৩০ নভেম্বর ২০২৪, ১৪:১৭

বিসিএসের নিয়োগপ্রক্রিয়া: পিএসসির সংস্কার ও জবাবদিহি প্রয়োজন

শরিফুল হাসান  © টিডিসি ফটো

সরকারি চাকরিতে নিয়োগপ্রক্রিয়া ও পিএসসির সংস্কার নিয়ে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে গত ২৬ নভেম্বরে আমার বক্তব্যের শুরুতে বলেছি, পৃথিবীর অধিকাংশ দেশে চার বছরে এক সরকারের মেয়াদ শেষে আরেক সরকার আসে। বাংলাদেশে উচ্চমাধ্যমিক শেষ করে বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি হয়ে চার বছরে স্নাতক শেষ করা যায়। অথচ চার বছরেও একটা বিসিএসের নিয়োগপ্রক্রিয়া শেষ হয় না বাংলাদেশে। পৃথিবীর আর কোনো দেশে সরকারি চাকরি নিয়োগের পরীক্ষায় এত দীর্ঘ সময় লাগে না। আবার চার বছরের এই দীর্ঘ প্রক্রিয়ার সব ধাপে উত্তীর্ণ হলেও অধিকাংশ প্রার্থী একটা নন-ক্যাডারে চাকরি পান না।

সর্বশেষ নতুন নন-ক্যাডার বিধিমালা করে ক্যাডার ও নন-ক্যাডারেরে ফল একই সঙ্গে প্রকাশের নামে বিসিএস উত্তীর্ণ প্রার্থীদের চাকরির পথ আরো সংকুচিত করা হয়েছে। এর মধ্যেই প্রশ্নপত্র ফাঁস, মৌখিক পরীক্ষায় পছন্দের প্রার্থীদের অতিরিক্ত নম্বর দেওয়াসহ নানা অস্বচ্ছতার অভিযোগ আছে। কোটা সংস্কারকে কেন্দ্র করে সুন্দর এক বাংলাদেশ গড়ার স্বপ্নে তরুণরা আজ সংস্কারের যে দাবি তুলেছেন, সেই ধারাবাহিকতায় বিসিএসের নিয়োগপ্রক্রিয়া থেকে শুরু করে সরকারি কর্ম কমিশনের (পিএসসি) সংস্কার ও জবাবদিহি প্রয়োজন। সে জন্যই কয়েকটি প্রস্তাব তুলে ধরছি।

দীর্ঘসূত্রতা কমাতে হবে, এক বছরের মধ্যে একটা বিসিএস শেষ করতে হবে

মোটামুটি ভালো বেতন, সামাজিক সম্মান, নিরাপত্তাসহ নানা কারণে সরকারি চাকরির প্রতি তরুণদের আগ্রহ বাড়ছে। একেকটি বিসিএসে এখন ৪-৫ লাখ তরুণ অংশ নিচ্ছেন। তাদের বয়স ২১ থেকে ৩০ বছর। চাকরিতে বয়সসীমা ৩২ বছর করায় এই সংখ্যা আরো বাড়বে। কিন্তু একেকটা নিয়োগে তিন থেকে চার বছর লাগছে বলে তরুণদের জীবনের একটা বড় অংশই চলে যাচ্ছে সরকারি চাকরির পরীক্ষায়। ১৯৮২ সাল থেকে শুরু হওয়া বিসিএসগুলোর তথ্য বিশ্লেষণ করে দেখা গেছে, প্রতিটি বিসিএসেই পরীক্ষা হয়েছে এক বছর, নিয়োগ হয়েছে আরেক বছর। তবে যত দিন গেছে, দীর্ঘসূত্রতা বেড়েছে। বিশেষ করে গত দুই যুগের প্রতিটা বিসিএসের  প্রিলিমিনারি, লিখিত ও চূড়ান্ত পরীক্ষার ফলের সময়সূচি বিশ্লেষণ করে দেখা গেছে,  আগে যেখানে দেড় থেকে দুই বছরের মধ্যে একেকটা বিসিএস শেষ হতো, এখন সেটা তিন থেকে চার বছর এমনকি তারও বেশি সময় লাগছে। 

২০২০ সালের সেপ্টেম্বরে সোহরাব হোসাইন পিএসসির চেয়ারম্যান হিসেবে যোগ দিয়ে এক বছরের মধ্যেই একটা বিসিএস প্রক্রিয়া শেষ করার কথা বলেছিলেন। অথচ তিনি চেয়ারম্যান থাকাকালে ৪১তম বিসিএসের প্রক্রিয়া শেষ করে যোগদানে সময় লেগেছে সাড়ে চার বছর। কোনো বিসিএসের ফল প্রকাশে এই দীর্ঘসূত্রতা গোটা বিশ্বে রেকর্ড হতে পারে। এ ছাড়া বর্তমানে ৪৪, ৪৫, ৪৬, ৪৭—সব কয়টি বিসিএসের নিয়োগপ্রক্রিয়া ঝুলে আছে। এই চারটি বিসিএস নিয়ে যে সংকটে পড়বে পিএসসি, যথাযথ ব্যবস্থা না নিলে আগামী চার-পাঁচ বছরে উত্তরণের আশা করা কঠিন। সরকার ও পিএসসিকে দ্রুত এই সংকটের সমাধান ভাবতে হবে। গত কয়েকটি বিসিএসের ফল বিশ্লেষণ করে দেখা গেছে, বিজ্ঞপ্তি প্রকাশ করে আবেদন ও প্রিলিমিনারি পরীক্ষা গ্রহণ ও ফল প্রকাশে ছয় মাস সময় লাগে। এরপর লিখিত পরীক্ষা নিয়ে সেই পরীক্ষার ফল প্রকাশ করতেই এখন এক থেকে দেড় বছর লেগে যাচ্ছে। এরপর মৌখিক পরীক্ষা নিয়ে ফল প্রকাশ করতে লাগছে আরও ছয় মাস। এরপর যাচাই-বাছাই করে গেজেট প্রকাশ করতে লাগছে ছয় মাস থেকে এক বছর।

সময় বিশ্লেষণ করে দেখা গেছে, প্রতিটি বিসিএসে লিখিত পরীক্ষার ফল প্রকাশ করতেই গড়ে এক বছর বা তারও বেশি লেগেছে এবং দীর্ঘসূত্রতার বড় কারণ এখানেই। পিএসসির ভাষ্য অনুযায়ী, ৩৮তম বিসিএস থেকে দুজন পরীক্ষক বিসিএসের খাতা মূল্যায়ন করেন, ফলে একটি বড় সময় এখানেই চলে যায়। আবার দুই পরীক্ষকের মধ্যে ২০ শতাংশ বা এর অধিক নম্বরের পার্থক্য হলে তৃতীয় পরীক্ষকের কাছে যায়। ফলে সময় লাগে আরও বেশি। এই যেমন ৪১তম বিসিএসে ১০ হাজারের বেশি খাতা তৃতীয় পরীক্ষক দেখেছেন। ফলে সময় বেশি লাগছে। ৪১, ৪৩, ৪৪, ৪৫—প্রতিটি বিসিএসেই লিখিত পরীক্ষার ফল প্রকাশে এক বছরের বেশি সময় লেগেছে। এখন প্রশ্ন হলো, পরীক্ষকের অবহেলার দায় কেন পরীক্ষার্থীরা নেবেন? সমস্যার সমাধানে পিএসসি পরীক্ষক ও নিরীক্ষকদের খাতা দেখার জন্য ১০-১৫ দিন বা এক মাসের সুনির্দিষ্ট সময় বেঁধে দিতে পারে।

আরও পড়ুন: গুচ্ছ পদ্ধতির বিলোপ: শিক্ষার্থীদের স্বপ্নভঙ্গের শঙ্কা

পিএসসিকে মনে রাখতে হবে, কয়েক লাখ ছেলে-মেয়ের পরীক্ষা নিয়ে তিন মাসে মাধ্যমিক ও উচ্চমাধ্যমিক পরীক্ষার ফল প্রকাশ করা যায়। তাহলে কোন কারণে ১০-১৫ হাজার ছেলে-মেয়ের লিখিত পরীক্ষার ফল দিতে তিন মাসের বেশি লাগবে? বিশেষ করে এক বছরের বেশি সময় কখনোই কাঙ্ক্ষিত নয়। দীর্ঘসূত্রতা কমাতে হলে লিখিত পরীক্ষার খাতা মূল্যায়নের এই সময় কমাতেই হবে। ৮ অক্টোবর সাবেক চেয়ারম্যান সোহবার হোসাইনসহ পিএসসির ১২ জন সদস্য পদত্যাগ করেছেন। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের লোকপ্রসাশন বিভাগের অধ্যাপক মোবাশ্বের মোনেমকে চেয়ারম্যান করে পিএসসির নতুন কমিশন গঠিত হয়েছে। তাদের সবচেয়ে বড় চ্যালেঞ্জ হবে দীর্ঘসূত্রতা কমানো। এ জন্য তাঁরা অতীতের বিসিএসগুলোর সময় বিশ্লেষণ করতে পারেন। একেকটা বিসিএস তাদের এক বছরের মধ্যে শেষ করে আনতেই হবে।  এ জন্য বছরের কোন মাসে নতুন বিসিএসের বিজ্ঞাপন হবে, কোন মাসে প্রিলিমিনারি, কবে লিখিত পরীক্ষা, কবে ফল, কবে যোগদান সবকিছুর নির্ধারিত ক্যালেন্ডার করতে হবে। 

ক্যাডার সংখ্যা কমানো যেতে পারে

বাংলাদেশে ২৬টি ক্যাডার রয়েছে। এর মধ্যে জেনারেল, টেকনিক্যাল আর উভয় ক্যাডার আছে। এক শিক্ষা ক্যাডারেই অসংখ্য বিষয়। ফলে পরীক্ষা ও নিয়োগে সময় বেশি লাগে। এতগুলো ক্যাডার একসঙ্গে রাখার প্রয়োজন আছে কি না, ভাবতে হবে। প্রয়োজনে বিসিএসে ফরেন সার্ভিস, পুলিশ সার্ভিস, প্রশাসন সার্ভিস ও টেকনিকাল ক্যাডারে নামে ক্যাডার সংখ্যা কমিয়ে আনা যেতে পারে। সে অনুযায়ী পররাষ্ট্র, পুলিশ, প্রশাসন, টেকনিকাল ক্যাডারে ভাইভা নেওয়া যেতে পারে। আর সরকারকেও আন্ত ক্যাডার বৈষম্য দূর করতে হবে। নয়তো এক ক্যাডার থেকে পরের বছর পরীক্ষা দিয়ে অরেক ক্যাডারে যাওয়ার প্রবনতা বন্ধ হবে না। 

মৌখিক পরীক্ষার নম্বর যেন বৈষম্য সৃষ্টি না করে

বিসিএসের মৌখিক পরীক্ষায় ২০০ নম্বরের বিধান কতটা যৌক্তিক সেটি নিয়ে বিশ্লেষণ করতে হবে। প্রয়োজনে এই নম্বর কমিয়ে ১০০ করা যেতে পারে। কারণ, বিসিএসের প্রিলিমিনারি, লিখিত পরীক্ষায় প্রার্থীদের মধ্যে নম্বরের ব্যবধান কম থাকলেও দেখা যায় স্বজনপ্রীতির কারণে মৌখিক পরীক্ষায় বেশি নম্বর দেন। ফলে বড় ধরনের ব্যবধান হয়ে যায়। কাজেই মৌখিক পরীক্ষার নম্বর কমাতে হবে কিংবা এমনভাবে মৌখিক পরীক্ষা নিতে হবে, যাতে পছন্দের প্রার্থীকে বেশি নম্বর দেওয়ার সুযোগ না থাকে। 

প্রিলিমিনারি, লিখিত, মৌখিক সব পরীক্ষার নম্বর প্রকাশ করতে হবে

বর্তমানে একটা বিসিএস শেষ হয়ে যাওয়ার পর নির্ধারিত ফি দিয়ে আবেদন করলে একজন প্রার্থী শুধুমাত্র তাঁর লিখিত পরীক্ষার নম্বর জানতে পারেন। কিন্তু প্রিলিমিনারি পরীক্ষায় তিনি কতো নম্বর পেলে, মৌখিকে কতো সেগুলো জানা যায় না। কিন্তু স্বচ্ছতার স্বার্থে প্রত্যেক প্রার্থীর প্রিলিমিনারি, লিখিত ও মৌখিক প্রতিটা পরীক্ষার নম্বর প্রকাশ করা উচিত। এতে জবাবদিহিতা বাড়বে। স্বচ্ছতা প্রতিষ্ঠিত হবে। একাধিক বিসিএস একসঙ্গে হওয়ার কারণে অনেকে দেখা যায় ক্যাডার পরিবর্তন করে বা যোগ দেয় না। মেধাতালিকা প্রকাশ করা থাকলে কোন বিসিএসে কেউ যোগ না দিলে অপেক্ষমাণ মেধাতালিকা থেকে প্রার্থী নিয়োগ দেওয়া যেতে পারে।

নন-ক্যাডারে নিয়োগ বাড়াতে হবে, প্রয়োজনে ২০২৩ এর নন-ক্যাডার বিধি বাতিল বা সংস্কার করতে হবে

একেকটা বিসিএস পরীক্ষায় এখন চার লাখেরও বেশি পরীক্ষার্থী অংশ নিচ্ছেন। কিন্তু প্রতি বিসিএসে সাধারণভাবে গড়ে দুই থেকে আড়াই হাজার ক্যাডার পদে নিয়োগ দেওয়া হয়। ফলে বিসিএসে উত্তীর্ণ হলেও বিপুলসংখ্যক প্রার্থী চাকরি থেকে বঞ্চিত হতেন। এই প্রার্থীদের প্রথম শ্রেণির অন্যান্য পদে নিয়োগ দেওয়ার জন্যই ২০১০ সালে নন-ক্যাডার নিয়োগে বিশেষ বিধিমালা করার উদ্যোগ নেন ওই সময়ের চেয়ারম্যান প্রয়াত সা’দত হুসাইন।

আরও পড়ুন: কোন দেশের সরকার প্রধান নিজ নামে শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান তৈরি করে?

রিপোর্টার হিসেবে আমি তখন পিএসসির নানা বিষয়ে সংবাদ করি। নন-ক্যাডারের এই নিয়োগ বিধিমালা করার কারণ হিসেবে সা’দত হুসাইন আমাকে বলেছিলেন, বিসিএস পরীক্ষায় উত্তীর্ণদের মধ্য থেকেই যদি প্রথম শ্রেণির বিভিন্ন পদে সুপারিশ করা যায়, তাহলে নিয়োগে দুর্নীতি ও সময় কমবে। এ ছাড়া একেকটি বিসিএসে আট থেকে ১০ হাজার প্রার্থী উত্তীর্ণ হলেও বেশির ভাগ চাকরি পেতেন না। নন-ক্যাডারে নিয়োগ দিতে পারলে চাকরি পাওয়ার সংখ্যা বাড়বে। সরকারের বিভিন্ন দপ্তরও মেধাবী কর্মকর্তা পাবে। নন-ক্যাডারে নিয়োগের সিদ্ধান্তটি ছিল ইতিবাচক। কিন্তু মন্ত্রণালয় ও দপ্তরগুলো খুব বেশিসংখ্যক চাহিদা না দেওয়ার কারণে দেখা গেল, ২৮ থেকে ৩৩ তম বিসিএসে উত্তীর্ণ এমন প্রায় ১৯ হাজার প্রার্থী কোনো চাকরি পাননি। দীর্ঘ একটা প্রক্রিয়া ও মেধা যাচাইয়ের মাধ্যমে উত্তীর্ণ হয়েও পদ না থাকার কারণে চাকরি না পাওয়াটা প্রার্থীদের জন্য ছিল হতাশার। সমস্যার কিছুটা সমাধানে ২০১৪ সালে বিসিএসের মাধ্যমে দ্বিতীয় শ্রেণির পদেও নিয়োগের সিদ্ধান্ত হয়। 

এরপর ৩৪ বিসিএসে নন-ক্যাডার থেকে ২ হাজার ২৫৭ জন, ৩৫ বিসিএস থেকে ২ হাজার, ৩৬ বিসিএস থেকে ১ হাজার ২৮৭ জন, ৩৭ বিসিএস থেকে ১ হাজার ৭৪৩ জন,  ৩৮তম বিসিএস থেকে ২ হাজার ৭৫১ জন, ৪০তম বিসিএস থেকে ৩ হাজার ৬৫৭, ৪১তম বিসিএস থেকে ৩ হাজার ১৪৮ জনকে নিয়োগের সুপারিশ করা হয়েছে। ৪২তম (বিশেষ ) বিসিএসেও ৫৮১ জনকে নিয়োগের সুপারিশ করা হয়েছে। কিন্তু সাবেক চেয়ারম্যান সোহরাব হোসাইনের একসঙ্গে ক্যডার ও নন-ক্যাডারের ফল দেওয়ার অযৌক্তিক উদ্যোগ ও নন-ক্যাডার বিধিমালা-২০২৩-এর কারণে ৪৩তম বিসিএসে মাত্র ৬৪২ জন নন-ক্যাডারে নিয়োগ পান। আর এভাবেই তিনি নন-ক্যাডারের নিয়োগ প্রক্রিয়া ধ্বংস করেন। 

নন-ক্যাডার নিয়োগে আগে প্রতিটি বিসিএসে চূড়ান্ত ফল প্রকাশের পর প্রার্থীদের কাছ থেকে আবেদন নেওয়া হতো এবং পরের বিসিএসের চূড়ান্ত ফল প্রকাশের আগপর্যন্ত বিভিন্ন মন্ত্রণালয় থেকে যত চাহিদা আসত, সেই অনুযায়ী নিয়োগ দেওয়া হতো। কিন্তু সোহরাব হোসেন নতুন বিধিমালার উদ্যোগ নেন এবং নতুন বিধিমালার ৪ ধারা অনুযায়ী, এখন থেকে বিসিএসের বিজ্ঞপ্তিতে ক্যাডার পদের পাশাপাশি নন-ক্যাডার পদের সংখ্যাও উল্লেখ থাকবে এবং একসঙ্গে ৪৩তম বিসিএসে ক্যাডার ও নন-ক্যাডারে নিয়োগে ফল দেন। এটি নিয়োগে বড় ধরনের ক্ষতি করেছে। এই বিধি বাতিল বা সংস্কার করে আগের মতো পরের বিসিএসের চূড়ান্ত ফল দেওয়ার আগপর্যন্ত নন-ক্যাডারের সুযোগ রাখা উচিত। মনে রাখতে হবে, বিসিএস থেকে নন-ক্যাডারের বিভিন্ন পদে নিয়োগ দেওয়ার ফলে দুর্নীতি বন্ধ হয়েছে। ফলে ৯ম থেকে ১২তম গ্রেড পর্যন্ত যত বেশিসংখ্যক পদ বিসিএস থেকে নিয়োগ দেওয়া উচিত।

শূন্য পদগুলো নিয়মিত পূরণ করতে হবে, বছরে একটি দুটি নন-ক্যাডারের পরীক্ষা নিয়ে ধারাবাহিকভাবে নিয়োগ করতে হবে

জনপ্রশাসন থেকে প্রকাশিত স্ট্যাটিসটিকস অব গভর্নমেন্ট সার্ভেন্ট ২০২২ মোতাবেক, সব মন্ত্রণালয়, বিভাগ, অধিদপ্তর ও দপ্তরের কর্মকর্তা-কর্মচারীদের পদের বিপরীতে ৫ লাখ ৩ হাজার ৩৩৩টি শূন্য পদ আছে। এ বছরের শুরুতে জাতীয় সংসদের এক প্রশ্নোত্তর পর্বে জানানো হয় সরকারের বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানে রাজস্বখাতভুক্ত প্রায় ৩ লাখ ৫৮ হাজার ১২৫টি পদ খালি আছে। এর মধ্যে প্রথম শ্রেণির ৪৩ হাজার ৩৬৬টি ও দ্বিতীয় শ্রেণির ৪০ হাজার ৩৬১টি পদ শূন্য রয়েছে।  অথচ ৩-৪ বছরের অমানুষিক খাটুনি ও অপেক্ষার পর বিভিন্ন  বিসিএস থেকে অধিকাংশ প্রার্থীই খালি হাতে ফেরত গিয়েছেন, যা চাকরিপ্রার্থীদের মধ্যে ব্যাপক হতাশার জন্ম দিয়েছে।

আরও পড়ুন: শেখ হাসিনার অডিও কল, ট্রাম্পকার্ড ও ভারতীয় গণমাধ্যমের অতিরঞ্জন

সমস্যা সমাধানে নিয়মিত বিসিএস থেকে উত্তীর্ণ প্রার্থীদের নন-ক্যাডারে নিয়োগ দেওয়া যেতে পারে। পাশাপাশি নন-ক্যাডারে অসংখ্য পরীক্ষা না নিয়ে সব নন-ক্যাডারের জন্য কিংবা একই ধরনের পদের জন্য একটি-দুটি পরীক্ষা নিয়ে তালিকা করে নিয়োগ দেওয়া যেতে পারে। বর্তমানে সরকারের নানা দপ্তর ও সংস্থা বিচ্ছিন্নভাবে পরীক্ষা নেয়। একই দিনে একাধিক পরীক্ষা পড়ে। পরীক্ষাগুলোয় নিয়মিত প্রশ্নপত্র ফাঁস, স্বজনপ্রীতির অভিযোগ উঠে। এ জন্য পিএসসির মাধ্যমে সরাসরি বা পিএসসির নির্দেশনায় পরীক্ষা নেয়া উচিত। 

যাচাইয়ের নামে হয়রানি নয়

বিসিএস চূড়ান্ত ফল প্রকাশের পর যোগদানে বিলম্বের আরেকটি বড় কারণ পুলিশ যাচাই। এই সময়সীমা কমানো উচিত। পাশাপাশি যাচাইয়ের নামে হয়রানি বন্ধ করা উচিত। বিসিএস পরীক্ষায় উত্তীর্ণ একজন প্রার্থীর প্রাক্-যাচাই ফরমে ১৬ ধরনের তথ্য দিতে হয়। সাধারণ তথ্যের পাশাপাশি তিনি কোনো মামলায় গ্রেপ্তার, অভিযুক্ত বা দণ্ডিত হয়েছেন কি না, এ তথ্য চাওয়া হয়। উত্তীর্ণ হওয়ার পর এসব যাচাই শেষ করে পুলিশের বিশেষ শাখা প্রতিবেদন দেয়। এর বাইরে অন্য কোনো তথ্য যাচাই করার কথা না থাকলেও বছরের পর বছর গোয়েন্দা সংস্থাগুলো প্রার্থীর পরিবারের রাজনৈতিক পরিচয় যাচাই করছে। অথচ ফৌজদারি অপরাধ ছাড়া একজনকেও আটকে দেওয়া ঠিক নয়। এটা অনৈতিক চর্চা।
 
আওয়ামী লীগ আমলে বিসিএসের ২৮তম ব্যাচ থেকে ৪২তম ব্যাচ পর্যন্ত অন্তত ২৬৫ জন প্রার্থীর নিয়োগ এভাবে আটকে ছিল। ভিন্ন রাজনৈতিক মতাদর্শ কিংবা নেতিবাচক গোয়েন্দা প্রতিবেদনের কারণ দেখিয়ে তাদের নিয়োগ দেওয়া হয়নি। আমি এ নিয়ে ধারাবাহিকভাবে প্রতিবেদন করেছি। ৫ আগস্টে সরকারের পতনের পর গত ১৪ আগস্ট তাদের সবার গেজেট হয়েছে। এর মানে বিসিএসে চূড়ান্তভাবে উত্তীর্ণদের আটকে রাখার কোনো সুযোগ নেই। আফসোস, এরপরও রাজনৈতিক রং খোঁজার চেষ্টা বন্ধ হয়নি। ৪৩ বিসিএসের ২ হাজার ক্যাডার এই সংকটে যোগ দিতে পারেনি। আটকে আছে ৪০ বিসিএসের পুলিশ কর্মকর্তারা। এগুলো অন্যায়।

লাখ লাখ প্রার্থীর সঙ্গে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করে একজন প্রার্থী যখন প্রিলিমিনারি, লিখিত ও মৌখিক শেষ করে চূড়ান্ত উত্তীর্ণ হন, তখন তার রাজনৈতিক রং খোঁজার চেষ্টা অনাকাঙ্ক্ষিত। শুধু নিয়োগ নয়, রাজনৈতিক পরিচয় কোনোভাবেই সরকারি চাকরিতে পদ বা পদোন্নতির জন্য যোগ্যতা বা অযোগ্যতা কোনোটাই হতে পারে না। শক্তিশালী ও জনবান্ধব জনপ্রশাসন চাইলে নিয়োগ থেকে শুরু করে পদোন্নতিতে শুধু মেধা, সততা ও যোগ্যতাকে বিবেচনায় আনা উচিত। সব সময় যদি মেধা, সততা ও যোগ্যতাকে প্রাধান্য দিয়ে পেশাদার জনপ্রশাসন গড়া যায়, তাহলে দেশ ও জনগন সবার জন্য মঙ্গল।

প্রশ্নপত্র ফাঁস হলেই পরীক্ষা বাতিল করতে হবে, সংশ্লিষ্টদের শাস্তি দিতে হবে

বিসিএস নিয়ে কম বেশি প্রশ্নপত্র ফাঁসের অভিযোগ উঠলেও এসব ঘটনায় দায়ীদের কখনোই শাস্তি হয় না। অভিযোগ উঠে, পিএসসির ভেতরের একদল কর্মকর্তা-কর্মচারীর যুক্ততা ছাড়া প্রশ্নপত্র ফাঁস অসম্ভব। কাজেই প্রশ্নপত্র ফাঁসের বিরুদ্ধে পিএসসিকে কঠোর হতে হবে। ক্যাডার বা নন-ক্যাডার যে কোনো পরীক্ষার প্রশ্নপত্র ফাঁস হলেই সঙ্গে সঙ্গে ওই পরীক্ষা বাতিল করতে হবে। এই পরীক্ষার দায়িত্বে থাকা পিএসসির সদস্য ও কর্মকর্তাসহ সংশ্লিষ্টদের জবাবদিহিতায় আনতে হবে। তাদের বিসিএস প্রক্রিয়া থেকে বহিষ্কার করতে হবে।  

পিএসসির চেয়ারম্যান ও সদস্য নিয়োগে সততা ও যোগ্যতা দেখতে হবে, নিয়মিত সবাইকে সম্পদের হিসেব দিতে হবে

বছরের পর বছর ধরে পিএসসি যেন সাবেক আমলা বা সরকারের পছন্দের লোকদের পুনবার্সন কেন্দ্রে পরিণত হয়েছে। চেয়ারম্যান বা সদস্য নিয়োগের ক্ষেত্রে যখন যে সরকার তার পছন্দের লোকদের পাঠায়। এর বদলে সত্যিকারভাবে যারা রাষ্ট্রের জন্য মেধাবী ও তরুণ কর্মকর্তা নিয়োগে কাজ করতে পারবেন, যাদের বিরুদ্ধে অতীতে কোনো ধরনের দুর্নীতি বা অনিয়মের অভিযোগ নেই, যারা নিয়োগপ্রক্রিয়ায় অবদান রাখতে পারবেন এমন মানুষকেই পিএসসিতে নিয়োগ দেওয়া উচিত। প্রয়োজনে সার্চ কমিটি গঠন করে সৎ, দক্ষ, অভিজ্ঞ, নিরপেক্ষ মানুষদের নিয়োগ দিতে হবে এবং প্রত্যেকের জবাবদিহিতা প্রতিষ্ঠা করতে হবে। সম্প্রতি প্রশ্নপত্র ফাঁসের অভিযোগ ওঠার পর পিএসসির অনেক কর্মকর্তা-কর্মচারীর বিপুল পরিমাণ সম্পদের অভিযোগ পাওয়া গেছে। অতীতেও এ ধরনের অভিযোগ উঠেছে। এ জন্য পিএসসির চেয়ারম্যান, সব সদস্য ও পিএসসির সব কর্মকর্তা-কর্মচারীর সম্পদের হিসাব দিতে হবে। পিএসসিকেই দুর্নীতিবাজ কর্মকর্তা-কর্মচারীর বিরুদ্ধে সবার আগে সক্রিয় হতে হবে।

পিএসসির জবাবদিহিতা নিশ্চিত করতে হবে

চাকরিপ্রার্থীরা পিএসসিতে কোনো বিষয়ে অভিযোগ জানাতে গেলে অনেক সময় তাদের সঙ্গে দুর্ব্যবহার করা হয়। তাদের কথা বলার কোনো সুযোগ নেই। চাকরিপ্রার্থীদের কাছে পিএসসির কোনো জবাবদিহিও নেই। এই জবাবদিহি সৃষ্টি করতে হবে। কেন একটি বিসিএসের নিয়োগ এক বছরেও হচ্ছে না, কেন প্রশ্নপত্র ফাঁস হয়, অতীতে নিয়োগে কী ধরনের অনিয়ম হয়েছেÑএসব বিষয়ে একটি নিরপেক্ষ তদন্ত করা উচিত। পিএসসিতে একজন সদস্য ও পরিচালকের নেতৃত্বে একটি শাখা করতে হবে, যেখানে চাকরিপ্রার্থীরা তাদের নানা অভিযোগ জানাতে পারবেন। বছরে একাধিকবার পিএসসি তরুণদের মুখোমুখি হয়ে নানা প্রশ্নের উত্তর দিতে পারে। সর্বোপরি পিএসসিকে জবাবদিহিতা নিশ্চিত করতে হবে।

আরও পড়ুন: ভুল পথে অন্তবর্তীকালীন সরকার!

ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের তরুণরা গত ২৬ নভেম্বর ‘সরকারি চাকুরীতে নিয়োগপ্রক্রিয়া এবং পিএসসির সংস্কার’ শীর্ষক একটি সেমিনারের আয়োজন করেছিল, যেখানে পিএসসির সাবেক সদস্য, সাবেক সরকারি কর্মকর্তা এবং ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের একাধিক শিক্ষক উপস্থিত ছিলেন। ওই অনুষ্ঠানে মূল প্রবন্ধে আমি পিএসসির সংস্কারে এই ১০টি দাবি তুলে ধরেছিলাম। 

বিষয়গুলো নিয়ে আমি বছরের পর বছর ধরে লিখছি, বলছি। দেশের সব তরুণ এবং নীতিনির্ধারকরা যেন বিষয়গুলো জানতে পারেন সে কারণে ফেসবুকে দেওয়া। কেউ একজন আলোচনার কিছু অংশ ভিডিও করেছেন। চাইলে এখানে দেখতে পারেন।

ভিডিওটা দেখে মনে হচ্ছে পুরো বক্তব্যটা ভিডিও থাকলে ভালো হতো। দেখেন আমি দুই দশক ধরে পিএসসি ও নিয়োগবিষয়ক সাংবাদিকতা ও লেখালেখির অভিজ্ঞতায় মনে করছি, এই বিষয়গুলো বাস্তবায়ন করা হলে নিয়োগে আরো স্বচ্ছতা প্রতিষ্ঠিত হবে এবং অনিয়ম কমে আসবে। এর ফলে দেশ ও জাতি যেমন উপকৃত হবে তেমনি পিএসসিও তারুণ্যবান্ধব হতে পারবে। আশা করছি পিএসসি ও সরকার বিষয়গুলো বিবেচনা করবে।

লেখক: সাংবাদিক
(ফেসবুক থেকে নেওয়া)