নিবন্ধিত শিক্ষকদের আহাজারি কে শুনবে?
বেসরকারি শিক্ষক নিবন্ধন ও প্রত্যয়ন কর্তৃপক্ষ (এনটিআরসিএ) প্রতিষ্ঠার পর থেকে ১৪টি শিক্ষক নিবন্ধন পরীক্ষা সম্পন্ন করেন। গত ২৬ ডিসেম্বর পঞ্চদশ শিক্ষক নিবন্ধনের আবেদন সময়সীমা শেষ হয়। মহামান্য হাইকোর্টের নির্দেশনায় প্রতিষ্ঠানটি সম্মিলিত মেধাতালিকা প্রকাশ করে। এ তালিকা অনুসারে প্রায় ছয় লাখ নিবন্ধিত শিক্ষক আছেন। ২০১৬ সালে এনটিআরসিএ-র ওপর নিয়োগ ক্ষমতা ন্যস্ত হওয়ায় মেধাবী, মানসম্মত শিক্ষকের চাহিদা পূরণের দ্বার উন্মোচিত হয়। কিন্তু সাম্প্রতিক কার্যক্রমে সনদপ্রাপ্তদের সেই প্রত্যাশা পূরণ হবে বলে মনে হচ্ছে না। এক থেকে দ্বাদশ শিক্ষক নিবন্ধন পরীক্ষা একইভাবে সম্পন্ন হলেও ত্রয়োদশ এবং চতুর্দশ পরীক্ষা বিসিএসের আদলে নেওয়া হয়।
উল্লেখ্য, দ্বাদশ নিবন্ধন ফলাফলের পর নিয়োগের উদ্দেশ্যে উপজেলাভিত্তিক একটি মেধাতালিকা করা হয়েছিল। যা হোক, মহামান্য হাইকোর্ট গত বছরের ১৪ ডিসেম্বর ১৬৬টি রিটের চূড়ান্ত রায়ে ১-১২তম শিক্ষক নিবন্ধিতদের জাতীয় মেধা তালিকা করার নির্দেশ প্রদান করেন। কিন্তু প্রতিষ্ঠানটি ত্রয়োদশ ও চতুর্দশ শিক্ষক নিবন্ধিতদের ঐ মেধা তালিকায় যুক্ত করে এক ঢিলে দুই পাখি শিকার করতে যাচ্ছে। অন্যদিকে ১-১৪তম নিবন্ধিতদের গণবিজ্ঞপ্তি কিংবা নিয়োগ সুপারিশ সম্পন্ন না করেই পঞ্চদশ শিক্ষক নিবন্ধনের বিজ্ঞপ্তি প্রকাশ করা হয়েছে। ঐ বিজ্ঞপ্তিতে অনুসারে পঁয়ত্রিশোর্ধ প্রার্থীরা শিক্ষক নিবন্ধনে আবেদনসহ পরীক্ষায় অবতীর্ণ হয়ে সনদ অর্জন করবেন কিন্তু এমপিও নীতিমালা অনুসারে গণবিজ্ঞপ্তিতে আবেদন কিংবা পরবর্তীকালে এমপিওভুক্ত হতে পারবেন না। একজন পঁয়ত্রিশোর্ধ প্রার্থী যদি সনদ অর্জন করে গণবিজ্ঞপ্তিতে আবেদন করার সুযোগ না পান কিংবা নিয়োগ পেয়েও এমপিওভুক্ত না হতে পারেন তাহলে তার এই সনদের মূল্য কী?
এদিকে শিক্ষক নিয়োগের গণবিজ্ঞপ্তিতে প্রতিষ্ঠান প্রতি ১৮০ টাকা ফি নেওয়া হচ্ছে। উল্লিখিত ফি একবারই প্রযোজ্য হলে কোনো কথা ছিল না। কিন্তু একজন প্রার্থীকে একাধিক প্রতিষ্ঠানে আবেদন করতে গুনতে হচ্ছে হাজার হাজার টাকা। এরপরও চাকরি নিশ্চিত নয়। এ বিষয়ে এনটিআরসিএ চেয়ারম্যান একটি বিশেষ নোটিশে উল্লেখ করেন যে, বিসিএস পরীক্ষায় একজন প্রার্থীকে ৮০০-১০০০ টাকা ফি দিয়ে আবেদন করতে হয়। এতে বেকারদের অভিযোগ থাকবে না যদি মেধা তালিকার ভিত্তিতে নিয়োগ হয়। প্রশ্ন হচ্ছে, সম্মিলিত জাতীয় মেধা তালিকা থাকা সত্ত্বেও কেন নিবন্ধন সনদপ্রাপ্তদের একাধিক আবেদন করতে হবে? কেন তারা ১০০-২০০ প্রতিষ্ঠানে আবেদন করতে বিশ থেকে চল্লিশ হাজার টাকা খরচ করবেন? বিষয়টি স্বভাবতই জুয়া খেলার মতো!
এখানে উল্লেখ্য, মহামান্য হাইকোর্ট ২০১৬ সালে করা ১৬৬ রিটের চূড়ান্ত শুনানিতে সরকার এবং এনটিআরসিএ-কে সাতটি নির্দেশনা দেন। চূড়ান্ত রায়ের এক নম্বর পয়েন্টে শিক্ষক নিবন্ধিতদের নিয়োগ না হওয়া পর্যন্ত সনদের মেয়াদ বহাল থাকার কথা বলেছেন। দুই নম্বর পয়েন্টে রায়ের নব্বই দিনের মধ্যে একটি মেধা তালিকা করার নির্দেশ দিয়েছেন যাতে আবেদনকারীরা তাঁদের মেধাতালিকা এবং পজিশন দেখতে পাবেন। তিন নম্বর পয়েন্টে বেসরকারি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে শিক্ষক নিয়োগ সুপারিশের উদ্দেশ্যে একটি সম্মিলিত জাতীয় মেধা তালিকা করতে বলা হয়েছে যা উপজেলা, জেলা কিংবা বিভাগভিত্তিক হবে না। রায়ের চার নম্বর পয়েন্টে সর্বশেষ একটি নিয়োগ সম্পন্ন করে বছরে একবার সম্মিলিত মেধা তালিকা আপডেট করতে এনটিআরসিএকে নির্দেশ দেওয়া হয়েছে। পাঁচ নম্বর পয়েন্টে জাতীয় মেধাতালিকা অনুসারে রিট পিটিশনার এবং প্রত্যাশিত আবেদনকারীদের নাম যাদের সনদ ইস্যু করা হয়েছে, বেসরকারি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে নিয়োগ দেওয়ার জন্য প্রস্তাব/সুপারিশ করতে নির্দেশ দিয়েছেন এবং নিয়োগের পর শিক্ষা মন্ত্রণালয় কিংবা শিক্ষাবোর্ড নিয়োগকৃত শিক্ষকদের আবেদনে নিজ এলাকার প্রতিষ্ঠানে বদলি করার অনুমতি দিতে পারেন। ছয় নম্বর পয়েন্টে শিক্ষক নিয়োগ সুপারিশ পাওয়ার ৬০ দিনের মধ্যে ব্যবস্থাপনা কমিটি বা পরিচালনা পর্ষদ কার্যকর না করলে সংশ্লিষ্ট শিক্ষাবোর্ড ঐ কমিটিকে ভেঙে দেবেন এবং ঐ প্রতিষ্ঠানের ব্যাপারে আইনগত ব্যবস্থা নেবেন। সর্বশেষ সাত নম্বর পয়েন্টে বলা হয়, চাকরির এন্ট্রি প্রসেসে যেহেতু কোনো বয়স নির্ধারণ নেই সেহেতু বেসরকারি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে নিয়োগের উদ্দেশ্যে প্রার্থীদের বয়সসীমা করতে সরকারের একটি জরুরি পদক্ষেপ নেওয়া উচিত।
মহামান্য হাইকোর্টের নির্দেশনা মানতে হলে সাতটি নির্দেশনাই পুরোপুরি মানা দরকার। সাতটি নির্দেশনার মধ্যে কোনো বিচার-প্রার্থী বঞ্চিত হলে আদালত অবমাননা হবে। বিষয়টি শিক্ষা মন্ত্রণালয় এবং এনটিআরসিএ চেয়ারম্যানের উপলব্ধি করে আশু পদক্ষেপ নেওয়া দরকার।