উৎসবের ডামাডোলে নুসরাত-আবরার-তনুরা যেন হারিয়ে না যায়!
বাংলা পঞ্জিকা থেকে প্রকৃতির নিয়মে আরো একটি বছর কালের গর্ভে হারিয়ে গেল। তবে আমাদের সামনে রেখে গেল সঙ্কটাকীর্ণ যত গ্লানি। বছর শেষে নুসরাত, আবরারদের করুণ মৃত্যু আমাদের প্রত্যক্ষ করতে হয়েছে। তবুও সূর্য ওঠে। অনন্ত আশাবাদই আমাদের সামনে ভরসা। রাত যত গভীরই হোক সকাল আসন্ন।
আজ ভোরে আকাশে যে নতুন সূর্য উঠেছে, সেটি আরও একটি নতুন বছরের বৈশাখ মাসের প্রথম দিন। এই নতুন সূর্যের আলোর ফোয়ারা শত দুঃখ, গ্লানি, দুর্দশা, হানাহানি, খুন, রাহাজানি ভুলিয়ে সবার জীবনে সুখের বার্তা বয়ে নিয়ে আসবে প্রত্যাশা সেটাই। সকাল থেকেই উৎসবের আবহ সে প্রত্যাশাকেই স্মরণ করিয়ে দিচ্ছে।
কয়েকদিন ধরেই তীব্র গরমের মধ্যে থেমে থেমে বৃষ্টিও হচ্ছে। তবে এ বৃষ্টি প্রায় প্রতিদিনই সংবাদপত্র আর টেলিভিশনের পর্দায় ফুটে উঠা খুন, গুম, রাহাজানি, নিপীড়ন এবং দুঃখ-দুর্দশার ছবি ধুয়েমুছে পরিষ্কার করে দিতে পারছে না। এরমধ্যেই আবহমান বাংলার অন্যতম উৎসব বাংলা নববর্ষ বরণের প্রস্তুতিও থেমে থাকেনি। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের চারুকলা, রমনার বটমূলসহ সবখানে চলছে উৎসব আনন্দ। মনের অজান্তেই অনেকে গেয়ে উঠছেন, ‘এসো হে বৈশাখ, এসো এসো।’
অন্যান্যবারের মতো এবারও পান্তা-ইলিশ নিয়ে তুমুল সমালোচনা চলছে। অনেকের অভিযোগ পহেলা বৈশাখের পান্তা-ইলিশ বাংলা সংস্কৃতিতে অনুপ্রবেশ করেছে। এটা স্বল্প আয়ের মানুষের সঙ্গে মশকারাও মনে করেন তারা। তবে ইলিশ কেনার প্রতিযোগিতা কিন্তু থেকে নেই। গণমাধ্যমে হাজার টাকার ইশলিশের খবর।
আজ বিত্তবানেরা পান্তা-ইলিশ খাওয়া নিয়ে ব্যস্ত থাকলেও বিত্তহীনেরা পণ্যের পসরা সাজিয়ে আয়ের চেষ্টা করছেন। রাজধানী ঢাকাসহ যেখানে জনসমাগম বেশি, সেখানে তাদের উপস্থিতিও বেশি। এখান থেকে কিছু আয় করে যদি সংসারের চাকা একটু সচল হয়।
এবারের পয়লা বৈশাখের আগে থেকেই আলোচনার কেন্দ্রবিন্দুতে রয়েছে ফেনীর সোনাগাজীর মাদ্রাসা ছাত্রী ও চলমান আলিম পরীক্ষায় অংশগ্রহণকারী নুসরাত জাহান রাফিকে আগুনে পুড়িয়ে নৃসংশভাবে হত্যার ঘটনা। তারও আগে বনানীর অগ্নিকাণ্ড, চকবাজারে আগুন লেগে অসংখ্য মানুষের প্রাণহানি কিংবা বিশ্ববিদ্যালয় ছাত্র আবরারকে বাস চাপা দিয়ে হত্যার ঘটনা নাড়িয়ে দিয়ে গেছে সবাইকে।
দুই বছর আগে বাংলা নববর্ষ পালনের প্রাক্কালে কুমিল্লা ভিক্টোরিয়া কলেজের ছাত্রী সোহাগী জাহান তনু হত্যার ঘটনাও সবাইকে নাড়িয়ে দিয়ে গিয়েছিল। অত্যন্ত দুঃখজনকভাবে তনু হত্যার বিচার আমরা এখনো পাইনি। তারও কয়েক বছর আগে গেলে সাংবাদিক দম্পত্তি সাগর-রুনি হত্যার বিচার হয়নি।
খোঁজ নিলে এমন অসংখ্য ঘটনা হয়ত সামনে আসবে। বিজ্ঞজনেরা বলেন, বিচারহীনতার সংস্কৃতির কারণে তনু, সাগর-রুনির স্বজনরা ন্যায়বিচার পাননি। আমরা অত-শত বুঝতে চাইনা- আমার ভাই-স্বজনরা এভাবে হত্যার শিকার কেন হবে, সে প্রশ্নের জবাব চাই? জানি মিলবে না, তারপরও হাল ছাড়তে রাজি নই।
পহেলা বৈশাখ উপলক্ষে এ জাতি আজ উৎসবে মাতোয়ারা। তবে নুসরাত-আবরার-তনু-সাগর-রুনিদের কথাও ভুললে চলবে না। প্রতিনিয়ত এমন এমন অসংখ্য ঘটনা আমাদের সামনে ঘটে যাচ্ছে। হয়ত- আমাদের প্রতিবাদের জায়গাগুলো দুর্বল হয়ে গেছে বলেই আজ অপরাধীরা পার পেয়ে যাচ্ছে বা প্রকাশ্যে ঘুরে বেড়াচ্ছে।
আমরা উৎসব করছি ঠিক আছে। তবে এটাও মনে রাখতে হবে- নুসরাত, আবরাররাও আমাদের এই উৎসবে শামিল হতে পারত। তবে তাদের জন্য সেই নিরাপদ পরিবেশ আমরা তৈরি করতে পারিনি। ফলে আমাদের মধ্য থেকে হারিয়ে গেছে তারা।
আমাদের মনে রাখা দরকার, অপরাধীর সংখ্যা কম। তবে ভালো মানুষগুলোর নিষ্ক্রিয়তাই কিন্তু অপরাধীদের দৌরাত্ম ক্রমেই বাড়াচ্ছে। এজন্য প্রতিবাদের জায়গাটা জোরালো করুন। তাহলে হয়ত- আর কোন নুসরাত, তনু, আবরারকে হারিয়ে যেতে হবে না।
লেখক: এম টি রহমান,গণমাধ্যমকর্মী