কিন্ডারগার্টেন ও ইংলিশ মিডিয়াম স্কুল বনাম দেশের শিক্ষার মান
আমাদের দেশের শিক্ষাব্যবস্থা নিয়ে আলোচনা-সমালোচনা দীর্ঘদিনের। প্রচলিত শিক্ষাপদ্ধতি ও ধরন নিয়ে আপত্তি রয়েছে অনেক আগে থেকেই। অবশ্য এর পক্ষে থাকা মানুষও নেহাত কম নয়। সব মিলিয়ে শিক্ষাব্যবস্থায় বিশৃঙ্খলা চলছে দীর্ঘদিন ধরেই, তা বলা চলে। অনেক বেশি পরীক্ষা-নিরীক্ষা ও পরিবর্তনের কারণে শিক্ষাব্যবস্থা নিয়ে আলোচনা-সমালোচনা অনেক হয়েছে, এখনও চলছে। এতে সাধারণ শিক্ষার্থী ও অভিভাবকদের ভোগান্তি যেমন বাড়ছে, শিক্ষার মান নিয়েও প্রশ্ন তোলারও পথ তৈরি হয়েছে। প্রায় এক দশক ধরে জিপিএ ব্যবস্থা নিয়েই সম্ভবত সবচেয়ে বেশি আলোচনা হয়েছে। এক বছরের তুলনায় আরেক বছরের জিপিএ ৫ প্রাপ্তির সংখ্যায় বেশ পার্থক্য চোখে পড়েছে। পাসের হারের ক্ষেত্রেও অনেক তারতম্য দেখা গেছে। এর বাইরে বেসরকারি পর্যায়ে গড়ে ওঠা শিক্ষাব্যবস্থা নিয়ে সমালোচনার পরিমাণই বেশি।
আমাদের শিক্ষাব্যবস্থা কিছু অসাধু ব্যবসায়ীর চক্রে পড়ে গেছে, এ কথা বললে সম্ভবত ভুল হবে না। প্রায় শতাধিক বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয় গড়ে উঠেছে এদেশে। এসব বিশ্ববিদ্যালয়ের অধিকাংশেরই শিক্ষার নিম্নমান ও অবৈধ ব্যবসা নিয়ে তো অভিযোগের অভাব নেই। এত বিশ্ববিদ্যালয় এদেশের প্রেক্ষাপটে প্রয়োজন আছে কি না, সে প্রশ্নও তোলা যেতে পারে। এর বাইরে প্রাথমিক থেকে উচ্চ মাধ্যমিক পর্যন্ত বেসরকারি পর্যায়ে বিভিন্ন ধরনের অসংখ্য শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান গড়ে উঠেছে। প্রতিষ্ঠানগুলোর শিক্ষাদান পদ্ধতি এবং মান নিয়ে অভিযোগও অনেক। এর মধ্যে কিন্ডারগার্টেন ও ইংলিশ মিডিয়াম নামে ব্যাঙের ছাতার মতো গড়ে ওঠা কিছু প্রতিষ্ঠান শিক্ষাব্যবস্থায় উদ্বেগ আরও বাড়াচ্ছে বৈকি। তবে এর মধ্যে কিছু প্রতিষ্ঠান মানসম্মত শিক্ষা দিচ্ছে, তাও কিন্তু অস্বীকার করার সুযোগ নেই। হতাশাজনক ব্যাপার হলো, এ ধরনের প্রতিষ্ঠান হাতেগোনা এবং তার বেশিরভাগই শহরকেন্দ্রিক।
চলতি শতাব্দীর শুরুর দশকে কিংবা আরও কয়েক বছর আগে কিন্ডারগার্টেন কিংবা ইংলিশ মিডিয়াম শিক্ষাব্যবস্থা ছিল অনেকের কাছেই অপরিচিত। মূলত সরকারি প্রাইমারি, হাইস্কুল, কলেজ কিংবা মাদ্রাসা ছিল সব শ্রেণি-পেশার মানুষের সন্তানদের লেখাপড়া করানোর মূল অবলম্বন। তবে তখনও কিন্ডারগার্টেন কিংবা ইংলিশ মিডিয়ামের মতো কিছু প্রতিষ্ঠান গড়ে উঠলেও সেগুলো ছিল অনেকটা শহরকেন্দ্রিক। এছাড়া ওইসব শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের শিক্ষার মানও ছিল সবচেয়ে ভালো। মূলত ধনী শ্রেণির সন্তানেরাই এ ধরনের প্রতিষ্ঠানগুলোতে পড়াশোনা করত। সাধারণ নিম্নআয়ের মানুষ এসব প্রতিষ্ঠানে সন্তানদের ভর্তি করাতেন না বললেও চলে। সব মিলিয়ে সে সময় কিন্ডারগার্টেন ও ইংলিশ মিডিয়াম স্কুলকে অনেকটা অভিজাত শ্রেণির শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান হিসেবেই বিবেচনা করা হতো।
তবে মাত্র এক দশকের ব্যবধানে কিন্ডারগার্টেন ও ইংলিশ মিডিয়াম স্কুলের এ অবস্থান বদলেছে অনেক। শুধু শহরেই নয়, এখন প্রত্যন্ত গ্রামেও এ ধরনের শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের দেখা মিলছে। শুধু তাই নয়, থানা কিংবা ছোট শহরগুলোতে বেশ একাধিক প্রতিষ্ঠান গড়ে উঠতে দেখা গেছে। যাদের ন্যূনতম অর্থ খরচ করার সামর্থ্য আছে তারা তাদের সন্তানকে এ ধরনের শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে ভর্তি করাচ্ছেন। তাদের উদ্দেশ্যই হলো, টাকা খরচ করে হলেও সন্তানকে সুশিক্ষিত ও মানুষের মতো মানুষ করে তোলা। এককথায় বলা চলে, কিন্ডারগার্টেন ও ইংলিশ মিডিয়াম শিক্ষা নিয়ে সাধারণ মানুষের প্রত্যাশা অনেক বেশি।
কিন্ডারগার্টেন ও ইংলিশ মিডিয়াম নিয়ে সাধারণ মানুষের যে প্রত্যাশা, বাস্তবে তা কতটা প্রতিফলিত হচ্ছে? এ প্রশ্নের উত্তর খুঁজতে যাওয়ার আগে বর্তমানের এ ধরনের স্কুলগুলোর শিক্ষার মান ও আনুষঙ্গিক অন্য বিষয়গুলো সম্পর্কে জানা দরকার। প্রাথমিক শিক্ষাব্যবস্থায় তথা প্রাক-প্রাথমিক স্কুল চালুর ক্ষেত্রে যোগ্য ও অভিজ্ঞ শিক্ষকমণ্ডলী নিয়োগ, শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের আশপাশে পর্যাপ্ত ও উন্মুক্ত খেলার মাঠের ব্যবস্থা এবং অভিভাবকদের মধ্যে সচেতনতা বাড়ানোর প্রতি গুরুত্ব দেওয়া হয়। আর প্রাথমিক শিক্ষার লক্ষ্য হচ্ছে, বিনোদনমূলক প্রাক-প্রাথমিক শিক্ষার মাধ্যমে শিক্ষার প্রতি ঝোঁক তৈরি করা। শিক্ষার্থীকে মানসিক ও শারীরিকভাবে প্রস্তুত করা, কৌশলগতভাবে শিশুদের মাঝে সামাজিকীকরণ শিক্ষাদান, শিশুদের নাচ, গান, আবৃত্তি, চিত্রাঙ্কন, গল্প বলা, গণনা ও বর্ণমালা শিক্ষার ক্ষেত্রে দক্ষতা এবং আত্মবিশ্বাস তৈরির মাধ্যমে শিক্ষার্থীর মন থেকে বই ও স্কুলভীতি দূর করা। গণস্বাক্ষরতা অভিযান ও এডুকেশন ওয়াচের প্রতিবেদনেও শিশুশিক্ষায় এসব বিষয়কে অত্যধিক গুরুত্ব দেওয়া হয়েছে।
এখনকার কিন্ডারগার্টেন ও ইংলিশ মিডিয়ামগুলোর শিক্ষার মান ও সার্বিক ব্যবস্থার ক্ষেত্রে কী দেখা যায়? কিছু স্থানে দেখা যাচ্ছে, একটিমাত্র ভবনে সম্পূর্ণ একটি স্কুলের শিক্ষা কার্যক্রম পরিচালনা করা হচ্ছে। দুর্বল অবকাঠামোর পাশাপাশি খেলাধুলার জন্য কোনো মাঠও নেই। কিছু শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে ইনডোর কিছু খেলাধুলার ব্যবস্থা থাকলেও তা শিশুর বিকাশের জন্য পর্যাপ্ত নয়, এটা যে কেউ বলে দিতে পারবেন। এছাড়া এক্সট্রা কারিকুলার অ্যাকটিভিটিস বলে যে একটি ব্যাপার রয়েছে, তা এসব প্রতিষ্ঠানে মানা হয় না বলতে গেলেই চলে। সব মিলিয়ে কিন্ডারগার্টেন ও ইংলিশ মিডিয়াম স্কুলের শিক্ষাব্যবস্থা মানের দিক থেকে যে এখনও অনেক পিছিয়ে, তা বলে না দিলেও চলে। কিছু প্রতিষ্ঠানে শিক্ষার মান ভালো হলেও অন্য সুযোগ-সুবিধা কম।
কিছু গণমাধ্যমের খবর অনুযায়ী, কিন্ডারগার্টেন ও ইংলিশ মিডিয়াম স্কুলের শিক্ষকদের দক্ষতা ও যোগ্যতা নিয়েও প্রশ্ন রয়েছে। এমনকি তাদের নিয়োগের পর তেমন কোনো প্রশিক্ষণের ব্যবস্থাও করা হয় না। এভাবে গ্রাম থেকে শহরের অলিগলিতে গড়ে উঠছে বিভিন্ন নামের শিশু শিক্ষালয়। চটকদার বিজ্ঞাপন দিয়ে সাইনবোর্ড টানিয়ে ছাত্রছাত্রী ভর্তি করা হচ্ছে। আর অভিভাবকদের কাছ থেকে হাতিয়ে নেওয়া হচ্ছে মোটা অঙ্কের অর্থ। অর্থাৎ মানসম্মত শিক্ষার চেয়ে এ ধরনের প্রতিষ্ঠানে বাণিজ্যই বেশি প্রাধান্য পাচ্ছে।
বাণিজ্যিক উদ্দেশ্যে গড়ে তোলা এ শিক্ষাব্যবস্থায় শিক্ষার মান তো ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছেই, শিশুকাল থেকেই ছাত্রছাত্রীদের স্বাভাবিক বিকাশও বাধাগ্রস্ত হচ্ছে বৈকি। অথচ এভাবে বিভিন্ন চক্র হাতিয়ে নিচ্ছে বিপুল অঙ্কের অর্থ। হতাশাজনক ব্যাপার হলো, সবমহল এ বিষয়ে অবগত থাকলেও শিক্ষাব্যবস্থায় এ ধরনের বিশৃঙ্খলা ও অনিয়মের অবসান হচ্ছে না। ফলে সার্বিকভাবে শিক্ষাব্যবস্থায় ঝুঁকি ক্রমেই বাড়ছে, যার অবসান হওয়া জরুরি। এক্ষেত্রে সরকারের সংশ্লিষ্ট মন্ত্রণালয় ও দফতর বিশেষ করে প্রাথমিক ও গণশিক্ষা মন্ত্রণালয়ের বড় ভূমিকা রাখা জরুরি। স্থানীয় প্রশাসনেরও শিক্ষার মান ও ছাত্রছাত্রীদের মানসম্মত শিক্ষা নিশ্চিতে আরও তৎপর হওয়ার প্রয়োজনীয়তা রয়েছে।
একটি জেলায় কিন্ডারগার্টেন ও ইংলিশ মিডিয়াম শিক্ষাব্যবস্থা নিয়ে গণমাধ্যমে প্রকাশিত খবরে বলা হচ্ছে, চট্টগ্রাম বিভাগের ওই জেলাটিতে শিশুশিক্ষার নামে অবাধে বাণিজ্য ও প্রতারণা চলছে। অনুমোদনহীন কিছু প্রতিষ্ঠান গড়ে তুলে অভিভাবকদের কাছ থেকে মোটা অঙ্কের টাকা হাতিয়ে নেওয়া হচ্ছে। এমনকি অধিকাংশ প্রতিষ্ঠানেই প্রশিক্ষিত শিক্ষক, ভালো অবকাঠামো ও খেলার মাঠ নেই। অথচ যেকোন শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে এ ধরনের সুযোগ-সুবিধা থাকাকে মৌলিক ব্যাপার বলা চলে। কিন্তু এগুলো না থাকলে সেখানে শিক্ষার মান কোন পর্যায়ে পৌঁছাবে তা সহজেই অনুমেয়। শুধু ওই জেলাতেই নয়, এ ধরনের মানহীন বাণিজ্যিক শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান কিন্তু সারা দেশেই গড়ে উঠেছে।
বাণিজ্যিক উদ্দেশ্যে এ ধরনের শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান গড়ে তোলার ক্ষেত্রে প্রায়ই প্রভাবশালী মহলের সংশ্লিষ্টতা দেখা যায়। ফলে প্রশাসন চাইলেও তাদের বিরুদ্ধে কার্যকর ব্যবস্থা নিতে পারে না। এমনকি কিছু ক্ষেত্রে সংশ্লিষ্ট সরকারি কর্মকর্তাদের হয়রানির শিকার হওয়ার অভিযোগও রয়েছে। আবার আগে থেকেই আমাদের সরকারি দফতরগুলোতেও অনিয়ম ও দুর্নীতির অভিযোগ ব্যাপক। ফলে কিন্ডারগার্টেন ও ইংলিশ মিডিয়াম চালাতেও দুর্নীতির বিষয়গুলো কিন্তু উড়িয়ে দেওয়া যায় না। সার্বিকভাবে বলা চলে বিভিন্ন পক্ষের যোগসাজশে এ ধরনের মানহীন শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের সংখ্যা ক্রমেই বাড়ছে। এর অবসান হওয়া জরুরি।
এ ধরনের প্রতিষ্ঠানের শিক্ষার মান নিয়ে প্রশ্ন ওঠায় এগুলো যে বন্ধ করে দিতে হবে, ব্যাপারটা কিন্তু তা নয়। কারণ বিপুল পরিমাণ ছাত্রছাত্রীর শিক্ষার মান নিশ্চিতে এ ধরনের প্রতিষ্ঠানের প্রয়োজনীয়তা রয়েছে। গুরুত্বপূর্ণ ব্যাপার হলো, এ ধরনের প্রতিষ্ঠানগুলোতে অনেক বেকার তরুণের কর্মসংস্থানেরও ব্যবস্থা হচ্ছে। এটি দেশে বেকারত্ব কমিয়ে নিয়ে আসতে কিছুটা হলেও ভূমিকা রাখছে। এসব দিক বিবেচনা করে সংশ্লিষ্ট প্রতিষ্ঠানগুলোর শিক্ষার মান নিশ্চিত করার ওপর গুরুত্ব দিতে হবে। এক্ষেত্রে প্রতিষ্ঠানগুলো সম্পূর্ণ সরকারি নিয়মনীতির অধীনে আনার বিকল্প নেই। এছাড়া শিক্ষককে দক্ষ করে গড়ে তুলতে প্রতিষ্ঠানগুলোকে বাধ্য করা জরুরি। শিশুদের স্বাভাবিক বিকাশের জন্য খেলাধুলা ও শিক্ষামূলক অন্য কার্যক্রমে সম্পৃক্ত করার বিকল্প নেই। সংশ্লিষ্ট প্রতিষ্ঠানগুলো এ বিষয়টি যাতে অবশ্যই নিশ্চিত করে সে ব্যবস্থাও গ্রহণ করতে হবে।
কিন্ডারগার্টেন ও ইংলিশ মিডিয়াম গড়ে তোলার ক্ষেত্রে প্রায়ই অনিয়মের কথা শোনা যায়। এক্ষেত্রে যারাই অনিয়মে জড়িত থাকুন না কেন, সবার বিরুদ্ধে কঠোর ব্যবস্থা গ্রহণ করতে হবে। প্রতিষ্ঠানগুলোর কর্ণধারদেরও আরও সতর্ক হওয়া জরুরি। ব্যবসায়ের উদ্দেশ্য তো আছেই, শিক্ষার মান নিশ্চিতেও তাদের আরও দায়িত্বশীল হতে হবে। অভিভাবকদেরও আরও সতর্ক হওয়ার ব্যাপার রয়েছে। নিজের সন্তানকে কোনো প্রতিষ্ঠানে ভর্তির আগে অবশ্যই সে প্রতিষ্ঠানের শিক্ষার মান ও আনুষঙ্গিক অন্যান্য সুযোগ-সুবিধার ব্যাপারে জেনে নেওয়া প্রয়োজন।
দেশের ভবিষ্যতের কথা বিবেচনা করে শিক্ষার মানের ক্ষেত্রে ছাড় দেওয়ার কোনো সুযোগ নেই বলে মনে করি। আজকের শিশুই আগামী দিনে দেশের কর্ণধার। তাদের ছোটবেলা থেকেই যথাযথভাবে সুনাগরিক হিসেবে গড়ে তোলার দায়িত্বটাও আমাদেরই; কিন্তু এতে কোনো কারণে ব্যর্থ হলে তা বিপর্যয় নামিয়ে আনতে পারে। দায়িত্বটাও তাই সবাইকে যথাযথভাবেই কাঁধে তুলে নিতে হবে।
লেখক: গণমাধ্যমকর্মী
touhiddu.rahman1@gmail.com