ধ্বংসের মুখে সুস্থ পরিবার কাঠামো
অবাধ মেলামেশা ও যত্রতত্র সহজলভ্য রোমান্টিকতা বা রোমান্টিসিজম যুব সমাজকে ঘুণ পোকার মত তিলে তিলে শেষ করছে। দিনে দিনে ধ্বংস হচ্ছে সুস্থ পরিবার কাঠামো যা নড়বড়ে করে দিচ্ছে রাষ্ট্রের মূল ভিত। মূলত পরিবার একটা রাষ্ট্রের মনোমারিক বা ডিস্ট্রাকচারাল ইউনিট। রসায়নের ভাষায় মনোমার না থাকলে যেমন পলিমার গঠন সম্ভব নয়, ঠিক একইভাবে সামাজিক জীবনে পরিবার প্রথা উঠে গেলে রাষ্ট্রের অস্তিত্বও হয় হুমকির সম্মুখীন। কাজেই পরিবার ব্যবস্থাকে কোন ভাবেই অগ্রাহ্য করার বিন্দু মাত্র কোন সুযোগ নাই। গ্রহণযোগ্য সকল প্রকারের প্রগতি ও আধুনিকতার সাথে সামঞ্জস্য রেখে হলেও সুস্থ স্বাভাবিক পরিবার কাঠামোর প্রয়োজনীয়তার উপর সর্বোচ্চ গুরুত্বারোপ করা অত্যাবশ্যক। পাশাপাশি প্রগতি ও আধুনিকতা শব্দ দুটি চয়নের পূর্বেই আমাদের ভেবে দেখা উচিত বস্তুত কোনটি প্রগতি আর কোনটি পশ্চাদ্গতি। তা নাহলে তথাকথিত প্রগতি ও আধুনিকতা সমাজে ডেকে আনতে পারে মহাবিপর্যয়, এমনকি সেটা গড়াতে পারে পৃথিবী ধ্বংসের পূর্ব আলামত পর্যন্ত। বিভিন্ন ধর্মের মহাগ্রন্থগুলো থেকেও একই ধরনের ইঙ্গিত ও ভবিষ্যদ্বাণী পাওয়া যায়।
মানব সভ্যতা না থাকলে পৃথিবীর অস্তিত্ব কল্পনা করা যায় না। পাশাপাশি কোন একটি সভ্যতাকে ধ্বংস করার জন্য আধুনিকতার নামে যুব সমাজের মধ্যে অশ্লীলতা, বেহায়াপনার যথাযথ প্রসারই যথেষ্ট। তাই এখন থেকেই এ ব্যাপারে উদ্যোগী না হলে সামনে এক অন্ধকার ভবিষ্যতের বিকল্প কিছুই অবশিষ্ট থাকবে না আমাদের সামনে। উল্লেখ্য যে, আমাদের দেশে যুব সমাজ এখন নৈতিক অবক্ষয়ের সর্বোচ্চ সীমায় অবস্থান করছে। ছেলে-মেয়েদের অবাধ মেলামেশা দেখলে অনেক সময় মনে হতে পারে বিশ্ববিদ্যালয়সহ বিভিন্ন শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের ক্যাম্পাসগুলো অনেকটা বাংলা সিনেমার শুটিং স্পটের মত। বিশেষ করে কোন কোন বিভাগের বারান্দায় প্রেম-ভালোবাসার নামে যেন সিনেমাতে গীতমালা কিংবা ছায়াছন্দের কল্পনায় থাকা অন্তরঙ্গ মুহূর্তের রোমান্টিক দৃশ্যগুলো চিত্রায়ণের মত অশ্লীল কার্যকলাপ অবলীলায় চলতে থাকে।
মনে হতে পারে কর্তৃপক্ষ অনন্যোপায় হয়ে নিজেদের অপারগতা মেনে নিচ্ছে অথবা কুইনাইনের মত গলাধঃকরণ করছে দর্শনীয় দৃশ্যগুলো। আজব এক দেশ যা দেশের বাইরে কোন বিশ্ববিদ্যালয়, কলেজ কিংবা অন্য কোনো শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান ক্যাম্পাসে কখনো চোখে পড়েনি। কখনো কখনো মনে হয় বিভিন্ন শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের শিক্ষা সফরগুলো শিক্ষার্থীদের কারো কারো নিকট বহুল কাঙ্ক্ষিত মধুচন্দ্রিমার মত। কোথাও কোথাও নবীন বরণ অনুষ্ঠানে সাংস্কৃতিক পর্বের ছদ্মাবরণে যেন আয়োজিত হয় যাত্রাপালা রসের বাইদানী।
পাশাপাশি বহিরাগত বিভিন্ন অপসাংস্কৃতিক আগ্রাসন দেশীয় সুস্থ বিনোদনকে অপ্রতিরোধ্য গতিতে ধ্বংস করে যুব সমাজকে দিনে দিনে বিপথগামী করেই চলছে। বিশেষ করে পশ্চিমা বিশ্বের লিভ টুগেদার ফরমুলা তরুণ প্রজন্মকে খুব বেশি মাত্রায় প্রভাবিত করছে। থার্টি ফার্স্ট নাইট, ভ্যালেন্টাইন'স ডে-এর মত বিজাতীয় সংস্কৃতিগুলোর কারণে সুস্থ ধারার বাঙালি সংস্কৃতি অনেকটাই হারিয়ে যেতে বসেছে। দেশীয় সংস্কৃতিগুলোও অনেক ক্ষেত্রে ভিনদেশি সংস্কৃতি দ্বারা সংকরায়িত হচ্ছে। নতুন প্রজন্ম ধর্মীয় রীতিনীতি বা রেওয়াজগুলোকে অনেকটা ভুলতেই বসেছে। তারা এগুলোকে অনেক ক্ষেত্রেই বিবেচনা করে তাদের তথাকথিত প্রগতি এবং উন্নয়নের পথে প্রতিবন্ধকতা হিসাবে। একটা বয়স থাকে যখন মন অনেক কিছুই চায়। আর এই ডিজিটালাইজড যুগে অনেক চাওয়া পাওয়াই সহজলভ্য হয়ে যাওয়ায় কখনো কখনো যেন মেঘ না চাইতেই চলে আসে বৃষ্টি।
বিশেষ করে পর্নোগ্রাফি তো তরুণ প্রজন্মের কাছে বিনোদনের সবচেয়ে পছন্দের জায়গাটি দখল করে নিয়েছে। নেশা-দ্রব্যাদিসহ উন্নত বিশ্বের অনেক দেশে স্বীকৃতিপ্রাপ্ত বিভিন্ন বিকৃত যৌনাচারও যুব সমাজকে দিনে দিনে ঠেলে দিচ্ছে বিবাহ-বহির্ভূত কিংবা বিভিন্ন অনৈতিক সম্পর্ক স্থাপনের দিকে। বিবাহ বিচ্ছেদের পরিমাণ দিনে দিনে জ্যামিতিক হারে বেড়েই চলছে। পরকীয়া সম্পর্কের বৈধতার বিষয়টিও হয়তো-বা অতি শীঘ্রই পরিণত হবে সময়ের দাবিতে। শেষ পর্যন্ত পরিবার ব্যবস্থা বলতে হয়তো-বা আর কিছুই অবশিষ্ট থাকবে না।
অনেক পরিবারেই বাবা-মা দুজনই কর্মব্যস্ততার কারণে সন্তানদের পর্যাপ্ত সময় দিতে পারে না। অনেকটা সাক্ষী গোপালের মতই সন্তানদের বেপরোয়া কার্যকলাপ চেয়ে চেয়ে দেখছে, অভিভাবক হিসেবে বরণ করে নিতে হচ্ছে নিজেদের অসহায়ত্ব। কারণ অধিকার ও দায়িত্ব একে অন্যের পরিপূরক। ঠিকভাবে দায়িত্ব পালন করতে না পারলে অধিকারের সম্ভাবনাও হয়ে যায় ক্ষীণ -- এটাই রূঢ় বাস্তবতা। মনে হয় এক কালো মেঘের অমানিশা হাতছানি দিচ্ছে পুরো জাতিকে উদ্দেশ্য করে।
তাই আর দেরি নয়। সঠিক সময়ে এর লাগাম টেনে ধরতে না পারলে অদূর ভবিষ্যতে পুরো জাতিকে এর চড়া মাশুল গুণতে হবে। মনে রাখতে হবে, "সময়ের এক ফোঁড়, অসময়ের দশ ফোঁড়"। চলমান অবস্থা থেকে পরিত্রাণের উপায় আমাদেরকেই বের করে আনতে হবে।
সাধারণ মানুষকেই উদার ও ত্যাগী মনোভাব নিয়ে এগিয়ে আসতে হবে। তৈরি করতে হবে গণসচেতনতা। মানুষের মধ্যকার হারিয়ে যাওয়া এক সময়কার শিক্ষণীয় ধর্মীয় মুল্যবোধগুলোকে পুনরায় জাগ্রত করতে হবে। পারিবারিকভাবে আমাদের ছেলে-মেয়েদেরকে দিতে হবে যথাযথ কাউন্সেলিং। বিভিন্ন সময়কার জনবান্ধব সরকারগুলোর কাছ থেকে প্রয়োজনীয় সব ধরনের সহযোগিতা ও দিক নির্দেশনা চেয়ে নিতে হবে। একই সাথে সরকারিভাবেও অব্যাহত রাখতে হবে সব ধরনের পৃষ্ঠপোষকতা। শিক্ষা প্রতিষ্ঠানগুলোতে ধর্মীয় ও নৈতিক শিক্ষার উপর আরোপ করতে হবে রাষ্ট্রীয় বাধ্যবাধকতা।
তরুণ প্রজন্মের জন্যে সরকারি ও বেসরকারি সব ধরনের পৃষ্ঠপোষকতায় মানসিক স্বাস্থ্যের উন্নয়নে বিভিন্ন ধরনের কাউন্সেলিং, সেমিনার, সিম্পোজিয়াম, কর্মশালা ইত্যাদি আয়োজন করতে হবে। তথাকথিত বুদ্ধিজীবী যারা শিক্ষা কারিকুলামে বিবর্তনের ফলে বানর থেকে সৃষ্টির সেরা জীব মানুষে রূপান্তরিত হওয়াকে পৃষ্ঠপোষকতা করে, এসব ব্যাপারে তাদের কোন কনসার্ন বা মাথাব্যথা না থাকাটাই স্বাভাবিক। আর থাকবেই বা কেন? তাদের সন্তানেরা তো উন্নত বিশ্বের মাটিতে নিরাপদেই আছে। সব ধরনের নাগরিক অধিকার ও সুবিধাদি নিয়ে উন্নত জীবন যাপন করছে। বরং এ নিয়ে কথা বললে তাদের প্রগতিবাদী ভাবমূর্তি অনেকটাই ক্ষুণ্ন হতে পারে। কুইনাইনের মত গলাধঃকরণ করা লাগতে পারে প্রতিক্রিয়াশীলতার তক্ মা।
সর্বোপরি এই পরিস্থিতি থেকে পরিত্রাণের নিমিত্ত আমাদের পরিপূর্ণভাবে আত্মসমর্পণ করতে হবে মহান সৃষ্টিকর্তার নিকট। স্মরণে রাখতে হবে তাঁর করুণা ও দয়ার মুখাপেক্ষী হওয়ার বিকল্প অন্য কোনো পন্থাই আমাদের নিকট অনুসরণীয় ও অনুকরণীয় হতে পারে না। তাই এখন থেকেই আমাদের স্লোগান হোক "সুস্থ ও সবল পরিবার কাঠামোই হোক উন্নত রাষ্ট্রের মূল ভিত্তি"।
লেখক: অধ্যাপক, গবেষক ও সাবেক ছাত্র উপদেষ্টা, রসায়ন বিভাগ, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়