১৬ আগস্ট ২০২৫, ১৫:৫১

আজকের এই দিনে সৌদি আরব যেভাবে বাংলাদেশকে স্বীকৃতি দিয়েছিল

রাজু নূরুল  © টিডিসি সম্পাদিত

স্বাধীন বাংলাদেশে বয়স তখন মাত্র ২ বছর। তখনও বিশ্বের কিছু দেশ স্বীকৃতি দেয়নি বাংলাদেশকে। এর মধ্যে উল্লেখযোগ্য সৌদি আরব। ১৯৭৩ সালের শেষের দিকে উত্তরপশ্চিম আফ্রিকার দেশ আলজেরিয়ায় এক সম্মেলনে তৎকালীন সৌদি বাদশাহ ফয়সাল বিন আবদুল আজিজের সঙ্গে সাক্ষাৎ হয়েছিল স্বাধীন বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রী বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের।

দুই দেশের মধ্যে নাজুক সম্পর্ক বিরাজমান থাকা সত্ত্বেও পররাষ্ট্রমন্ত্রী ড. কামাল হোসেন আর কুষ্টিয়ার আওয়ামী লীগ নেতা ও বঙ্গবন্ধুর সফরসঙ্গী ব্যারিস্টার আমিরুল ইসলামের অক্লান্ত প্রচেষ্টায় সেদিন আলজেরিয়ায় মুজিব ও সৌদি বাদশাহ ফয়সালের মধ্যে বৈঠকের আয়োজন সম্ভব হয়।

বঙ্গবন্ধুর সফরসঙ্গী ও তৎকালীন বাংলাদেশ বেতারের মহাপরিচালক বিশিষ্ট সাংবাদিক এম আর আখতার মুকুল রচিত ‘মুজিবের রক্তে লাল’ বইটিতে সে বৈঠকের বর্ণনা রয়েছে।
লেখকের বর্ণনা থেকে পাওয়া কথোপকথন:

বাদশাহ ফয়সাল : এক্সেলেন্সি, আমি শুনেছি যে, আসলে বাংলাদেশ আমাদের কাছ থেকে কিছু সাহায্যের প্রত্যাশী। কিন্তু কথা হচ্ছে, আপনারা কোন ধরনের সাহায্য চান? দয়া করে বলুন আপনারা কী চান? অবশ্য এসব সাহায্য দেওয়ার জন্য আমাদের কিছু পূর্বশর্ত রয়েছে।

মুজিব : এক্সেলেন্সি, বেয়াদবি নেবেন না। আমি হচ্ছি বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রী। কিন্তু আমার তো মনে হয় না মিসকিনের মতো বাংলাদেশ আপনাদের কাছে কোনো সাহায্য চেয়েছে?

বাদশাহ ফয়সাল : তাহলে আপনারা কিংডম অব সৌদি অ্যারাবিয়ার কাছ থেকে কী চাচ্ছেন?

মুজিব : বাংলাদেশের পরহেজগার মুসলমানরা পবিত্র কাবা শরিফে নামাজ আদায়ের অধিকার চাচ্ছে। এক্সেলেন্সি, আপনিই বলুন সেখানে তো কোনো শর্ত থাকতে পারে না? আপনি সুমহান এবং প্রতিটি বাঙালি মুসলমান আপনার প্রতি শ্রদ্ধাশীল। আপনি হচ্ছেন পবিত্র কাবা শরিফের হেফাজতকারী। এখানে দুনিয়ার সমস্ত মুসলমানের নামাজ আদায়ের হক রয়েছে। সেখানে আবার শর্ত কেন? এক্সেলেন্সি, আমরা আপনাদের কাছ থেকে ভ্রাতৃসুলভ সমান ব্যবহার প্রত্যাশা করছি।

বাদশাহ ফয়সাল : এসব তো আর রাজনৈতিক কথাবার্তা হলো না। এক্সেলেন্সি, বলুন আপনারা কিংডম অব সৌদি অ্যারাবিয়ার কাছ থেকে কী চাচ্ছেন?

মুজিব : এক্সেলেন্সি, আপনি জানেন এই দুনিয়ায় ইন্দোনেশিয়ার পর বাংলাদেশ হচ্ছে দ্বিতীয় বৃহত্তম মুসলিম জনসংখ্যার দেশ। তাই আমি জানতে চাচ্ছি, কেন সৌদি আরব আজ পর্যন্ত স্বাধীন ও সার্বভৌম বাংলাদেশের স্বীকৃতি দিচ্ছে না?

বাদশাহ ফয়সাল : আমি পরম করুণাময় আল্লাহতায়ালা ছাড়া আর কারও কাছে জবাবদিহি করি না। তবুও আপনি একজন মুসলমান, তাই বলছি; সৌদির স্বীকৃতি পেতে হলে বাংলাদেশের নাম পরিবর্তন করে ইসলামিক রিপাবলিক অব বাংলাদেশ রাখতে হবে।

মুজিব : এই শর্তটা কিন্তু বাংলাদেশের জন্য প্রযোজ্য হতে পারে না। বাংলাদেশের সংখ্যাগরিষ্ঠ জনসংখ্যা মুসলমান হলেও এ দেশের প্রায় এক কোটির মতো অমুসলিম জনসংখ্যা রয়েছে। সবাই একই সঙ্গে একাত্তরের মুক্তিযুদ্ধে হয় শরিক হয়েছে, না হয় দুর্ভোগ পোহায়েছে। তা ছাড়া এক্সেলেন্সি সবচেয়ে বড় কথা হচ্ছে যে, পরম করুণাময় আল্লাহতায়ালা তো শুধু আল-মুসলেমিন নন, তিনি হচ্ছেন রাব্বুল আলামিন। তিনি শুধু মুসলমানদের আল্লাহ নন, তিনি হচ্ছেন সবকিছুর অধিকর্তা। তিনি হচ্ছেন সবকিছুর একমাত্র স্রষ্টা। এক্সেলেন্সি, বেয়াদবি মাফ করবেন। আপনাদের দেশটার নামও তো ইসলামিক রিপাবলিক অব সৌদি অ্যারাবিয়া নয়। এই মহান দেশের নাম আরব জাহানের অন্যতম শ্রেষ্ঠ মনীষী ও রাজনীতিবিদ মরহুম বাদশাহ ইবনে সউদের সম্মানে ‘কিংডম অব সৌদি অ্যারাবিয়া’। কই আমরা তো কেউই এ নামে আপত্তি করিনি?

বাদশাহ ফয়সাল : এক্সেলেন্সি, এছাড়া আমার অন্য একটা শর্ত রয়েছে এবং তা হচ্ছে অবিলম্বে সমস্ত পাকিস্তানি যুদ্ধবন্দিকে ছেড়ে দিতে হবে।

মুজিব : এক্সেলেন্সি, এটা তো বাংলাদেশ ও পাকিস্তানের মধ্যে দ্বিপাক্ষিক ব্যাপার। দুটো দেশের মধ্যে এ ধরনের আরও অমীমাংসিত প্রশ্ন রয়েছে। যেমন ধরুন, বাংলাদেশ থেকে কয়েক লাখ পাকিস্তানি নাগরিককে দেশে ফিরিয়ে নেওয়া এবং বাংলাদেশের প্রাপ্য অর্থ পরিশোধ করা; এমন বেশকিছু অমীমাংসিত বিষয় রয়েছে। এসবের মীমাংসা কিছুটা সময়সাপেক্ষ ব্যাপার। তাই শুধু বিনা শর্তে ৯১ হাজার পাকিস্তানি যুদ্ধবন্দিকে ছেড়ে দেওয়ার প্রশ্নটি পৃথকভাবে বিবেচনা করা বাঞ্ছনীয় হবে না। আর এজন্য সৌদি আরবই বা এত উদগ্রীব কেন?

বাদশাহ ফয়সাল : এক্সেলেন্সি, শুধু এটুকু জেনে রাখুন সৌদি আরব আর পাকিস্তান একই কথা। পাকিস্তান আমাদের সবচেয়ে অকৃত্রিম বন্ধু। তাহলে এক্সেলেন্সি, আর তো কথা থাকতে পারে না? তবে আমাদের দুটো শর্তের বিষয় চিন্তা করে দেখবেন। একটা হচ্ছে ইসলামী প্রজাতন্ত্রের ঘোষণা। আর একটা, বিনাশর্তে যুদ্ধবন্দিদের মুক্তি। আশা করি বাংলাদেশের জন্য সাহায্যের কোনো কমতি হবে না।

মুজিব : এক্সেলেন্সি একটা বিষয় একটু বুঝিয়ে বললে খুশি হতাম।

বাদশাহ ফয়সাল : এক্সেলেন্সি, বলুন কী বিষয়?

মুজিব : প্রায় দুই বছর পর্যন্ত সৌদি আরব স্বাধীন বাংলাদেশকে স্বীকৃতি না দেওয়ায় সেখানকার পরহেজগার মুসলমানরা পবিত্র হজ আদায় করতে পারছে না, সে কথা ভেবে দেখেছেন কি এক্সেলেন্সি? এভাবে বাধার সৃষ্টি করা কি জায়েজ হচ্ছে? পবিত্র কাবা শরিফে তো দুনিয়ার সমস্ত দেশের মুসলমানদের নামাজ আদায়ের হক রয়েছে। তাহলে কেন এই বাধার সৃষ্টি? কেননা, আজ হাজার হাজার বাঙালি পরহেজগার মুসলমানকে ভারতের পাসপোর্টে পবিত্র হজ পালন করতে হচ্ছে?

সেই প্রশ্নের উত্তর আর পাননি বঙ্গবন্ধু। হঠাৎ করেই আলোচনার পরিসমাপ্তি ঘটে যায়। ইতিহাসের এক অদ্ভুত কাকতালীয় ব্যাপার—যেদিন সৌদি আরব বাংলাদেশকে স্বীকৃতি দিল, সেদিনই (১৬ আগস্ট ১৯৭৫) এদেশে বঙ্গবন্ধুর জানাজা পড়ানো হচ্ছিল।

একাত্তরে আমরা স্বাধীনতা অর্জন করলেও সৌদি আরবের স্বীকৃতির জন্য অপেক্ষা করতে হয়েছে বঙ্গবন্ধুর মৃত্যু পর্যন্ত। বঙ্গবন্ধু হত্যার ঠিক পরদিনই, ১৯৭৫ সালের ১৬ আগস্ট, সৌদি আরব বাংলাদেশকে আনুষ্ঠানিকভাবে স্বীকৃতি দিয়েছিল।

রাজু নূরুল: লেখক, অনুবাদক, গবেষক; যোগাযোগ: raju_norul@yahoo.com