১৫ এপ্রিল ২০১৯, ১১:১০

আরবদের নিকট ‘হালকা’ হয়ে যাচ্ছে প্যালেস্টাইন ইস্যু!

  © সংগৃহীত

২০১৮ সালের দিকে গণমাধ্যমে কিছু ছবি ও ভিডিও প্রকাশ পায় যাতে দেখা যায় আল আকসা মসজিদ কম্পাউন্ডের ‘দামাস্কাস গেইটে’ পর্যবেক্ষণ টাওয়ার বসিয়েছে ইসরায়েলি প্রতিরক্ষা বাহিনী। খোদ ইসরায়েলি পত্রিকা লেখে, মুসলমানদের সবচেয়ে পুরনো এই কেবলার প্রবেশপথে সম্প্রতি যে ইসরায়েলি সামরিক উপস্থিতি বেড়েছে এটা তারই একটি নমুনা বা নিদর্শন।

মার্কিন প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্প যে জেরুজালেমকে ইসরায়েলের চিরস্থায়ী রাজধানী হিসেবে স্বীকৃতি দিয়েছেন, আর আল আকসা মসজিদের প্রবেশ পথে ইসরায়েল যে এই পর্যবেক্ষণ টাওয়ার বসালো, এ দুটি পদক্ষেপের সময়ের পার্থক্য খুব বেশি না। ইসরায়েল নতুন করে হাজার হাজার ইহুদি বাড়ি নির্মাণের পরিকল্পনা ঘোষণা করেছে, আর যুক্তরাষ্ট্র শিগগিরই জেরুজালেমে দূতাবাস স্থানান্তরের কথা জানিয়েছে।

আল আকসা মসজিদের প্রবেশপথে ইসরায়েলের পর্যবেক্ষণ টাওয়ার নির্মাণের পর প্রতিক্রিয়ার বিষয়টি আমলে নিলে দেখা যায়, প্যালেস্টাইন ও জেরুজালেম ইস্যুটি আরব তথা মুসলিম বিশ্বের সর্বোচ্চ অগ্রাধিকার তালিকা থেকে ছিটকে পড়েছে। যুক্তরাষ্ট্র ও ইসরায়েলের সাম্প্রতীক পদক্ষেপের বিপরীতে নিন্দা আর ছোটখাট কিছু বিক্ষোভ- প্রতিবাদের মধ্যেই সীমাবদ্ধ ছিল মুসলিম প্রতিক্রিয়া।

হতাশার খবর আরো আছে। যুক্তরাষ্ট্রের পক্ষ থেকে জেরুজালেমকে ইসরায়েলের স্থায়ী রাজধানী ঘোষণার পর পাল্টা প্রতিক্রিয়া হিসেবে তুরস্কের ইস্তাম্বুলে ৫৭ সদস্যের ওআইসির যে শীর্ষ সম্মেলন অনুষ্ঠিত হয় তাতে মাত্র ১৬ টি দেশের রাষ্ট্র ও সরকার প্রধানের অংশগ্রহণই এটা পরিষ্কার করে দেয় যে, প্যালেস্টাইন এখন আর আরব ও মুসলিম বিশ্বের অগ্রাধিকার বিষয় নয়।

ওআইসির ঐ সম্মেলনে আরব ও মুসলিম নেতাদের উপস্থিতির চিত্র সত্যিই বেদনাদায়ক। অথচ আরব বিশ্ব আর মুসলমানরা জেরুজালেম ইস্যুকে তাদের জন্য অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ ইস্যু বলে মনে করত।

ট্রাম্পের ঘোষণার পর প্যালেস্টাইন কর্তৃপক্ষ তিন দিনের প্রতিবাদ কর্মসূচীর ঘোষণা দিয়েছিল। কিন্তু এরাই যুক্তরাষ্ট্র ও ইসরায়েল বিরোধী আন্দোলনকারী ও বন্দিদের তথ্য ইসরায়েলি গোয়েন্দা সংস্থার কাছে সরবরাহ করছিল! প্যালেস্টাইনের প্রেসিডেন্ট মাহমুদ আব্বাস অনেক ইসরায়েলি কর্মকর্তার সাথে ফোনে কথা বলেছেন, দেখা করেছেন। তিনি তাদের আশ্বন্ত করেছেন যে তিনি কখনোই নতুন কোন ফিলিস্তিনি ইন্তিফাদা গ্রহণ/সহ্য করবেন না।

প্যালেস্টাইন আর জেরুজালেম ইস্যু যে এখন মুসলিম ও আরব দুনিয়ায় অগুরুত্বপূর্ণ ইস্যুতে পরিণত হয়েছে তার আরেকটি লক্ষণ হচ্ছে কতিপয় আরব রাষ্ট্রের ইসরায়েল কানেকশন। এই ইসরায়েল কানেকশন বেড়েছে ট্রাম্প যুক্তরাষ্ট্রের ক্ষমতায় আসার পর। ট্রাম্পের ঘোষণার মাত্র দুই সপ্তাহ আগে মিশরের প্রেসিডেন্ট জেনারেল আবদেল ফাত্তাহ আল সিসির প্রশংসা করেন ইসরায়েলি প্রধানমন্ত্রী বেনিয়ামিন নেতানিয়াহু। তিনি বলেন, ‘মিশর ইসরায়েলের উত্তম বন্ধু’। ২০১৬ সালের জুলাইয়ে নেতানিয়াহু ও মিসরের পররাষ্ট্রমন্ত্রী শামেহ শুকরি জেরুজালেমে বসে ইউরো ফাইনাল - ২০১৬ উপভোগ করেন।

কায়রোতে নিযুক্ত সাবেক ইসরায়েলি রাষ্ট্রদূত ডেভিড গভরিন ২০১৭ সালের মার্চে নেতানিয়াহু ও সিসির মধ্যকার গোপন সম্পর্কের খবর ফাঁস করে দেন। নেতানিয়াহু এবং তার বিরোধী নেতা ইসহাক হারজগ কায়রোতে সিসির সাথে গোপনে মিলিত হয়েছিলেন। সিসি দুজনের মধ্যে মধ্যস্থতা করছিলেন। এই দুই নেতার সমঝোতায় ইসরায়েলে একটি কোয়ালিশন সরকার গঠনে আরো কিছু আরব দেশ মধ্যস্থতা করে বলে আলজাজিরায় ফাঁস হয়। আরব মুসলিম রাষ্ট্রগুলো স্থিতিশীল ইসরায়েল রাষ্ট্র সমর্থন করছে, আর চাপ দিয়ে যাচ্ছে ইসরায়েলে একটি শক্তিশালী সরকার গঠনের।

সৌদি যুবরাজ মোহাম্মদ বিন সালমান একটি প্রতিনিধি দল নিয়ে ২০১৭ সালে গোপনে ইসরায়েল সফরে যান। ইসরায়েলের যোগাযোগ মন্ত্রী আইয়ূব কারা বলেছিলেন, ‘অনেকগুলো আরব দেশের সঙ্গে ইসরায়েলের ভাল সম্পর্ক রয়েছে। এগুলোর মধ্যে রয়েছে মিশর, জর্ডান ও সৌদি আরব।’ এছাড়া উত্তর আফ্রিকার কিছু দেশ, আরো কিছু উপসাগরীয় দেশ ও ইরাকের একটি অংশের সাথেও ঘনিষ্ঠতার কথা জানান ইসরায়েলি মন্ত্রী।

আরব দেশগুলোতে ইসরায়েল এরইমধ্যে মিলিটারি অপারেশনও চালিয়েছে। নিউইয়র্ক টাইমস এক প্রতিবেদনে জানায়, ইসরায়েলি ড্রোন ও হেলিকপ্টার মিশরে শতাধিকবার হামলা চালিয়েছে। তাতে প্রেসিডেন্ট সিসির সম্মতি ছিল। পত্রিকাটি লিখে, তিন তিনটি যুদ্ধে একে অপরের বিপক্ষে থাকা মিশর এবং ইসরায়েল এখন গোপন মিত্র জোট এবং তারা একটি কমন শত্রুর বিরুদ্ধে লড়াই করছে।

ফিলিস্তিনি সংগঠন হামাসের সাথে দায়েসের (আইএস) সম্পর্ক আছে, যুক্তরাষ্ট্র আর ইসরায়েল এমন অভিযোগ তুলে আরব ও মুসলিমদের হামাস থেকে মুখ ফেরানোর চেষ্টা করছে। গাজায় ইসরায়েল সর্বশেষ যে বড় ধরনের হামলা চালায়, তখন নেতানিয়াহু বলেছিলেন, ‘হামাসই আইএস, আইএসই হামাস।’

প্যালেস্টাইন ও জেরুজালেম ইস্যুতে মুসলিম ও আরবদের প্রতিক্রিয়া নিয়ে মাথা না ঘামিয়ে ইসরায়েল যা খুশি তাই করছে। কারণ দেশটি আরব শাসকদের মনের কথা জানে।

লেখক: সোহেল রানা, গণমাধ্যমকর্মী।