গুচ্ছ পদ্ধতির বিলোপ: শিক্ষার্থীদের স্বপ্নভঙ্গের শঙ্কা
বাংলাদেশের উচ্চশিক্ষার ক্ষেত্রে গুচ্ছভুক্ত বিশ্ববিদ্যালয়ভিত্তিক ভর্তি পদ্ধতি শিক্ষার্থীদের জন্য একটি যুগান্তকারী উদ্যোগ ছিল। এই পদ্ধতি চালুর ফলে শিক্ষার্থীদের সময়, অর্থ ও মানসিক চাপ উল্লেখযোগ্যভাবে কমে আসে। একাধিক বিশ্ববিদ্যালয়ের জন্য একক ভর্তি পরীক্ষার ব্যবস্থা শিক্ষার্থীদের জন্য যেমন সুবিধাজনক, তেমনি দেশের উচ্চশিক্ষা ব্যবস্থার জন্যও এটি একটি সমন্বিত দৃষ্টিভঙ্গি নিশ্চিত করেছিল। কিন্তু সম্প্রতি গুচ্ছ পদ্ধতির বিলোপের আলোচনা শিক্ষার্থীদের মধ্যে উদ্বেগ সৃষ্টি করেছে। বিশেষ করে দরিদ্র ও মধ্যবিত্ত পরিবারের শিক্ষার্থীদের জন্য বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়ার স্বপ্ন একটি দুঃস্বপ্ন হয়ে উঠছে।
গুচ্ছ পদ্ধতির সবচেয়ে বড় সুবিধা ছিল একবার ফি দিয়েই একাধিক বিশ্ববিদ্যালয়ে আবেদন করার সুযোগ। দরিদ্র ও মধ্যবিত্ত পরিবারগুলো এই পদ্ধতির মাধ্যমে আর্থিক সাশ্রয় করতে পেরেছে। তবে গুচ্ছ পদ্ধতি বাতিল হয়ে বিশ্ববিদ্যালয়গুলো আলাদা হয়ে গেলে প্রতিটি বিশ্ববিদ্যালয়ের জন্য পৃথকভাবে আবেদন করতে হবে। এতে প্রতিটি আবেদন ও পরীক্ষার জন্য আলাদা ফি দিতে হবে, যা দরিদ্র পরিবারের জন্য একটি বড় বাধা হয়ে দাঁড়াবে। আর্থিক সীমাবদ্ধতার কারণে অনেক শিক্ষার্থী উচ্চশিক্ষার স্বপ্ন থেকে বঞ্চিত হবে।
গুচ্ছ পদ্ধতি সব বিশ্ববিদ্যালয়ের জন্য একটি সমান মানদণ্ড তৈরি করেছিল। তবে আলাদা হলে প্রতিটি বিশ্ববিদ্যালয় নিজস্ব মানদণ্ড নির্ধারণ করবে, যা শিক্ষার্থীদের জন্য অসম প্রতিযোগিতার ক্ষেত্র তৈরি করতে পারে।
আরও পড়ুন: কৃষি গুচ্ছে ভর্তি: অপেক্ষমাণ প্রার্থীদের বিষয় ও বিশ্ববিদ্যালয় মনোনয়ন প্রকাশ
গুচ্ছ পদ্ধতিতে একটি নির্দিষ্ট কেন্দ্রে পরীক্ষা অনুষ্ঠিত হওয়ায় শিক্ষার্থীদের ভ্রমণ ও থাকার খরচ অনেকটাই কমে এসেছিল। বিশেষ করে প্রত্যন্ত অঞ্চল থেকে আসা শিক্ষার্থীরা এর সুবিধা পেয়েছে। তবে বিশ্ববিদ্যালয়গুলো আলাদা হলে একাধিক জায়গায় ভর্তি পরীক্ষা অনুষ্ঠিত হবে। এতে শিক্ষার্থীদের একাধিক জায়গায় ভ্রমণ করতে হবে ও সেখানে থাকার খরচ যোগ করতে হবে। দরিদ্র পরিবারের সন্তানদের জন্য এ ব্যয়ভার বহন করা প্রায় অসম্ভব হয়ে পড়বে। বিষয়টিও বিবেচনায় নেওয়া জরুরি!
দরিদ্র পরিবার থেকে উঠে আসা শিক্ষার্থীরা সীমিত সম্পদে নিজেদের উচ্চশিক্ষার স্বপ্ন পূরণের জন্য কঠোর পরিশ্রম করে। গুচ্ছ পদ্ধতি তাদের এই স্বপ্নকে সহজ ও বাস্তবসম্মত করে তুলেছিল। কিন্তু পদ্ধতিটি বাতিল হয়ে গেলে তাদের সামনে একাধিক পরীক্ষার চাপ, ভর্তির জন্য বাড়তি প্রতিযোগিতা ও আর্থিক বাধা একত্রে কাজ করবে। এ পরিস্থিতি শিক্ষার্থীদের মানসিক চাপ ও হতাশা বাড়িয়ে দিতে পারে। অনেকেই অর্থনৈতিক সীমাবদ্ধতার কারণে উচ্চশিক্ষার সুযোগ গ্রহণে নিরুৎসাহিত হবে। আর বর্তমানের মানসিক হতাশা চরম আকার ধারণ করেছে। হয়তো এ ধরনের পরিস্থিতিতে অনেক শিক্ষার্থী ভুল সিদ্ধান্ত নিয়ে নিজেদের জীবন বিপন্ন করতে পারে।
গুচ্ছ পদ্ধতির অন্যতম ইতিবাচক দিক ছিল একটি সমন্বিত ও সুশৃঙ্খল শিক্ষা ব্যবস্থা নিশ্চিত করা। আলাদা হলে বিশ্ববিদ্যালয়গুলোর ওপর প্রশাসনিক চাপ বৃদ্ধি পাবে। আলাদা পরীক্ষা আয়োজনের ব্যয় বৃদ্ধি পাবে এবং শিক্ষার মান বজায় রাখা কঠিন হয়ে পড়বে। দরিদ্র ও সুবিধাবঞ্চিত শিক্ষার্থীদের অংশগ্রহণ কমে গেলে জাতীয়ভাবে দক্ষ জনশক্তি তৈরিতেও এর নেতিবাচক প্রভাব পড়বে।
আরও পড়ুন: ৫ম মনোনয়ন: গুচ্ছে ভর্তির মাইগ্রেশন বন্ধ করতে হবে আজকের মধ্যে
প্রতিটি বিশ্ববিদ্যালয় আলাদা ভর্তি পরীক্ষা পরিচালনা করলে প্রশাসনিক ব্যয় ও জটিলতা বৃদ্ধি পাবে। একই সঙ্গে মানসম্মত পরীক্ষা আয়োজন করা এবং এর স্বচ্ছতা নিশ্চিত করাও কঠিন হয়ে উঠবে। গুচ্ছ পদ্ধতি বিশ্ববিদ্যালয়গুলোর মধ্যে সহযোগিতামূলক একটি পরিবেশ তৈরি করেছিল। এটি ভেঙে গেলে বিশ্ববিদ্যালয়গুলোর মধ্যে প্রতিযোগিতার মনোভাব বৃদ্ধি পাবে, যা উচ্চশিক্ষার মান উন্নয়নে নেতিবাচক প্রভাব ফেলতে পারে।
গুচ্ছভুক্ত পদ্ধতির সুবিধাগুলো বিবেচনা করে এটি আরও পরিপূর্ণ ও কার্যকর করার চেষ্টা করা উচিত। যদি কোনো কারণে এ পদ্ধতি বাতিলের সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়। তবে শিক্ষার্থীদের স্বার্থ সুরক্ষায় একটি সহজ ও সুষম ভর্তি ব্যবস্থা চালু করা জরুরি। পাশাপাশি শিক্ষার্থীদের মানসিক ও আর্থিক চাপ কমাতে নীতিনির্ধারকদের বিশেষ গুরুত্ব দেওয়া উচিত।
আরও পড়ুন: গুচ্ছ ভর্তি পরীক্ষা থেকে বেরিয়ে আসতে চান বাকৃবি শিক্ষক-শিক্ষার্থীরা
গুচ্ছভুক্ত বিশ্ববিদ্যালয়গুলো আলাদা হলে শিক্ষার্থীদের জন্য যে সমস্যাগুলো তৈরি হবে, তা শুধু ব্যক্তিগত পর্যায়েই নয়, বরং জাতীয় পর্যায়েও শিক্ষার মান ও সুযোগ-সুবিধা নিশ্চিতকরণে প্রতিবন্ধকতা সৃষ্টি করবে। তাই এসব সমস্যা বিবেচনা করে গুচ্ছ পদ্ধতি বজায় রাখা অথবা বিকল্প কোনো কার্যকর ব্যবস্থা গ্রহণ করাই হবে সময়োপযোগী সিদ্ধান্ত। গুচ্ছ পদ্ধতি ছিল উচ্চশিক্ষায় একটি উদ্ভাবনী উদ্যোগ, যা দরিদ্র শিক্ষার্থীদের স্বপ্ন পূরণে সহায়ক ছিল। পদ্ধতিটির বিলোপ শিক্ষার্থীদের বিশেষত দরিদ্র ও প্রত্যন্ত অঞ্চলের শিক্ষার্থীদের জন্য একটি বড় বাধা হয়ে দাঁড়াবে। শিক্ষা এমন একটি মৌলিক অধিকার, যা কারও আর্থিক সীমাবদ্ধতার কারণে বঞ্চিত হওয়া উচিত নয়। গুচ্ছ পদ্ধতির সুবিধাগুলো বিবেচনায় রেখে এটি আরও উন্নত করার উদ্যোগ নেওয়া উচিত। একই সঙ্গে দরিদ্র শিক্ষার্থীদের আর্থিক ও মানসিক চাপ কমিয়ে উচ্চশিক্ষার পথ সুগম করা আমাদের শিক্ষানীতির অন্যতম প্রধান লক্ষ্য হওয়া উচিত।
লেখক: ভর্তিচ্ছু শিক্ষার্থী, এইচএসসি ২০২৪