স্বেচ্ছাসেবী সংগঠন ‘ইনফিনিটি’র পথচলা এক অনন্য উচ্চতায়
যান্ত্রিক এই শহরে হাজারো ব্যস্ত মানুষ প্রতিনিয়ত ছুটছে নিজেদের চাহিদা মেটানোর লক্ষ্যে, তাই ব্যস্ততার গন্ডিটা মানুষকে সীমাবদ্ধ করে রাখে নিজেদের মধ্যে। নিজেদের নিয়ে মত্ত আজকের পৃথিবী। তবে ইট-পাথরের প্রাচীরের বাইরে আসলে দেখা মিলে এক অন্য জগতের এক ভিন্ন পর্যায়ের মানুষদের, যারা নিজেদের জন্য নয় বরং নিঃস্বার্থভাবে সহযোগিতা করে যাচ্ছেন সমাজের অবহেলিত, সুবিধাবঞ্চিত, অসহায় মানুষদের। নিঃস্বার্থভাবে নিজেদের অর্থ, শ্রম ও ত্যাগ দিয়ে সাহয্য করে যাচ্ছেন বারংবার, এরকম অনেক চিত্র আমাদের দেখা মিলে।
ঠিক তেমনি চট্রগ্রামের হাটহাজারীতে একদল তরুন ছাত্রদের হাতে গড়া ‘ইনফিনিটি’ নামক মানবিক সংগঠনটি গত কয়েক বছর ধরে মানবতার সেবায় নিজেদের উৎসর্গ করে যাচ্ছে প্রতিনিয়ত। ‘ইনফিনিটি’- যার অর্থ অসীম। বিখ্যাত মার্কিন বধির-অন্ধ লেখিকা ও রাজনৈতিক আন্দোলনকারী ‘হেলেন কেলার’র একটি বিখ্যাত উক্তি আছে, ‘পৃথিবীর সুন্দরতম জিনিসগুলো হাতে ছোঁয়া যায় না, চোখে দেখা যায় না, সেগুলো একমাত্র হৃদয় দিয়ে অনুভব করতে হয় - ভালোবাসা, দয়া, আন্তরিকতা।’
সময়টা ২০১৫ সালের মাঝামাঝি সময় রমজানের শেষের দিকে, সবদিকে তখন ঈদের আমেজ চলছিলো। প্রত্যেকের ঘর নূতন কাপড়ের সুবাসে সুবাসিত হয়ে উঠছিলো। হাসির শব্দে প্রতিটি ঘর হয়ে উঠছিলো আলোকোজ্জ্বল। কিন্তু এই উজ্জ্বলতা থেকে বঞ্চিত ছিলো তিনজন শিশু। বয়স আর কত হবে! ৫-৮-১০ এর মতো। যারা চোখে পড়ে কয়েকজন কিশোরের, দশম শ্রেণিতে পড়া কয়েকজন কিশোর।
হয়তো ‘হেলেন কেলারের’ সেই ভালোবাসা, দয়া, আন্তরিকতার চোখ ছিলো তাদের। তারা বঞ্চনা জিনিসটা কখনও হয়তো চোখে দেখেনি, ছোঁয়ার সুযোগও পায়নি। কিন্তু তারা অনুভব করেছে, আর সেই অনুভবতা তিনজন শিশুর চোখে দিয়েছে ভাষা, ঠোঁটে দিয়েছে হাসি, আর মনে দিয়েছে এক বিশালতা!
তারপর দশম শ্রেণীর সেই কিশোরেরা এক নতুন স্বপ্ন দেখে, বঞ্চিত মানুষের ঠোঁটে হাসি ফোটানোর স্বপ্ন! সেই স্বপ্ন পরবর্তী বছর তাদেরকে আবার এক করে। তারা একটি ইভেন্ট খোলে, নাম দেয় ‘পথশিশুদের সাথে ইদ আনন্দ-২’। সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমগুলোতেও চলতে থাকে সংগ্রহ। কিছু প্রতিবন্ধকতা পার হয়ে সুষ্ঠুভাবে সফল হয় ‘পথশিশুদের সাথে ইদ আনন্দ-২’। তাদের স্বপ্ন আরও বড় হয়। দশম শ্রেণীর কিশোরগুলো স্কুলের গণ্ডি পেড়িয়ে তখন ভিন্ন ভিন্ন কলেজে।
সময়টা তখন ২০১৭ সাল! ভালোবাসা, দয়া, আন্তরিকতা সবকিছু এখন তাদের কাছে দায়িত্বের মতো।হাসি ফোটানো যেন এখন কর্তব্যের মতো হয়ে উঠেছে। সেই কর্তব্যের পিছু ছুটতে ছুটতে ‘পথশিশুদের সাথে ইদ আনন্দ-৩’ ও সফলভাবে সমাপ্ত হয়।
তারপর আসে ২০১৮ সাল। কিশোরেরা এখন তরুণ হয়ে ওঠেছে। সুকান্ত ভট্টাচার্যের ১৮ বছর বয়সের তরুণ! যেন সে কর্তব্য কে লালন করছে দেহের রক্তে। ২০১৫ সালে সুবিধাবঞ্চিতের যে সংখ্যাটি ছিলো ‘তিন’; ২০১৬ সালে সুবিধাবঞ্চিতের যে সংখ্যাটি ছিলো ৪৩; ২০১৭ সালে সুবিধাবঞ্চিতের যে সংখ্যাটি ছিলো ৭০; সে সংখ্যাটি ২০১৮ তে এসে দাঁড়ালো ১৯২ জনে।
‘To be a human being is to be in a state of tension between your appetites and your dreams, and the social realities around you and your obligations to your fellow man.’ - John Updike
সফল হলো ‘সুবিধা বঞ্চিত শিশুদের সাথে ইদ আনন্দ-৪’ ইভেন্টিও। তরুণেরা এখন কলেজের গণ্ডি পেরিয়ে বিশ্ববিদ্যালয়ে। তারা নিজেদেরকে প্রশ্ন করে কেন শুধু বছরে একবার? নিজেদেরকে প্রতিশ্রুতি দেয়, প্রতিমাসে কমপক্ষে একবার হলেও তারা সুবিধাবঞ্চিতদের দ্বারে পৌঁছাবে। সিদ্ধান্ত হলো প্রতিজন সদস্যের জন্মদিন উদযাপন করা হবে সুবিধা বঞ্চিত পথশিশুদের সাথে। যে অর্থটা তারা নিজেদের ‘ট্রিট ট্রেন্ড’ হিসেবে ব্যয় করে সেই অর্থটা পৌঁছে যাক কিছু সুবিধাবঞ্চিতের কাছে।
ধারাবাহিকতায় চলতে থাকলো ‘Share Your Birthday Event’। সে ইভেন্ট এর মাধ্যমে তারা পৌছে যায় বিভিন্ন শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে, মানবতার দেয়াল বসিয়ে দেয় গরীব মেধাবী শিক্ষার্থীদের মাঝে। এখানেই থেমে নেই তারা। সাময়িক সমস্যাগ্রস্ত মানুষের পাশে দাঁড়িয়ে সঙ্গ দিচ্ছে তাদের। সহযোগিতার হাত বাড়িয়ে দিচ্ছে বন্যার্তদের দিকে, সহযোগিতার হাত বাড়িয়ে দিচ্ছে অগ্নিদগ্ধ হয়ে ক্ষতিগ্রস্তদের দিকে।সম্প্রতি তারা ব্লাড ক্যাম্পেইন নিয়েও কাজ করে যাচ্ছে বিভিন্ন স্থানে।
সদস্যদের দ্বারা পরিচালিত হচ্ছে প্রত্যন্ত অঞ্চলের একটি প্রাথমিক বিদ্যালয়। ওই বিদ্যালয়েই ২০১৯ সালের ফেব্রুয়ারী মাসের ৩ তারিখে পাঠ্য সহায়ক বই বিতরণ করে ‘ইনফিনিটি বাংলাদেশ’। শুরুটা সুবিধাবঞ্চিতদের নিয়ে হলেও এখন ইনফিনিটি বাংলাদেশ শিক্ষা ও বিভিন্ন সামাজিক কার্যক্রমেও অংশগ্রহণ করে যাচ্ছে।
সম্প্রতি চট্রগ্রাম প্রেসক্লাবে অনুষ্ঠিত ‘দুই বাংলার সাংস্কৃতিক উৎসব ২০১৯’ অনুষ্ঠানে ইনফিনিটি বাংলাদেশকে সংবর্ধিত সংগঠন স্মারক এবং মহান বিজয় দিবস-২০১৯ সম্মাননা স্মারক প্রদান করে আন্তর্জাতিক সংগঠন হিসেবে ভূষিত ‘কথা সাহিত্য সাংস্কৃতিক ও নাট্য সংগঠন’।
তাদের কার্যক্রম সম্পর্কে বিস্তারিত জানতে চাইলে ‘ইনফিটি’র সভাপতি সাকিব আল করিম দ্যা ডেইলি ক্যাম্পাসকে জানান, ‘মানুষ মানুষের জন্য’ তিন শব্দের বাক্যটি বলাটা যতটা সহজ, এর অর্থ বুঝাটা তার ছেয়ে অনেক কঠিন। কখন মানুষ মানুষের জন্য? নিশ্চয় যখন সহযোগিতার প্রয়োজন। সামাজিক জীব হিসবে মানুষ কখনোই অপরের সাহায্য এডিয়ে যেতে পারে না, সে যতই আত্মনির্ভরশীল হোক না কেন। আর আমরা সবাই মিলে সেই সহযোগিতা করে যাচ্ছি। সুবিধাবঞ্চিত, অসহায়, গরীব মেধাবী শিশুদের মুখে সামান্য হাসি ফুটাতে পারাটা আমাদের একমাত্র অর্জন, মানবতার জন্য ইনফিনিটি সবার প্রয়োজনে, সবার আগে।
সাধারণ সম্পাদক সামিউল আলম সাইম জানান, ‘Share Your birthday’ ইভেন্টটির মাধ্যমে আমরা বিভিন্ন শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে বিনামূল্যে শিক্ষা সামগ্রী বিতরণ করে আসছি।’ তিনি জনসাধারণের উদ্দেশ্যে বলেন, আপনার আশেপাশের কোনো শিক্ষার্থী যদি অর্থের অভাবে পড়াশুনায় বাধার সম্মুখীন হয় তাহলে আমাদের কাছে খবরটি পৌছান। ইনফিনিটি সংগঠন অবশ্যয় সুবিধা বঞ্চিতদের পাশে দাড়াবে।
আজকাল এমন মন-মানসিকতার মানুষের দেখা পাওয়া খুব একটা নেই বললেই চলে। বিগত তিনবছর ধরে তাদের ব্যাক্তিগত অর্জন বলতে কিছুই নেই, গরীব, দুস্থ, অসহায়, পথশিশুদের পাশে সফলভাবে দাড়াতে পারাটাই তাদের একমাত্র সাফল্য। ব্যস্ত পৃথীবিতে গল্প শুনার মানুষেরও বড্ড অভাব আজকাল, তাদের স্বপ্ন তারা একদিন এই সমাজকে পরিবর্তন করবে, এমন ব্যাতিক্রম চিত্র আমাদের পত্যেকের মনের কোণায় বাসা বেধে রাখাটা খুবই জরুরি।
সবাই নিজ নিজ অবস্থান থেকে সাহায্যের হাত বাড়িয়ে দিলে বাংলাদেশে শিক্ষার অভাব বোধ করবে না কোনো শিশু, আমাদের দেশের প্রায় অলিগলিতে অগণিত সুবিধাবঞ্চিত, অসহায়, গরীব মানুষ রয়েছেন আসুন ‘ইনফিনিটি’ সংগঠনটির মত আমরাও স্বেচ্ছায় সাহায্য করি মানবিক কল্যানে। সবার ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র প্রায়াসই খুলে দিক মানবতার দোয়ার।