কল্পনাকে জাগ্রত করেই অর্জিত হয় সাফল্য

শিক্ষাহীন মানুষের নিজস্ব জ্ঞান স্ব-পরিবেশে সীমাবদ্ধ থাকে। ‘শিক্ষা’ তার নিজ পরিবেশসহ বিভিন্ন সমাজ কিংবা সভ্যতা’র সম্পর্ক গড়ে তোলেই যেন সচেতন করে। মনীষীর জীবনকে পর্যালোচনায়, অতীতের আলোকে বর্তমানের স্বরূপ উদঘাটন, দেশ-কালের নানা বৈচিত্র্যময় পরিবেশের ‘আদর্শ, নীতি, বিশ্বাস এবং সংস্কার’ এর বিভিন্নতার উপলব্ধি, সহানুভূতির ‘উদারতা ও প্রশস্ততা’ কিংবা বিচারের দীপ্তিতে কল্পনার ঔজ্জ্বল্য সম্পাদন করাই শিক্ষার অবদান। জ্ঞানার্জনের মধ্য দিয়েই যেন এই মানুষ যে শক্তি অর্জন করে, সেই শক্তি অর্জনই যেন শিক্ষার উদ্দেশ্য। সে উদ্দেশ্য থেকেই তো আসে সুস্থ ‘কল্পনা বা স্বপ্ন পুরনের ইচ্ছা’।

জ্ঞান না থাকলে বুদ্ধি আসে না আর বুদ্ধি ছাড়া মুক্তি বা সফলতা আসতে পারে না। জ্ঞান চর্চার মাধ্যমেই সফল হওয়ার লক্ষ্যে মানুষ ‘কল্পনা’ করেই নানা পরিকল্পনা করে। সুতরাং প্রত্যেক মানুষ ‘ছোট হোক কিংবা বড়ই হোক’ কোন না কোন স্বপ্ন নিয়েই থাকে, আর কল্পনা থেকেই যেন স্বপ্নের জন্ম। সে স্বপ্নগুলোকে অনেকেই বয়স কালে পূরণ করার চেষ্টা করে, আবার ছোট বেলার অনেক স্বপ্ন পূরণের উচ্চ আকাঙ্ক্ষা অকালে ঝরে পড়ে। এই স্বপ্ন পূরণের আকাঙ্ক্ষা ছোট থেকে হোক বা বড় হয়ে হোক স্বপ্ন পূরণের ‘সূত্রপাত’ কিন্তু, ছোটতেই জাগ্রত হয়। তাদের নানান কিছু চিন্তা করার মাধ্যমে তা চলে আসে। আর তারা কেউ কেউ খুব বেশি পড়াশোনাও করে এবং নিজের মস্তিষ্কটি ব্যবহার করে, সেটি খুব কম চিন্তাভাবনার আবেগপূর্ণ অভ্যাসে পরিণত হয়। এইটি আলবার্ট আইনস্টাইনের উক্তি। তিনি আরও বলেছেন আমাদের মন অথবা ব্রেইন থেকেই কল্পনা আসে।

মস্তিষ্ক হলো দেহের চালক। এই দেহের সমস্ত শারীর বৃত্তীয় কর্মকাণ্ড এটি দ্বারা চালিত হয়। এটির বিভিন্ন অংশের কর্মকাণ্ডে দেহের শ্রবণ, শ্বসন, চিন্তা-চেতনা, বিবেক, সৃজনশীল কাজ বা কল্পনাসহ পেশি চালনা ইত্যাদি কাজ নিয়ন্ত্রণ করে।

সুতরাং এই মন ও ব্রেইন এ কারণে উল্লেখ করলাম, কারণ হলো উভয়েই একটা অপরটার সঙ্গে সম্পৃক্ত, সব বড় বড় অর্জনের পেছনেই মন বা ব্রেইনের হাত অনেকাংশেই বেশি। তাই মানুষের মনের কাজ হচ্ছে মানুষকে ‘স্বপ্ন’ দেখাতে সাহস যোগায়। মানুষের যদি মন থেকে তা বিশ্বাস করে তাহলেই স্বপ্নপূরণ করাটা অনেক সহজ কাজ হয়। সব সময়ে ইতিবাচক চিন্তা করতে হবে। বেশি বেশি স্বপ্ন দেখতেই হবে।

একজন কল্পনাবাজ কিংবা স্বপ্নবাজ হতেই হবে। যদি কারও স্বপ্ন থেকেই থাকে, তাকে সর্ব প্রথমে নিজস্ব স্বপ্ন’কে মূল্যায়ন করতে হবে, সম্মান করতেও হবে সেই নিজ স্বপ্ন ধারাটিকে। ‘স্বপ্ন’ ছোট হোক বা বড় হোক সেটা নিয়েই গর্ব করতে হবে। তাই আলবার্ট আইনস্টাইন বলেছিল- ‘যদি তুমি একটি সুখী জীবন চাও, তাহলে এটাকে একটি লক্ষ্যের সাথেই বেধে ফেল, যে কোন মানুষ অথবা বস্তুর সাথে নয়’। আবার ডেল কার্নেগী স্বপ্ন পূরণের উদ্দেশ্যে বলেছিল যে, ‘আত্ম বিশ্বাস ও কঠোর পরিশ্রম ব্যর্থতা নামক রোগকে মারার সবচে বড় ওষুধ। এমনটাই আপনাকে একজন সফলকাম মানুষে পরিণত করবে।’

সফলতা অর্জনের ‘শর্টকাট’ কোনো পদ্ধতি নেই। ‘সাফল্য হল আপনি যা চান তা হাসিল করা। সুখ হল আপনি যা চান তা পাওয়া।’ এ স্বপ্ন নিয়ে বলতে গেলে বলা যায়, এ পি জে আবদুল কালাম মতে ‘স্বপ্ন সেইটা নয়, যেইটা মানুষরা ঘুমিয়ে ঘুমিয়ে দেখে আর স্বপ্ন সেটাই যেটা পূরণের প্রত্যাশা মানুষকে ঘুমাতে দেয় না। বেশির ভাগ মানুষের ‘স্বপ্ন’ হয় আকাশ কুসুম কল্পনার মত। এমন স্বপ্নটাই দেখা উচিৎ হবে যে স্বপ্নটা পূরণের সাধ্য সকলের রয়েছে। জয় করার মতোই ‘স্বপ্ন কিংবা কল্পনা’ বিশ্বাস যোগ্য হতে হবে।

একটু পরিষ্কার ধারণায় আসা যাক- ‘কল্পনা থেকেই স্বপ্ন’, আর কল্পনাটিরও অসীম ক্ষমতা রয়েছে। এটি জ্ঞানের চাইতেও বেশি ‘পরিধি সম্পন্ন’। কারণ, যিনি সব দিক থেকে অনেক বেশি জ্ঞান অর্জন করেছেন, যার অভিজ্ঞতা অনেক বেশি, সর্ব ক্ষেত্রে তিনিই যেন অনেক কিছু নিজ কল্পনায় বিশ্লেষণ করতে পারেন। সেই কল্পনাকেই বাস্তবতায় রূপ দেওয়ার চেষ্টা তখন তাঁর কাছে প্রবল হয়ে ওঠে। সুতরাং মানুষ এ ভাবেই ভবিষ্যতের প্রতিচ্ছবি দেখতে পায়। অনেক ক্ষেত্রেই যে কোনো ব্যাপার নিয়ে কল্পনা করা যায় তখন সেই ব্যাপার সম্পর্কেই আরও বেশি জানবার আগ্রহটাও যেন বাড়ে। এজন্যে বিজ্ঞানী অ্যালবার্ট আইনস্টাইন বলেছিল,- ‘কল্পনা জ্ঞানের চেয়ে আরো গুরুত্বপূর্ণ’।

তিনি আরও বলেছেন,- যদি আমাকে একটি সমস্যা সমাধানের জন্য এক ঘন্টা বেধে দেয়া হয়, আমি ৫৫ মিনিট সমস্যাটা নিয়ে চিন্তা করি এবং আর বাকি ৫ মিনিট সমাধানটা নিয়ে চিন্তা করি। সুতরাং সমাধান হতে যে বাধ্য তা অ্যালবার্ট আইনস্টাইনের এধরনের কল্পনা থেকেই বুঝা যায়। আপনার 'দর্শন ও স্বপ্ন'কে নিজের সন্তানের মত লালন করুন কারণ এ গুলোই আপনার চূড়ান্ত অর্জনের প্রতিচিত্র হয়ে উঠবে। এই কথা- ‘নেপোলিয়ন হিল’ জানিয়ে আলোকিত মানুষ হওয়ায় যথেষ্ট দৃষ্টান্ত দিয়ে ছিল।

সত্যিকারের জ্ঞানী ব্যক্তি হতে চাইলে- কল্পনা এবং স্বপ্নের সঙ্গে প্রথমেই চরিত্রবান হতে হবে। বিনয়, ভদ্রতা বা কৃতজ্ঞতাবোধ থাকা দরকার। পরিশ্রম, উৎসুক মন কিংবা সহজাত বুদ্ধিমত্তা ছাড়া জ্ঞানের জগতে খুব সহজেই যেকেউ প্রবেশ করতে পারে নি। ‘ধৈর্য, সহ্য এবং সরলতা’ না থাকলে জ্ঞানকে ধারণ করাও যায় না। তাই কৌশল, দক্ষতা, সময়জ্ঞান কিংবা সাহস না থাকলে জ্ঞানকে সুযোগমতো ব্যবহার করা যায় না।

মানুষের হৃদয়ের বিশালতা থাকা প্রয়োজন, ক্ষমা করার ক্ষমতা এবং অপ্রিয় বিষয় গুলোকে মানুষকেই যেন ভুলে থাকার যোগ্যতা বা দক্ষতা দরকার। এ যোগ্যতা না থাকলে আপনার জ্ঞান বিস্মৃতির কবলে পড়ে দিন দিন হ্রাস পেতেও থাকবে। সংযম, দিব্যদৃষ্টি, অনুভূতিপ্রবণ বা সহানুভূতিশীল না হলে জ্ঞান কেউ গ্রহণ করার জন্য এগিয়ে আসবে না।

সুতরাং, মোহনীয় ব্যক্তিত্ব, কথা-কর্মের নান্দনিক মাধুর্য কিংবা পর্যাপ্ত রুচিশীলতা না থাকলে ‘জ্ঞান’ লোকারণ্যেও বিজ্ঞময় সুগন্ধি ছড়াবে না। পরিশ্রম করতেই হবে, কঠিন পরিশ্রম। আপনার কাজকে সহজ করতেই পরিশ্রম করতে হবে। কারণ, একবার পরিশ্রম করে যদি আপনি কাজকেই সঠিক ভাবে বুঝতে সক্ষম হন। তবে পরবর্তী সময়ের কোন কঠিন কাজটি পরিশ্রম না করেই তার সঠিক ফায়দা লাভ করা যায়'।

তাই বলতে চাই- কল্পনা শক্তি জাগ্রত করেই পরিশ্রম করা প্রয়োজন। দার্শনিক মার্শাল বলেছিল, ‘মানুষের কল্পনাশক্তি না থাকলে পৃথিবীর এতো উন্নতি সাধিত হত না!’ জেনে রাখা দরকার যে, কোন ভিশন কিংবা মিশনকে সামনে রেখে সুদূর প্রসারী চিন্তা করা হলো কল্পনা আর নিজের অজান্তে বা ঘুমে যা চলে আসে তা স্বপ্ন! কেবলই স্বপ্ন! তাই জীবনের প্রতি ক্ষেত্রে কি পেলাম ‘কল্পনা শক্তি’ দ্বারা সেটাই বড় প্রশ্ন নয়, বরং কি করেছি সেটাই বড় প্রশ্ন। জীবনের বহুমুখী কর্মটি এক কথায় পরিকল্পিত কল্পনাতে করতে হবে। এমন পরিকল্পনার ধাপ গুলোকে প্রয়োগ করে, পরিকল্পনা বাস্তবায়নে বিভিন্ন প্রকারের পদক্ষেপ দরকার। তাই শারীরিক ও মানুষিক পরিশ্রমের মাধ্যমে ধাপ গুলো সম্পূর্ণ করতে হবে। যদি সেইসকল কাজ সঠিক মত করা যায়, তাহলেই এই জীবনে সফলতার দ্বারপ্রান্তে পৌঁছা যাবে।

জানা দরকার শরীর রক্ষার পাশাপাশি জ্ঞানের সঙ্গে সামঞ্জস্য রেখে মন-মানসিকতা, চিন্তা-চেতনা এবং কল্পনার সংমিশ্রণ ঘটিয়েই জ্ঞান অর্জন অতীব জরুরি। কেউ যদি মন’কে পরিচালনার ধরন না জেনে জ্ঞানার্জন করে চায় তবে তার সুস্থ-শরীর ও শক্তি-সামর্থ্য অবশ্যই বিপদাপন্ন কিংবা বিপত্তি বয়ে আনতে পাবে। জানা কথা হলো, মানুষের ‘মন এবং মস্তিষ্ক’ প্রায়ই দ্বিমুখী চিন্তা করে। আর বিপরীতমুখী সিদ্ধান্তও নিয়ে ফেলে আবার পরস্পর বিরোধী স্বপ্ন দেখে। মানুষের ‘পাঁচটি ইন্দ্রিয়’ আবার পাঁচ রকমের-রূপ, রস, গন্ধ, শব্দ, স্পর্শ দ্বারাই যেন পাঁচ ভাবে মন ও মস্তিষ্কের পরস্পরবিরোধী চিন্তা-চেতনা ও স্বপ্নকে প্রভাবিত করে। প্রতিটি ঘটনা-দুর্ঘটনা, প্রেক্ষাপট বা পরিস্থিতিকে জটিল থেকেই জটিলতর করে তোলে। এমন এ জটিল সমীকরণের সঙ্গে যুক্ত হয় পরিবেশ-পরিস্থিতি, সমাজ-সংসার। তাছাড়া বিশেষজ্ঞ কিংবা জ্ঞানী-গুণীদের নানা মুখী বুদ্ধি-পরামর্শ ও তাপ-চাপ ইত্যাদি। ফলে এত সব বাধাবিপত্তি পেরিয়ে মানুষের মন ও মস্তিষ্ক কেবল তখনই সঠিক কল্পনাটি করতে পারে। আর যখনই সেখানে অতি প্রয়োজনীয় জ্ঞান উপস্থিত থাকে।

সত্য স্বপ্ন বা কল্পনা হলো মানুষের সম্প্রসারিত সূক্ষ্ম সহজাত অনুভূতির ফল। প্রতিটি মানুষের ভেতরেই এ সূক্ষ্ম সহজাত অনুভূতির উপস্থিতি কিছুটা হলেও থাকে। আসলে ভবিষ্যৎ দেখার চেষ্টাই যেন কল্পনার কাজ। যারা এ পৃথিবীর বুকে মাথা উঁচু করে দাঁড়িয়ে রয়েছে, তাদের বেশির ভাগ ব্যক্তিই ভবিষ্যৎ কি হবে তা কল্পনার দ্বারা অনুমান করতে পেরে ছিল। এটাই মানুষের অনেক বড় একটা গুন। আসলেই ভবিষ্যৎ সবার জন্য অনিশ্চিত, যেটা ভাবব সেটা নাও ঘটতে পারে। কিন্তু অনুমান কতটুকু সঠিক হচ্ছে তাকে তো বুঝতে কল্পনার প্রয়োজন।

সুতরাং- সবারই ভবিষ্যৎ নিয়ে নিজস্ব কল্পনা কিংবা স্বপ্নের রূপটাই বা কেমন তাকে অনুভব করা ও দেখার চেষ্টা করা উচিৎ। তাই কল্পনা শক্তিতে জাগ্রত করেই নির্দিষ্ট লক্ষ্যে এগিয়ে যাওয়ার চেষ্টা করতে হবে। ‘ব্রায়ান ট্র্যাসি’ বলেছিল সাফল্যের মূল চাবিকাঠি হল আমরা যা ভয় পাই সে গুলো অপেক্ষা- আমরা যা আশা করি বা পেতে চাই সেগুলোর উপর আমাদের সচেতন মনকে প্রতিষ্ঠিত করতে হবে। সুতরাং- কল্পনা বা স্বপ্নকে জাগ্রত করে জীবনের ‘লক্ষ্য বা সফলতা’ অর্জন করা প্রয়োজন। পরিশেষে ‘আলবার্ট আইনস্টাইন’ এর একটি উক্তির আলোকেই বলতে চাই, ‘কল্পনা বিদ্যার চেয়েও শক্তি শালী কেননা বিদ্যারসীমা আছে কিন্তু কল্পনার সীমা নেই’।

লেখক: নজরুল ইসলাম তোফা
প্রভাষক, রাজশাহী আর্ট কলেজ।


সর্বশেষ সংবাদ