তিতুমীর কলেজকে বিশ্ববিদ্যালয় করার দাবি কতটা যৌক্তিক?

এম এ মতিন
এম এ মতিন  © টিডিসি ফটো

তিতুমীর কলেজ ঢাকার মহাখালীস্থ বীর উত্তম এ কে খন্দকার রোডে অবস্থিত বাংলাদেশের অন্যতম বৃহত্তম কলেজ। এগারো একর জায়গায় অবস্থিত এই কলেজের বাইশটি বিভাগে প্রায় ৩৫,০০০ ছাত্র-ছাত্রী পড়াশোনা করে। শিক্ষক-শিক্ষিকার সংখ্যা বর্তমানে ২২৫ জন এবং কর্মকর্তা-কর্মচারী রয়েছেন ২৫০ জনের মত। এই কলেজটি স্থাপিত হয় ১৯৬৮ সনে। নাম ছিল জিন্নাহ কলেজ। প্রতিষ্ঠার মাত্র ৩ বছর পরে ১৯৭১ সালের ৩ মার্চ  পাকিস্তান সরকারের বিরুদ্ধে চলমান অসহযোগ আন্দোলনের সময় সর্বদলীয় ছাত্র সংগ্রাম পরিষদের কেন্দ্রীয় নেতা ঐ কলেজের ছাত্র আব্দুস সালাম (পরবর্তীতে লে. কর্নেল আব্দুস সালাম, অব. বীর উত্তম) এর দাবির পরিপ্রেক্ষিতে বৃটিশদের বিরুদ্ধে সম্মুখযুদ্ধে নিহত মীর নেসার আলী তিতুমীর (১৭৮২ – ১৮৩১) –এর নামানুসারে তিতুমীর কলেজ নামকরণ করা হয়। দিনটি ছিল ঢাকাস্থ পল্টন ময়দানে অসহযোগ আন্দোলনের পক্ষে ডাকা ঐ আন্দোলনের অন্যতম নেতা মাওলানা আব্দুল হামিদ  খান ভাসানী ও শেখ মুজিবর রহমান -এর এক জন সভা অনুষ্ঠানের ঠিক পূর্ব মুহূর্ত। সুতরাং তিতুমীর কলেজ নামকরণের একটি ঐতিহাসিক পটভূমিকা ও  তাৎপর্য রয়েছে। 

তিতুমীর কলেজসহ হাল আমলে আলোচনার তুঙ্গে উঠা দেশের আরও ছয়টি কলেজ(ঢাকা কলেজ, ইডেন কলেজ, সোহরাওয়ার্দী কলেজ, কবি নজরুল কলেজ, বদরুন্নেসা কলেজ, ) জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয়ের অধীনে ছিল। কিছুসংখ্যক ছাত্রছাত্রীর ঠুনকো দাবির পরিপ্রেক্ষিতে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় এই কলেজগুলোকে ২০১৭ সালে অধিগ্রহণ করে। কলেজগুলোর শিক্ষাদান এবং প্রশাসনিক সকল কাজ আগের মতই চলবে, শুধুমাত্র পরীক্ষা গ্রহণ  ও সনদ প্রদান করবে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে না পড়েও সনদ পাওয়ায় ছাত্ররা দারুণ খুশী। তখনকার জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয়ের ভিসি অধ্যাপক ড. হারুন-অর-রশিদ–এর বিরোধিতা সত্ত্বেও ঢাবি’র কতিপয় আওয়ামীপন্থী স্বার্থান্বেষী? শিক্ষকের চাপাচাপিতে ঢাবি’র তৎকালীন ভিসি ৭ কলেজ ঢাবি’র অধীনে আনতে বাধ্য হয়েছিলেন। কী স্বার্থ ছিল এই সিদ্ধান্তের পেছনে? নিজ বিভাগের রুটিন ক্লাশ বাদ দিয়ে কলেজের পরীক্ষার বহিরাগত পরীক্ষক হওয়া, খাতা দেখা, নিয়োগ পরীক্ষার পরীক্ষক হওয়া, আরও নানা আর্থিক কাজে সংশ্লিষ্ট হওয়ার অপূর্ব সুযোগ! মোটের উপর কলেজগুলো তো ঢাবি’র অধীনস্থ! এই ব্যবস্থা চলে আসছে বিগত ২০১৭ সাল থেকে। বলা দরকার, ঢাবি অধিগ্রহণের পরে কলেজগুলোর শিক্ষার পরিবেশ কিংবা গুণগত মানের উন্নতি কিংবা সেশন জ্যামের কোন সন্তোষজনক সুরাহা হয়েছে বলে জানা যায় নি। একাধারে ৭/৮ বছর একটি ব্যবস্থা চলার পর হঠাৎ করে  কোন কারণ না দেখিয়ে বা যুক্তি না দেখিয়ে বন্ধ করে দেয়ার ঘোষণা দিলে প্রতিক্রিয়া যা হওয়ার তাই হয়েছে। শিক্ষা উপদেষ্টা প্রফেসর ওয়াহিদ উদ্দিন মাহমুদ বলেছেন, তাকে না জানিয়েই ঢাবি এই সিদ্ধান্ত নিয়েছে। এ দিকে তিতুমীর কলেজের ছাত্ররা তাদের কলেজ কে তিতুমীর বিশ্ববিদ্যালয় করার দাবিতে সোচ্চার হয়েছে। অন্যদিকে বিশ্ববিদ্যালয় মঞ্জুরী কমিশনের (ইউজিসি) চেয়ারম্যান বলেছেন, ৭ কলেজের ছাত্রছাত্রীদের জন্যে ‘জুলাই ৩৬ বিশ্ববিদ্যালয়’ নামে একটি নূতন বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠা করা হবে। কেউ কেউ বলছেন, বিশ্ববিদ্যালয়টির নাম হতে পারে, ‘বিজয় ২৪ বিশ্ববিদ্যালয়’। নাম যাই হোক না কেন, উল্লিখিত ৭ কলেজের জন্যে একটি নূতন বিশ্ববিদ্যালয় করা কতটা যৌক্তিক? অন্যদিকে তিতুমীর কলেজকে আলাদা বিশ্ববিদ্যালয় করার দাবিই বা কতটুকু সঙ্গত?

বাংলাদেশে বর্তমানে ১৭৭টি বিশ্ববিদ্যালয় রয়েছে। এগুলোর মধ্যে ৬১টি সরকারি ও ১১৬টি বেসরকারি পর্যায়ের। স্বাধীনতার পর ১৯৭৩ সালের বিশ্ববিদ্যালয় অধ্যাদেশ সংসদে পাশকালে  দেশে বিশ্ববিদ্যালয় ছিল মাত্র ৬টি। এগুলোর মধ্যে জেনারেল বিশ্ববিদ্যালয় হিসেবে পরিচিত ছিল ৪টি (ঢাবি, জাবি, চবি ও রাবি) এবং স্পেশালাইজড বিশ্ববিদ্যালয় ছিল ২টি (বাংলাদেশ কৃষি বিশ্ববিদ্যালয় ও বাংলাদেশ প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয়)। স্বাধীনতার সময় দেশের জনসংখ্যা ছিল সাড়ে সাত কোটি আর এখন সাড়ে ষোল কোটি (বলা হয় ১৮ কোটি)। জনসংখ্যার অনুপাতে বিশ্ববিদ্যালয়ের সংখ্যা দ্বিগুণের চেয়ে কিছু বেশি হয়ে ১৫-১৬ তে দাঁড়াতে পারতো। কিন্তু তা না হয়ে  জ্যামিতিক হারে বেড়ে ১৭৭ এ উপনীত হয়েছে। এখানেই শেষ নয়। বিগত সরকার সর্বশেষ আরও ২০টি সরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ের অনুমোদন দিয়েছে। যেগুলোর অধিকাংশই বিশেষায়িত বিজ্ঞান, প্রযুক্তি, কৃষি, চিকিৎসা বা ডিজিটাল বিশ্ববিদ্যালয় বলে জানা যায়। এই বিশ্ববিদ্যালয়গুলোর সর্বশেষ যা অবস্থা তাতে দেশে আর কোন কোন নতুন বিশ্ববিদ্যালয় স্থাপন অযৌক্তিক। সবশেষ অনুমোদিত ২০টির মধ্যে ১৮টি পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয় চলছে কলেজের শ্রেণিকক্ষে, বিদ্যালয়ের ভবনে ও ভাড়া করা জায়গায়। ভিসি নেই, শিক্ষক নেই, নেই লাইব্রেরি-ল্যাবরেটরি। বিদ্যমান এ সকল সমস্যা দেশে আর কোন নতুন বিশ্ববিদ্যালয় স্থাপনের পদক্ষেপে তাই অযৌক্তিক ও অবিমৃষ্যতার ইঙ্গিত দেয়।  ইতোমধ্যে অবশ্য বলা হচ্ছে – প্রতি জেলায় একটি করে বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠা করা হবে!

নবপ্রতিষ্ঠিত বিশ্ববিদ্যালয়গুলোর সমস্যা
রাষ্ট্র ও নীতিনির্ধারকদের প্রতি জেলায় বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠা করার এই সিদ্ধান্ত বর্তমান প্রেক্ষাপটে যৌক্তিক নয় বলে অনেকে মনে করেন। একে রাজনীতিকগণ ‘উন্নয়নের মহাসড়কের এক জাজ্বল্যমান গল্প’ হিসেবে প্রচারে নিয়ে এসেছেন বটে কিন্তু এ সম্পর্কে দৈনিক প্রথম আলো ‘নতুন পাবলিক  বিশ্ববিদ্যালয় গৃহহীন, তবু ভূমিহীন’ ( ৮ মে ২০২৪) শীর্ষক প্রতিবেদনে বিশ্ববিদ্যালয় মঞ্জুরি কমিশনের (ইউজিসি) বরাত দিয়ে বলা হয়েছে, ‘নতুন প্রতিষ্ঠিত ২০টি সরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ের নিজস্ব জমি নেই। সেগুলো পরিচালিত হচ্ছে অন্য কোনো প্রতিষ্ঠানের ভবনে কিংবা ব্যক্তিমালিকানাধীন ভবন ভাড়া করে। ফলে চরমভাবে বিপর্যস্ত হচ্ছে এই নবাগত বিশ্ববিদ্যালয়গুলোর শিক্ষা কার্যক্রম’। এ প্রসঙ্গে দৈনিক যুগান্তরের সঙ্গে কথা বলেন বিশ্ববিদ্যালয় মঞ্জুরি কমিশনের (ইউজিসি) সদস্য অধ্যাপক ড. মোহাম্মদ আলমগীর। তিনি জানান, ‘গত কয়েক দশকে যেসব পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠা হয়েছে, এগুলোরর প্রতিটির ক্ষেত্রেই সমস্যা আছে। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠার আগে নয় বছর পরিকল্পনা ও প্রয়োজনীয়তা নিরূপণে সময় ব্যয় হয়েছে নাথান কমিশনের (১৯১২)। এখন আইন পাশের পরই উপাচার্য নিযুক্ত হন। এরপর কয়েকটি ভবন ভাড়া করেই ছাত্রছাত্রী ভর্তি চলে। ধীরে ধীরে শিক্ষক নিয়োগ ও অবকাঠামো নির্মাণ শুরু হয়। উপাচার্যই হন প্রকল্প পরিচালক। ফলে উচ্চশিক্ষা বলতে যা হওয়ার কথা, তা হয় না। উল্টো কখনো উপাচার্যদের বিরুদ্ধে মাথা হেঁট করার মতো অভিযোগ আসছে। আইন পাশের পর প্রকল্প পরিচালক নিয়োগ দিলে তিনি ক্যাম্পাস তৈরি করতেন। সেটা হস্তান্তরের পর উপাচার্য ও শিক্ষক নিয়োগ শেষে শিক্ষা কার্যক্রম শুরু হলে আজকে এত প্রশ্ন উঠত না’।

শিক্ষক সমস্যা
ইউজিসি আর এক প্রতিবেদনে বলেছে, বর্তমানে ‘৩৯টি বিশ্ববিদ্যালয়ে উপাচার্য নেই। উপ-উপাচার্য নেই ৭২ আর কোষাধ্যক্ষ ৪৩টিতে। অধ্যাপক এবং সহযোগী অধ্যাপক নেই এরূপ অনেক বিশ্ববিদ্যালয়ের অনেক বিভাগে বিদ্যমান। মফস্বল এলাকার বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতে সিনিয়র শিক্ষকরা যেতে চান না’। শিক্ষক ও প্রশাসনে শীর্ষ কর্মকর্তা ছাড়াও, নানা সংকটে জর্জরিত বিভিন্ন বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়। বছরের পর বছর এরা অস্থায়ী ক্যাম্পাসে কার্যক্রম চালাচ্ছে। আইন অনুযায়ী, ১০৯টি বিশ্ববিদ্যালয়ের মধ্যে ৫২টির স্থায়ী ক্যাম্পাসে যাওয়ার কথা। কিন্তু প্রতিষ্ঠার ১২ বছর পরও অন্তত ২৫টি ভাড়া বাড়িতে আছে। 

বাংলাদেশে এই মুহূর্তে সরকারি বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ে ৪৫ লাখের মতো শিক্ষার্থী আছে। যেহেতু সরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ের সংখ্যা কম, তাই প্রয়োজনের তাগিদেই বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠিত হয়েছে। কিন্তু যেভাবে এগুলো চলছে তাতে শিক্ষার মান অর্জিত হচ্ছে না। শুধু সনদধারী গ্র্যাজুয়েট সৃষ্টি হচ্ছে। এতে চাকরি বাজারে এরা উপেক্ষিত হচ্ছে। ফলে দেশের শ্রমবাজারে বিদেশিরা জায়গা করে নিচ্ছে।

উচ্চশিক্ষার উদ্দেশ্য কী?
স্বাধীন বাংলাদেশের প্রথম শিক্ষা কমিশন ‘কুদরত-ই-খোদা শিক্ষা কমিশনের রিপোর্টে  উচ্চশিক্ষা সম্পর্কে বলা হয়েছে, …For, the role of higher education is to prepare competent knowledgable and far-sighted people for assuming various higher responsibilities, to create such an educated group in who the attachment to work, love for learning, freedom of thought, a sense of fairness and the humanitarian instinct are fully developed; to open up new horizons of knowledge through research and to analyse economic problems and indicate their solutions. … Research plays a special role in higher education. So due importance must be given to research simultaneously with giving teaching our full attention. Research makes teaching productive, makes substantial addition to knowledge and enriches human life through its discoveries in importan tfields of science. Whenever we think of educational development we must think both of teaching and research. The fundamental principle of higher education is based upon this dual role. –পৃ. ৮০-৮১।

[ভাবার্থ: “উচ্চশিক্ষার লক্ষ্য হচ্ছে – যোগ্য, জ্ঞানী ও দূরদর্শী এমন মানবসম্পদ তৈরি করা যারা বিভিন্ন উচ্চতর পদে দায়িত্ব গ্রহণে সক্ষম। যাদের শিক্ষার প্রতি থাকবে অনুরাগ, মুক্ত চিন্তাশক্তি, নিরপেক্ষ আচরণ এবং মানবিক মূল্যবোধ। তাঁরা গবেষণার মাধ্যমে জ্ঞানের নতুন নতুন দার উন্মোচন করবেন এবং এর মাধ্যমে জাতীয় অর্থনৈতিক সকল সমস্যা পর্যালোচনা করবেন এবং তার আলোকে সমাধান খুঁজে বের করবেন। আরও বলা হয়েছে – উচ্চশিক্ষায় গবেষণার বিশেষ ভূমিকা রয়েছে। সেজন্যে শিক্ষা প্রদানের সাথে গবেষণা কর্মে যথাযথ মনোযোগ দিতে হবে। গবেষণা শিক্ষাকে পরিপূর্ণতা দান করে এবং জ্ঞানকে সমৃদ্ধতর করে। ফলত জ্ঞানবিজ্ঞানের নবতর উদ্ভাবনের  মাধ্যমে মানব কল্যাণ সাধন করে। সুতরাং যখনই শিক্ষা উন্নয়নের প্রসঙ্গ আসে তখনই আমাদের শিক্ষা ও গবেষণা উচ্চশিক্ষা বিষয়ে বাংলাদেশের জাতীয় শিক্ষানীতি ২০১০ এ বিবৃত লক্ষের কথা সামনে আসে। সেখানে বলা হয়েছে, “উচ্চশিক্ষার উদ্দেশ্য হলো – জ্ঞান সৃজন ও উদ্ভাবন। সেই সাথে দক্ষ মানবসম্পদ সৃষ্টি”। 

সুতরাং উচ্চশিক্ষা কোনো সার্টিফিকেট সর্বস্ব শিক্ষা নয়। এটি হচ্ছে কোন বিষয়ে বিশেষ জ্ঞান ও দক্ষতার অধিকারী হয়ে শিক্ষা গবেষণা, আর্থ-সামাজিক কর্মকাণ্ড, প্রশাসন, বিজ্ঞান, ইন্নোভেশন, মানবিক, ইত্যাদি ক্ষেত্রে উচ্চতর তত্ত্বাবধানমূলক দায়িত্ব পালনে সক্ষম হওয়া। যাকে ব্যবস্থাপনার ভাষায় ‘দক্ষ মানবসম্পদ’ বলা হয়। কিন্তু আমাদের বিশ্ববিদ্যালয়গুলো থেকে যে সকল গ্র্যাজুয়েট বের হয় তাদের সম্বন্ধে (ঢালাওভাবে সবাই নয়) বাংলাদেশের শিল্পমালিক, উদ্যোক্তাসহ চাকরিদাতাদের সাধারণ মত হচ্ছে এরা তাদের প্রতিষ্ঠানে ঈপ্সিত দায়িত্বপালনে সক্ষম নয়। সুতরাং তাদেরকে বাইরে থেকে এ সকল পদে লোক নিয়োগ করতে হয়। বাংলাদেশে বর্তমানে বিভিন্ন বেসরকারি ও বহুজাতিক দপ্তর ও প্রতিষ্ঠানে প্রায় ৩ লক্ষ বিদেশি কাজ করছেন। ইতঃপূর্বেকার সরকারের অর্থমন্ত্রী সংসদে বলেছেন, বিদেশিরা বছরে ৫ বিলিয়ন ডলার নিয়ে যাচ্ছে। অন্যদিকে আমাদের বিশ্ববিদ্যালয় পাশ গ্র্যাজুয়েটগণ বেকার থাকছেন। উল্লেখ্য বর্তমানে বাংলাদেশে উচ্চশিক্ষিত বেকারের হার প্রায় ১০%। যদিও সার্বিক বেকারত্বের হার ৫% এর নিচে। সরকারি গবেষণা প্রতিষ্ঠান বি আই ডি এস’র এক সাম্প্রতিক গবেষণায় দেখা যায় জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয় থেকে পাশ করা মানবিক ও সমাজবিজ্ঞান শাখার কয়েকটি বিষয়ের গ্র্যাজুয়েটদের প্রায় ৭০% বেকার থাকছেন। অতএব বিশ্ববিদ্যালয়ের সর্বোচ্চ ডিগ্রি নিয়ে আমাদের গ্র্যাজুয়েটরা যদি দেশীয়/বহুজাতিক প্রতিষ্ঠানে কাজ করতে সক্ষম না হন এবং তাদেরকে অর্জিত যোগ্যতার নিচ পদে কাজ করতে হয় কিংবা বেকার থাকতে হয় তাহলে এই উচ্চশিক্ষা গ্রহণের যৌক্তিকতা কী? সরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র হলে সরকার তার পেছনে অনেক টাকা খরচ করে আর বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ে ছাত্র হলে তার পিতামাতাকে যথেষ্ট পরিমাণ অর্থ খরচ করতে হয়। এ অবস্থায় আমাদের করণীয় কী? 

উচ্চশিক্ষা কাদের জন্যে?
উচ্চশিক্ষা কখনো সর্বজনীন হতে পারে না – হওয়া উচিত নয়। অতি মেধাবী, উদ্ভাবনী শক্তিসম্পন্ন, সৃষ্টিশীল, নেতৃত্ব গ্রহণ/প্রদানের যোগ্য ছাত্র-ছাত্রীদের জন্যই কেবলমাত্র উচ্চশিক্ষার দ্বার উন্মোচিত থাকা উচিত। উচ্চমাধ্যমিক পাশ হলেই বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি হতে হবে এমন ধারণা থেকে আমাদের বের হয়ে আসতে হবে। বর্তমানে যে সকল ছাত্র-ছাত্রী বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি হচ্ছে – তারা কি সবাই সত্যিকার অর্থে উচ্চশিক্ষা গ্রহণের যোগ্য। আন্তর্জাতিক মানদণ্ডের কথা না হয় বাদই দিলাম– দেশীয় মানদণ্ডেও কি তারা যোগ্যতার ছাপ রাখতে পেরেছে? ঢাবি কর্তৃপক্ষ তাদের ভর্তি পরীক্ষার ফলাফল জনসমক্ষে প্রকাশ করে জাতিকে দেখিয়ে দিয়েছে যে, আমরা যাদের বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি করাচ্ছি – তাদের অধিকাংশই উচ্চশিক্ষা গ্রহণের প্রায় অযোগ্য। ইদানীং ঢাবি’র ভর্তি পরীক্ষায় পাশ নম্বর ৩৫ পায় নাই শতকরা ৯০ জন। শতকরা মাত্র ১০ জন পাস করে। সিট পূরণের জন্যে তাহলে ঢাবিকে ফেল করা ছাত্র-ছাত্রী ভর্তি করাতে হচ্ছে। বুয়েট –এর ভর্তি পরীক্ষার তথ্যাদি ঢাবি’র মত জনসমক্ষে প্রকাশ না করা হলেও অনুমান করা যায় যে সেখানকার অবস্থাও তথৈবচ হওয়া ছাড়া উপায় নাই। কেননা, যোগানদাতা প্রতিষ্ঠান তো এক ও অভিন্ন। বলার অপেক্ষা রাখে না যে, ঢাবিতে ফেল করা ছাত্র-ছাত্রীরাই অন্যান্য বিশ্ববিদ্যালয়, বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয় (যাদের আর্থিক অবস্থা ভাল) এবং সরকারি কলেজ ও পরে বেসরকারি কলেজে ভর্তি হয় এবং পাশ করে বেকারত্বের হার বৃদ্ধি করে। এ অবস্থায় উচ্চশিক্ষাকে সীমিত, নির্বাচিত এবং লক্ষভিত্তিক করা, ৮ম শ্রেণি পর্যন্ত প্রাথমিক শিক্ষাকে সর্বজনীন ও বাধ্যতামূলক করা এবং কারিগরি/ভোকেশনাল শিক্ষাকে উপযুক্ত সকলের দোরগোড়ায় পৌঁছানোর ব্যবস্থা গ্রহণ এখন  সময়ের দাবি। 

বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠার ঐতিহাসিক পরিপ্রেক্ষিত
স্যার চার্লস উড (১৮০০–১৮৮৫) বৃটিশ আইনসভার সদস্য এবং ভারতবর্ষে ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানির বোর্ড অফ কন্ট্রোলের সভাপতি ছিলেন (১৮৪৬-৫২)। ব্রিটিশ সরকার তথা ইষ্ট ইন্ডিয়া কোম্পানি ১৮৫৪ সালে ভারতবর্ষে বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠার লক্ষ্যে চার্লস উড কে প্রধান করে একটি উচ্চশিক্ষা কমিশন গঠন করেন। ইতিহাসে এই কমিশন ‘উড কমিশন’ নামে পরিচিত। তখন ভারত বর্ষের গভর্নর জেনারেল ছিলেন লর্ড ডালহৌসি (১৮৪৮-৫৬)। চার্লস উড ডালহৌসির নিকট ১৮৫৪ সালে কমিশনের রিপোর্ট পেশ করেন। ইতিহাসে এই রিপোর্ট ‘উড’স ডেসপ্যাচ অন এডুকেশন ১৮৫৪’ (Wood's Dispatch on Education, 1854) নামে পরিচিত। উড’স ডেসপ্যাচকে ভারতে উচ্চশিক্ষার 'ম্যাগনা-কার্টা' হিসাবে বিবেচনা করা হয়।

উড কমিশনের রিপোর্টের ভিত্তিতেই লন্ডন বিশ্ববিদ্যালয়ের আদলে ১৮৫৭-৮৭ পর্যন্ত দীর্ঘ ৩০ বছরে ভারতবর্ষে মোট ৩টি বিশ্ববিদ্যালয় (বোম্বে, মাদ্রাজ ও কলকাতা) প্রতিষ্ঠিত হয়েছিল। পরবর্তীতে আরও ২টি (পাঞ্জাব ও এলাহাবাদ) বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠিত হয়। অতঃপর ১৯১৬-৪৭ পর্যন্ত ৩১ বছরে ভারত বর্ষে  বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠিত হয়েছিল ১৭টি। তখন ভারতবর্ষের (পাক-ভারত-বাংলাদেশ) জনসংখ্যা ছিল মাত্র ৩৯ কোটি। আর  এখন ১৪২ কোটি লোকের দেশ ভারতে  বিশ্ববিদ্যালয়ের সংখ্যা ১১১৩ টি (সরকারি, বেসরকারি)।   এটি উচ্চশিক্ষা বিস্তার এবং উন্নয়নের পরিচায়ক বৈ কি? পৃথিবীর স্বল্পোন্নত সমান সংখ্যক জসংখ্যার দেশসমূহের বিশ্ববিদ্যালয়ের সংখ্যা পর্যালোচনা করলে দেখা যায়–  ১০.৫০ কোটি জনসংখ্যা অধ্যুষিত ভারতের পশ্চিমবঙ্গ রাজ্যে সরকারি-বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয় রয়েছে মোট ১১০টি, ২.২০ কোটির দেশ শ্রীলংকায় বিশ্ববিদ্যালয়ের সংখ্যা মাত্র ১৭টি, ১০ কোটির দেশ ভিয়েতনামে বিশ্ববিদ্যালয়ের সংখ্যা ২৪২টি (সরকারি ১৭৬ ও বেসরকারি ৬৬টি), ২৪ কোটির দেশ পাকিস্তানে বিশ্ববিদ্যালয় রয়েছে ২০০টি (সরকারি ১৬৫ টি ও বেসরকারি ৩৫টি)। এই পরিসংখ্যান হয়তো আরও বাড়ানো যায় কিন্তু এ থেকে সিদ্ধান্ত নেয়া কঠিন যে জনসংখ্যার উপরে কি বিশ্ববিদ্যালয়ের সংখ্যা নির্ভর করে? হয়তো নয়। কিন্তু এ কথাও তো সত্য যে, জনসংখ্যা বেশি হলে ছাত্রসংখ্যাও বেশি হবে। কিন্তু ছাত্রসংখ্যা বেশি হলেই যে সবাই উচ্চশিক্ষা অর্জনে সক্ষম হবে কিংবা রাষ্ট্র তাদের শিক্ষাখরচ মেটানোর সক্ষমতা রাখবে তা তো নাও হতে পারে।

বৈশ্বিক র‌্যাঙ্কিংয়ে বাংলাদেশের বিশ্ববিদ্যালয়সমূহের অবস্থান
পৃথিবীতে বৈশ্বিক বিশ্ববিদ্যালয়-র‌্যাঙ্কিং কাজে নিয়োজিত  বড় বড় প্রতিষ্ঠানের কথা আমরা জানি। এগুলোর মধ্যে দ্য টাইমস হায়ার এডুকেশন, কোয়াককোয়ারেলি সায়মন্ডস এবং একাডেমিক র‌্যাঙ্কিং অব ওয়ার্ল্ড ইউনিভার্সিটিজ তথা সাংহাই র‌্যাঙ্কিং অন্যতম।  এ সকল এজেন্সির র‍্যাঙ্কিং এর ফলাফল আমাদের দেশের পত্রপত্রিকায় প্রকাশিত হয়। তাতে প্রতীয়মান হয় যে, বাংলাদেশের বিশ্ববিদ্যালয়সমূহ (সরকারি, বেসরকারি) বৈশ্বিক বিশ্ববিদ্যালয় র‍্যাংকিং এ বেশ পিছিয়ে। এমন কি দক্ষিণ এশিয়ায়ও তাদের স্থান প্রথমদিকে নেই। যাইহোক, সম্প্রতি ঢাবি সহ বাংলাদেশের কয়েকটি বিশ্ববিদ্যালয়ের বৈশ্বিক র‍্যাঙ্কিং এ এগিয়ে যাওয়ার খবর পাওয়া যাচ্ছে। 

তবে এ কথা সত্য যে, ঔপনিবেশিকতার ঔরসে জন্ম হলেও প্রতি-ঔপনিবেশিক জাতীয়তাবাদী ভূমিকার কারণে বাংলাদেশকে তার বিশ্ববিদ্যালয় ব্যবস্থাই এতদূর এনেছে। বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীদের রাজনৈতিক-চেতনার আঁতুড়ঘরে জন্ম নিয়েছে বাংলাদেশ। কিন্তু, পঞ্চাশ-ষাট-সত্তর দশকের সে সময়ের সঙ্গে আজ আর বাস্তবিক কারণেই তুলনা করা চলে না। কিন্তু বর্তমানে রাষ্ট্র-সমাজের সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ বিদ্যাপীঠ তাত্ত্বিকভাবেই এখন আর বিশ্ববিদ্যালয়ের মতো কাজ বা ফাংশন করছে না বাংলাদেশে। মানহীন ও পদোন্নতি নির্ভর গবেষণা, ছাত্রসংসদহীন ক্যাম্পাসে দলীয়করণ ও সন্ত্রাসনির্ভর রাজনীতি, শিক্ষা কার্যক্রমের যাচ্ছেতাই দশাসহ সরকারি চাকরিকেন্দ্রিক পড়ালেখার প্রতি শিক্ষার্থীদের নিদারুণ ঝোঁক পুরো ব্যবস্থাটাকেই ঝুঁকিতে ফেলেছে।

নীতিনির্ধারকেরা স্বীকার করতে না চাইলেও দেখা যাবে, সামগ্রিক বৈশ্বিক প্রেক্ষাপটে ব্যবস্থাটি মৃতপ্রায় ও অকার্যকর। আর একে আরও বেশি ত্বরান্বিত করেছে অপ্রয়োজনীয় ও অপরিকল্পিত বিশ্ববিদ্যালয় ও করণিক সৃষ্টির ‘রাজকীয়’ বিশ্ববিদ্যালয়বাজি। সুতরাং আজকের প্রেক্ষাপটে নতুন বিশ্ববিদ্যালয় স্থাপনের আগে আমাদের চিন্তা করা  উচিত এই বিশ্ববিদ্যালয় থেকে জাতি কী পাবে? নতুন বিশ্ববিদ্যালয় স্থাপন নাকি পুরনোগুলোকে ঢেলে সাজিয়ে শক্তিশালীকরণ – কোনটি অধিক যৌক্তিক? একটি বিশ্ববিদ্যালয়ের টাকা দিয়ে উপজেলা পর্যায়ে কয়েকটি পলিটেকনিক/টেকনিক্যাল ইন্সটিটিউট স্থাপন? 

উচ্চশিক্ষা না কারিগরি শিক্ষা
উচ্চশিক্ষার যে সংকটময় চিত্র উপরে তুলে ধরা হলো – এ প্রেক্ষাপটে আমাদের করণীয় কী? আমরা কি উচ্চশিক্ষার সুযোগ ক্রমাগত বাড়াতেই থাকবো – নাকি তা সীমিত এবং অর্থবহ করে কারিগরি/ভোকেশনাল শিক্ষার সুযোগ বৃদ্ধি করে মানবসম্পদ উন্নয়নের লক্ষ্যে দৃঢ়ভাবে কাজ শুরু করবো? এ কথা সত্য যে, জন্মগতভাবে সব মানুষ সমান নয় – নয় সমান মেধাবী। ছাত্র-ছাত্রীদের বেলায়ও একই কথা প্রযোজ্য। সব ছেলে-মেয়ে, সব ছাত্রছাত্রী সমান মেধাবী নয়। এর অর্থ এই নয় যে, যারা মেধাবী নয় – তারা অথর্ব – কোন কাজের যোগ্য নয়। স্বল্প মেধাবীদের কাজ এক রকম ও মেধাবীদের কাজ অন্যরকম। সবাই নিজ নিজ কর্মদক্ষতা ও মেধাগুণে স্ব স্ব ক্ষেত্রে অবদান রাখতে সক্ষম। সেভাবেই আদিকাল থেকে পৃথিবী চলে আসছে। রাষ্ট্র পরিচালক ও নীতিনির্ধারকদের দায়িত্ব হচ্ছে– মেধাবী-স্বল্পমেধাবী-মেধাহীন সকল ছেলেমেয়ে-ছাত্রছাত্রীকে শ্রেণীকরণকরণ করে যার যার যোগ্যতা অনুযায়ী যথাস্থানে পদায়নের ব্যবস্থা গ্রহণ করা।

উচ্চশিক্ষাকে সীমিত, নির্বাচিত এবং লক্ষভিত্তিক করা হলে বহুসংখ্যক ছাত্র-ছাত্রী বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষার কাঠামোর বাইরে পড়ে যাবে এবং  তাদের ভবিষ্যত কী? এখানে আমাদের বর্তমান শিক্ষাব্যবস্থার পুনর্গঠন এবং সংস্কার সম্পর্কে দুই একটি কথা বলা দরকার। প্রাথমিকের বয়স ৫ না হয়ে তা ৮ হওয়া উচিত। কুদরত-ই-খোদা শিক্ষাকমিশনে এ সুপারিশ করা হয়েছিল। ছেলেমেয়েরা ৫ বছর লেখাপড়া করে তেমন  কিছুই শিখতে পারে না। তাছাড়া ১১-১২ বছর বয়সের ছেলেমেয়েরা কীইবা বৈষয়িক জ্ঞানের অধিকারী হয়? শারীরিক শক্তি সামর্থ্যও তেমন একটা জন্মায় না। পঞ্চম শ্রেণি পাশের পর মাধ্যমিক পর্যন্ত যেতে আরও ৫ বছর সময় লাগে। এই সময়ের মধ্যে আর্থ-সামাজিক কারণে ঝরে পড়ে বহু সংখ্যক ছাত্রছাত্রী। আর পঞ্চম শ্রেণি পর্যন্ত শিক্ষা নিয়ে কোথাও দাঁড়ানো সম্ভব হয় না।  এ দিকে বাধ্যতামূলক ৮ম শ্রেণি পর্যন্ত প্রাথমিক শিক্ষা হলে এবং ঝরে পড়া বন্ধ করতে পারলে ৮ম শ্রেণি পাশ ছেলেমেয়েরা অনেক কিছু করতে পারে। শারীরিক দিক দিয়েও যথেষ্ট সামর্থ্যবান হয়ে উঠে। এখন রাষ্ট্র ও সমাজের কর্তব্য হলো ৮ম শ্রেণি পাশ এই বিপুল সংখ্যক ছাত্রছাত্রীর মধ্যে থেকে যোগ্যতরদের মাধ্যমিকে ভর্তির সুযোগ করে দেয়া এবং বাকিদের চতুর্থ শ্রেণীর চাকরি, ড্রাইভিং, কারিগরি যাবতীয় ট্রেড কোর্সে ভর্তির সুযোগ করে দেয়া। এর উদ্দেশ্য হল এদেরকে কোন একটি কারিগরি বিষয়ে দক্ষ করে গড়ে তোলা। দক্ষ শ্রমিকের মূল্য অদক্ষ শ্রমিকের চেয়ে অনেক বেশি। এ প্রসঙ্গে আমি পাঠকদের চীন সাংস্কৃতিক বিপ্লব (১৯৬৬ – ১৯৭৭) এর কথা স্মরণ করাতে চাই। এই বিপ্লবের ফল হিসেবে চীনে  উচ্চশিক্ষা সীমিত করে কারিগরি শিক্ষাকে বাধ্যতামূলক করা হয়েছে। এর সুফল চীন ভোগ করছে। 

কারিগরি শিক্ষা সংস্কার
চীনসহ  বিশ্বের যেসব দেশ কারিগরি শিক্ষাকে বেশি গুরুত্ব দিয়েছে, সেসব দেশ অর্থনৈতিকভাবে তত বেশি সমৃদ্ধ হয়েছে। দেশের সব শ্রেণির শিক্ষিত জনগোষ্ঠী সমন্বিত অর্থনৈতিক উন্নয়নে ভূমিকা রাখলেও এক্ষেত্রে অগ্রণী ভূমিকা পালন করে আসছে কারিগরি শিক্ষা। বিশেষ করে মধ্যমস্তরের কারিগরি শিক্ষা। কারিগরি শিক্ষায় শিক্ষিত জনগোষ্ঠীর সম্পৃক্ততার হারের ওপর গড় বাৎসরিক মাথাপিছু আয় নিবিড়ভাবে নির্ভরশীল। বিশ্বের বিভিন্ন দেশ, যেমন – অস্ট্রেলিয়া, চীন, জাপান, জার্মানি, দক্ষিণ কোরিয়া, ইন্দোনেশিয়া, সিঙ্গাপুর, মালয়েশিয়া, ফিলিপাইন কারিগরি শিক্ষার প্রতি গুরুত্বারোপ করায় আজ তারা উন্নত বিশ্বের কাতারে অবস্থান নিশ্চিত করেছে। ষাট থেকে সত্তর দশকে মালয়েশিয়ার শিক্ষার্থীরা প্রযুক্তি শিক্ষার জন্য ঢাকা পলিটেকনিক ইনস্টিটিউটে এসে ভর্তি হতেন। আর এখন আমাদের ছাত্রদের মালয়েশিয়ায় যেতে হয় তাদের দেশের প্রযুক্তি জ্ঞান অর্জনের জন্য। শিক্ষা ব্যবস্থা ঢেলে সাজিয়ে কারিগরি শিক্ষার হার বৃদ্ধি করার কারণেই তারা আজ উন্নত বিশ্বের কাতারে। আমাদের দেশে ১৯৫৫ সালে তৎকালীন ইস্ট পাকিস্তান পলিটেকনিক ইনস্টিটিউট (বর্তমান ঢাকা পলিটেকনিক ইনস্টিটিউট) প্রতিষ্ঠার মধ্য দিয়ে মধ্যম স্তরের প্রকৌশলী তথা ডিপ্লোমা প্রকৌশলী তৈরির স্বতন্ত্র শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের যাত্রা শুরু হয়। দীর্ঘ ৬৯ বছরে সরকারি ৫০টি এবং বেসরকারি পর্যায়ে প্রায় ৫ শতাধিক পলিটেকনিক ইনস্টিটিউট স্থাপিত হয়েছে। এর পাশাপাশি প্রতি জেলায় স্থাপিত সরকারি বৃত্তিমূলক শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান (টিএসসি) দক্ষ জনবল তৈরিতে ভূমিকা রাখছে। বর্তমানে কারিগরি শিক্ষার হার প্রায় ১৫-১৬ শতাংশ। বিগত সরকার এ হার ২০২০ সালের মধ্যে ২০ শতাংশে উন্নীত করার ঘোষণা দিয়েছিল। সে টার্গেট অর্জিত হয়নি। বিগত সরকার কারিগরি শিক্ষায় শিক্ষিতের হার ২০৩০ সালের মধ্যে ৩০ শতাংশ এবং ২০৪০ সালের মধ্যে ৫০ শতাংশে উন্নীত করার পরিকল্পনা গ্রহণ করেছিল। এটা খুবই আশাব্যঞ্জক হলেও কারিগরি শিক্ষা এখনো অবহেলিত। কারিগরি শিক্ষায় ৫০ শতাংশ ভর্তি বাধ্যতামূলক করতে হবে যেহেতু কারিগরি শিক্ষা গ্রহণে এখনো আমাদের দেশে আগ্রহ কম। সাধারণ ও কারিগরি শিক্ষা গ্রহণের অনুপাত নির্ধারণ হওয়া প্রয়োজন। অন্তর্বর্তী সরকার এ বিষয়ে সঠিক দিক নির্দেশনা প্রদান করবে বলে আমাদের বিশ্বাস। এখানে বাংলাদেশে কারিগরি শিক্ষার বর্তমান অবস্থার উপর সামান্য আলোকপাত করা দরকার। বর্তমানে শিক্ষা মন্ত্রণালয়ের অধীন কারিগরি ও মাদ্রাসা শিক্ষা বিভাগের অধীনে শের-ই-বাংলা নগরস্থ আগারগাঁও এ অবস্থিত কারিগরি শিক্ষা অধিদপ্তর। বাংলাদেশের একমাত্র কারিগরি শিক্ষা বোর্ডের অফিস এখানেই। কারিগরি শিক্ষা সম্প্রসারণ ও মানোন্নয়নের মাধ্যমে দক্ষ মানবসম্পদ সৃষ্টির লক্ষ্যে ১৯৬০ সালে এটি প্রতিষ্ঠিত হয়। এর অধীনে সরকারি কারিগরি শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের সংখ্যা মোট ২০০টি। এগুলোতে শিক্ষার স্তর মোট  ৩ টি। ১. ডিপ্লোমা ডিগ্রির নিচে ৬ মাস/ ১ বছর মেয়াদি ভোকেশনাল/ট্রেড কোর্স ২. পলিটেকনিক ইনস্টিটিউটে ডিপ্লোমা ইঞ্জিনিয়ারিং ও ৩। স্নাতক পর্যায়ে বিএসসি ইঞ্জিনিয়ারিং। এগুলোর মধ্যে সার্টিফিকেট পর্যায়ে ১৩৪ টি টেকনিক্যাল স্কুল ও কলেজ এবং ১ টি ভোকেশনাল টিচার্স ট্রেনিং ইনস্টিটিউট রয়েছে। এ ছাড়া ডিপ্লোমা পর্যায়ে ৫০টি পলিটেকনিক ইন্সটিটিউট এবং ডিগ্রি পর্যায়ে ৪ টি ইঞ্জিনিয়ারিং কলেজ রয়েছে। এগুলো ছাড়াও এই অধিদপ্তরের অধীনে কারিগরি শিক্ষা বোর্ড ২০২২-২৩ সালে সরকারি ও বেসরকারি মিলিয়ে সর্বমোট ১১,১১৮ টি কারিগরি শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের অনুমোদন দিয়েছে। এগুলোর মধ্যে সরকারি ৭৭৭টি ও বেসরকারি ১০,৩৪১টি। এগুলোর মোট আসন সংখ্যা হচ্ছে ১৩,৬৯,১০৫টি। ২০২২-২৩ সালে ভর্তি হয়েছে মোট ৬,৭৩,৫৯১ জন (সরকারি ৯৭,৯২৯ জন ও বেসরকারি ৫,৭৬,৬৬২ জন)। 

এ ছাড়া এই অধিদপ্তরের র অধীনে রয়েছে ‘জাতীয় কম্পিউটার প্রশিক্ষণ ও গবেষণা একাডেমি (নেকটার)। ১৯৮৪ সালে বগুড়া জেলার শাজাহানপুর উপজেলার জাহাঙ্গীরাবাদ সেনানিবাস সংলগ্ন নেকটার –এর কার্যক্রম শুরু হয়। এর মূল কাজ হচ্ছে – শিক্ষিত বেকার যুবক ও মহিলাদের কম্পিউটার প্রশিক্ষণের মাধ্যমে দক্ষ ও আত্নকর্মসংস্থান এবং অনলাইন মার্কেট প্লেসে কাজ করার উপযোগী করে গড়ে তোলা। এ ছাড়াও সরকারের নির্দেশ অনুযায়ী স্কুল, কলেজ, মাদ্রাসা ও কারিগরি প্রতিষ্ঠানের শিক্ষকদের জন্যে তথ্য প্রযুক্তি (আই সি টি) বিষয়ে প্রশিক্ষণ প্রদান করা। 

জাতীয় শিক্ষানীতি ২০১০-এ দেশে বৃত্তিমূলক ও কারিগরি শিক্ষা সম্প্রসারণে প্রতি জেলায় একটি করে সরকারি পলিটেকনিক ইনস্টিটিউট ও প্রতিটি উপজেলায় একটি করে বৃত্তিমূলক শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান স্থাপন, টেক্সটাইল ও লেদার ইনস্টিটিউটসহ এ ধরনের প্রতিষ্ঠানের সংখ্যা বৃদ্ধির কথা উল্লেখ করা হয়েছে। এ শিক্ষানীতিতে কারিগরি শিক্ষা বোর্ডকে অধিকতর শক্তিশালী করা ও প্রয়োজনীয় আর্থিক সংস্থান ও জনবল বৃদ্ধি, যোগ্য ও দক্ষ শিক্ষক-প্রশিক্ষক নিয়োগের অঙ্গীকার করা হলেও বাস্তব অগ্রগতি সামান্যই। প্রতিটি বিভাগে কারিগরি শিক্ষা বোর্ড হওয়া দরকার। একটি মাত্র কারিগরি শিক্ষা বোর্ডের পক্ষে বিপুল সংখ্যক কারিগরি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান তত্ত্বাবধান করা সম্ভব নয়। দেশে ৮টি সাধারণ শিক্ষা বোর্ড প্রতিষ্ঠা হলেও কারিগরি শিক্ষা বোর্ডের সংখ্যা ১টিই রয়ে গেছে। অর্থাৎ কারিগরি শিক্ষা উপেক্ষিতই রয়ে গেছে। উপরন্তু পরিকল্পনাহীনতার কারণেই দেশে এখন সরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ের সংখ্যা পঞ্চাশোর্ধ। জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয়ের অধীনে পরিচালিত প্রায় ৭০০ সরকারি-বেসরকারি কলেজে অনার্স-মাস্টার্স খোলা হয়েছে। বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ের সংখ্যা বাড়তে বাড়তে এখন ১১৫টি (জুন ২০২৩)। এসব উচ্চশিক্ষা প্রতিষ্ঠানে প্রতি বছর স্নাতক (পাস),স্নাতক (সম্মান) ও মাস্টার্স পর্যায়ে প্রায় ১০-১২ লাখ শিক্ষার্থী ভর্তি হন। প্রতি বছর এসব প্রতিষ্ঠান থেকে উচ্চ ডিগ্রি নিয়ে বেরিয়ে আসেন প্রায় ৭-৮ লাখ। কিন্তু এত বিপুলসংখ্যক উচ্চশিক্ষিত লোকবলের চাহিদা আমাদের শ্রমবাজারে নেই। সে কারণে প্রতি বছর প্রায় ৩-৫ লাখ উচ্চশিক্ষিত তরুণ-তরুণী বেকারের তালিকায় যুক্ত হচ্ছেন। তাই আমরা মনে করি ১.  স্নাতক ও স্নাতকোত্তর শিক্ষাকে সীমিত করে সনদনির্ভর দক্ষতাহীন শিক্ষিত মানুষের সংখ্যা হ্রাস করা। ২. প্রাথমিক (৮ম শ্রেণি পাশ) ও এসএসসি উত্তীর্ণ শিক্ষার্থীদের কমপক্ষে ৫০ শতাংশকে কারিগরি শিক্ষাগ্রহণ বাধ্যতামূলক করা। ৩. সাধারণ শিক্ষায় একাদশ শ্রেণির আসন সংখ্যা যৌক্তিক হারে সংকুচিত করে কারিগরি শিক্ষার আসন বৃদ্ধি করা এবং কোনো আসন যাতে খালি না থাকে তা নিশ্চিত করা। ৪. শুধু পরিমাণগত নয়, গুণগত মানও নিশ্চিত করা। ৫. বেসরকারি পর্যায়ে নতুন পলিটেকনিক ইনস্টিটিউট অনুমোদনের ক্ষেত্রে মান ও ইতোমধ্যে অনুমোদিত প্রতিষ্ঠানের সংখ্যা বিবেচনায় নিয়ে সিদ্ধান্ত নেয়া। ৬. প্রতিটি বিভাগে ১টি করে কারিগরি শিক্ষা বোর্ড স্থাপন করা। এবং ৭. শ্রম বাজারের চাহিদা নিরূপণ করে জাতীয় শিক্ষা ব্যবস্থাকে ঢেলে সাজানো।[বুয়েট, কুয়েট, চুয়েট, রুয়েট ও বুয়েট এই আলোচনার অন্তর্ভুক্ত নয়]। 

দক্ষ শ্রমিক বনাম অদক্ষ শ্রমিক
আমাদের ফরেন রিজার্ভের সিংহ ভাগ আসে বৈদেশিক রেমিট্যান্স থেকে। ২০২৩ ২৪ সালে গার্মেন্টস রফতানি থেকে এসেছে প্রায় ৫৬.০০ বিলিয়ন ডলার এবং বিদেশে কর্মরত ব্যক্তিগণ (প্রায় ১.৫০ কোটি) পাঠিয়েছেন প্রায় ২২ বিলিয়ন ডলার। এই ২২ বিলিয়নের মধ্যে বিভিন্ন দেশে কর্মরত শ্রমিকদের একটি অংশ রয়েছে। শ্রমিকরা আবার ২ ভাগে বিভক্ত। দক্ষ ও অদক্ষ শ্রমিক। দক্ষ শ্রমিকদের বেতন অদক্ষ শ্রমিকদের চেয়ে কয়েকগুণ বেশি। আমাদের কাছে যথেষ্ট পরিমাণ তথ্য ও উপাত্ত না থাকলেও এ কথা অভিজ্ঞতা, পর্যবেক্ষণ ও অনুমান থেকে বলা যায় যে,  বিদেশে কর্মরত বাংলাদেশি শ্রমিকদের অধিকাংশই অদক্ষ এবং সংগত কারণেই তাদের বেতন কম। ২.৫ কোটি জনসংখ্যার দেশ শ্রীলংকার মাত্র ৩০ লক্ষ মানুষ বিদেশে কাজ করেন।  কিন্তু ২০২২-২৩ সালে বিদেশে কর্মরত শ্রীলংকানদের প্রেরিত রেমিট্যান্সের পরিমাণ প্রায় ৫৫ বিলিয়ন ডলার যা আমাদের চেয়ে দ্বিগুণ এবং আমাদের গার্মেন্টস থেকে প্রাপ্ত রেমিট্যান্স এর কাছাকাছি।

সুতরাং একথা বলা বোধ হয় অযৌক্তিক হবে না যে, বিদেশে লোক প্রেরণ ও ফরেন রেমিট্যান্স অর্জনে শ্রীলঙ্কার নিকট থেকে আমাদের শিক্ষা গ্রহণের প্রয়োজন রয়েছে। কিভাবে মাত্র ৩০ লক্ষ লোক এক বছরে ৫৫ বিলিয়ন ডলার রেমিট্যান্স পাঠাতে পারে আর আমাদের ১.৫০ কোটি লোক পাঠায় মাত্র ২২.০০ বিলিয়ন? এদিক থেকে ভারতীয়, পাকিস্তানি এম কি নেপালি শ্রমিকরাও আমাদের চেয়ে এগিয়ে – প্রাপ্ত তথ্যাদি তাই সাক্ষ্য দেয়। তাই আমাদের দক্ষ শ্রমিক তৈরি, সরকারি সহযোগিতায় (প্রয়োজনে ঋণ দিয়ে) তাদের বিদেশ পাঠানোর ব্যবস্থা গ্রহণ করা যেতে পারে।  দেশের জনশক্তিকে পুঁজিবাজারে কাজে লাগানোর জন্য তাই  দরকার প্রাইমারি থেকে বিশ্ববিদ্যালয় পর্যন্ত শিক্ষাব্যবস্থাকে ঢেলে সাজানো এবং যথাসম্ভব মানসম্পন্ন বিশেষায়িত কলেজিয়েট কারিগরি শিক্ষার প্রসার। 

মাধ্যমিক শিক্ষা উন্নতকরণ
স্যাডলার কমিশনের রিপোর্টে দেখা যায়, এই কমিশন কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের বিভিন্ন সমস্যার পাশাপাশি তৎকালীন এতদঞ্চলের মাধ্যমিক শিক্ষার সমস্যার উপর আলোক পার করেছে। কারণ– কমিটির বিদগ্ধ সদস্যগণ উপলব্ধি করতে পেরেছিলেন যে, মাধ্যমিক তথা এন্ট্রান্স পাশের পর যারা কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি হন তাদের শিক্ষার গুণগত  মান অধোগামী। তাই তা কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার মানকে প্রশ্নবিদ্ধ করে।  শতবর্ষ পেরিয়ে গেলেও স্যাডলার  কমিশনের  সেই সুপারিশ বাংলাদেশের ক্ষেত্রে আজও প্রযোজ্য বলে মনে করি। যখন দেখা যায়, ঢাবি’র ভর্তি পরীক্ষায় শতকরা ৯০ জন ফেল করে তখন দেশে বিদ্যমান মাধ্যমিক শিক্ষার প্রতিই বিজ্ঞজনেরা অঙ্গুলি নির্দেশ করেন। ২০১০ সালের জাতীয় শিক্ষানীতিকে পাশ কাটিয়ে মাধ্যমিক শিক্ষার নতুন শিক্ষাক্রম, পাঠদান ও মূল্যায়ন পদ্ধতি মাধ্যমিক শিক্ষার গুণগত মানকে কতটা প্রশ্নবিদ্ধ করেছে শিক্ষাবিদ বিশেষজ্ঞ দিয়ে তা মূল্যায়ন করা অতি জরুরি। 

আলিয়া মাদ্রাসা ও কওমি মাদ্রাসা ছাত্রদের কী হবে?
আলিয়া মাদ্রাসা ও কওমি মাদ্রাসার শিক্ষাক্রম বিশ্ববিদ্যালয়ের মতই ১৬ বছরের এবং শেষ বছরগুলোতে বিশেষায়িত শিক্ষা প্রদান করা হয়ে থাকে। আলিয়া শিক্ষাব্যবস্থার আধুনিকায়ন করে এতে বিজ্ঞান ও বাণিজ্য শিক্ষা প্রবর্তন করা হয়েছে। দ্বাদশ শ্রেণি (আলিম) পাশ করে ছাত্রছাত্রীরা চিকিৎসা, প্রকৌশলসহ বিশ্ববিদ্যালয়ের স্নাতক শ্রেণীতে ভর্তি হতে পারে। অন্যদিকে কওমি মাদ্রাসার সিলেবাসেও গণিত, বিজ্ঞান ও ইংরেজি ভাষা শিক্ষাবিষয়ক পাঠক্রম চালু হয়েছে।  সুতরাং বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার মত এখানেও ঢালাওভাবে সবাইকে মাদ্রাসার উচ্চশিক্ষা (ডিগ্রি) নেয়ার প্রয়োজন নেই। কেবল তারাই মাদ্রাসার সর্বোচ্চ ডিগ্রি নেয়ার জন্যে বিবেচিত হবে যারা কর্তৃপক্ষের বিবেচনায় উপযুক্ত হবে। বাকিরা কারিগরি শিক্ষা গ্রহণ করে জীবন-জীবিকার সন্ধান করবেন। সাধারণ বিশ্ববিদ্যালয়ের মত মাদ্রাসার সর্বোচ্চ ডিগ্রি অর্জনও হবে সীমিত ও মেধাভিত্তিক।

বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ের ভূমিকা
নব্বইয়ের দশকের আগ পর্যন্ত বাংলাদেশ থেকে অনেক শিক্ষার্থী দেশীয় বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তির সুযোগ না পেয়ে আমাদের পার্শ্ববর্তী দেশগুলোয় পড়াশোনার জন্য চলে  যেত।  কিন্তু বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠার পর থেকে এ সংখ্যা প্রায় শূন্যের কোঠায় নেমে এসেছে। সুতরাং বাংলাদেশের অর্থনীতিতে বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ের অবদান অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। তবে বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়সমূহের ভর্তিও গুচ্ছ পরীক্ষার মাধ্যমে সীমিত হওয়া প্রয়োজন। যারা সত্যিকার অর্থে উচ্চশিক্ষা গ্রহণের যোগ্য কেবল তাদেরকেই ভর্তির অনুমোদন দেয়া উচিত। 

উপসংহার 
আর্থসামাজিক চ্যালেঞ্জ মোকাবেলা এবং অর্থনৈতিক উন্নতির প্রয়োজনে একটি দক্ষ ও উদ্ভাবনী সমাজ গড়ে তোলার স্বার্থে প্রাইভেট ও পাবলিক- উভয় বিশ্ববিদ্যালয়গুলোর উচিত ফলাফলভিত্তিক শিক্ষা (OBE) এবং ছাত্রকেন্দ্রিক শেখার (SCL) মডেলগুলো গ্রহণ করা। একটি দেশের মোট দেশজ উৎপাদনের (জিডিপি) ৬ শতাংশ শিক্ষা খাতে বরাদ্দ করা উচিত বলে শিক্ষাসংশ্লিষ্ট মহলের অভিমত; কিন্তু বাংলাদেশে শিক্ষা খাতে জিডিপির ২ শতাংশ ব্যয় হয়ে থাকে। অথচ পার্শ্ববর্তী দেশ ভারতে ব্যয় হয় জিডিপির ৩.৮ শতাংশ আর পাকিস্তানে ২.৬ শতাংশ। অর্থের হিসাবে ২০২৩-২০২৪ বছরের বাজেটে যে টাকা শিক্ষা খাতে বরাদ্দ করা হয়েছে, তা দক্ষিণ এশিয়ার দেশগুলোর মধ্যে সর্বনিম্ন। দেশের বিপুল সংখ্যক তরুণ  জনগোষ্ঠীকে কাজে লাগাতে হলে শিক্ষায় বিনিয়োগ বাড়াতে হবে। তাই শিক্ষায় বাজেট বরাদ্দ বৃদ্ধির বিষয়টি সরকার পুনর্বিবেচনা করবে বলে আমরা আশাবাদী। অর্থনৈতিক ও সামাজিক সূচকে বিগত বছরগুলোতে বাংলাদেশ বিস্ময়কর সাফল্য অর্জন করেছে।

আমরা আশা করি, শিক্ষাখাতে বরাদ্দ বাড়ালে টেকসই উন্নয়ন লক্ষ্যমাত্রা (এসডিজি) অর্জনের পথে বাংলাদেশ আরো এক ধাপ এগিয়ে যাবে। ফলে শিক্ষাখাতে ব্যয় জাতীয় আয়ের (জিডিপি) ২ দশমিক ৬ শতাংশ থেকে ৬ শতাংশে এবং জাতীয় বাজেটের বরাদ্দ ১১ দশমিক ৬০ শতাংশ থেকে বাড়িয়ে ২০ শতাংশে উন্নীত করা যেতে পারে।  আর অগ্রাধিকার ভিত্তিতে সর্বজনীন প্রাথমিক শিক্ষা (৮ম শ্রেণি পর্যন্ত) প্রবর্তন এবং সেখান থেকে ঝরে পড়া নিরোধের লক্ষে যাবতীয় সুযোগ সুবিধা বৃদ্ধিসহ  অবকাঠামোগত উন্নয়নে ব্যয় বাড়াতে হবে। 

সবশেষে বলবো, যেহেতু মানবসম্পদ উন্নয়নে উচ্চশিক্ষা গুরুত্বপূর্ণ সেহেতু মানসম্মত উচ্চশিক্ষা নিয়ে সবাইকে নতুন করে ভাবতে হবে। এই সমস্যাকে সর্বোচ্চ গুরুত্বারোপ করে সমাধানে সবাইকে এগিয়ে আসতে হবে। সেইসঙ্গে শিক্ষাখাতের দুর্নীতি বন্ধ ও যথাযথ ব্যবস্থাপনার পাশাপাশি শিক্ষাখাতের বাজেটের বড় অংশ সর্বজনীন প্রাথমিক শিক্ষা, মাধ্যমিক শিক্ষা এবং কারিগরি শিক্ষাখাতে  ব্যয় করতে হবে। তবেই জাতির জন্য একটা কাঙ্ক্ষিত ফল বয়ে আনতে পারে বলে আশা করা যায়। তাই বাংলাদেশে আপাতত আর কোন বিশ্ববিদ্যালয় স্থাপন না করে বিদ্যমানগুলোর গুণগত মান বৃদ্ধি ও কারিগরি শিক্ষার প্রতি সর্বাত্মক গুরুত্ব দেয়া প্রয়োজন বলে মনে করি।

লেখক: উপদেষ্টা, গ্রন্থাগার ও তথ্যবিজ্ঞান বিভাগ ও প্রক্টর, এশিয়ান ইউনিভার্সিটি অব বাংলাদেশ, আশুলিয়া এবং প্রাক্তন পরিচালক, বাংলাদেশ লোকপ্রশাসন প্রশিক্ষণ কেন্দ্র (বিপিএটিসি), সাভার, ঢাকা।
ই-মেইল: amatin@aub.ac.bd

 


সর্বশেষ সংবাদ