কোটা সংস্কার আন্দোলনের ভয়াল সেই ৮ এপ্রিল!
সম্প্রতি বাংলাদেশে ঘটে যাওয়া আলোচিত ঘটনাগুলোর মধ্যে অন্যতম ছিল কোটা সংস্কার আন্দোলন। যদিও একটি পক্ষ পরিকল্পিতভাবে এই আন্দোলনকে কোটাবিরোধী আন্দোলন বানানোর হীন চেষ্টা করে আসছিল শুরু থেকেই কিন্তু আদৌও। এটি কোটা বিরোধী আন্দোলন ছিল না, এটি ছিল সরকারি চাকুরিতে কোটা বৈষম্য দূরীকরণ করে একটি মিনিমাম লেভেলে রাখা।
অবশেষে সরকার শিক্ষার্থীদের আন্দোলনের মুখে প্রথম ও দ্বিতীয় শ্রেণীতে কোটা বাতিল করে। যদিও কোটা বাতিলের যে প্রজ্ঞাপন এটি এখনো পরিষ্কার নয়, ধোঁয়াশা রয়ে গিয়েছে। তারপরও বলবো, শিক্ষার্থীদের এই যৌক্তিক আন্দোলন শতভাগ সফল তারা ব্যর্থ নন, এখানে ব্যর্থ সরকার এবং রাষ্ট্রযন্ত্র। কারণ সরকার সঠিক সময়ে সাধারণ শিক্ষার্থীদের পালস বুঝতে পারেনি। উল্টো শিক্ষার্থীদেরকে নানাভাবে হয়রানি করেছে, জেলে পাঠিয়েছে এমনকি রিমান্ডেও নিয়েছিল- যা একটি সভ্য দেশে বিরল ঘটনা।
আজকে ৮ এপ্রিল, ২০১৯! গতবছরের আজকের এই দিনে আমাদের ‘বাংলাদেশ সাধারণ ছাত্র অধিকার সংরক্ষণ পরিষদ’র পূর্ব ঘোষিত কর্মসূচি ছিল গণ পদযাত্রা। কেন্দ্রীয়ভাবে আমরা পালন করবো ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে এবং সমগ্র দেশের অন্যান্য কমিটিগুলো তাদের সুবিধাজনক সময়ে সুবিধাজনক জায়গায় পালন করার নির্দেশ দেওয়া হলো কেন্দ্রের পক্ষ থেকে।
আমরা সবাই জড়ো হলাম ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের কেন্দ্রীয় গ্রন্থাগারের সামনে। কিছুক্ষণের মধ্যেই মুহুর্মুহু স্লোগানে বিভিন্ন হল এবং ঢাকার বিভিন্ন জায়গা থেকে শিক্ষার্থীরা মিছিল নিয়ে আসতে থাকে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে। দুপুর হতেনা হতেই ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় এলাকা জনসমুদ্রে পরিণত হয়। আমরা আমাদের গণ পদযাত্রা ঠিক দুপুর ২ টায়। যাত্রা শুরু হলো লাইব্রেরির সামনে থেকে ভিসি চত্বর হয়ে নীলক্ষেত মোড় দিয়ে কাঁটাবন হয়ে শাহবাগ পর্যন্ত।
এই মিছিলটি ছিল ইতিহাস সৃষ্টিকারী একটি গণ মিছিল। এতো মানুষ রাস্তায় নেমে আসবে কেউ আমরা কখনো কল্পনাও করিনি আগে। ৫২’র ভাষা আন্দোলন এবং ৭১’র মহান মুক্তিযুদ্ধের পর এতবড় আন্দোলন বাংলার ইতিহাসে আর ঘটেনি।। আমাদের পূর্ব পরিকল্পনা অনুযায়ী শাহবাগে ঘোষণা দিলাম যে, আমরা এখানেই অবস্থান করবো। সবাই শাহবাগে অবস্থান নিলাম, মূহুর্তেই শাহবাগ চারদিকে বন্ধ হয়ে গেল।
শাহবাগ চত্বর লোকে লোকারণ্য হয়ে গেল। চলতে থাকল বৈষম্য বিরোধী গান কবিতা আবৃত্তিসহ ভাষণ। সময় যতই গড়াতে থাকল মানুষের সমাগম ততই বাড়তে থাকল। সময় সন্ধ্যা ঠিক ৭টা ৪৫ মিনিট। এখন অবধি সরকারের দায়িত্বশীল কেউ শাহবাগে আসলেন না আমাদের সাথে কথা বললেন না। হঠাৎ করেই শুরু হলো আমাদের উপর বৃষ্টির মতো গুলিবর্ষণ (রাবার বুলেট) টিয়ারশেল এবং গরম পানির স্প্রে নিক্ষেপ। মূহুর্তেই শাহবাগসহ ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় এলাকা রণক্ষেত্রে পরিণত হলো।
শিক্ষার্থীরা সরকারের পেটুয়া বাহিনীর বর্বর হামলা থেকে বাঁচতে বিশ্ববিদ্যালয় এলাকার দিকে ছুঁটতে থাকল। আমার মনে হচ্ছিল, এই বুঝি দম বন্ধ হয়ে যাবে। তারপরও থেমে থাকিনি। সবাইকে নিয়ে আমরা দাঁড়িয়ে গেলাম পুলিশের সামনে। আর বলতে লাগলাম চালাও তোমাদের যতো গুলি আছে তবুও কোটা সংস্কার না করে আমরা ঘরে ফিরবো না।
বিশ্ববিদ্যালয়ের কেন্দ্রীয় গ্রন্থাগার, কেন্দ্রীয় মসজিদ কোনটাই বাদ যায়নি সেদিন পুলিশের আক্রমণ থেকে। অসংখ্য সহযোদ্ধা আহত হয়, তাদেরকে দ্রুত মেডিকেলে পাঠানোর ব্যবস্থা করি আমরা। বড় দুঃখের বিষয়, এমন একটি ভয়াল কালরাত্রে বিশ্ববিদ্যালয়ের মেরুদণ্ডহীন প্রশাসন বের হননি।
আমরা জানি, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় একটি শতভাগ স্বাধীন এবং স্বায়ত্তশাসিত প্রতিষ্ঠান। এখানে বিনা অনুমতিতে পুলিশ তো দূরে থাক একটা আইসক্রিমের দোকানও আসতে পারেনা, সেখানে বিশ্ববিদ্যালয় এলাকায় পুলিশ বাহিনী ছাত্রদের উপর বর্বর যে আক্রমণ চালিয়েছিল তা ইতিহাসে বিরল কালো দৃষ্টান্ত হয়ে থাকবে।
আমি মনে করি, এই হামলায় বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রত্যক্ষ মদদ ছিল, তা নাহলে কেন পুলিশ বিনা উষ্কানিতে শিক্ষার্থীদের উপর হামলা চালাবে। তাও আবার বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসনের অনুমতি ছাড়াই।
সেই রাতের কথা আজ মনে করলে গাঁ শিহরে ওঠে। সেই রাতে ছাত্রলীগ এবং পুলিশ বাহিনী মিলে চতুর্মুখী হামলা চালায় আমাদের উপর। রক্তে রঞ্জিত হয়ে যায় পুরো ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় এলাকা। পুরো এলাকায় বিদ্যুৎ বন্ধ করে দিয়ে হামলা চালানো হয়। মনে হয় ৭১ এর সেই ভয়াল কালরাত্রি পার করতেছি আমরা।
রাত ১ টার পরে বিশ্ববিদ্যালয়ের ভাইদের উপর বর্বর হামলা দেখে হলগুলোতে ঘুমোতে পারেননি আমার বোনেরা। তারা রাতের আধারে হলের গেট ভেঙে বের হয়ে আসে টিএসসিতে। সবার আগে কুয়েত মৈত্রী এবং ফজিলাতুন্নেছা মুজিব হলের আপুরা হলের গেট ভেঙ্গে বের হয়। তারপরে রোকেয়া হল, তারপরে শামসুন্নাহার হল সবশেষে কবি সুফিয়া কামাল হলের আপুরা বের হয়ে আসে।
সেই ভয়াল রাতে আমার বোনদেরকেও ছাড় দেওয়া হয়নি। তাদের উপরও চালানো হয় ইতিহাসের বর্বর আক্রমণ। অনেক ছাত্রী ভয়াবহভাবে আহত হয়। একপর্যায়ে আমরা টিএসসির দিকে দৌড় দেই, একটা অংশ টিএসসির ভিতরে চলে যায়, আর একটা অংশ কার্জন হলের দিকে।
৯ এপ্রিল ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় এলাকায় নতুন এক সূর্য উদিত হয়। সকালে সব হল থেকে শিক্ষার্থীরা সন্ত্রাস বিরোধী রাজু ভাস্কর্যে আসতে থাকে। বেলা বাড়ার সাথে সাথে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় এলাকা আবার জনসমুদ্রে পরিণত হয়ে যায়.......(চলমান)।
লেখক: ফারুক হাসান, যুগ্ম-আহবায়ক,বাংলাদেশ সাধারণ ছাত্র অধিকার সংরক্ষণ পরিষদ