০৮ ফেব্রুয়ারি ২০১৯, ১৭:১৭

গেস্টরুম নির্যাতন, র‌্যাগিং সংস্কৃতি ও উচ্চশিক্ষায় চা শিঙাড়া সমুচার গর্ব

লেখক

১৯২১ সালে প্রতিষ্ঠিত হওয়ার পর দেশের শীর্ষস্থানীয় উচ্চশিক্ষা প্রতিষ্ঠান হিসেবে জায়গা করে নিয়েছে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়। দেশভাগ, ভাষা আন্দোলন, ১৯৭১ সালের মহান মুক্তিযুদ্ধ, স্বৈরাচারবিরোধী আন্দোলনসহ অনেক কিছুতে নেতৃস্থানীয় ভূমিকা রেখেছেন এ বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক, শিক্ষার্থী, কর্মকর্তা ও কর্মচারীরা। এদেশের ইতিহাসে তাই ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অবদান অনেক। গর্বের জায়গাও নেহাত কম নয়। তবে সবকিছুকে ছাপিয়ে এ বিশ্ববিদ্যালয়ের মূল কাজ হওয়ার কথা কিন্তু দেশের নাগরিকদের সুশিক্ষায় শিক্ষিত করে তোলা। এটি যথাযথভাবে করা গেলেই তা বিশ্ববিদ্যালয়ের জন্য সবচেয়ে গর্বের ব্যাপার হতো। কিন্তু দুঃখজনক ব্যাপার হলো, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার মান নিয়ে বড়সড় প্রশ্নই রয়ে গেছে। অনেক বৈশ্বিক র‌্যাংকিংয়ে এখন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অবস্থান বেশ খানিকটা নিচের দিকেই। দেশের অন্যান্য উচ্চশিক্ষা প্রতিষ্ঠানের মানের ক্ষেত্রেও একই অবস্থা।


এ অবস্থার মধ্যে একটি খবর সপ্তাহখানেক আগে দেশের বিভিন্ন গণমাধ্যমে বেশ ফলাও করে প্রচার করা হয়। সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমেও ব্যাপারটি ভাইরাল হয়। বিষয়বস্তুটি ছিল মাত্র ১০ টাকায় চা, শিঙাড়া, সমুচা ও চপ পাওয়ার ব্যাপারটিকে বেশ গর্বের বলে উল্লেখ করেছিলেন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের বর্তমান ভিসি অধ্যাপক ড. আখতারুজ্জামান। তার বক্তব্যটি ছিল এমনÑ‘তুমি পৃথিবীর ইতিহাসে কোথাও পাবে না ১০ টাকায় এক কাপ চা, একটা শিঙাড়া, একটা চপ ও একটা সমুচা। বাংলাদেশে এটা পাওয়া যায়। এটি যদি কোনো আন্তর্জাতিক সম্প্রদায় জানতে পারে, তাহলে এটা গিনেস বুকে রেকর্ড হবে। ১০ টাকায় গরম পানিও তো পাওয়া যাবে না রাস্তায়, অথচ ১০ টাকায় একটা চা, একটা শিঙাড়া, একটা সমুচা, একটা চপ এগুলো পাওয়া যাবে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্রশিক্ষক কেন্দ্রে (টিএসসি)। এটি আমাদের গর্ব, এটি আমাদের ঐতিহ্য।’


ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ভিসির এমন বক্তব্যের পর পক্ষে-বিপক্ষে বক্তব্য এসেছে অনেক। তবে বিপক্ষে থাকার সংখ্যাই হয়তো বেশি ছিল। এক্ষেত্রে আমার অবস্থান হলো তিনি যা বলেছেন এক দৃষ্টিকোণ থেকে সেটাই হয়তো ঠিক। বিশ্ববিদ্যালয় জীবনে শিক্ষার্থীদের প্রায় সবারই ডাকসু কিংবা টিএসসি ক্যাফেটেরিয়াকেন্দ্রিক অনেক মধুর স্মৃতি থাকে। সেখানে এই এক টাকা দামের চা কিংবা তিন টাকা দামের শিঙাড়া, সমুচা ও চপও অবিচ্ছেদ্য অংশ। এ নিয়ে অনেক লেখালেখিও হয়েছে। শিক্ষার্থীদের আড্ডায় কিংবা অ্যালামনাইয়ের অনুষ্ঠানে সাবেক শিক্ষার্থীরা যখন মিলিত হন, তখন অনেক কিছুর সঙ্গে এ ব্যাপারটিও থাকে তাদের আলোচনার বিষয়বস্তু। এটিকে তাই ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীদের আবেগের জায়গা বললেও ভুল হবে না। বিশ্ববিদ্যালয়ের ভিসি অধ্যাপক ড. আখতারুজ্জামান হয়তো সেটিই বোঝাতে চেয়েছিলেন। পরে এর পক্ষে নিজের যুক্তিও তিনি তুলে ধরেছেন।


তার সিংভাগ বক্তব্যের সঙ্গেই আমি ঐকমত্য পোষণ করি। তবে দ্বিমত পোষণের জায়গাও রয়েছে একটি গুরুত্বপূর্ণ পয়েন্টে। সেটি হলো গর্ব কিংবা ঐতিহ্যের জায়গা নিয়ে। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের আরও অনেক গৌরবোজ্জ্বল জায়গা থাকলেও এই চা, শিঙাড়া, সমুচা ও চপ কীভাবে গর্ব এবং ঐতিহ্যের বস্তু হয়, তা কোনোভাবেই বোধগম্য নয়। ভিসি হিসেবে তিনি এটি বলতে পারেন কি না সে প্রশ্ন তোলা যায়। তবে এর মাধ্যমে তিনি যদি শিক্ষার্থীদের আবেগ-অনুভূতির বিষয়টি ইঙ্গিত করতে চান, তাহলে অন্যভাবে কথাটা বলতেই পারতেন। গিনেস বুকে ওঠা কিংবা গর্ব করার মতো কোনো ব্যাপার এটি নয় বলেই মনে করি।


এ বিষয়টি নিয়ে যখন চারদিকে আলোচনা-সমালোচনা চলছে, তখন গোপালগঞ্জের বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ের (বশেমুরবিপ্রবি) একটি ঘটনাও বেশ আলোড়ন তুলেছে। ওই বিশ্ববিদ্যালয়ের কৃষি বিভাগের প্রথম বর্ষের দুই শিক্ষার্থীকে বিশ্ববিদ্যালয় ক্যাম্পাসের বাইরে একটি গ্রামের মেসে নিয়ে র‌্যাগিং করেন একই বিশ্ববিদ্যালয়ের ছয় শিক্ষার্থী। শুধু তা-ই নয়, র‌্যাগিংয়ের ভিডিও করে তা সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম ফেসবুকে ছেড়ে দেওয়া হয়। সেটি ভাইরাল হলে টনক নড়ে বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষের। আজীবন বহিষ্কার করা হয় ছয় শিক্ষার্থীকে। তাদের বিরুদ্ধে তথ্যপ্রযুক্তি আইনে মামলাও হয়েছে।


র‌্যাগিংয়ের এই সমস্যা কিন্তু দেশের অধিকাংশ উচ্চশিক্ষা প্রতিষ্ঠানেই রয়েছে নানা আঙ্গিকে। খোদ ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়েও হচ্ছে, তবে একটি ভিন্নভাবে ‘গেস্টরুম পরিচিতি সভা’ নামক পদ্ধতিতে। বিশ্ববিদ্যালয়ের হলে থাকা প্রথম বর্ষের প্রতিটি শিক্ষার্থীর ক্ষেত্রেই এ ধরনের পরিস্থিতির মোকাবিলা করা প্রায় নিশ্চিত। মূলত ক্ষমতাসীন দলের ছাত্রসংগঠনের নেতারাই এটি আহ্বান করে আসছেন। নতুন শিক্ষার্থীদের আচার-আচরণ শেখানোর নামে প্রতিদিন রাতে কিংবা সপ্তাহে দুই থেকে তিন দিন শিক্ষার্থীদের গেস্টরুমে ডাকা হয়। সেখানে আচার-আচরণ শেখানোর পাশাপাশি সারা দিনের বিভিন্ন অভিযোগের বিচারও করা হয়। বিশেষ করে রাজনৈতিক কর্মসূচিতে হাজির না হলে মানসিক ও শারীরিক শাস্তি দেওয়া নিত্যনৈমিত্তিক ব্যাপার। এমনকি রাতভর হলের বাইরে থাকতে বাধ্য করারও নজির রয়েছে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের একাধিক হলে। দ্বিতীয় ও তৃতীয় বর্ষ, এমনকি চতুর্থ বর্ষেও এ ধরনের পরিস্থিতির মুখোমুখি হতে হয় শিক্ষার্থীদের।


ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের একটি পুরোনো ও ঐতিহ্যবাহী হলে থেকে নিজেই এই গেস্টরুম সংস্কৃতির মুখোমুখি হয়েছি, অনেককে মানসিক ও শারীরিক নির্যাতনের শিকার হতেও দেখেছি। একবার রাজনৈতিক কর্মসূচিতে অনুপস্থিত থাকাসহ বেশ কিছু অভিযোগে আমাকে ও আমার ২৫-৩০ সহপাঠীকে ডাকা হয়েছিল গেস্টরুমে। সেখান থেকে আমাদের নিয়ে যাওয়া হয় হলের মাঠের একপাশে। পরে একেকজনকে ডেকে নিয়ে অকথ্য ভাষায় গালাগালসহ চড়-থাপ্পড় মারতেও দেখেছি। যদিও সেদিন নিজে রাজনৈতিক কর্মসূচিতে হাজির থাকায় রক্ষা পেয়েছিলাম। তবে এ ধরনের ঘটনা বিশ্ববিদ্যালয়ের হলগুলোতে ঘটার অভিযোগ অসংখ্য।


বরিশাল বিশ্ববিদ্যালয়ের ভিসির দেওয়া একটি বক্তব্যও সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে কয়েক দিন ধরেই আলোচনা হচ্ছে। ধূমপায়ী কোনো শিক্ষার্থীকে ভর্তি করা হবে না বলে জানিয়েছেন এ বিশ্ববিদ্যালয়ের ভিসি অধ্যাপক ড. এস এম ইমামুল হক। ভর্তি পরীক্ষায় অধূমপায়ীদের অগ্রাধিকার দেওয়া হবে বলেও জানিয়েছেন। তার দেওয়া তথ্যানুযায়ী, বরিশাল বিশ্ববিদ্যালয়কে ইতোমধ্যে মাদকমুক্ত ও র‌্যাগিংমুক্ত ঘোষণা করা হয়েছে। বরিশাল বিশ্ববিদ্যালয়ের ভিসির কথা সত্য হলে তা নিঃসন্দেহে ভালো খবর। তবে ধূমপায়ী শিক্ষার্থী নিয়ে যে কথা তিনি বলেছেন, তা কতটা বাস্তবসম্মত বোধগম্য নয়। স্নাতক পর্যায়ের শিক্ষার্থীদের ধূমপায়ী হওয়া বা না হওয়ার বিষয়টি কীভাবে চিহ্নিত করা হবে জানি না। এছাড়া তাদের ভর্তি করা হবে না বলা হয়েছে সেটিও কীভাবে বাস্তবায়ন করা হবে, ঠিক বোঝা যায় না।


এখন আসি মূল কথায়। ১০ টাকার চা, সমুচা ও শিঙাড়ার প্যাকেজ এবং গেস্টরুম, র‌্যাগিং, কিংবা ধূমপায়ী শিক্ষার্থী ভর্তি করার ব্যাপারগুলো নিয়ে আলোচনা করাটা আসলে মূল উদ্দেশ্য নয়। মূল উদ্দেশ্য হলো দেশের উচ্চশিক্ষা পরিস্থিতির তুলনামূলক একটি চিত্র তুলে ধরা। উচ্চশিক্ষা প্রতিষ্ঠান নিয়ে বৈশ্বিক যেসব র‌্যাংকিং করা হয়, দেশের বিশ্ববিদ্যালয়গুলোর অবস্থা সেখানে মোটেও সন্তোষজনক নয়। গত বছরের অক্টোবরে বিশ্ববিদ্যালয়ের মান যাচাইকারী ব্রিটিশ প্রতিষ্ঠান কুয়াককুয়ারেলি সাইমন্ডস (কিউএস) লিমিটেড এশিয়ার সেরা ৫০০ বিশ্ববিদ্যালয়ের তালিকা করে। এতে স্থান পায় বাংলাদেশের মাত্র ছয়টি বিশ্ববিদ্যালয়। অথচ দেশে এখন সরকারি-বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ের সংখ্যা দেড়শ’র কাছাকাছি। তালিকায় সবার ওপরে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় ১২৭তম আর বাংলাদেশ প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয় (বুয়েট) ১৭৫তম। দেশের বাকি চার বিশ্ববিদ্যালয়ের সিরিয়াল তিনশ’র ওপরে।


তবে সারা বিশ্বের যে র‌্যাংকিং প্রকাশ করা হয়, সেখানে দেশের দু-একটি বিশ্ববিদ্যালয় স্থান করে নেয়। আরও স্পষ্ট করে বললে বুয়েট ও ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়। তাও আবার থাকে পাঁচশ’র ওপরে। বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়গুলোর মধ্যে হাতে গোনা কয়েকটি বাদে বাকিগুলোর অবস্থা বেশ শোচনীয়। গবেষণার অবস্থা তো আরও খারাপ, যা নিয়ে দীর্ঘদিন ধরেই সুশীল সমাজ থেকে শুরু করে সবাই উদ্বেগ প্রকাশ করে আসছেন। বিশ্ববিদ্যালয়গুলোর শিক্ষার মানের যখন এ অবস্থা, তখন এর ভিসিসহ হর্তাকর্তাদের মানোন্নয়নে নজর দেওয়াটাও ছিল প্রত্যাশিত। প্রয়োজন ছিল শিক্ষার্থীদের পড়াশোনা এবং শিক্ষকদের গবেষণার জন্য ভালো পরিবেশ সৃষ্টি করা; কিন্তু বাস্তবে কি তা হচ্ছে? হচ্ছে না।


এখনও বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতে আবাসন সংকট চরমে, লাইব্রেরির অবস্থা অত্যন্ত শোচনীয়, পড়াশোনার চেয়ে রাজনৈতিক কর্মসূচিতেই ছাত্রছাত্রীদের সময় দিতে হয় বেশি, ক্লাসও ক্ষেত্রবিশেষে অনিয়মিত, গবেষণায় সুখবর নেই, শিক্ষকদের বড় অংশই জড়াচ্ছেন রাজনীতি ও দলাদলিতে, প্রশ্নবিদ্ধ শিক্ষক নিয়োগ প্রক্রিয়া এবং কর্মকর্তা-কর্মচারীরাও জড়াচ্ছেন রাজনৈতিক কর্মকাণ্ডে। এমন হাজারো সমস্যায় জর্জরিত বিশ্ববিদ্যালয়গুলো। বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ের পরিস্থিতি তো আরও খারাপ। সব মিলিয়ে দেশের উচ্চশিক্ষার পরিবেশ উন্নত হওয়ার পরিবর্তে দিন দিন খারাপই হচ্ছে।


অন্যদিকে মনোযোগ দেওয়ার পরিবর্তে বিশ্ববিদ্যালয়গুলোর কর্তাব্যক্তিরা যদি শিক্ষার মানোন্নয়ন ও গবেষণার উন্নয়নে নজর দিতেন, তাহলে হয়তো উচ্চশিক্ষা পরিস্থিতি আরও উন্নত হতো। সুনাম বাড়ত দেশে-বিদেশে। সেক্ষেত্রে দেশের বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতে গর্ব করার মতো অনেক কিছুই আমরা দেখতে পেতাম। আশা করি সংশ্লিষ্টরা এ বিষয়টি অনুধাবন করবেন। উচ্চশিক্ষার ক্ষেত্রে গর্ব ও ঐতিহ্যের নিত্যনতুন বিষয় উদ্ভাবিত হোক সে প্রত্যাশাই থাকল।

গণমাধ্যমকর্মী
touhiddu.rahman1@gmail.com