ব্রজমোহন কলেজের উদ্ভিদ উদ্যান ও শিক্ষকদের টেনিস কোর্ট
পঞ্চাশের দশকে দেখেছি যে ব্রজমোহন কলেজের মূল ভবনের পেছনে কে.পি. হলের পাশে, কলেজের পেছন ও কলেজ রোডের মাঝে অধ্যাপকদের জন্য দুটো টেনিস কোর্ট পাশাপাশি ছিল। তার একটিতে নবিশরা এবং অন্যটিতে আরো পরিশীলিত খেলোয়াড়রা খেলতেন। দুটি মাঠের মাঝখানে বেশকিছু বেতের চেয়ার ছিল অধ্যাপক-খেলোয়াড়দের জন্য।
মাঠে ঢোকার মুখে বাঁশের গেট ছিল, যা ঝুমকো লতায় ঢাকা ছিল। সে দিকটায় পুরোটা সাদা ও গোলাপি গোলাপ, বেল ফুল ও নানান মৌসুমি ফুলের সমাবেশ ছিল। নবিশদের মাঠের দিকটায়ও ফুলের বাগান ছিল। পরিশীলিত খেলোয়াড়দের মাঠের দিকটায় বড় বড় পাম গাছ, শিশু গাছ ছিল। বলা বাহুল্য, রাস্তা পেরিয়ে কে.পি. হলের সামনেও দুটি বড় পাম গাছ ছিল। সেখানে একটি সিমেন্টের বেঞ্চি ছিল, যেখান থেকে শিক্ষার্থীরা শিক্ষকদের খেলা দেখতে পারত। সেখানে একটি জলের কলও ছিল।
পঞ্চাশের দশকে এ দুটি কোর্টের মাঝখানে একটি ছোট মঞ্চ তৈরি করা হয়েছিল, যেখানে বরিশাল সাহিত্য সম্মেলনে আসা কবি গোলাম মোস্তফা ও শিল্পী আব্বাসউদ্দীন আহমেদ গান গেয়েছিলেন। ষাটের দশকে দুটি ব্যাপার ঘটেছিল। ১৯৬০ সালে পরিশীলিত খেলোয়াড়দের কোর্টটি সিমেন্টের করে হার্ড কোর্ট করে ফেলা হয়।
তার চেয়েও বড় কথা, ১৯৬০ সালে ব্রজমোহন কলেজকে সবুজায়নের যে প্রকল্প নিয়েছিলেন, তার অংশ হিসেবেই টেনিস কোর্টের পাশের বাগান দুটিতে অনেক নতুন গাছ লাগালেন নিসর্গ প্রেমিক প্রয়াত দ্বিজেন শর্মা। সেখানে বেশ কয়টি অ্যাকাশিয়া গাছের একটি আমাকে লাগাতে দিয়েছিলেন তিনি। একটি পাম গাছের ওপর তার তুলে দেয়া ভারি সুন্দর একটি নানা রঙের অর্কিডের ওপর বড় লোভ ছিল আমার। তিনিই প্রথম কলেজ রোড ও কোর্টের মধ্যকার জায়গায় একটি গ্রিনহাউজ গড়ে তোলেন। বলে নেয়া ভালো যে অধ্যাপক শর্মাও নিয়মিত টেনিস খেলতেন সেখানে এবং ভারি আজব এক কনুই ভাঙা সার্ভ ছিল তার।
কাদের খেলতে দেখেছি সে দুটি কোর্টে? পঞ্চাশের দশকে সর্বঅধ্যাপক দেবেন্দ্রনাথ চ্যাটার্জি (ডিএনসি), দেব কুমার বোস (ডিকেবি), কাজী গোলাম কাদের (কেজিকে), আমিনুল ইসলাম মজুমদার, বাকের আলী মিয়া, নূরুল হুদা, মোহাম্মদ হোসেন, কাজী আইয়ুব আলী, সৈয়দ মোয়াজ্জেম হোসেন, মুজাফ্ফর হোসেন, কাজী আইয়ুব আলী এবং অন্যদের। ১৯৫৯-৬০ সালে দুরন্ত খেলতেন অধ্যক্ষ কবীর চৌধুরী। এর সঙ্গে ষাটের দশকে যুক্ত হলেন সর্বঅধ্যাপক ফজলুল হক, শরীফ নূরুল হুদা, মোহাম্মদ হানিফ, শামসুল হক, শামসুল ইসলাম, আসাদুজ্জামান, শামসুদ্দীন আহমেদ ও অন্যরা।
এত সব জানি কী করে? ব্রজমোহন কলেজের অধ্যাপক পিতার কারণে। পঞ্চাশের দশকে নবিশি কোর্টে মাঝে মাঝে খেলতেন তিনি। কিন্তু মূলত যেতেন বন্ধু-সহকর্মীদের সঙ্গে গল্প করতে। প্রায়ই সঙ্গে নিয়ে যেতেন আমাকে। আসত অন্য অধ্যাপকদের সন্তানরাও। বড়দের খেলা হয়ে গেলে ঘনায়মান অন্ধকারে যখন বড়রা গল্প করতেন তখন আমরা খেলতাম টুক টুক করে। প্রথম কৈশোরেও এটা করেছি।
কিন্তু যখন কলেজে পড়ছি তখন মাঝে মাঝে কে.পি. হলে ক্লাস শেষ করে তার বারান্দায় দাঁড়িয়ে অধ্যাপকদের খেলা দেখতাম। তারপর যখন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়তে চলে গেলাম তখন সলিমুল্লাহ হলের কোর্টে প্রচুর টেনিস খেলেছি। ছুটিছাটায় বরিশাল গেলে টেনিস পেটাতাম মূলত অধ্যাপক মোহাম্মদ হানিফের সঙ্গে। মা-বাবার পুত্রসম তাকে আমরা ভাইবোনেরা হানিফ ভাই বলেই ডাকতাম। আশির দশকে যখন বিশ্ববিদ্যালয় অধ্যাপক হিসেবে বহিরাগত পরীক্ষক হয়ে বরিশাল গিয়েছি তখন খেলেছি বাবার বন্ধু-সহকর্মীদের সঙ্গে, যাদের একসময় শ্রদ্ধাভরে নিরাপদ দূরত্বে রেখেছি।
শেষের কথা চুপি চুপি বলি। ব্রজমোহন কলেজের টেনিস কোর্টের আশপাশের এতসব ফুলের কথা জানি কী করে? কারণ তারা নানা সময়ে আমার চৌর্যবৃত্তির শিকার হয়েছে যে। ভাগ্যিস, অধ্যাপক দ্বিজেন শর্মা বেঁচে নেই। থাকলে তার কানমলা থেকে বাঁচতে পারতাম না সম্ভবত, এমনকি এ বয়সেও।
‘কাল রাতের বেলা গান এলো মোর মনে’— তেমনি বরিশাল ব্রজমোহন কলেজের অধ্যাপকদের টেনিস কোর্টের স্মৃতির বৈঠা ছলাৎ করে উঠেছিল আমার মনের জলে। উঁহু, এমনি এমনি সে স্মৃতির চর জেগে ওঠেনি আমার হূদয়নদীতে। সে চরের পলি জমে উঠছিল সাম্প্রতিক সময়ের এক সংবাদের কারণে— ব্রজমোহন কলেজের শিক্ষকরা নিজেদের জন্য একটি টেনিস কোর্ট বানাতে চান। কিন্তু মুশকিল হচ্ছে, কাজটি করার জন্য তারা যে জায়গা নির্বাচন করেছেন, তা কলেজের উদ্ভিদ উদ্যানের; যেখানে বেশকিছু দুষ্প্রাপ্য বৃক্ষ আছে।
ফলে যা হওয়ার তা-ই হয়েছে। শিক্ষকদের এ সিদ্ধান্তের বিরুদ্ধে প্রতিবাদের ঝড় উঠেছে। মানববন্ধন গড়ে উঠেছে তাদের এ নির্বাচনের বিপরীতে। নিন্দিত হয়েছেন তারা। আমার স্মৃতিমূলক লেখাটি হয়তো পুরো বিষয়টিকে একটি বস্তুনিষ্ঠ প্রেক্ষিত প্রদানে সাহায্য করবে, ফলে সমস্যাটির একটি সুচিন্তিত সমাধান খুঁজে বের করা যাবে।
আমার প্রথম জানার বিষয়, এত স্থান থাকতে অধ্যাপকরা উদ্ভিদ উদ্যানটিই বেছে নিলেন কেন তাদের খেলার জায়গা হিসেবে। আমরা জানি, উদ্ভিদ উদ্যানটি গড়ে উঠেছে বহুদিন ধরে অব্যবহূত পুরনো টেনিস কোর্টের ওপর। সে উদ্যানের ভিত্তি ভূমিতে খুঁজলে হয়তো সিমেন্টের ওই কোর্টটির ভিত্তি খুঁজে পাওয়া যাবে। তাই কি অধ্যাপকরা ভেবেছেন, যেহেতু টেনিস কোর্টের পুরনো ভিত্তিটি সেখানেই আছে, সেটা খুঁজে পেতে সেখানেই আবার টেনিস কোর্টটি গড়ে তোলা যাক না!
এটা যদি তাদের ভাবনার যুক্তি হয়, তাহলে বলতেই হবে যে তাদের ভাবনাটা একপেশে। নতুন কোর্ট গড়ে তোলার অত্যুৎসাহে তারা বিস্মৃত হয়েছেন যে সেখানে কলেজের উদ্ভিদ উদ্যানটি অবস্থিত।
আমার দ্বিতীয় জানার বিষয়, আমি বর্তমান উদ্ভিদ উদ্যানটি দেখিনি কিন্তু আমি নিসর্গ প্রেমিক প্রয়াত অধ্যাপক দ্বিজেন শর্মার তৈরি হরিত্কক্ষটি দেখেছি। বলতে কি, বালক আমি তার পায়ে পায়ে ঘুরেছি সেটি গড়ে ওঠার কালে। হরিত্কক্ষটির প্রতি আমার দুর্বলতা আছে। তাই জানতে চাই, কলেজ রোডের দেয়াল ঘেঁষে তৈরি সেটির কী হাল, নাকি তাও সংযুক্ত হয়ে গেছে উদ্ভিদ উদ্যানের সঙ্গে কিংবা তার ওপরই ভিত্তি করে গড়ে উঠেছে কলেজের বর্তমান উদ্ভিদ উদ্যানটি? বড় জানতে ইচ্ছে করে!
সবকিছু ভেবেচিন্তে কয়েকটি কথা বলি। প্রীত হয়েছি খুব যে কলেজের অধ্যাপকরা টেনিস খেলতে চেয়েছেন। শিক্ষকদের মস্তিষ্কের জন্য শরীরচর্চা খুব প্রয়োজন। সেই সঙ্গে এটা ভেবেও ভালো লেগেছে যে এর ফলে একটি পুরনো ঐতিহ্য আবার ফিরে আসবে। স্মৃতি সুরভি বলে তো একটি কথা আছে, তাই না?
সুতরাং আমরা সবাই চাই ব্রজমোহন কলেজের অধ্যাপকদের জন্য একটা টেনিস কোর্ট গড়ে উঠুক। কিন্তু সেটা কলেজের উদ্ভিদ উদ্যান নষ্ট করে নয়; প্রয়োজনও তো তার নেই। বিশাল জায়গা ব্রজমোহন কলেজের। তার যেকোনো একটি সুনন্দ জায়গায় নতুন টেনিস কোর্টটি গড়ে উঠুক না! একটি সুন্দর উদ্ভিদ উদ্যান কেন নষ্ট করতে হবে? কেন নষ্ট করতে হবে সবুজায়ন ও পরিবেশ? সবকিছুর মধ্যে সুষম ভারসাম্য রক্ষা করেও তো আমরা যা চাই তা পেতে পারি। সেই সঙ্গে উদ্ভিদ উদ্যানটিকে আরো সুন্দর ও সম্পদশালী কি করা যায় না? পুরনো বৃক্ষগুলোর আরো সযত্ন পরিচর্যা করা যেতে পারে। নতুন নতুন বৃক্ষমুখ সংযোজিত হতে পারে পুরনোদের সঙ্গে। সব মিলিয়ে আত্মপ্রকাশ করতে পারে সুন্দরতর একটি উদ্ভিদ উদ্যান। সেখানে বাতাসের সঙ্গে গাছেরা যখন এক পাশ থেকে অন্য পাশে শাখা দোলাবে তখন টেনিস মাঠে খেলারত অধ্যাপকদের মনে হবে— দুদিকে মাথা দুলিয়ে বৃক্ষরা তাদের খেলাটাই উপভোগ করছে।
লেখক: নিউইয়র্কে জাতিসংঘ উন্নয়ন কর্মসূচির (ইউএনডিপি) মানব উন্নয়ন প্রতিবেদন কার্যালয়ের সাবেক পরিচালক