ছাত্রদলের শাওন কাবী গ্রেপ্তারের নেপথ্যে কী?

মো. ফিরোজ আলম
মো. ফিরোজ আলম   © টিডিসি সম্পাদিত

চাঁদপুরের ফরিদগঞ্জের আলোচিত ইউনিয়ন ছাত্রদল সভাপতি শাওন কাবী রিজা আটক হন এলাকার তুচ্ছ ঘটনাকে কেন্দ্র করে। অনেকে এটা মনে করলেও আসলে ঘটনাটি তুচ্ছ নয়। সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে প্রকাশিত একটি ভিডিওতে দেখা যায় দায়িত্বরত এসআই  তার ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তা ওসিকে ফোনে বলছেন, ‘প্রাইভেট কারের গতিবেগ ছিল ৮০ কি. মি.। ওই সড়কে গতিসীমা ৮০ কিলোমিটার ছিল না। অতিরিক্ত গতিসীমা থাকায় চালক গাড়ি নিয়ন্ত্রণ রাখতে ব্যর্থ হয়ে একজন বাইক চালককে আহত করে। আহত অবস্থায় পড়ে থাকা ব্যক্তিকে হাসপাতালে নিয়ে যেতে সহযোগিতা না করে আরো দ্রুতবেগে প্রাইভেটকার চালিয়ে গেলে একটি পর্যায়ে তিনি জনতার হাতে ধরা পড়েন।’ এই অস্বাভাবিক গতিতে যারা গাড়ি চালায় তাদের অধিকাংশই ক্ষেত্রে দুর্ঘটনার পর দেখা যায় মাদকাসক্ত অবস্থায় ছিলেন। এক্ষেত্রেও এমনটা হয়েছে কিনা খতিয়ে দেখা দরকার।

যেকোনো এলাকায় ছোটখাটো সামাজিক কলহ কিংবা এরকম দুর্ঘটনার ক্ষেত্রে স্থানীয় লোকজন মীমাংসা অথবা সহযোগিতার জন্য এগিয়ে আসে। যদি ব্যর্থ হন তখন আইন-শৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর দ্বারস্থ হন, এটাই আমাদের সামাজিক বন্ধনের প্রচলিত নিয়ম এবং এটাই স্বাভাবিক। কেননা রিমোট এরিয়ায় পরিচিত আত্মীয়-স্বজন না থাকা স্বাভাবিক এমনকি সম্পূর্ণ এলাকাও অপরিচিত থাকতে পারে। পুলিশ/আইন শৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী এসে সহযোগিতা করবে, অনেকাংশে তাদেরকে অবগত করতে হয় ঐ এলাকার স্থানীয় মানুষদেরই। তারা যদি না আসে পরিবারই বা নিকটাত্মীয়রা জানবে কীভাবে? যাত্রাপথে কোনো দুর্ঘটনা ঘটলে যদি ঐ এলাকার লোকজন সহযোগিতা না করে তো হাসপাতালে কীভাবে পৌঁছাবে?এখন এই জাতীয় দুর্ঘটনায় সহযোগিতা করতে গিয়ে যদি উল্টো বিপদে পড়তে হয় তাহলে আমাদের সামাজিক বন্ধন ভেঙে সমাজব্যবস্থা ভেঙে পড়ার সম্ভাবনাও রয়েছে। 

শাওন কাবীকে গ্রেফতার করতে আসলে তিনি থানায় যেতে অপারগতা প্রকাশ করেন। তখন পুলিশ কর্মকর্তা জিজ্ঞাসা করছেন আপনি কি প্রধানমন্ত্রীর ছেলে? প্রধানমন্ত্রীর ছেলে কে, তা এই দেশে কারো অজানা নয়, তাছাড়া এখন দেশে কোনো প্রধানমন্ত্রীও নেই। তাহলে তুচ্ছতাচ্ছিল্য করে, উত্ত্যক্ত করার মানে কি? উত্তরে শাওন কাবী বলতেছেন আমি কোনো পক্ষের লোক না, আমি ইউনিয়ন ছাত্রদলের প্রেসিডেন্ট। আওয়ামী ফ্যাসিবাদের আমলে আওয়ামী লীগের সহযোগী আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর কাছে বিএনপি কিংবা ছাত্রদলের এই পরিচয় ছিল অনেকাংশে অভিশপ্ত জীবনে নিজেকে সঁপে দেয়ার মতো। তবুও যারা মাথা নত না করে সকল জুলুমের বিরুদ্ধে লড়াই করে বাংলাদেশকে মুক্ত করেছে, এই পরিচয় দেয়াটা কী এখনও অপরাধ? অপরাধ বলে গণ্য হতেই পারে কেননা সেই সকল লোকজন অধিকাংশই এখনও বহাল তবিয়তেই আছে, কেবলমাত্র ট্রান্সফারের মাধ্যমে স্থান পরিবর্তন করা হয়েছে। মামলার এজাহারে লেখা হয়েছে শাওন পুলিশকে মারধর করেছে, এবং পুলিশ সদস্যরা হাসপাতালে চিকিৎসাধীন। ভিডিওতে দেখা যায় শাওনকে জোরপূর্বক গ্রেফতার করতে চাইলে তিনি নিষেধ করছেন, এবং বাঁধা দিচ্ছেন। শাওন যদি হামলা না করে থাকে তবুও এই রকম মিথ্যা অভিযোগ এবং এজাহার দায়ের করার বিচার নিশ্চিত বাংলাদেশে আদৌও হবে কী?

যেকোনো ঘটনায় কিংবা ওসি কাউকে থানায় ডাকার বিধান নেই কিংবা যে কেহ যেতে বললেই থানায় যেতে বাধ্য না। এমনকি কাউকে কোনো স্থান থেকে থানায় তুলে নিতে হলে সুনির্দিষ্ট আমলযোগ্য অভিযোগে গ্রেফতার করতে হবে। কোনো ঘটনার সাথে সম্পৃক্ত থাকলে, যদি সাক্ষী হিসেবেও কাউকে জিজ্ঞাসাবাদ করতে হলে ফৌজদারি কার্যবিধির ১৬০ ধারা অনুযায়ী লিখিত নোটিশ দিয়ে থানায় ডাকতে হবে। শাওন কাবীকে গ্রেফতার করতে দায়িত্বরত কর্মকর্তা যখন ফোনে ওসির কাছে মিথ্যা তথ্য দিচ্ছেন তখন শাওন কাবী ওসির সাথে ফোনে কথা বলতে চান। কিন্তু তিনি কাবীকে কথা বলতে দেন নাই, উল্টো বলেন নিজের ফোন দিয়ে কল করে কথা বলার জন্য তিরস্কার করা হয়। এরকম পরিস্থিতিতে ওসি সাহেবরা কতটা ফোনে কথা বলেন, তার প্রমাণ ঘটনাস্থলে দায়িত্বরত জুনিয়র কর্মকর্তার আচরণ থেকেই বোঝা যায়। শাওনকে যখন গাড়িতে উঠাতে বলে গ্রেফতারের কথা বলেন, তখন শাওন বলেন “আমি থানায় যাব না, আপনার ওসিকে এখানে আসতে বলুন।” আইন অনুযায়ী জিজ্ঞাসাবাদের জন্য আটক বা জোর করে তুলে নেওয়া বেআইনি। বাংলা কলেজ ছাত্রদলের সাবেক তথ্য ও প্রযুক্তি বিষয়ক সম্পাদক হওয়ায় শাওন কাবী জানতেন, ওসি ফোন করে ডাকলে সেটা আইন সঙ্গত নয়, সেক্ষেত্রে ওসির কোনো কাজ থাকলে ওসিকেই আসতে হবে।

স্থানীয় সূত্রে জানা যায় প্রাইভেটকারের যাত্রীরা সংশ্লিষ্ট এলাকার পুলিশের ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তার আত্মীয় পরিচয় দেন। আমরা অতীতেও দেখেছি পুলিশ কর্মকর্তা কিংবা রাষ্ট্রের কোনো সরকারি ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তা, এমনকি তাদের আত্মীয় স্বজনের ক্ষমতা অপব্যবহারের দাপট। এরা সকলে একই সূত্রে গাঁথা থাকায় ন্যায়-অন্যায় ভুলে একে অপরের সহযোগিতার জন্য মরিয়া হয়ে উঠে। সেক্ষেত্রে যদি আবার হয় সংশ্লিষ্ট দপ্তরের ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তার আদেশ তাহলে তো অতিউৎসাহী হয়ে ঝাঁপিয়ে পড়ে তাদের মনোরঞ্জন করে সান্নিধ্য পাওয়ার জন্য। শাওন কাবীর ক্ষেত্রেও এমনটা হয়েছে কিনা খতিয়ে দেখা দরকার। আর হয়ে থাকলেও ক্ষমতার দাপটে তাঁরা আড়ালে চলে যাবেন, কিংবা পরবর্তীতে সুবিধা নিতে ভুক্তভোগী লঘু দণ্ড নিজের ঘাড়ে নিয়ে তাদের নিষ্কলঙ্ক রাখতে মরিয়া হয়ে পরবেন নাতো?

এছাড়াও প্রাইভেট কারের যাত্রীরা কন্টেন্ট ক্রিয়েটর হয়েও নিজেদের সাংবাদিক হিসেবে দাবি করেন। ওসির কথায়ও তার কিছুটা নমুনা পাওয়া যায়। মাহমুদুল হাসান হিমু নামের একজন তার ফেসবুকে লিখেছেন ওসি শাহ আলম ফোন ব্যাক করেছেন। এক পর্যায়ে তিনি বলেন এলাকার সমন্বয়ক, এস এ টিভি, বাংলাদেশ প্রতিদিনের সাংবাদিকের চাপে পড়ে গ্রেপ্তার করতে বাধ্য হয়েছি। কোনো সাংবাদিক চাপ প্রয়োগ করলেই কেন গ্রেফতার করতে হবে তা প্রশ্নসাপেক্ষ। এই সাংবাদিকরা কেন চাপ প্রয়োগ করলেন সেটাও খুঁজে দেখা দরকার। তাছাড়া দেশে এখন সাংবাদিক নামধারী কন্টেন্ট ক্রিয়েটর, স্থানীয় নামে-বেনামে ভুঁইফোড় পত্রিকা এবং নামধারী সাংবাদিক আজকাল অসংখ্য। এরা সাংবাদিকতার পরিচয় ব্যবহার করে বিভিন্ন সময়ে বিভিন্ন আধিপত্য বিস্তার, ক্ষমতার অপব্যবহার করে চাঁদাবাজিসহ বিভিন্ন অপকর্মে জড়িয়ে পড়ছেন। সাংবাদিক পরিচয় কারা দিতে পারবেন তারও একটি মানদণ্ড নির্ধারণ এবং প্রয়োগ করা কেবলমাত্র প্রয়োজনই নয় অত্যাবশ্যক হয়ে দাঁড়িয়েছে।

ছাত্রদল কেন্দ্রীয় সংসদ থেকে অভিযোগের তথ্য যাচাই-বাছাই ছাড়াই সাংগঠনিক শৃঙ্খলা ভঙ্গের সুনির্দিষ্ট অভিযোগের ভিত্তিতে ফরিদগঞ্জের রূপসা দক্ষিণ ইউনিয়ন ছাত্রদলের সভাপতি শাওনকে সদস্য পদসহ সাংগঠনিক পদ থেকে বহিষ্কার করা হয়েছে। ছাত্রদল সভাপতি রাকিবুল ইসলাম রাকিব ও সাধারণ সম্পাদক নাছির উদ্দীন নাছির বুধবার এ সিদ্ধান্ত অনুমোদন করেন। ছাত্রদলের সব পর্যায়ের নেতাকর্মী বহিষ্কৃতদের সঙ্গে কোনো সাংগঠনিক সম্পর্ক না রাখার নির্দেশনা রয়েছে সেই প্রেস বিজ্ঞপ্তিতে। 

কোনো রাজনৈতিক সংগঠন থেকে বহিষ্কার করলে একজন নেতা কিংবা কর্মীকে কতটা রাজনৈতিক, সামাজিক কিংবা প্রশাসনিক হয়রানির মধ্যে দিয়ে যেতে হয় তা একমাত্র ভুক্তভোগী এবং তার অনুসারীরা বুঝতে পারেন। সাধারণত অপরাধ প্রবণতা নিয়ন্ত্রণ এবং দলীয় ভাবমূর্তি ক্ষুণ্ন করলে, দলকে সুসংগঠিত করতে সুনির্দিষ্ট অপরাধের ভিত্তিতে যেকোনো অপরাধীকে দল থেকে বহিষ্কার করা হয়। শাওন কাবীর ক্ষেত্রে এরকম হয়েছে কিনা কিংবা দলের কাছে অভিযোগের জবাবদিহিতা প্রকাশ করার সুযোগ দিয়ে পদ স্থগিত কিংবা বহিষ্কার করা হলো ভালো হতো। 

অনেক গুরুত্বপূর্ণ বিষয়ে বিএনপি’র ভাবমূর্তি রক্ষা করতে নেতাকর্মীদের তৎক্ষণাৎ আত্মপক্ষ সমর্থনের সুযোগ দেয়া কঠিন হয়ে পরে। অপরাধ প্রমাণিত না হলে বহিষ্কার আদেশ প্রত্যাহার করার সুযোগ রয়েছে। সেই হিসেবে ছাত্রদল শাওন কাবীকে তৎক্ষণাৎ বহিষ্কার করে সঠিক সিদ্ধান্ত গ্রহণ করেছে। 

কিন্তু অনেকাংশ গ্রুপিং ভারী করতে একপক্ষ আরেক পক্ষের বিষয়ে অসত্য কিংবা অসম্পূর্ণ তথ্য দিয়ে বহিষ্কার করতে প্রকাশ্যে কিংবা অপ্রকাশ্যে সোচ্চার দেখা যায়। বিএনপির দায়িত্বশীলদের ভুলে গেলে চলবে না বিএনপি’র প্রতিষ্ঠাতা এবং রাষ্ট্রপতি শহীদ জিয়াউর রহমান চট্টগ্রামে গিয়েছিলেন দলীয় অন্তঃকোন্দলের সমাধান করে সবার ঐক্যমত্যের ভিত্তিতে দলকে সুসংগঠিত করতে। কিন্তু তার পূর্বেই একদল বিপথগামী সেনারা তাকে সার্কিট হাউসে হত্যা করেন। বিএনপির নেতা-কর্মীরা দীর্ঘদিন ধরে গুম-খুন, নির্যাতন-নিপীড়ন, জেল-জুলুম, মামলা-হামলায় অতিষ্ঠ হয়ে দিশেহারা।

আজ সেই জুলুম থেকে মুক্ত হলেও শুরু হয়েছে নতুন করে ষড়যন্ত্র। একদিকে শুরু হয়েছে গ্রুপ ভারী করে সুবিধা নিতে কঠিন দিনগুলোতে আওয়ামী লীগ এবং আওয়ামী প্রশাসনের সাথে আপস কারী সুবিধাবাদীদের দৌড়ঝাঁপ। অন্যদিকে দুর্দিনে ফ্যাসিবাদী লড়াই সংগ্রামের নেতৃবৃন্দের রাজনৈতিক পরিচয় কলুষিত করে দলের ভাবমূর্তি ক্ষুণ্ন করার ষড়যন্ত্র। শাওন কাবী এইরকম পরিস্থিতির শিকার কিনা তাও খতিয়ে দেখা এখন সময়ের ব্যাপার মাত্র। নগ্ন গ্রুপিং ও দলীয় অন্তঃকোন্দলের এই সংকীর্ণ মানসিকতা থেকে রাজনৈতিক নেতৃবৃন্দের বের করতে এবং মানবিক বাংলাদেশ বিনির্মাণে সুস্থ ধারার রাজনীতি করতে এখন সবার আগে প্রয়োজন দলীয় নেতা কর্মীদের রাজনৈতিক প্রশিক্ষণ।

লেখক: এমফিল গবেষক, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় ও সাবেক গণসংযোগ সম্পাদক, ছাত্রদল কেন্দ্রীয় সংসদ


সর্বশেষ সংবাদ