পন্ন করেছো সেখানে মেজর কি নিয়েছো?
আমি উত্তর দিলাম: মেজর সেভাবে নয় স্যার, যে সময় যে কোর্স অফার করা হয়েছিল আমার সুবিধস মত কোর্স নিয়েছি। কি কি বিষয় সম্পন্ন করেছো? আমি বিষয়গুলোর নাম বললাম। বললেন, থিসিস কি নিয়া করবা? আমি বললাম স্যার এখনো ডিসাইড করিনি। আচ্ছা বলো মটরের ব্যাক ই এমএফকি আমি বললাম। এরপর বললেন, আমি যদি মটরের শ্যাফটকে ধরে রাখি ঘুরতে না দেই তাহলে ব্যাক ই.এম.এফ বাড়বে না কমবে, আনি হুট করে বলে দিলাম বাড়বে, এরপর বললেন তাহলে লোড বাড়ালে? তখন আমি বললাম সরি স্যার শ্যাফটকে ঘুরতে না দিলে ব্যাক ইএমএফ কমবে (কেন কমবে তার ব্যখ্যা দিলাম, ফ্যারাডেস ল অফ ইলেক্ট্রোম্যাগনেটিক ইন্ডাকশন দিয়ে, যেহেতু শ্যাফট ঘুরবেনা আমার আরমেচারও (মানে রোটর) ঘুরবেনা, আর্মেচার না ঘুরলে রেট অফ চেঞ্জ অব ফ্লাক্স কম হবে ভোল্টেজ ইন্ডিউউজসড কমে যাবে, ব্যাক ইএমফ কমে যাবে, ফলে কারেন্ট বেড়ে যাবে, মটর গরম হয়ে যাবে।)
৫) আরেকজন বোর্ড মেম্বার বললেন, কিছু সাম্প্রতিক জিজ্ঞাসা করি, একটি দেশের প্রধানমন্ত্রী বাংলাদেশ সফরে আছেন তার নাম কি ? আমি বললাম ভুটানের প্রধানমন্ত্রী ডা. লোটে শেরেং। উনি কোথায় পড়ালেখা করেন? বললাম, ময়মনসিংহ মেডিক্যাল কলেজ, কোন পর্যন্ত তিনি এদেশে পড়ালেখা করেন? বললাম, এফসিপিএস।
৫) সদস্য (এডমিন) স্যার: ভিটিএমআইএস কি? বললাম, ভেসেল ট্রাফিক ম্যানেজমেন্ট ইনফরমেশন সিস্টেম। চেয়ারম্যান স্যার উনার দিকে থাকালে উনি আর প্রশ্ন করেন নি।
৬) সদস্য প্রকৌশল স্যার রিফিটার কেন ইউজ করা হয়? আমি বললাম, উইক সিগনাল কে এম্পলিফাই করার জন্য। এই জবাবে উনি সন্তুষ্ট না।
৭) চেয়ারম্যান স্যার: আচ্ছা ক্যাবল টিভির লাইনেকি ব্যবহার করে সিগনালকে এম্পলিফাই করতে? আমি বললাম এম্পলিফায়ার (আমি সিউর জানিনা আইডিয়া দিয়ে বলে দিলাম)। এরপর উনি বললেন আসলে সিগনালের কি এম্পলিফাই করা হয়? আমি বললাম এম্পলিচুড। উনি পাশের জনকে জিজ্ঞাসা করলেন যে এম্পলিচুড কে কি চেঞ্জ করা যায়? উনি উত্তর দিলেন, জি পারা যায় স্যার।
৮) সদস্য (প্রশাসন): আচ্ছা মডুলেশন এর উদহারণ দাওতো কোথায় কি কাজে লাগে? আমি বললাম, স্যার যেমন আমাদের টেলিভিশন ট্রান্সমিশন এ দুই রকম মডুলেশন ইউজ হয়- এম্পলিচুড মডুলেশন যেটাকে ভেস্টিজিয়াল সাইডব্যান্ড মডুলেশন ভিএসবি মডুলেশন বলে যেটা ভিডিও এর জন্য আর ফ্রিকুয়েন্সী মডুলেশন করা হয় ভয়েস ট্রান্সমিট করার জন্য। (উত্তর শুনে উনাদের চেহেরায় অসন্তোষের লক্ষন ফুটে উঠে। কেন উত্তর দিতে পারছি)
(এই পর্যায়ে আমার গলা সম্পুর্ন শুকিয়ে গেছে। মুখে কোন ফ্লুইড নাই-সামনে মাম পানির হাফ লিটারের বোতল যেটা পরীক্ষার্থীর জন্য রাখা। আমি অনুমতি নিয়ে এক চুমুক পানি নিয়ে মুখ ভিজিয়ে নিলাম।)
৯) অন্য একজন সদস্য: আচ্ছা বলো টিডিএমএ কি? আমি বললাম টাইম ভিভিশন মাল্টিপল এক্সেস। এই টেকনিকে একটা নির্দিষ্ট ফ্রিকুয়েন্সী ব্যান্ডকে মাল্টিপল ইউজার ইউজ করতে পারে তবে ডিপারেন্ট টাইম স্লটে।
এরপর বললেন জিএসএম কি বলো? বললাম, গ্লোবাল সিস্টেম ফর মোবাইল কমিউনিকেশন। সিডিএমএ কি? কোড ডিভিশন মাল্টিপল এক্সেস, কোথায় ব্যবহার করা হয়? বললাম, ডব্লিউ সিডিএমএ ত্রিজি টেকনোলজি তে ব্যবহৃত হয়। এরপর বললেন জিএসএমএর ফ্রিকুয়েন্সী ব্যান্ড বলো, আমি জিএসএম ৯০০ এর আপ্লোড ফ্রিকোয়েন্সী ব্যান্ড ৮৯০ বলতেই সদস্য প্রকৌশল স্যার বললেন কি সব বলে!! পারেনা কিছুই (কর্কসভাবে)।
আমি আরো ভটকে গেলাম! নার্ভাসনেস আরেকটু বাড়লো। এর পর চেয়ারম্যান স্যার আর কেউ কিছু জিজ্ঞেস করবে কিনা জিগ্যেস করলেন।
১০) আরেকজন সদস্য: প্রশ্ন করলেন, পৃথিবীর সপ্তাচার্য কি কি? আমি বললাম চীনের গ্রেট ওয়াল, আগ্রার তাজমহল, কুতুব মিনার আর মনে আসছিলনা তখন প্রসঙ্গ অন্য দিকে মোড় নেয়, আমাকে আসতে বলেন, আমি সালাম দিয়ে, সার্টিফিকেট এর ফাইল নিয়ে প্রস্থান করলাম।
ভাইভা শেষ করে বের হয়ে হয়ে চিন্তা করতে থাকলাম- চট্টগ্রাম বন্দর নিয়ে মানুষের মুখে যে রটনা আছে তাই সত্যি যা আজ বাস্তবে দেখলাম। হয়ত অন্য দুজন ক্যান্ডিডেট এর মধ্যে তাদের প্রার্থী রয়ে গেছে সেজন্য আমার সাথে এমন তুচ্ছ-তাচ্ছিল্য করা হয়েছে। ভাইভা বোর্ডের কমবেশি সবার এটিচুড ছিল কিভাবে আমাকে হেয় করা যায়।
বর্তমান চেয়ারম্যান স্যার ২০১৭ তে যে ভাইভা দিয়েছি সেই বোর্ডের ও সদস্য ছিলেন অথচ দুই বোর্ডের পরিবেশ ১৮০ ডিগ্রী উল্টো।
সবার শেষে ভাইভা ছিল আজিজের। আমি তার জন্য অপেক্ষা করছিলাম। ভাইভা শেষে আজিজ বেরিয়ে এসে যা বলেছে বুঝলাম, আমাদের প্রতি বোর্ডের খুব ক্ষোভ কারণ সবাই প্রাইভেট ভার্সিটির। তাদের অনেক মন্তব্য ছিল রীতিমতো আপত্তিকর যেমন প্রাইভেট ভার্সিটিতে কি পড়ায়! প্রাইভেট ভার্সিটির পোলাপান কে ফার্মের মুরগী বানায়, এগুলো কোত্থেকে এসেছে, হেন-তেন ইত্যাদি।
সন্ধায় রেজাল্ট দেখে বুঝলাম আমাদের তিনজনের মধ্যে কেউই তাদের প্রার্থী ছিলাম না। তাই তিনজনকেই ফেল দেখানো হয়েছে। আর আমাদের তিনজনের দুর্ভাগ্য সম্ভবত তিন কারণে-
১) আমরা তিনজনের কেউই তাদের আত্নীয় ছিলাম না।
২) আমরা এমন কোন জায়গা থেকে ফোন দেওয়াই নাই বা লবিং করাই নাই যে তারা ফেলতে না পারে।
৩) সর্বশেষ হতে পারে, বোর্ড/বোর্ডের নীতিনির্ধারক মহোদয়গণের প্রাইভেট ভার্সিটির প্রতি চূড়ান্ত মাত্রার ডিসক্রিমিনেশন ।
লেখক: চাকরিপ্রত্যাশী এবং সাবেক শিক্ষার্থী ইউনিভার্সিটি অব সাইন্স এন্ড টেকনোলজি, চট্টগ্রাম