১১ এপ্রিল ২০১৯, ২০:০৫

নুসরাত বেঁচে আছে, দেশ ক্লিনিক্যালি ডেড

কামরুন নাহার (ডানে) এবং নুসরাত

অমুক চাচার তমুক ভাইয়ের তমুক ফুফার তমুক ছেলে সেদিন বললো ‘আপা দোয়া কইরেন’; আমি বললাম, ‘কেনো নির্বাচন করছেন’? সে বললো, ‘বিশ্ববিদ্যালয়ে লেকচারার হিসেবে জয়েন করেছি’। আমি অবাক হইনি; এই দেশে এখন শিক্ষক হওয়া সবচেয়ে সহজ। ও রীতিমতো গুণ্ডা, এডিশনালি বদমাশ। তার শিক্ষক হওয়া মানে ছাত্রীদের জীবন শেষ! ট্রেইলার শেষ। আসেন পুরো সিনেমা দেখি।

ছোট মুখে বড় কথা বলে ফেলছি; গুরুজনরা মাফ করবেন। ‘দুর্নীতিতে চ্যাম্পিয়ন’ এই দেশে গত ১৫-২০ বছরে ধানের পাশাপাশি আর একটি জিনিসের বাম্পার ফলন হয়েছে আর তা হোলো শিক্ষাখাতে দুর্নীতির বাম্পারফলন। তথ্য উপাত্ত দিতে পারবো না। খালি চোখে যা দেখি, যা প্রতিদিন এক্সপিরিয়েন্স করি নানান মাধ্যমে তার থেকে এটা আমার একটা সরল ভাবনা, সরল মতামত। আমি শিক্ষকতায় আছি মোটে ১০ বছর। কিন্তু এই অল্প সময়ে অনেক কিছু দেখে ফেলেছি। প্রাথমিক বিদ্যালয় থেকে শুরু করে বিশ্ববিদ্যালয় পর্যন্ত আমি পরিচিত অন্তত ১০জন করে অযোগ্য মানুষ দেখাতে পারবো যাদের শিক্ষক হিসেবে নিয়োগ হয়েছে সব ধরণের নিয়ম ভেঙ্গে, মোটা টাকার বিনিময়ে। না, তাদের নাম পরিচয় দেবার কোনো ইচ্ছা আমার নাই। করে কেটে খাচ্ছে খাক না! কতোজনই তো খাচ্ছে।

এখন আপনারা বলবেন অন্যখাতে দুর্নীতি আরও বেশি হচ্ছে সেটা আপনার চোখে পড়েনা! শোনেন, অন্য যে কোনো খাতের দুর্নীতি খানিকটা মেনে নেয়া গেলেও (মেনে নেয়া কোনোভাবেই কাম্য নয়, উচিতও নয়) মৌলিক অধিকারের এই চার নম্বর অধিকারটিতে দুর্নীতি মেনে নেয়া কঠিন শুধু নয় রীতিমতো অন্যায়। এখানেই তো নীতি নৈতিকতার শিক্ষা দেয়া হয় , জীবনের ভীত গড়ে তোলার শিক্ষা দেয়া হয়, ভালো মানুষ হবার শিক্ষা দেয়া হয়। তো শিক্ষকের নিয়োগই যদি হয় অমুক নেতার তমুক ভাইয়ের শ্যালক কোটায় বেশ মোটা অঙ্কের টাকার বিনিময়ে তাহলে তো শিক্ষার আসল উদ্দেশ্যই ব্যর্থ।

আচ্ছা এবার আসল প্রসঙ্গে আসি। নুসরাত মেয়েটি মারা গেছে। এখন প্লিজ জানতে চাইবেন না যেনো নুসরাত কে! লুচ্চা এ-নবাব সিরাজউদ্দৌলা নাকি জেলে! কী সর্বনাশ নবাবকে জেলে ঢুকালো কে! কার এতো সাহস! বাকী লুচ্চা এ-নবাবরা কোথায় আপনারা! নবাবের পক্ষে আইনজীবী দাঁড় করান! সেতো আপনাদেরই ভাই-ব্রাদার, ইয়ার-দোস্ত; একই পালের ভেড়া আপনারা! তার ভাগ্যাকাশে আজ দুর্যোগের ঘনঘটা! আপনারা না থাকলে কে তাকে আশা দেবে! কে দেবে ভরসা!

শিক্ষার অবকাঠামোগত দুর্নীতি, শিক্ষক নিয়োগ সংক্রান্ত দুর্নীতি আমাদের চোখে পড়ে। রোজ এসব দেখতে দেখতে আমাদের মুখস্থ হয়ে গেছে সকালে উঠিয়া আমি মনে মনে বলি কবিতার মতো। এখন শিক্ষক দ্বারা ছাত্রী যৌন নিপীড়ন, ছাত্রী ধর্ষিত এসব সংবাদও আমাদের মুখস্থ হয়ে যাচ্ছে; অভ্যাসে পরিণত হয়ে যাচ্ছে; রোজ না শুনলে যেনো পেটের ভাত হজম হতে চায় না। স্কুল ভবনের ২০ লাখ টাকা মেরে খাওয়ার মতো ঘটনা রোজ সামনে আসে কিন্তু স্নেহ দেবার ছলে আলতো করে ছাত্রীর বুকে হাত দিয়ে দেবার, ব্রার হুকের উপর হাত রেখে আদর করার, অতি স্নেহ দেবার নামে ছাত্রীকে শিক্ষকের একেবারে তার পুরুষাঙ্গ বরাবর বসিয়ে সুখ নেবার, শিক্ষকের রুমে গিয়ে তার সামনে ওড়না ফেলে বসে না থাকলে পরীক্ষায় ফেল করিয়ে দেবার হুমকির খবর কেউ রাখি না, সেগুলো পত্রিকায় আসেনা, নিউজ চ্যানেল লাইভ করতে পারেনা। যদি রাখতাম, যদি সামনে আসতো তাহলে নুসরাতদের মামলা করার শাস্তি হিসেবে আগুনে পুড়ে মরতে হতোনা।

নুসরাতের মরাই উচিত! ওর কতো বড় সাহস ও লুচ্চা এ- নবাব সিরাজউদ্দৌলার বিরুদ্ধে মামলা করে! নুসরাত জানে না সিরাজউদ্দৌলাদের সিণ্ডিকেট আছে – তাদের কিচ্ছু হবে না। সিন্ডিকেট একাট্টা হয়ে নারায়ে তাকবির বলে ঝাঁপিয়ে পড়ে জেল থেকে বের করে আনবে তাদের দোসরকে আর সে বের হয়ে নতুন কোনো নুসরাতের সন্ধান করবে। সিন্ডিকেট করে সহকর্মীকে কনসেন্টে রেখে এই দেশের অনেক শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে ছাত্রীকে বিছানায় যেতে বাধ্য করা হয়। আমরা অনেকেই জানি এসব কিন্তু জিজ্ঞেস করলে বলবো ওমা তাই জানিনা তো! স্বীকার করলে তো আমাদেরও জাত যাবে! আমাদের আবার স্বজাত্যবোধ অনেক বেশি যাকে বলে টনটনা।

আমি গত পরশু রাতেই বলছিলাম নুসরাত বড়জোর আর একদিন সারভাইভ করবে। আমার ধারণা সবাই আমার মতো ভেবেছিলেন। আমি বলার পর আর ২১ ঘণ্টা বেঁচেছিল নুসরাত। বাবার বয়সী শিক্ষকের যৌন রোষে পড়ে অকালে যেখানে ছাত্রীকে প্রাণ দিতে হয় সেখানে মা-বাবারা কোন ভরসায় তার মেয়েকে স্কুলে পড়তে পাঠাবে! বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি পরীক্ষা দিতে আসা ছাত্রীটি যখন শিক্ষকের যৌন লালসার হাত থেকে রেহাই পায়না তখন বুঝে নিতে হয় দেশের মেরুদণ্ড বাঁকা হয়ে গেছে। নুসরাতের বেলায় ব্যাপারটি আরও ভয়াবহ! সে ছিলো আপাদমস্তক হিজাবে ঢাকা মাদ্রাসার ছাত্রী আর যার জন্য তাকে প্রাণ দিতে হলো সে অধ্যক্ষই শুধু নয় মাথায় টুপি পরা রীতিমতো মওলানা। কী দারুণ! তালিয়া!

দিনের পর দিন, বছরের পর বছর নুসরাতরা চুপ থেকে যখন আর পারেনা তখনই মুখ খোলে আর এই মুখ খোলার শাস্তি হোলো আগুনে পুড়ে মৃত্যু, যাতে বের হয়ে আসে দেশ ও জাতির কঙ্কালসার চেহারা! বহু ঘটনায় এই দেশে অপরাধীর শাস্তি হয়না, অপরাধের বিচার হয়না। বিচার না হতে হতে দেশ এখন গুণ্ডা, বদমাশ, ধর্ষক, নিপীড়ক, দুর্নীতিবাজদের অভয়ারণ্যে পরিণত হয়েছে। আর এই স্কোরকার্ডে শিক্ষকদের গোল নেহাত কম নয়। নুসরাত হত্যার একটা দৃষ্টান্তমূলক শাস্তি হোক আমি চাইনা কারণ আমি জানি এমন কিছু হবে না, এই দেশে এমন কিছু হয়না; শিক্ষকের কামের আগুনে পুড়ে যে দেশে ছাত্রীকে মরতে হয় সে দেশ ক্লিনিক্যালি ডেড কিন্তু প্রতিবাদ করে নুসরাত প্রমাণ করে গেছে মরে গিয়েও কিভাবে বেঁচে থাকতে হয়!


লেখক: সহকারী অধ্যাপক, বাংলাদেশ প্রেস ইনস্টিটিউট