মানুষ পশুকেও হার মানাচ্ছে
আগুনে পুড়লে কেমন লাগে? জ্বলে না ব্যথা করে। জ্বলা কি খুব বেশি। চোখ দিয়ে কি পানি বের হয়। আহ চা খেতে গিয়ে জিহ্বা মোটামুটি সব বাঙালিরই পুড়েছে। আগুনে সরাসরি না পুড়লেও রান্না করার সময়, ভাতের মাড় ঝরানোর সময় কিংবা গোসলের গরম পানি ঢালার সময় হাতে মোটামুটি সবাই আগুনের উত্তাপ পেয়ে থাকি। এমন বাঙালি হয়তো পাওয়া যাবে না যিনি ছোটখাটো আগুনের জ্বালা টের পাননি।
বছর দেড়েক আগে আমার পায়ে গরম চা পড়ে পা পুড়ে গিয়েছিলো। সে কী ব্যাথা। আমি প্রায় কেঁদেই ফেলেছি। সারারাত সে কী যন্ত্রণা বলে বোঝানো যাবে না। যখন আমরা এসব ছোটখাটো আগুনেই বিচলিত হয়ে যাই, তখন কারো শরীরের যদি ৮০ ভাগ পুড়ে যায় তাহলে তার যন্ত্রণা কেমন? না ভাবতে পারছি না। ভয়ে গা শিউরে উঠছে। আমার সেই দিনের কান্নার মুখটাই বার বার ভেসে উঠছে।
গত ৬ এপ্রিল ফেনীর সোনাগাজীর একটি মাদ্রাসায় আলিম পরীক্ষা দিতে গেলে কৌশলে মেয়েটিকে ছাদে ডেকে নিয়ে গিয়ে তার গায়ে আগুন ধরিয়ে দেওয়া হয়। তার অপরাধ, তিনি অধ্যক্ষের অশালীন আচরণের বিচার চেয়েছিলেন। গত ২৭ মার্চ অধ্যক্ষের বিরুদ্ধে শিশু ও নারী নির্যাতন দমন আইনে মামলা করেছিলেন মেয়েটির মা। অধ্যক্ষকে গ্রেপ্তারও করে পুলিশ। এরপরই শুরু হয় হুমকি–ধমকি। মামলা প্রত্যাহারে রাজি না হওয়ায় ছাত্রীটির গায়ে আগুন ধরিয়ে দেওয়া হয়।
আগুনে পোড়া শিক্ষার্থী প্রথমদিনেই অ্যাম্বুলেন্সের ভেতর তার বক্তব্য দিয়েছিলেন। কাতর কণ্ঠে বলেছিলেন, তাকে মুখঢাকা কয়েকজন ছাদে ডেকে নেন, তাদের নাম তিনি মনে করতে পারছে না। তাকে প্রিন্সিপ্যালের বিরুদ্ধে মামলা তুলে নিতে বলেছিলেন তারা। আগুনে পোড়া শিক্ষার্থীর প্রথমদিনই অ্যাম্বুলেন্সের ভেতর তার বক্তব্য দিয়েছিলেন। কাতর কণ্ঠে বলেছিলেন, তাকে মুখঢাকা কয়েকজন ছাদে ডেকে নেন, তাদের নাম তিনি মনে করতে পারছে না। তাকে প্রিন্সিপ্যালের বিরুদ্ধে মামলা তুলে নিতে বলেছিলেন তারা।
তীব্র ব্যথা সারা শরীর জুড়ে। কথা বলতে বলতে গলাটা ধরে আসছিলো বারবার। তারপরও বলছিলেন, “আমি এই অন্যায়ের প্রতিবাদ করেই যাবো। আমার জীবন থাকতে যে অন্যায় প্রিন্সিপাল আমার সঙ্গে করেছেন, জীবন থাকতে সে অন্যায়ের সঙ্গে আপোষ করবো না।”
৮০ ভাগ পুড়ে যাওয়া শরীর নিয়েই সাহসের সঙ্গে মেয়েটি ডায়িং ডিক্লেয়ারেশন বলেছেন- “আমি সারা বাংলাদেশের কাছে বলবো, সারা পৃথিবীর কাছে বলবো এই অন্যায়ের প্রতিবাদ করার জন্য। আমি এই অন্যায়ের প্রতিবাদ করবো...।”
এতো সাহস, মনের এই শক্তি- এই বয়সে কোথায় পায়, কে দেয়, কিভাবে পায়?
মেয়েটি যখন ব্যথায় কাতরাচ্ছেন আর বিচারের দাবী জানাচ্ছেন, তখন আমরা ব্যস্ত টি-শার্টের একটি লেখা- ‘গা ঘেঁষে দাঁড়াবেন না’ নিয়ে সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে ট্রল করায়। আমরা কি মনুষ্যত্ববোধ হারিয়ে ফেলেছি? আমাদের অনুভূতিগুলা কি সব ভোঁতা হয়ে গেছে? আমরা কি অমানুষ হয়ে যাচ্ছি? হ্যা, আজ আমরা মানুষ হয়ে ও পশুকে হার মানাচ্ছি।
আমাদের দুটি চোখ দিয়েছে শুধু দেখার জন্য নয়, শুধু কাঁদার জন্য নয় বরং মাঝে মাঝে জ্বলে ওঠার জন্যও। মেয়েটির আগুনপোড়া শরীর আমাদের নিভে যাওয়া চোখগুলোকে ও ক্ষয়ে যাওয়া মনুষ্যত্ববোধকে জ্বালিয়ে তুলুক। যদি আমরা ব্যর্থ হই, আমরা পিছিয়ে পড়বো, ইতিহাস আমাদের ক্ষমা করবে না।
আমরা চিনতে না পারলেও নুসরাত কিন্তু এ সমাজ চিনে গিয়েছিলেন। তিনি মারা যাওয়ার পর থেকেই গৌরিপ্রসন্ন মজুমদারের প্রায় ৮০ বছর আগের লেখা একটি গানের কথা বারবার মনে আসছে, কিন্তু গুনগুনিয়ে গাইতেও পারছি না।
‘তোমার ভুবনে মাগো এত পাপ’
একটি কথা মনে রাখা দরকার, যে সাহস, যে মনোবল মেয়েটি দেখিয়েছেন তা তুলনাহীন। ‘কারণ বেড়ালের মত হাজার বছর বাঁচার চেয়ে সিংহের মত গর্জন দিয়ে এক মিনিট বেঁচে থাকা শ্রেয়’। আগুনে পুড়ে মেয়েটি ‘আগুন মেয়ে’ হয়ে উঠেছেন। এই ‘আগুন মেয়ে’ সকল নির্যাতিতা মেয়েদের মনে ঠিকই আগুন জ্বালিয়ে দেবে।
লেখক: গণমাধ্যমকর্মী