১২ ডিসেম্বর ২০২৪, ২১:২৩

তিউনিশিয়া থেকে সিরিয়া: স্বৈরাচার মুক্ত নতুন ব্যবস্থার সন্ধানে

ইনসেটে লেখক মো. নিজাম উদ্দিন   © সংগৃহীত

এক.
বু আজিজি। তিউনিসিয়ান ফল বিক্রেতা ছিলেন। ফলের দোকান নিয়ে বসতেন রাস্তার পাশে। উচ্চ শিক্ষিত ছিলেন। চাকরি না পেয়ে ফলের ব্যবসাই ছিল তার চলার একমাত্র অবলম্বন। একদিন তিউনিসিয়ার পুলিশ তার ফলের দোকান গুড়িয়ে দেয় এবং তাকে লাঞ্ছিত করে। প্রতিবাদ স্বরূপ বু আজিজি তার গায়ে আগুন জ্বালিয়ে দেয়। কয়েক দিন হসপিটালে চিকিৎসা নিলেও এক পর্যায়ে সে মারা যায়। বু আজিজির গায়ের আগুন দ্রোহের লেলিহান শিখা হয়ে ছড়িয়ে পড়ে পুরো তিউনিসিয়ায়। ত্রিশ বছরের স্বৈরশাসক তিউনিসিয়ার প্রেসিডেন্ট বেন আলীর দুঃশাসনে মানুষ ছিল অতিষ্ঠ। দুর্নীতি,স্বজনপ্রীতি, অর্থনৈতিক দুরবস্থা এবং বেকারত্ব সমাজকে গ্রাস করেছিল। তরুণদের মধ্যে হতাশা এবং ক্ষোভ ছিল পাহাড় সম। ফলে বিদ্রোহের একটি ক্ষেত্র আগে থেকেই প্রস্তুত ছিল। বু আজিজির গায়ে আগুন জ্বালিয়ে প্রতিবাদ বেন আলীর পতনের চূড়ান্ত পরিণতি ঠিক করে দেয়। জনতার গণঅভ্যুত্থানে এক পর্যায়ে পতন হয় তিউনিসিয়ার প্রেসিডেন্ট বেন আলীর।সৌদি আরবে পালিয়ে গিয়ে জনরোষ থেকে রক্ষা পান। দুনিয়া কাঁপানো আরব বসন্তের সূচনা এভাবেই বু আজিজির আত্মত্যাগের মাধ্যমে। একবিংশ শতাব্দীর ইতিহাসে বু আজিজিই সম্ভবত সবচেয়ে ইনফ্লুয়েন্সিশান রেভ্যুলিউশনারী। পৃথিবী তাঁকে মনে রাখবে। 

দুই.
তিউনিসিয়ার সেই গণঅভ্যুত্থান পরবর্তীতে মিশরকে প্রভাবিত করে। মিশরের স্বৈরশাসক হোসনি মোবারকের বিরুদ্ধে জনতা তিউনিসিয়ান স্টাইলে রাজপথে নেমে আসে।সৃষ্টি হয় তাহরির স্কয়ারের। পতন হয় মিশরের স্বৈরশাসক হোসনি মোবারকের। পরবর্তীতে একে একে এই গণঅভ্যুত্থান লিবিয়া, লেবানন, সিরিয়াসহ আরব বিশ্বের স্বৈরশাসক নিয়ন্ত্রিত রাষ্ট্রগুলোর ক্ষমতার মসনদ তছনছ করে দেয় এই আরব বসন্তের ঢেউ। 

আরব বসন্তে শুধু যে আরব বিশ্বের স্বৈরশাসকের ক্ষমতার শেষ যাত্রা শুরু হয়েছে তাই নয়, পৃথিবীর যেখানেই স্বৈরশাসন, সেখানেই আরব বসন্তের প্রভাব পড়েছে। একই স্টাইলে জনতা বিক্ষোভে শামিল হয়েছে আর স্বৈরাচার পালিয়ে গেছে। আফগানরা বিশ বছরের মার্কিন দখলদারিত্বের অবসান ঘটিয়ে জনগণের বিজয় নিশ্চিত করেছে। প্রেসিডেন্ট হামিদ কারজাই পালিয়ে গেছে। দখলদাররা যে যেভাবে পেরেছে, পালিয়েছে।

শ্রীলঙ্কায় রাজাপাকসে পরিবারের দুঃশাসনে মানুষ যুগের পরে যুগ ভুগেছে। অর্থনীতি ধ্বসে গিয়ে ছিল। বেকারত্বে বিরক্ত ছিল তরুণ প্রজন্ম। হাম্বানটোডা সমুদ্র বন্দর চীনের কাছে লিজ দিতে বাধ্য হয়েছিল সরকার। ভারতের তাদেরদারী তো ছিলই। কখনো মাহিন্দা রাজাপাকসে কখনো তার ভাই গোটাবায়া রাজাপাকসে যুগের পরে যুগ স্বৈরাচারী কায়দায় শ্রীলঙ্কা শাসন করে একটি চরম পর্যায়ের কর্তৃত্ববাদী শাসনব্যবস্থা প্রতিষ্ঠা করে। জনগণ জেগে উঠে।রাজাপাকসে পরিবারের দুঃশাসনের বিরুদ্ধে। তীব্র গণঅভ্যুত্থানে পালিয়ে যান প্রেসিডেন্ট গোটাবায়া রাজাপাকসে। স্বৈরাচারের দোসর এমপি মন্ত্রীরা জনতার হাতে লাঞ্ছিত হয়। বিপ্লবী জনতা প্রেসিডেন্টশিয়াল পেলেস দখল করে উল্লাসে মেতে উঠে। ফলে শ্রীলঙ্কায় পতন হয় রাজাপাকসে যুগের। 

তিন.
পনেরো বছর যাবত বাংলাদেশের জনগণ ভোট দিয়ে সরকার গঠন করতে পারেনি। বিরোধীদের দমন করার জন্য এমন কোনো পথ নেই যা শাসকশ্রেণি গ্রহণ করেনি। গুম খুনের অভয়ারণ্যে পরিণত হয় বাংলাদেশ। আয়নাঘরের মতো নিষ্ঠুরতম টর্চার সেল গড়ে তুলে সরকার। হামলা মামলা জেল জুলুম নিপীড়ন নির্যাতন ছিল নিত্য সঙ্গী। প্রায়  একলাখ পঞ্চাশ হাজার নেতাকর্মীর নামে মিথ্যা মামলা করা হয়। বিডিআর বিদ্রোহ, শাপলা চত্বর, ২৮শে অক্টোবর এগুলো বিশেষ ক্ষত সৃষ্টি করে জাতির জীবনে। ভারতের আধিপত্য এদেশের মানুষের মেনে নেওয়াই যেন ছিল নিয়তি।আইনের শাসন, মানবাধিকার, গণতন্ত্র, মত প্রকাশের স্বাধীনতা মারাত্মকভাবে বিঘ্নিত হচ্ছিল। একটা পর্যায়ে মানুষ ঘুরে দাঁড়িয়ে যায়। তরুণরা নেতৃত্ব দেয়,রাজনৈতিক দলগুলোও কাঁধে কাঁধ মিলিয়ে অংশগ্রহণ করে। তারুণ্যের বিদ্রোহে দেশ উত্তাল হয়ে পড়ে। গণহত্যা চালিয়েও রেহাই পায়নি স্বৈরাচার । একটা পর্যায়ে ভারতে পালিয়ে যেতে বাধ্য হয় শেখ হাসিনা। এক নতুন যুগে প্রবেশ করে বাংলাদেশের রাজনীতি। 

চার:
সিরিয়ার প্রেসিডেন্ট বাশার আল আসাদ রাশিয়ায় পালিয়ে গেছে। জনগণের সম্মিলিত লড়াইয়ের কাছে ঠিকতে না পেরে। আরব বসন্তের ঢেউ সিরিয়াতেও লেগেছিল অনেক আগেই। কিন্তু মধ্যপ্রাচ্যের রাজনীতির নানা মারপ্যাঁচে শেষ পর্যন্ত টিকেই যাচ্ছিলেন বাশার আল আসাদ। রাশিয়া, ইরান, তুরস্ক এবং লেবাননের হিজবুল্লাহ, ইয়েমেনের হুতি সহ কিছু গুরুত্বপূর্ণ রাষ্ট্র এবং রাজনৈতিক শক্তির সমর্থন পাওয়ার এতো দিন টিকে ছিলেন বাশার আল আসাদ। সিরিয়া যুদ্ধের সবচেয়ে বেশি মূল্য দিতে হয়েছে রাষ্ট্র হিসেবে মনে হয় তুরস্ককে। প্রায় ত্রিশ লাখ সিরিয়ান শরণার্থীকে আশ্রয় দিয়ে ছিল তুরস্ক। এগুলো সিরিয়ায় ফেরাতে তুরস্কের প্রচেষ্টা তো ছিলই।ফলে নতুন হিসাব কষতে হয়েছে তুরস্ককেও। মধ্যপ্রাচ্যকে কেন্দ্র করে রাশিয়া- ইরান- তুরস্ক এবং মার্কিন- ইইউ এবং ইসরাইল এই বলয়ের হিসাব মেলানো কঠিন। কিন্তু মানুষ মুক্তির জন্য লড়াইয়ের রক্তাক্ত পথকেই গ্রহণ করেছে।

পাঁচ.
বাশার আল আসাদের পিতা হাফিজ আল আসাদ ছিলেন একজন সামরিক অফিসার। তিনিও স্বৈরাচারী কায়দায় সিরিয়ার প্রেসিডেন্ট হিসেবে উনত্রিশ বছর সিরিয়া শাসন করেছেন।আর বাশার আল আসাদের শাসনের চব্বিশ বছর।পিতা পুত্র মিলে মোট তিপ্পান্ন বছর সিরিয়ায় স্বৈরশাসন কায়েম করে ছিলেন। কিন্তু শেষ রক্ষা হলো না। পালাতে হলো। বাশার আল আসাদের পতনে বিজয় উদ্‌যাপন করছে সিরিয়া।রাস্তায়, মসজিদে, পার্কে সিজদায় শুকরিয়া জানাচ্ছে মানুষ। নতুন দেশ গড়ার স্বপ্ন সবার চোখে মুখে। এখানেই হয়তো শেষ নয়,আরও অনেক কিছু বাকী। ফিলিস্তিন এখনও রক্তাক্ত প্রান্তর,মিয়ানমার এখনও রণাঙ্গন। তবুও পরিবর্তনের ঢেউ আঁচড়ে পড়ছে তামাম দুনিয়ায়। মুক্তিকামী মানুষ নতুন দিনের স্বপ্ন দেখছে।

এই যে দেশে দেশে পরিবর্তন এগুলোর সবগুলোতেই আরব বসন্তের একটা প্রভাব রয়েছে,সেটা প্রত্যক্ষ এবং পরোক্ষ যেভাবেই হোক। বিপ্লব কিংবা গণঅভ্যুত্থান তো ছোঁয়াচে রোগের মতো,এক দেশ থেকে ছড়িয়ে পড়ে অন্য দেশে। আরব বসন্তের বিপ্লবী সূচনা তিউনিসিয়ান তরুণ বু আজিজির গায়ে আগুন জ্বালিয়ে আত্মত্যাগের মাধ্যমে। 

তিউনিসিয়ায় যে পরিবর্তনের সূচনা হয়েছিল সেই পরিবর্তনের ঝড়ে সর্বশেষে বাংলাদেশ এবং সিরিয়া থেকেও স্বৈরাচার দূর হলো। আগামী দিনের নতুন পৃথিবী সেই মানুষটাকেও শ্রদ্ধায়,ভালোবাসায়, সম্মানে মনে রাখুক, যাদের জীবনের আত্মত্যাগ, রক্ত এবং শরীরের ঘাম স্বৈরশাসককে ক্ষমতা ছেড়ে পালিয়ে যেতে বাধ্য করেছিল। 

বিগত এক যুগে তিউনিসিয়া থেকে সিরিয়ায় গণমানুষের মুক্তির সংগ্রামে বিদায় নিয়েছে অনেক নিষ্ঠুরতম স্বৈরাচার শাসক। দীর্ঘদিন স্বৈরাচারের কবলে থাকা দেশ গুলো মুক্তি এবং অধিকারের জন্য লড়াই করে সফলতার মুখ দেখছে। এক নয়া রাজনৈতিক ব্যবস্থার দিকে এগুচ্ছে এইসব রাষ্ট্র গুলো। 

লেখক : সহ-সভাপতি, ছাত্রদল কেন্দ্রীয় সংসদ