বিসিএস কি মেধার মঞ্চ না ধৈর্যের কারাগার?
বাংলাদেশে তরুণ-তরুণীদের একটি বড় অংশের জীবনের লক্ষ্য হয়ে দাঁড়িয়েছে সরকারি চাকরি, বিশেষ করে বিসিএস। এটি শুধু একটি চাকরি নয়—এটি সামাজিক মর্যাদা, আর্থিক নিরাপত্তা এবং একটি ‘নির্ভরযোগ্য ভবিষ্যতের’ প্রতীক। অথচ এই স্বপ্নের পথে যে যান্ত্রিক ও আমলাতান্ত্রিক প্রক্রিয়া দাঁড়িয়ে আছে, তা অনেক সময় স্বপ্ন ভেঙে দেয়, জীবনের সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ বছরগুলো নিঃসঙ্গ অপেক্ষার মিছিলে ঠেলে দেয়। ৪৪তম বিসিএস পরীক্ষার ফল প্রকাশ নিয়ে যে জটিলতা ও ক্ষোভ তৈরি হয়েছে, তা কেবল একটি পরীক্ষার প্রতিবাদ নয়—এটি রাষ্ট্রীয় অদক্ষতা, অব্যবস্থাপনা এবং মূল্যবোধ সংকটের বিরুদ্ধে এক নীরব বিদ্রোহ।
একটি ফল প্রকাশে যখন দুই থেকে তিন বছর সময় লেগে যায়, তখন প্রশ্ন উঠে—এটা কি কেবল প্রক্রিয়ার ধীরগতি, নাকি পরিকল্পিত উদাসীনতা? বিশ্বের বহু দেশে যেখানে সরকারি চাকরির ফল প্রকাশে সর্বোচ্চ এক মাস সময় নেয়, সেখানে বাংলাদেশে প্রযুক্তির সহজলভ্যতা সত্ত্বেও এমন বিলম্ব কেবল অদক্ষতার প্রমাণই নয়, এটি তরুণদের সঙ্গে রাষ্ট্রের এক নির্মম পরিহাস। স্মার্ট বাংলাদেশ বাস্তবায়নের স্বপ্ন নিয়ে যখন সরকার কথা বলছে, তখন বিসিএস পরীক্ষার ফলাফলে বছরের পর বছর বিলম্ব যেন সেই স্বপ্নকে ব্যঙ্গ করে।ভাবা যায়, একজন তরুণ বিশ্ববিদ্যালয় শেষ করে বিসিএসের প্রস্তুতি নিচ্ছেন। তিনি প্রিলিমিনারি পাস করেছেন, লিখিত পরীক্ষাও দিয়েছেন। এরপর তিনি ফলাফলের জন্য অপেক্ষা করছেন—এক বছর, দুই বছর, এমনকি তিন বছর। এ সময় তার বয়স বাড়ছে, পরিবারের চাপে সংসার, জীবিকার কথা ভাবতে হচ্ছে, মানসিক চাপ বাড়ছে, অথচ ফলাফল এখনো অজানা। এমন বাস্তবতা কেবল একজন ব্যক্তির ক্ষতি নয়, এটি একটি সম্ভাবনাময় প্রজন্মকে নিঃশেষ করে দিচ্ছে—সময়ের অপচয়, মানসিক অবসাদ, এবং সামাজিক হতাশায় ঠেলে দিচ্ছে।
৪৪তম বিসিএস নিয়ে যে অভিযোগগুলো এসেছে, তা বিশেষভাবে উদ্বেগজনক। প্রায় ৮০০ ‘ক্যাডার রিপিট’ প্রার্থীর অভিযোগ, মৌখিক পরীক্ষার নম্বর গোপন রাখা, প্রশ্নপত্র ফাঁস, এবং বিষয়ভিত্তিক কোড বিভ্রাট—সবকিছু মিলে বিসিএস একটি প্রতিযোগিতা থেকে প্রহসনে পরিণত হয়েছে। প্রশ্ন উঠেছে—একই ব্যক্তি বারবার পরীক্ষায় অংশ নিয়ে নতুনদের জায়গা সংকুচিত করছেন, অথচ নিয়ন্ত্রণে কোনো কার্যকর নীতিমালা নেই। এমনকি মৌখিক পরীক্ষার নম্বরও গোপন রাখা হয়, যার মাধ্যমে যোগ্যতা নয়, ‘পছন্দ’ ও 'দলীয় সুপারিশ' অনেক সময় নিয়ামক হয়ে দাঁড়ায়।
এখন সময় এসেছে প্রশ্ন তোলার—পিএসসি কি কেবল একটি নিয়োগকারী প্রতিষ্ঠান, না কি এটি রাষ্ট্রীয় ন্যায়বিচারের প্রতীক? যদি সত্যিই আমরা একটি দক্ষ, সুশাসিত রাষ্ট্র গড়তে চাই, তবে পিএসসিকে সংস্কার করতে হবে প্রযুক্তিনির্ভর, স্বচ্ছ ও সময়ানুগ এক প্রতিষ্ঠানে। উদাহরণ হিসেবে সিঙ্গাপুর বা দক্ষিণ কোরিয়াকে দেখা যেতে পারে—তারা নিয়োগ পরীক্ষায় CBT (Computer-Based Test) এবং AI-ভিত্তিক স্ক্রুটিনি সফটওয়্যার ব্যবহার করে নির্ধারিত সময়ের মধ্যেই ফল প্রকাশ করে। অথচ বাংলাদেশে এখনো খাতা দেখা, কমিটির সভা, এবং প্রশাসনিক চিঠি চালাচালির নামে বছরের পর বছর চলে যাচ্ছে।
বিসিএস পরীক্ষার দীর্ঘসূত্রিতা ও স্বচ্ছতার অভাব তরুণদের মধ্যে ব্যাপক হতাশা তৈরি করছে। এ বাস্তবতায় কিছু সময়োপযোগী ও বাস্তবসম্মত সংস্কার এখন অত্যাবশ্যক। প্রথমত, প্রিলিমিনারি ও লিখিত পরীক্ষায় OMR ও CBT চালু করলে দ্রুত ও নির্ভুল মূল্যায়ন সম্ভব। বাংলাদেশ ব্যাংক, জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয়সহ বিভিন্ন নিয়োগ পরীক্ষায় OMR ব্যবহৃত হচ্ছে। ভারতের NTA (National Testing Agency) মাত্র ১৫–২০ দিনের মধ্যে CBT ভিত্তিক পরীক্ষার ফল প্রকাশ করে—যেখানে লাখ লাখ শিক্ষার্থী অংশ নেয়।
দ্বিতীয়ত, AI-ভিত্তিক স্বয়ংক্রিয় মূল্যায়নের মাধ্যমে প্রবন্ধ ও বিশ্লেষণধর্মী প্রশ্ন দ্রুত, নিরপেক্ষ ও মানবিক পক্ষপাতহীনভাবে মূল্যায়ন করা সম্ভব। আন্তর্জাতিকভাবে TOEFL, GRE এবং IELTS পরীক্ষায় AI স্কোরিং ব্যবহৃত হচ্ছে—যা বাংলাদেশেও বিসিএস পরীক্ষায় চালু করা সম্ভব।
তৃতীয়ত, মৌখিক পরীক্ষার নম্বর গোপন রাখা বিসিএসের সবচেয়ে বিতর্কিত অংশ। ভারতের UPSC মৌখিক পরীক্ষার নম্বর প্রকাশ বাধ্যতামূলক করেছে এবং অডিও রেকর্ড সংরক্ষণে নির্দেশ দেওয়া হয়েছে। বাংলাদেশেও এই রীতি চালু করলে স্বজনপ্রীতি ও পক্ষপাত দূর করা সম্ভব। চতুর্থত, বিসিএসের প্রতিটি ধাপে ফলাফল ঘোষণায় নির্দিষ্ট সময়সীমা নির্ধারণ জরুরি। দক্ষিণ কোরিয়া ও সিঙ্গাপুরে সরকারিভাবে CBT ব্যবস্থায় ৩ থেকে ৪ সপ্তাহেই চূড়ান্ত ফল প্রকাশ করা হয়। পঞ্চমত, ‘ক্যাডার রিপিট’ প্রার্থীদের সীমিত আবেদন নীতি থাকা দরকার। অনেক সময় দেখা যায়, একটি পদে চাকরি পেয়েও কেউ আবার পরীক্ষা দিয়ে অন্য ক্যাডারে যান—যা নতুনদের জন্য অসুবিধাজনক।
সবশেষে, ইউরোপীয় ইউনিয়নের EPSO (European Personnel Selection Office) এর মতো প্রযুক্তিনির্ভর আপিল বোর্ড চালু করে পরীক্ষার্থীদের অভিযোগ দ্রুত নিষ্পত্তি করা গেলে বিসিএস হয়ে উঠবে স্বচ্ছ ও তরুণবান্ধব এক নিয়োগব্যবস্থা। এই সংস্কারগুলো বাস্তবায়িত হলে বিসিএস কেবল নিয়োগ প্রক্রিয়া নয়, বরং জাতির ভবিষ্যৎ নেতৃত্ব তৈরির একটি আদর্শ মডেল হয়ে উঠবে।
এই সংস্কারগুলো বাস্তবায়ন শুধু একটি প্রশাসনিক উন্নয়ন নয়, এটি তরুণ প্রজন্মের প্রতি রাষ্ট্রের নৈতিক দায়বদ্ধতার বহিঃপ্রকাশ। শাহবাগে যে তরুণ চোখে আগুন নিয়ে দাঁড়িয়েছে, সে কিন্তু রাষ্ট্রবিরোধী নয়—বরং সে চায় এই রাষ্ট্রকে সঠিক পথে এগিয়ে নিতে। যদি রাষ্ট্র সেই স্বপ্নের মূল্য না দেয়, তাহলে এই অন্ধকার থেকে হতাশা, মাদকাসক্তি, অথবা মেধা পাচারের মতো সামাজিক দুর্যোগ জন্ম নিতে বাধ্য।
উপসংহারে বলা যায়, বিসিএস পরীক্ষার সংস্কার এখন বিলাসিতা নয়, বরং এক অবশ্যম্ভাবী প্রয়োজন। এই সংস্কার কেবল একটি প্রক্রিয়া নয়, এটি ন্যায়বিচার, সময়ের মূল্য, এবং মানবিক রাষ্ট্র গঠনের ভিত্তি। তরুণদের অপেক্ষার প্রতিদান দিতে না পারলে এক সময় তাদের আর অপেক্ষা থাকবে না—থাকবে শুধু অভিমান, ক্ষোভ, ও প্রত্যাখ্যান। এবং একটি জাতির সবচেয়ে বড় ক্ষতি তখনই ঘটে, যখন তার তরুণেরা রাষ্ট্রকে বিশ্বাস করতে চায় না। এখন প্রশ্ন আমাদের সবার কাছে—আমরা কি সেই বিশ্বাস পুনরুদ্ধারের দায়িত্ব নেব, নাকি আবারও বছরের পর বছর ধরে "ফলাফল প্রক্রিয়াধীন" এই বাক্যে একটি প্রজন্মকে আটকে রাখব?
লেখক: সহযোগী অধ্যাপক, ব্যবসায় প্রশাসন ডিসিপ্লিন বিভাগ, খুলনা বিশ্ববিদ্যালয়।