বিজয় দিবস: ৫৩ বছরের স্বাধীনতার অর্জন ও প্রশ্ন
চলতি বছর আমরা বিজয়ের ৫৩ বছর উদযাপন করছি। এটি আমাদের জাতীয় ইতিহাসের এক গৌরবোজ্জ্বল অধ্যায়। একাত্তরের মহান মুক্তিযুদ্ধে বিজয়ের মধ্য দিয়ে আমরা স্বাধীন ভূখণ্ড এবং জাতীয় পরিচয়ের অধিকার অর্জন করি। কিন্তু আজ, ৫৩ বছর পরও, প্রশ্ন থেকে যায়—আমরা কি স্বাধীনতার প্রকৃত স্বপ্ন বাস্তবায়ন করতে পেরেছি? স্বাধীনতা শুধু ভূখণ্ডের স্বাধীনতা নয়, বরং মানুষের জীবনযাত্রার মানোন্নয়ন, মত প্রকাশের স্বাধীনতা, এবং আন্তর্জাতিক অঙ্গনে আত্মমর্যাদার সঙ্গে টিকে থাকার সামর্থ্য।
প্রতিবেশীদের দ্বারা প্রভাবিত একটি স্বাধীনতা?
স্বাধীনতা মানে একটি জাতির নিজস্ব সিদ্ধান্ত গ্রহণের ক্ষমতা, পরনির্ভরশীলতা থেকে মুক্তি, এবং জনগণের সার্বভৌম অধিকার প্রতিষ্ঠা। কিন্তু বাংলাদেশ কি সত্যিই সেই স্বাধীনতা অর্জন করেছে? স্বাধীনতার ৫৩ বছর পরেও প্রতিবেশী দেশগুলোর প্রভাব ও চাপের কাছে আমাদের নীতিনির্ধারণ প্রক্রিয়া ও সার্বভৌমত্ব বারবার প্রশ্নবিদ্ধ হয়েছে।
মিয়ানমারের উদাহরণ আমাদের জন্য একটি কষ্টকর বাস্তবতা। তারা আন্তর্জাতিক আইনের তোয়াক্কা না করে রোহিঙ্গাদের জোরপূর্বক আমাদের দেশে পাঠিয়েছে। আমরা মানবিকতার খাতিরে শরণার্থীদের আশ্রয় দিয়েছি, কিন্তু তাদের নিরাপদে ফিরিয়ে নিতে মিয়ানমারের ওপর কোনো কার্যকর চাপ প্রয়োগ করতে পারিনি। আন্তর্জাতিক অঙ্গনে দীর্ঘদিন ধরে আমাদের এই ব্যর্থতা দেখিয়ে দেয় যে আমরা এখনো প্রতিবেশী দেশগুলোর বিরুদ্ধে শক্ত অবস্থান নিতে পারি না। এটি একটি জাতি হিসেবে আমাদের অবস্থানকে দুর্বল করে। অন্যদিকে, আরেক প্রতিবেশী দেশের সঙ্গে সীমান্তে প্রতিনিয়ত সংঘর্ষ এবং হত্যাকাণ্ড আমাদের নিরাপত্তার ঘাটতি এবং কূটনৈতিক অক্ষমতাকে তুলে ধরে। সীমান্তে বাংলাদেশি নাগরিকদের হত্যা এবং তাদের প্রতি অবহেলা আন্তর্জাতিক মানবাধিকার লঙ্ঘনের শামিল। কিন্তু এর প্রতিকার করতে আমরা অসহায় বোধ করি।
এছাড়া, আমাদের রাজনৈতিক দলগুলো দীর্ঘদিন ধরে প্রতিবেশী দেশগুলোর ওপর নির্ভরশীল। ক্ষমতা দখল এবং রক্ষা করতে বিদেশি শক্তির সহযোগিতা নেওয়ার সংস্কৃতি একটি স্বাধীন জাতির জন্য অপমানজনক। এমনকি যেসব রাজনৈতিক দল দীর্ঘদিন প্রতিবেশী দেশগুলোর বিরোধিতা করে এসেছে, তারাও এখন তাদের সঙ্গে সম্পর্ক উন্নয়নের চেষ্টা করছে। এটি তাদের নীতিগত দুর্বলতা এবং ক্ষমতার লোভকে প্রকাশ করে। এই পরিস্থিতিতে, আমাদের "স্বাধীনতা" শব্দটি শুধুমাত্র একটি আনুষ্ঠানিকতা হয়ে দাঁড়িয়েছে। প্রকৃত স্বাধীনতা তখনই অর্জিত হবে, যখন বাংলাদেশ কূটনৈতিকভাবে শক্তিশালী হবে এবং প্রতিবেশী দেশগুলোর প্রভাব থেকে মুক্ত থেকে নিজস্ব স্বার্থ রক্ষা করতে পারবে।
একটি স্বাধীন দেশ হিসেবে আমাদের জন্য অপরিহার্য হলো স্বচ্ছ ও সুষ্পষ্ট নীতিনির্ধারণ, আন্তর্জাতিক মঞ্চে কার্যকর ভূমিকা পালন, এবং শক্তিশালী কূটনৈতিক সম্পর্ক তৈরি করা। আমাদের বিজয়ের ৫৩ বছরে এই প্রশ্নটি বারবার সামনে আসে—আমরা কি একটি স্বাধীন দেশ, নাকি প্রতিবেশীদের দ্বারা প্রভাবিত একটি জাতি? আমাদের জাতীয় নেতৃত্বকে এই প্রভাব কাটিয়ে উঠতে এখনই পদক্ষেপ নিতে হবে। তা না হলে, আমাদের স্বাধীনতার প্রকৃত অর্থ কখনোই বাস্তবায়িত হবে না।
শিক্ষাব্যবস্থার সংকট স্বাধীনতার ৫৩ বছর পরও বাংলাদেশের শিক্ষাব্যবস্থা কাঙ্ক্ষিত মান অর্জন করতে পারেনি, যা একটি জাতির সার্বিক উন্নয়নের অন্যতম প্রধান অন্তরায়। যুগোপযোগী ও মানসম্মত শিক্ষা ব্যবস্থা ছাড়া কোনো দেশ টেকসই উন্নয়ন নিশ্চিত করতে পারে না। তবুও আমাদের দেশে শিক্ষাব্যবস্থার কাঠামো এখনো প্রথাগত পদ্ধতির মধ্যে আবদ্ধ। প্রাথমিক থেকে উচ্চশিক্ষা পর্যায়ে অবকাঠামোগত ও কারিগরি উন্নয়নের অভাব রয়েছে।
আধুনিক বিশ্বের চাহিদার সঙ্গে তাল মিলিয়ে যেখানে উন্নত দেশগুলো প্রোগ্রামিং, রোবটিক্স এবং কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তার মতো বিষয়গুলো শিক্ষা কারিকুলামে অন্তর্ভুক্ত করেছে, সেখানে আমাদের শিক্ষার্থীরা এখনো সেসব থেকে বঞ্চিত। এখানে শিক্ষার মানের বৈষম্য প্রকট। সরকারি স্কুলগুলোতে মানসম্মত শিক্ষা নিশ্চিত করা সম্ভব হয় না, কারণ প্রয়োজনীয় অবকাঠামো ও প্রশিক্ষিত শিক্ষকের ঘাটতি রয়েছে। অন্যদিকে, বেসরকারি স্কুলগুলো তুলনামূলকভাবে উন্নতমানের শিক্ষা দিলেও, সেগুলোর উচ্চ ব্যয় নিম্নবিত্ত ও মধ্যবিত্ত পরিবারের নাগালের বাইরে। ফলে অনেক শিক্ষার্থী মানসম্মত শিক্ষা থেকে বঞ্চিত হচ্ছে। একইসঙ্গে, শিক্ষা ব্যবস্থার অব্যবস্থাপনা এবং দুর্নীতি প্রায়ই শিক্ষার গুণগত মান নষ্ট করছে।
বিশ্ববিদ্যালয় পর্যায়ে গবেষণার ক্ষেত্রে বাংলাদেশের অবস্থান অত্যন্ত দুর্বল। গবেষণার জন্য বাজেটের স্বল্পতা এবং আধুনিক ল্যাবরেটরির অভাবে তরুণ শিক্ষার্থীদের মধ্যে গবেষণার প্রতি আগ্রহ কমছে। উপরন্তু, বিশ্ববিদ্যালয়ে অর্জিত ডিগ্রি কর্মক্ষেত্রে প্রাসঙ্গিক দক্ষতা দিতে ব্যর্থ হওয়ায় বেকারত্বের হার বেড়েই চলেছে। প্রতিবছর লক্ষ লক্ষ স্নাতক তৈরি হলেও, তাদের অনেকেই কর্মসংস্থানের সুযোগ পাচ্ছে না। ফলে শিক্ষিত বেকারের সংখ্যা দিন দিন বাড়ছে, যা দেশের সামাজিক ও অর্থনৈতিক উন্নয়নে নেতিবাচক প্রভাব ফেলছে। অতীতে বিভিন্ন সময়ে শিক্ষাক্রম পরিবর্তনের নামে নীতিগত অস্থিরতা সৃষ্টি করা হয়েছে। অনেক ক্ষেত্রেই এই পরিবর্তনগুলো জাতীয় স্বার্থের চেয়ে বিদেশি প্রভাবের প্রতি বেশি সংবেদনশীল বলে মনে হয়েছে। ফলে শিক্ষার্থীরা আন্তর্জাতিক প্রতিযোগিতায় পিছিয়ে পড়ছে।
এ অবস্থায় শিক্ষাব্যবস্থায় পরিবর্তন আনা অত্যন্ত জরুরি। আমাদের বাজেট বরাদ্দ বৃদ্ধি করে তা গবেষণা, প্রশিক্ষণ, এবং প্রযুক্তিনির্ভর শিক্ষার জন্য ব্যবহার করতে হবে। স্কুল ও কলেজ পর্যায়ে আধুনিক শিক্ষা পদ্ধতি প্রবর্তন এবং কারিগরি শিক্ষার প্রসার ঘটাতে হবে।
শিক্ষকদের প্রশিক্ষণ ও মর্যাদা বৃদ্ধি করতে হবে, যাতে তারা শ্রেণিকক্ষে গুণগত শিক্ষা নিশ্চিত করতে পারেন। পাশাপাশি, শিক্ষাখাতে দুর্নীতি বন্ধ এবং ব্যবস্থাপনা উন্নত করার জন্য কড়া পদক্ষেপ নিতে হবে।শিক্ষাব্যবস্থা একটি জাতির মেরুদণ্ড। এই মেরুদণ্ড শক্তিশালী করতে না পারলে বাংলাদেশের বিজয়ের প্রকৃত তাৎপর্য উপলব্ধি করা সম্ভব নয়। একটি আধুনিক, গবেষণানির্ভর, এবং প্রযুক্তিমুখী শিক্ষা ব্যবস্থা নিশ্চিত করতে পারলেই আমরা একটি উন্নত, মর্যাদাপূর্ণ বাংলাদেশ গড়ে তুলতে সক্ষম হব, যা আমাদের জাতীয় বিজয়কে অর্থবহ করে তুলবে।
রাজনৈতিক দুর্নীতি ও অর্থ পাচার: জাতীয় অগ্রগতির প্রধান অন্তরায়
স্বাধীনতার ৫৩ বছর পরেও বাংলাদেশের সবচেয়ে বড় চ্যালেঞ্জগুলোর মধ্যে একটি হলো রাজনৈতিক দুর্নীতি এবং এর সঙ্গে জড়িত অর্থ পাচার। দেশকে উন্নয়নের পথে এগিয়ে নিয়ে যেতে হলে রাজনৈতিক স্থিতিশীলতা ও সুশাসন নিশ্চিত করা অপরিহার্য, কিন্তু দুর্ভাগ্যজনকভাবে, আমাদের দেশের রাজনৈতিক কাঠামোতে দুর্নীতির প্রভাব গভীরভাবে প্রোথিত। ক্ষমতা দখল ও রক্ষণাবেক্ষণের জন্য বিভিন্ন দল ও গোষ্ঠী তাদের স্বার্থ রক্ষায় বিদেশি শক্তির ওপর নির্ভরশীল হয়েছে, যা আমাদের জাতীয় স্বার্থকে বারবার বিপন্ন করেছে।
অতীতের বিভিন্ন সরকার উন্নয়নের নামে বিশাল অঙ্কের প্রকল্প হাতে নিয়েছে, কিন্তু এর সিংহভাগ অর্থ ব্যয় হয়েছে অবকাঠামোগত দুর্নীতি এবং আত্মসাৎকরণের পেছনে। বিভিন্ন প্রকল্পের বাজেট ফুলিয়ে-ফাঁপিয়ে দেখিয়ে অর্থ লুটপাট করা হয়েছে। উন্নয়নের মাপকাঠি হিসেবে যেসব প্রকল্পকে সামনে আনা হয়েছে, সেগুলোর অনেকগুলোই দেশের মানুষের প্রকৃত চাহিদা পূরণ করতে ব্যর্থ হয়েছে। এর পাশাপাশি, দুর্নীতিবাজ রাজনীতিবিদ ও ব্যবসায়ীরা দেশের টাকা বিদেশে পাচার করে অর্থনীতিকে দুর্বল করে তুলেছে।
বিশ্বব্যাংক এবং অন্যান্য আন্তর্জাতিক সংস্থার রিপোর্ট অনুযায়ী, বাংলাদেশ থেকে প্রতিবছর বিপুল পরিমাণ অর্থ পাচার হচ্ছে। এই পাচারকৃত অর্থ দেশের শিল্পোন্নয়ন, স্বাস্থ্যসেবা, এবং শিক্ষাখাতে ব্যবহার হতে পারত। কিন্তু তা না হয়ে, ব্যক্তিগত স্বার্থে বিদেশি ব্যাংকে গচ্ছিত হচ্ছে, যা দেশের অর্থনৈতিক স্থিতিশীলতায় বড় আঘাত হানছে। রাজনৈতিক দুর্নীতির ফলে দেশের বিভিন্ন সেক্টরে অদক্ষতা ও স্বচ্ছতার অভাব দেখা দিয়েছে।
সরকারি ক্রয়-বিক্রয় থেকে শুরু করে প্রশাসনিক কার্যক্রম পর্যন্ত দুর্নীতির ছায়া প্রতিটি ক্ষেত্রে স্পষ্ট। অনেক সময় দেখা যায়, প্রকল্প অনুমোদনের ক্ষেত্রে গুণগত মানের চেয়ে ঘনিষ্ঠতার ভিত্তিতে কাজ বরাদ্দ দেওয়া হয়। এর ফলে প্রকল্পগুলো দীর্ঘস্থায়ী ও টেকসই হয় না, যা দেশের সাধারণ মানুষের জন্য ক্ষতিকর। অর্থ পাচার এবং রাজনৈতিক দুর্নীতি দেশের মানুষের মধ্যে গভীর হতাশা সৃষ্টি করছে। সাধারণ মানুষ যখন দুর্নীতি দেখে, তখন তাদের মধ্যে আইনের শাসনের প্রতি বিশ্বাস কমে যায়। তরুণ প্রজন্ম, যারা দেশের ভবিষ্যৎ, তারা এ অবস্থা দেখে হতাশাগ্রস্ত হয়ে পড়ছে এবং দেশ ছেড়ে যাওয়ার প্রবণতা বাড়ছে। এই "ব্রেন ড্রেন" দেশের সামগ্রিক অগ্রগতিকে আরও কঠিন করে তুলছে।
এই অবস্থা থেকে উত্তরণের জন্য জরুরি ভিত্তিতে কার্যকর ব্যবস্থা নেওয়া প্রয়োজন। প্রথমত, দুর্নীতিবিরোধী আইন শক্তিশালী করতে হবে এবং তার কঠোর বাস্তবায়ন নিশ্চিত করতে হবে। দুর্নীতির সঙ্গে জড়িত ব্যক্তিদের দলমত নির্বিশেষে বিচারের আওতায় আনতে হবে। দ্বিতীয়ত, অর্থ পাচার রোধে আন্তর্জাতিক সহযোগিতা বাড়াতে হবে এবং পাচার হওয়া অর্থ ফিরিয়ে আনতে ব্যবস্থা নিতে হবে। রাজনৈতিক স্থিতিশীলতা ও সুশাসন প্রতিষ্ঠা করতে না পারলে, আমাদের জাতীয় উন্নয়নের স্বপ্ন অপূর্ণ থেকে যাবে। বাংলাদেশ যখন ২.০ যুগে প্রবেশ করছে, তখন সময় এসেছে একটি স্বচ্ছ, জবাবদিহিমূলক এবং দুর্নীতিমুক্ত রাজনৈতিক কাঠামো গড়ে তোলার। এটাই হবে প্রকৃত স্বাধীনতার আসল অর্থ, যা আমাদের বিজয়ের ৫৩ বছর উদযাপনকে অর্থবহ করে তুলবে।
বিজয়ের প্রকৃত অর্থ পুনর্নির্ধারণ
১৯৭১ সালের মহান মুক্তিযুদ্ধ আমাদের একটি স্বাধীন রাষ্ট্র হিসেবে পরিচিতি এনে দিয়েছিল। কিন্তু স্বাধীনতার ৫৩ বছর পরেও আমরা কি সত্যিকার অর্থে বিজয়ের প্রকৃত অর্থ উপলব্ধি করতে পেরেছি? বিজয়ের অর্থ শুধু একটি ভূখণ্ডের মালিক হওয়া নয়, এটি একটি আত্মমর্যাদাশীল জাতি হিসেবে বিশ্ব দরবারে মাথা উঁচু করে দাঁড়ানোর প্রতিশ্রুতি। এই প্রতিশ্রুতি তখনই পূর্ণ হয় যখন একটি দেশ তার নাগরিকদের জন্য নিরাপত্তা, উন্নয়ন, এবং মর্যাদাপূর্ণ জীবন নিশ্চিত করতে সক্ষম হয়। দুর্ভাগ্যবশত, আমাদের বর্তমান পরিস্থিতি বিজয়ের সেই প্রকৃত অর্থ পুনর্নির্ধারণের দাবি জানায়।
স্বাধীনতার পর আমরা অর্থনৈতিক উন্নয়ন ও অবকাঠামোগত অগ্রগতির কিছু ক্ষেত্রে সাফল্য অর্জন করেছি, তবে রাজনৈতিক দুর্নীতি, অর্থ পাচার, শিক্ষাব্যবস্থার দুর্বলতা, এবং বৈদেশিক চাপের মতো সমস্যাগুলো আমাদের বিজয়ের মাহাত্ম্যকে ক্ষুণ্ন করেছে। আন্তর্জাতিক অঙ্গনে আমাদের অবস্থান এখনো পরনির্ভরশীলতার ছায়ায় ঢেকে আছে। প্রথমত, বিজয়ের প্রকৃত অর্থ তখনই বাস্তবায়িত হবে যখন দেশের প্রতিটি মানুষ সামাজিক ও অর্থনৈতিক নিরাপত্তা পাবে। আমাদের দেশ থেকে প্রতিনিয়ত অর্থ পাচার হওয়া এবং সীমান্তে মানুষের জীবনহানি এই বিজয়ের আদর্শের বিপরীতে যায়। মিয়ানমার থেকে আসা রোহিঙ্গা শরণার্থীদের আশ্রয় দেওয়া আমাদের মানবিক দায়িত্ব হলেও, তাদের ফেরত পাঠানোর ক্ষেত্রে আন্তর্জাতিক চাপ প্রয়োগে আমাদের ব্যর্থতা প্রমাণ করে যে আমরা এখনো একটি সার্বভৌম শক্তি হিসেবে কার্যকর হতে পারিনি।
দ্বিতীয়ত, আমাদের শিক্ষাব্যবস্থার ক্রমাগত অবনতি দেশের সামগ্রিক উন্নয়নের পথে একটি বড় বাধা। যুগোপযোগী শিক্ষা ও দক্ষতার অভাবে তরুণ প্রজন্ম বেকারত্বের জালে আটকে যাচ্ছে, যা বিজয়ের সত্যিকার অর্জনকে ম্লান করে দেয়। তৃতীয়ত, রাজনৈতিক দুর্নীতি ও ক্ষমতার অপব্যবহার জাতীয় উন্নয়নের ভিত্তি দুর্বল করে তুলছে। রাজনৈতিক দলগুলোর মধ্যে আস্থাহীনতা এবং বিদেশি প্রভাবের প্রতি অন্ধ আনুগত্য আমাদের নীতিনির্ধারণ প্রক্রিয়াকে বিভ্রান্ত করছে। বিজয়ের প্রকৃত অর্থ পুনর্নির্ধারণের সময় এখনই।
আমাদের এমন একটি রাষ্ট্র গড়তে হবে যেখানে মানুষ তার অধিকার, স্বাধীন মত প্রকাশ এবং সমান সুযোগ নিশ্চিত করতে পারে। একটি ন্যায়ভিত্তিক, দুর্নীতিমুক্ত, এবং শিক্ষিত সমাজই আমাদের প্রকৃত বিজয় এনে দিতে পারে। আমাদের সরকারকে এখনই উদ্যোগ নিতে হবে শিক্ষাব্যবস্থার সংস্কার, অর্থনৈতিক ন্যায্যতা প্রতিষ্ঠা, এবং রাজনৈতিক স্বচ্ছতার মাধ্যমে একটি টেকসই উন্নয়ন কাঠামো গড়ে তোলার। তবেই আমরা বিজয়ের ৫৩ বছর পূর্তিতে একটি আত্মমর্যাদাশীল জাতি হিসেবে বিশ্বে নিজেদের প্রতিষ্ঠিত করতে পারব। এই পুনর্নির্ধারণ আমাদের জন্য শুধু একটি দায়িত্ব নয়, বরং আমাদের মুক্তিযোদ্ধাদের প্রতি যথাযথ সম্মান প্রদর্শনের মাধ্যম।
নতুন বাংলাদেশ গড়ার প্রত্যয়
‘বাংলাদেশ ২.০’ গঠনের জন্য আমাদের নতুন করে পথচলা শুরু করতে হবে। এটি শুধুমাত্র তখনই সম্ভব, যখন আমরা রাজনৈতিক বিভাজন দূর করে একটি সমৃদ্ধ, আত্মনির্ভরশীল, এবং মর্যাদাপূর্ণ জাতি হিসেবে বিশ্ব দরবারে নিজেদের তুলে ধরতে পারব। বিজয় দিবস উদযাপন তখনই যথার্থ হবে, যখন বাংলাদেশ তার প্রত্যেক নাগরিকের জন্য শান্তি, নিরাপত্তা এবং মর্যাদা নিশ্চিত করতে পারবে। এর জন্য সুশাসন নিশ্চিত করে দুর্নীতি বন্ধ করতে হবে। প্রশাসনে জবাবদিহিতা প্রতিষ্ঠা এবং লুটপাট বন্ধ করাই হবে প্রথম পদক্ষেপ। শিক্ষা ব্যবস্থার পুনর্গঠন আজ সময়ের দাবি। আমাদের এমন একটি শিক্ষাব্যবস্থা প্রয়োজন, যা তরুণ প্রজন্মকে দক্ষ, কর্মক্ষম এবং বিশ্ব প্রতিযোগিতায় সক্ষম করে তুলবে।
কর্মসংস্থান সৃষ্টিতে স্থানীয় শিল্প ও প্রযুক্তিতে বিনিয়োগ বাড়াতে হবে, যাতে দেশের অভ্যন্তরীণ শ্রমশক্তি কাজে লাগানো যায়। নারীর ক্ষমতায়ন এবং সমান সুযোগ নিশ্চিত করা নতুন বাংলাদেশের অন্যতম শর্ত। পাশাপাশি, পরিবেশবান্ধব উন্নয়নের দিকে মনোযোগ দিয়ে সবুজ ও টেকসই উন্নয়নের মডেল তৈরি করতে হবে। কূটনৈতিকভাবে শক্তিশালী হতে হবে এবং প্রতিবেশীদের প্রভাবমুক্ত স্বাধীনতা রক্ষা করতে হবে।
জাতীয় স্বার্থ রক্ষায় দৃঢ় অবস্থান গ্রহণ করতে হবে। সর্বোপরি, বিভাজনের রাজনীতি পরিহার করে একটি ঐক্যবদ্ধ ও মানবিক সমাজ গড়াই হবে নতুন বাংলাদেশের মূল চেতনা। এই প্রত্যয়ে আমরা যদি ঐক্যবদ্ধ হই, তাহলে সত্যিকার অর্থে মুক্তিযুদ্ধের আদর্শ বাস্তবায়ন এবং একটি উন্নত বাংলাদেশ গড়া সম্ভব হবে। এটি আমাদের প্রজন্মের দায়িত্ব এবং ভবিষ্যৎ প্রজন্মের প্রতি অঙ্গীকার।
লেখক
সহকারী অধ্যাপক, নর্থ সাউথ ইউনিভার্সিটি।