০৮ ডিসেম্বর ২০২৪, ১৭:৩৬

উচ্চশিক্ষায় গবেষণার মূল মন্ত্র ও সংশ্লিষ্ট কিছু বিচ্যুতি

  © টিডিসি ফটো

গবেষণা মূলত জ্ঞানের মজুদ বাড়ানোর উদ্দেশ্যে সাধিত সৃজনশীল ও পদ্ধতিগত একটি কাজ। এর মাধ্যমে যেকোনো বিষয় বোঝার জন্য পর্যাপ্ত প্রমাণ সংগ্রহ, সংঘটন ও বিশ্লেষণের প্রয়োজন হয়। এতে পক্ষপাত ও ত্রুটির উৎস নিয়ন্ত্রণের প্রতি বিশেষ মনোযোগ দেয়া হয়। গবেষণার মূল উদ্দেশ্য বাস্তবিক কোনো সমস্যার সমাধান করা, যা একটি ধারাবাহিক কার্য প্রক্রিয়া বা নির্দিষ্ট কিছু ধাপ অনুসরণের মধ্য দিয়ে সম্পাদিত হয়ে থাকে। একটি গবেষণা প্রকল্প অতীতে সম্পন্ন কোনো কাজের সম্প্রসারণও হতে পারে। এমনকি প্রয়োজনবোধে গবেষণায় কোনো যন্ত্রপাতি, পদ্ধতি বা পরীক্ষা-নিরীক্ষার বৈধতা যাচাই করার জন্য আগের প্রকল্পের উপাদান বা সমগ্র প্রকল্পের পুনরাবৃত্তি করার সুযোগ পর্যন্ত রয়ে যায়।

গবেষণা শব্দের সন্ধি-বিচ্ছেদ করলে দাঁড়ায় গো+এষণা, যা নিপাতনে সিদ্ধ স্বরসন্ধি। কোনো একটি বিষয়ের ওপর গভীর পড়াশোনা এবং হাতে-কলমে নিবিড় পরীক্ষণের পর পরীক্ষালব্ধ ফলকে বই আকারে রিপোর্ট করার নাম থিসিস বা অভিসন্দর্ভ এবং পদ্ধতিগত পুরো কার্য প্রক্রিয়াটিকে বলা হয় গবেষণা। গবেষণাকার্য সম্পাদনকালে রেফারেন্স হিসেবে পুরনো কাজকে অনুসরণ করার যথেষ্ট সুযোগ থাকলেও কপি করা সম্পূর্ণ নিষিদ্ধ। কোন গবেষণাগার কিংবা লাইব্রেরিতে পুরনো কোনো অভিসন্দর্ভ বা প্রজেক্ট রিপোর্ট রক্ষণাবেক্ষণ করা হয়ে থাকে শুধু কনসেপ্ট ডেভেলপমেন্টের উদ্দেশ্যে। অন্যথায় তা হবে সম্পূর্ণরূপে গবেষণার পরিপন্থী একটি অনুশীলন, যা আজকাল কমন একটি প্রথা বা অভ্যাসে পরিণত হয়েছে। এ পরিস্থিতি মূলত তত্ত্বাবধায়ক এবং শিক্ষানবিশ উভয় পক্ষের সৃষ্টি, যা একদিনে প্রতিষ্ঠিত হয়নি। বিষয়টি পুরোপুরি গবেষণার পরিপন্থী একটি অনুশীলন, যা গবেষণার মূল দর্শনকে ক্ষতিগ্রস্ত করে। তাই গবেষণা করা কিংবা করানোর আগে গবেষণার তাৎপর্য অনুধাবন অত্যাবশ্যক। প্রয়োজনবোধে বিভিন্ন কর্মশালা, সেমিনার বা সিম্পোজিয়ামের মাধ্যমে গবেষণার মূল দর্শনকে তত্ত্বাবধায়ক ও শিক্ষানবিশদের সম্মুখে উপস্থাপন করা অপরিহার্য।

গবেষণা মূলত দুই ধরনের— মৌলিক ও প্রায়োগিক। মৌলিক গবেষণার প্রাথমিক উদ্দেশ্য হলো মানব জ্ঞানের অগ্রগতির জন্য বিভিন্ন ব্যবস্থা ও পদ্ধতি দস্তাবেজীকরণ, আবিষ্কার, ব্যাখ্যা প্রদান এবং গবেষণা ও উন্নয়ন। গবেষণার পদ্ধতিগুলো জ্ঞান-বিজ্ঞানের ওপর নির্ভর করে। এক্ষেত্রে মানববিদ্যা ও বিজ্ঞান উভয়ের মধ্যে যথেষ্ট পরিবর্তন লক্ষ্য করা যায়। গবেষণা অনুশীলনের বৈজ্ঞানিক অধ্যয়নকে মেটা-গবেষণা বলা হয়। গবেষণা পরিচালনায় নিযুক্ত ব্যক্তিকে বলা হয়ে থাকে গবেষক, যার কাজকর্ম আনুষ্ঠানিক চাকরির শিরোনামে একটি পেশা হিসেবে স্বীকৃত। সামাজিক গবেষক বা সমাজবিজ্ঞানী হওয়ার জন্য একজনের সামাজিক বিজ্ঞানের সঙ্গে সম্পর্কিত যেকোনো বিষয়ে প্রচুর জ্ঞান থাকা অত্যাবশ্যক। একইভাবে প্রাকৃতিক বিজ্ঞান গবেষক হওয়ার জন্য একজন ব্যক্তির প্রাকৃতিক বিজ্ঞান, যেমন পদার্থবিদ্যা, রসায়ন, জীববিদ্যা, জ্যোতির্বিদ্যা, প্রাণিবিদ্যা ইত্যাদি সম্পর্কিত ক্ষেত্রের জ্ঞান থাকা বাধ্যতামূলক।

গবেষণাকর্ম সম্পাদনকালে পদ্ধতিগত কিছু ধাপ অনুসরণ করা হয়, যা একটি মডেল-কাঠামোর ভিত্তিতে পরিচালিত হয়ে থাকে। মডেল-কাঠামোটি অনুসারে গবেষণা শুরু হয় একটি বিস্তৃত কাঠামোকে কেন্দ্র করে, যেখানে নির্দিষ্ট প্রজেক্ট বা লক্ষ্যের আওতায় প্রয়োজনীয় তথ্য সংগ্রহের মাধ্যমে তথ্য বিশ্লেষণ, ফল উপস্থাপন এবং প্রাসঙ্গিক আলোচনা সন্নিবেশিত করা হয়। গবেষণার প্রধান ধাপগুলো হচ্ছে—(১) গবেষণার সমস্যা চিহ্নিতকরণ, (২) প্রাসঙ্গিক গবেষণা ও তথ্য পর্যালোচনা, (৩) গবেষণার সমস্যা নির্দিষ্টকরণ, (৪) অনুমিত সিদ্ধান্ত গ্রহণ ও গবেষণার প্রশ্ন নির্দিষ্টকরণ, (৫) তথ্য সংগ্রহ, (৬) তথ্য বিশ্লেষণ ও বর্ণনাকরণ, (৭) প্রতিবেদন তৈরি। এভাবেই গবেষণা সৃজনশীল একটি ধারা যা একটি দেশ অথবা জাতি ও রাষ্ট্রকে এগিয়ে যাওয়ার ক্ষেত্রে মুখ্য ভূমিকা পালন করে। গবেষণা বস্তুত একটি মহান পেশা, যেখানে গবেষকদের উদ্ভাবনী কর্মকাণ্ড জাতীয় নেতাদের দিতে পারে নিত্যনতুন পথের দিশা। অতএব গবেষণাকার্য সম্পাদনকালে সততা, একাগ্রতা ও নৈতিকতা একান্ত প্রয়োজনীয়।

আজকাল প্রায়ই গবেষণাকর্মে চৌর্যবৃত্তির অভিযোগ লক্ষ করা যায়। বিষয়টি সত্যিকার অর্থেই হতাশাজনক। দোকানপাটে কাউকে ওজনে কম দিলে যেভাবে তাকে বঞ্চিত করা হয়, ঠিক একইভাবে কারো গবেষণাকর্ম চুরি করলে তার অধিকার হরণ করা হয়। যেহেতু এখানে কোনো আর্থিক সংশ্লিষ্টতা নেই তাই বিষয়টি লক্ষণীয়ভাবে চোখে পড়ে না কিন্তু যেকোনো বিবেচনাই গবেষণায় চৌর্যবৃত্তি বা প্লেজিয়ারিজম একটি দণ্ডনীয় অপরাধ। আবার কেউ গবেষণার ছদ্মাবরণে মিথ্যা তথ্য প্রদান করলে সেটাও মারাত্মক দুর্নীতি। কারণ গবেষণাকাজ সম্পাদনকালে কেউ মিথ্যা তথ্য প্রদান করলে সেটা পরবর্তী গবেষককে ভুল পথে পরিচালিত করতে পারে। গবেষণাকর্ম করতে গেলে গবেষককে অনেক রেফারেন্স অনুসরণ করতে হয়। ভুল রেফারেন্স কাউকে করতে পারে বিভ্রান্ত। গবেষক হতে পারেন হয়রানির শিকার ও তার মূল উদ্দেশ্য থেকে বিচ্যুত। অতএব গবেষণার মতো সৃজনশীল একটি ধারায় সততা না থাকলে দেশ ও জাতির প্রকৃত উন্নয়ন বাধাগ্রস্ত হয়, যা কোনোভাবেই প্রত্যাশিত নয়।

অন্যদিকে গবেষণা করতে গিয়ে অনেক ক্ষেত্রেই গবেষণার মূল দর্শনকে পদদলিত করা হয়। উচ্চ শিক্ষা ক্ষেত্রে গবেষণা তত্ত্বাবধায়ক নির্বাচনকালে শিক্ষার্থীরা প্রায়ই গবেষণাকর্মে তাদের তত্ত্বাবধায়কের প্রজ্ঞা, একাগ্রতা ও সততা বিবেচনায় না এনে তাদের বাহ্যিক শো-অফ ও প্রশাসনিক ক্ষমতাকে প্রাধান্য দেয়। অনেক ক্ষেত্রেই তাদের বিবেচনায় থাকে পদপদবির বদান্যে কোন তত্ত্বাবধায়করা বিভিন্ন ইন্টারভিউ বোর্ডকে প্রভাবিত করে নিজ নিজ শিক্ষানবিশদের চাকরি নিশ্চিত করতে পারে। এ ধরনের চিন্তাভাবনা গবেষণার মূল দর্শনের সঙ্গে পুরোপুরি সাংঘর্ষিক। সাধারণত বিশ্ববিদ্যালয় পর্যায়ে প্রতি ব্যাচের প্রথম দিকের মেধাবীরা যারা নিজ নিজ বিভাগে শিক্ষক হওয়ার মনোবাসনা পোষণ করে তারাই এই কাজটি বেশি করে থাকে। ইচ্ছা না থাকলেও পরিস্থিতি কখনো কখনো তাদের এমন সিদ্ধান্ত নিতে বাধ্য করে। কারণ পেটের ভাতের উপযুক্ত জোগান না হলে শুধু গবেষণা দিয়ে কী হবে? এটাই রূঢ় বাস্তবতা।

অন্যদিকে শিক্ষার্থীদের একটি বড় অংশ তত্ত্বাবধায়ক নির্বাচনকালে বিবেচনায় আনে কোথায় গেলে কম কাজ করে বেশি নম্বর পাওয়া যায়। তাদের উদ্দেশ্য মূলত সময় বাঁচিয়ে বিসিএসসহ বিভিন্ন সরকারি চাকরির প্রস্তুতি নেয়া অথবা বিদেশ গমনের উদ্দেশে IELTS, TOEFL, GRE পড়া। পরবর্তী সময়ে কোনো ভালো সরকারি চাকরি পেয়ে গেলে বিশ্ববিদ্যালয় থেকে লব্ধ অভিসন্দর্ভটিকে নিজেদের গবেষণার অভিজ্ঞতা প্রদর্শনের নিমিত্ত সীতা হার রূপে সহজেই ব্যবহার করা যায়। আর যদি কোনোভাবে একটি প্রকাশনা থাকে, তবে তো কথাই নেই—একেবারে সোনায় সোহাগা। কালেভদ্রে ভাগ্যচক্রে সরকারি বা বেসরকারি বড় পদপদবি দখল করে তারাই আবার টক শো-এর টেবিলে বসে গবেষণার নীতিনির্ধারণী বিষয়ে বুলি আওড়ায়। বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষকসহ পণ্ডিত ও গবেষকদের গবেষণার দীক্ষা দেয় যা আসলেই হতাশাজনক। এ ধরনের চিন্তাভাবনা ও কর্মকাণ্ড দেশে গবেষণা জগতের জন্য এক মহা অশনিসংকেত।

উপরোক্ত দুই ধারার বাইরেও তৃতীয় একটি ধারা রয়েছে যারা সত্যিকার অর্থেই গবেষণামনস্ক। এই ধারাটির কথা বলতে গেলে মনে পড়ে জহুরী আসলেই হীরা চিনতে ভুল করেন না। তারা সত্যিকারের পণ্ডিত ও ধ্যানে-জ্ঞানে গবেষণামনস্ক তত্ত্বাবধায়ক নির্বাচন করে এবং মন-প্রাণ দিয়ে গবেষণাগারে কাজ করে। মূলত এসব তত্ত্বাবধায়ক ও শিক্ষানবিশরাই গবেষণার জ্ঞান সাগরে সদা বহমান মূল স্রোতটির প্রতিনিধিত্ব করে। অতএব গবেষণা করতে গেলে একাগ্রতার পাশাপাশি সততা ও নৈতিকতা বেশি অপরিহার্য। অন্যথায় গবেষণা শুধু মুখে আওড়ানো বুলিতেই সীমাবদ্ধ থাকবে যা কোনো দিন আলোর মুখ দেখবে না অথবা কার্যকর কিছু দেশ ও জাতিকে উপহার দিতে পারবে না।

লেখক: অধ্যাপক, রসায়ন বিভাগ, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়