তাৎক্ষণিক প্রতিক্রিয়া: আর কত আছিয়াকে কবর দিতে হবে আমাদের?

রাজু নূরুল
রাজু নূরুল  © ফেসবুক থেকে নেওয়া

জীবন কী তা বোঝার আগেই, মাত্র ৮ বছর বয়সে মাগুরার যে শিশুটিকে মৃত্যুর কাছে হার মানতে হলো, সেটিকে শুধু ধর্ষণ ও নিপীড়নের কারণে মৃত্যু বলতে রাজি নই। এটি এমন এক পদ্ধতিগত মৃত্যু, যেখানে ব্যক্তি, পরিবার, সমাজ এবং গোটা দেশ—সবাই মিলে একটা ৮ বছর বয়সী শিশুকে একটু একটু করে হত্যা করেছে। রাষ্ট্র যখন তার ৮ বছর বয়সী এক শিশুর নিরাপত্তা দিতে ব্যর্থ হয়, এটি প্রকারান্তরে রাষ্ট্র কর্তৃক হত্যারই শামিল।

মাগুরার মেয়ে আছিয়ার মৃত্যুর  ঘটনা আমাদের সামনে এমন এক দেশের প্রতিচ্ছবি এনে হাজির করেছে, যেখানে একটি শিশু সিঁড়ি ঘরের নিচে খেলতে গিয়ে, বল কুড়াতে গিয়ে পরিত্যক্ত ছাদ ঘরে, আরবি পড়তে গিয়ে মক্তবে, সদ্য বিয়ে হওয়া বোনের সাথে বেড়াতে গিয়ে দুলাভাইয়ের বাড়িতে ধর্ষণের শিকার হয়। 

এটি সেই দেশের প্রতিচ্ছবি তুলে ধরে, যেখানে একটি মেয়ে রাতের বাসে তার কর্মস্থলে ফিরতে নিরাপদ বোধ করে না, ট্রেনে বাড়ি ফিরতে ভয় পায় এবং খোদ রাজধানীর বুকে দাঁড়িয়ে তার বিশ্ববিদ্যালয়ের রাস্তায় হাঁটতে গিয়ে, গায়ে থাকা ওড়না কীভাবে পরবে তা নিয়ে মন্তব্য শুনতে হয়। 

অপদস্থ হওয়ার পর, অভিযোগকারীকে গ্রেফতার করা হলে, তাকে ছাড়াতে মধ্যরাতে থানায় হানা দেয় তথাকথিত ‘তৌহিদী জনতা’ নামের একদল মানুষ। এরপর, নিপীড়নকারীর গলায় ফুলের মালা দিয়ে তাকে আদালত থেকে বের করে আনা হয়, এবং তার হাতে কোরআন তুলে দিয়ে এই স্বীকৃতি দেয়া হয় যে, নারীকে নিপীড়ন করা ঠিক আছে, বরং নারীর রাস্তায় বের হওয়া ঠিক নাই। 

মাগুরার শিশুটিকে ধর্ষণ ও হত্যাচেষ্টার কারণে তার বোনের স্বামী, শ্বশুরসহ ৪ জনকে গ্রেফতার করা হয়েছে— ধারণা করছি, যেহেতু সারা দেশের মানুষ এই বীভৎসতার বিরুদ্ধে রুখে দাঁড়িয়েছি, তাই তাদের বিচারও হবে। কিন্তু এই গ্রেফতার ও বিচার সম্পন্ন করার মাধ্যমে আমরা এই দেশে ঘটে যাওয়া নারী ও শিশুদের নিপীড়নের মূল কারণগুলোকে সমাধান করতে পারবেনা। 

নারী ও শিশুর প্রতি অব্যাহত নিপীড়নের পেছনের মূল কারণ হলো, স্বাধীনতার ৫০ বছর পরও আমরা এমন একটি সমাজ গড়ে তুলতে পারিনি, যেখানে নারীরা নিরাপদে চলাফেরা করতে পারে। বরং, ২০২৪ সালে এসে একটি গণ অভ্যুত্থানের মাধ্যমে সরকার পরিবর্তনের পর, আমরা নতুন করে ‘মোরাল পুলিশিং’ দেখতে পাচ্ছি। আমরা দেখতে পাচ্ছি যে, প্রতি নিয়ত নারীকে এই সবক দেয়া হচ্ছে যে, সে কি পরবে, কি পরবে না, কোথায় যাবে কিংবা যাবে না, অথবা নারী ঘর থেকে বের হলে তার সঙ্গে কোন কোন প্রজাতির পুরুষ থাকতে হবে। 

দ্বিতীয় বিষয়টি হলো, পূর্বে ঘটে যাওয়া ধর্ষণ ও নিপীড়নের বিচার। তনু, নুসরাত—এই ধরনের বড় বড় ঘটনা মানুষের মনকে নাড়া দিয়েছিল। মাগুরার মেয়েটির মত তাদের জন্যও মানুষের মন কেঁদেছে। কিন্তু খোঁজ নিয়ে দেখুন, এসব হত্যার কোনোটারই বিচার হয়নি। বরং কিছু কিছু ক্ষেত্রে তার উল্টোটা ঘটেছে। উদাহরণ দেখুন:

২০১৬ সালে দিনাজপুরে ৫ বছরের পূজাকে ধর্ষণের অভিযোগে যাবজ্জীবন সাজাপ্রাপ্ত আসামি ফ্রেব্রুয়ারির ২৩ তারিখে জামিন পেয়েছে। পূজার যৌনাঙ্গ ব্লেড দিয়ে কেটে, সারা শরীরে সিগারেটের ছ্যাঁকা দিয়ে, বুকে কামড় দিয়ে যে ব্যক্তি ধর্ষণ করেছিল, তাকে জামিন দেয়া হয়েছে! 

ফেনীর মাদ্রাসা শিক্ষার্থী নুসরাত জাহান রাফির গায়ে আগুন দিয়ে হত্যার মামলায় ফেনীর সোনাগাজী মডেল থানার সাবেক ওসি মোয়াজ্জেম হোসেনকে আট বছরের কারাদণ্ড দেওয়া হয়েছিল। এটা প্রমাণিত হয়েছিল যে, সে থানায় নুসরাতের বক্তব্যের ভিডিও ধারণ করে ইন্টারনেটে ছড়িয়ে দিয়েছিল। ২০১৯ সালের ২৮ নভেম্বর দেওয়া রায়ে তাকে ১০ লাখ টাকা জরিমানা করা হয়েছিল। কিন্তু ‘রাজনৈতিক প্রতিহিংসায় তাকে ফাঁসানো হয়েছে’, এমন অভিযোগে, সেই মামলার আবেদন প্রত্যাহারের চেষ্টা চলছে। ধারণা করা হচ্ছে, তাকেও ছেড়ে দেয়া হবে।  

এসব ধর্ষণের বিচারের জন্য আলাদা কোনো আইনের প্রয়োজন নেই। দেশের প্রচলিত আইনের মাধ্যমেই এসবের বিচার সম্ভব। প্রচণ্ড বিভৎসার কারণে কোনো বিশেষ ঘটনা মানুষের মনকে আন্দোলিত করলে তখন তাড়াহুড়ো করে আইন সংশোধন, দ্রুত বিচারের প্রতিশ্রুতি দেয়া হয়। এসব নিছক লোক দেখানো, ক্ষোভে ফুঁসতে থাকা জনতাকে শান্ত করার প্রাথমিক কৌশল ছাড়া আর কিছুই নয়। কেননা, দূর অতীতের দিকে তাকিয়ে আমরা এরকম একটা ঘটনাও দেখতে পাই না, যার দৃষ্টান্তমূলক শাস্তি হয়েছে।  

তনু, নুসরাত বা মাগুরার মেয়েটির মতো বীভৎস নিপীড়ন যখন আমাদের বিবেককে নাড়া দেয়, তখনও কিন্তু দেশের নানা প্রান্তে এই ধরনের ঘটনা ঘটতে থাকে। তখন, সামাজিকভাবে হেয় হওয়া, বিচার না পাওয়ার সংস্কৃতি, উল্টো নিপীড়নের শিকার মেয়েটির জীবন দুর্বিষহ হয়ে ওঠা, রাজনৈতিক হয়রানি, ভয়ভীতি প্রদর্শন, বিচারের দীর্ঘসূত্রিতা এবং বিচার ব্যবস্থার প্রতি অনাস্থার কারণে মানুষ এসব ঘটনা চার কান হতে দেয় না। এসব পরিস্থিতিতে এমন এক বিচারহীন সমাজ সৃষ্টি হয়, যেখানে নিপীড়কদের অবাধ চলাচলই স্বাভাবিক হয়ে পড়ে। 

কিন্তু এর জন্য শিল্প, সাহিত্য সংস্কৃতির বিকাশ, পারিবারিক ও সামাজিক মূল্যবোধ, মানুষের প্রতি পারস্পরিক শ্রদ্ধাবোধ, টেকসই শিক্ষা ব্যবস্থা ও নিরপেক্ষ বিচারিক প্রক্রিয়ার যে প্রয়োজনীয়তা; সেই আলোচনাকে চেপে ধরে উল্টো ভিকটিমকে গৃহবন্দী করে রাখার নানা কৌশল প্রয়োগ দেখতে পাই আমরা।

২০২৫ সালে এসে, গণ অভ্যুত্থান পরবর্তী সময়ে যখন একটি ‘নিরপেক্ষ’ অন্তবর্তীকালীন সরকার ক্ষমতায়, আমরা দেখতে চাই যে, বীভৎসভাবে নিপীড়নের শিকার হওয়া ৮ বছর বয়সী এক শিশুর নিপীড়কদের শাস্তি নিশ্চিত করার জন্য রাষ্ট্র কী কী পদক্ষেপ নিয়েছে। দেখতে চাই, একটি নিরাপদ, সবার জন্য অবাধ সমাজ নির্মাণে রাষ্ট্র কি ধরনের উদ্যোগ নিচ্ছে। যারা নিপীড়নের সঙ্গে প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষভাবে যুক্ত, যারা মদদ দিচ্ছে, তাদেরকে থামানোর জন্য কী পদক্ষেপ নেওয়া হবে, সেটাও দেখতে চাই। গোটা কাঠামোকে ভেঙেচুরে নতুন করে গঠন করার জন্য কী কী পদক্ষেপ সরকার নেবে, সেটিও দেখতে চাই। 

মাগুরার ৮ বছর বয়সী শিশুর সাথে যা হয়েছে, তা নিছক ধর্ষণ নয়; এটি এমন এক বীভৎস হত্যাকাণ্ড; যে হত্যার জন্য মাত্র ৪ জন দায়ী নয়; বরং পচে গলে যাওয়া গোটা সমাজ ব্যবস্থা এর জন্য দায়ী, যার পুরো ইন্ধন বছরের পর বছর ধরে রাষ্ট্র নিজে দিয়ে যাচ্ছে। এই বাস্তবতা স্বীকার করে, তা পরিবর্তনের জন্য রাষ্ট্র কী কী অঙ্গীকার ব্যক্ত করে সেটা দেখার জন্য তাকিয়ে থাকব।

লেখক: লেখক, অনুবাদক ও গবেষক 
যোগাযোগ: raju_norul@yahoo.com 


সর্বশেষ সংবাদ