শেখ হাসিনার অডিও কল, ট্রাম্পকার্ড ও ভারতীয় গণমাধ্যমের অতিরঞ্জন

পলাশ সরকার
পলাশ সরকার  © সংগৃহীত

কয়েকদিন পরপর প্রতিবেশী দেশ ভারতে অবস্থান করা বাংলাদেশের ক্ষমতাচ্যুত প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার অডিও রেকর্ড ফাঁস হচ্ছে। তবে সর্বশেষ অডিও ক্লিপের কথোপকথন, বিশ্বের সবচেয়ে ক্ষমতাধর ব্যক্তির ছবি ব্যবহার করে বিশৃঙ্খলা সৃষ্টির জন্য উসকানি এবং কিছু ভারতীয় পত্রিকায় এ খবরের পরিবেশন বাড়তি মনোযোগের দাবি রাখে। এই ঘটনাটি একই সঙ্গে ইচ্ছাকৃতভাবে একটি ঘটনার জন্ম দেওয়া ও একে অতিরঞ্জিত করে মিথ্যা তথ্যের সংমিশ্রণ ঘটিয়ে পরিবেশনের কেমন ফল আসতে পারে— তার একটি টেস্ট কেস হিসেবে বিবেচনা করা যেতে পারে।

যে বিষয়টি নিয়ে আমরা আলোচনা করব, তার সূত্রপাত গত ৮ নভেম্বর। ওই দিন সাবেক প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার নতুন আরো একটি অডিওরেকর্ড ছড়িয়ে পড়ে সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে। এই ফোনালাপে শেখ হাসিনা অপরপ্রান্তে থাকা ব্যক্তিকে আমেরিকার সদ্য নির্বাচিত প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্পের ছবি সম্বলিত পোস্টার নিয়ে ১০ ডিসেম্বর শহীদ নূর হোসেন দিবসে দলীয় নেতাকর্মীদের মিছিল বের করতে বলেন। তিনি বলেন, এতে যদি কেউ  বাধা দেয়, হামলা করে, তাহলে তা ট্রাম্পের ছবিতে হামলা হবে বলে বিবেচিত হবে। আর হামলার ছবি তোলার জন্য আলাদা লোক থাকবে এবং ছবি পাঠানো হবে ট্রাম্পের কাছে। শেখ হাসিনা দাবি করেন, ট্রাম্পের সঙ্গে তার ভালো যোগাযোগ আছে।

এর পরদিন শনিবার রাতে অর্থাৎ নূর হোসেন দিবসের আগের রাতে পুলিশ ডোনাল্ড ট্রাম্পের পোস্টারসহ ১০ জনকে রাজধানীর বিভিন্ন স্থান থেকে গ্রেফতার করে। ঢাকা মহানগর পুলিশের (ডিএমপি) পক্ষ থেকে বলা হয়, গ্রেফতারকৃতদের মধ্যে সম্প্রতি আওয়ামী লীগ সভাপতি শেখ হাসিনার ভাইরাল হওয়া অডিও ক্লিপের নির্দেশনা বাস্তবায়নকারীসহ বেশ কয়েকজন আওয়ামী লীগ কর্মী রয়েছেন। পুলিশ আরো জানায়, বাংলাদেশের বন্ধু প্রতিম রাষ্ট্র যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গে সুসম্পর্ক বিনষ্টের অপচেষ্টার অংশ হিসেবে তারা এই অপতৎপরতার পরিকল্পনা করেছে।

শেখ হাসিনার নির্দেশমতে গুলিস্তানেরর জিরো পয়েন্টে শহীদ নূর হোসেন দিবসের কর্মসূচির ঘোষণা দেওয়া হয় আওয়ামী লীগের ভেরিফায়েড ফেসবুক পেজ থেকে। সে মোতাবেক আওয়ামী লীগের কিছু নেতাকর্মী জড়ো হওয়ার চেষ্টা করেন। তবে জিরো পয়েন্ট এলাকায় বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের গণজমায়েত এবং বিএনপি, যুবদল ও ছাত্রদল এবং ইসলামী ছাত্রশিবিরের শক্ত অবস্থান কর্মসূচি দেখা যায়। মাস্ক পরে আওয়ামী লীগের আটদশজন করে কর্মী-সমর্থক বিক্ষিপ্তভাবে কয়েকটি মিছিল করেছিল। তবে কোথাও দাঁড়াতে পারেনি আওয়ামী লীগ। পুলিশ জানিয়েছে, অপতৎপরতা রোধে রাজধানীর বিভিন্ন এলাকা থেকে ৩৩ জনকে গ্রেফতার করেছে।

ইন্ডিয়া টুডে এক ভিডিও প্রতিবেদনের শিরোনামে লিখেছে, ‘বাংলাদেশে ডোনাল্ড ট্রাম্পের সমর্থকদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা।’ অথচ ওইদিন শেখ হাসিনার নির্দেশে কৌশলের অংশ হিসেবে ট্রাম্পের পোস্টার নিয়ে মাঠে নেমেছিল আওয়ামী লীগের লোকজন। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্টের অনুসারী কেউ ছিল না, সে সুযোগও নেই।

শেষ পর্যন্ত শেখ হাসিনার পরিকল্পনা মেতাবেক সংবাদ পরিবেশন করল ভারতের কয়েকটি গণমাধ্যম। তারা বাংলাদেশে আওয়ামী লীগের কর্মী-সমর্থক বা নেতাদের   মিছিলকে  ‘ট্রাম্পের সমর্থকদের’ মিছিল হিসেবে প্রচার করেছে।

এ নিয়ে ইন্ডিয়া টুডে এক ভিডিও প্রতিবেদনের শিরোনামে লিখেছে, ‘বাংলাদেশে ডোনাল্ড ট্রাম্পের সমর্থকদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা।’ অথচ ওইদিন শেখ হাসিনার নির্দেশে কৌশলের অংশ হিসেবে ট্রাম্পের পোস্টার নিয়ে মাঠে নেমেছিল আওয়ামী লীগের লোকজন। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্টের অনুসারী কেউ ছিল না, সে সুযোগও নেই। বাংলাদেশের মানুষ রাজনীতি সচেতন। বিশ্ব ও দেশীয় রাজনীতি, ইউক্রেন যুদ্ধ, গাজা হামলা, আমেরিকার প্রেসিডেন্ট নির্বাচন প্রভৃতি নিয়ে তাদের আগ্রহ আছে। কিন্তু মার্কিন প্রেসিডেন্টের  অনুসারী কিংবা ডেমোক্রেট বা রিপাবলিকান পার্টির কর্মী এ দেশে রয়েছে- এমনটা কখনো শোনা যায়নি।

এনডিটিভি তাদের একটি প্রতিবেদনে শিরোনামে লিখেছে, মিছিলের ডাক দেওয়ার পর শেখ হাসিনার দলীয় কার্যালয়ের বাইরে সংঘাত। উত্তপ্ত ঢাকা। কিন্তু ১০ নভেম্বর  গুলিস্তানে আওয়ামী লীগের দলীয় কার্যালয়ের বাইরে কোনো সংঘর্ষের ঘটনা ঘটেনি। ওইদিন যারা বিক্ষিপ্তভাবে সেখানে গিয়েছিল, তাদের কেউ কেউ আওয়ামী লীগের সমর্থনে স্লোগান দিলে তাদের কয়েকজনকে ধরে পুলিশের হাতে তুলে দিয়েছিল সরকার সমর্থিতরা। ঢাকার আয়তন ৩০৬ বর্গকিলোমিটার, এর জনসংখ্যা সোয়া দুই কোটির মতো। গুলিস্তান এলাকার রেশ বৃহৎ ঢাকার অন্যপ্রান্তে পড়েনি। শহরবাসীর মধ্যেও এর কোনো প্রভাব দেখা যায়নি।

ডোনাল্ড ট্রাম্পের ছবি নিয়ে বিক্ষোভের পরিকল্পনা ছিল আওয়ামী লীগ কর্মীদের

রাজধানীর জিরো পয়েন্ট মূলত সেদিন ছিল ছাত্র ও বিএনপি- জামায়াতের নেতাকর্মীদের নিয়ন্ত্রণে। সেখানে উল্লেখ  করার মতো পরিস্থিতি হয়নি, তবে কয়েকজনকে মারধর করা হয়েছিল।

নিউজট্র্যাক নামের একটি সংবাদমাধ্যম লিখেছে, বাংলাদেশে আবারও বিশৃঙ্খলা। আওয়ামী লীগ কর্মীদের বিক্ষোভ ঠেকাতে ডাকা হয়েছে সেনাবাহিনীকে। সংবাদমাধ্যমটির প্রতিবেদনে আওয়ামী লীগকে কর্মসূচি পালন করতে না দেওয়ার ব্যাপারে অন্তর্বর্তী সরকারের ঘোষণার কথা উল্লেখ করা হয়েছে।

দ্য ভোকাল নিউজ নামের একটি সংবাদমাধ্যম লিখেছে, ‘বাংলাদেশ ট্রাবল : হাসিনার কয়েকশ কর্মী আটক। সেনাবাহিনী মোতায়েন।’ অথচ সেদিন কয়েকশ কর্মীকে আটকের ঘটনা ঘটেনি। ৫ আগস্টের পর পুলিশ বাহিনীতে অস্থিরতা দেখা দেয়। অনেক পুলিশ সদস্য কাজে যোগদানে বিরত থাকে। আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতির কিছুটা অবনতি দেখা যায়। এমন পরিস্থিতিতে দেশে সেনা মোতায়েন করা হয়। এখন সেনাবাহিনী, পুলিশ র‌্যাব দেশের আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতি স্বাভাবিক করতে ও অবৈধ অস্ত্র উদ্ধারে কাজ করছে। কিন্তু দ্য ভোকাল সেনাবাহিনী মোতায়েন বলে ঘটনাকে যেভাবে চিত্রিত করতে চাইছে, বিষয়টি সেরকম কিছু ছিল না।

ভারতীয় গণমাধ্যমের সংবাদ যে মিথ্যা ও বানোয়াট তার প্রমাণ পাওয়া যায় আওয়ামী লীগের ফেসবুক পেজের পোস্ট থেকে। ১০ নভেম্বর আওয়ামী লীগের ভেরিফায়েড ফেসবুক পেজ থেকে একটি বার্তা দেওয়া হয়। যেখানে উল্লেখ করা হয়, ‘শত বাধার মুখেও মতিঝিল বাংলাদেশ ব্যাংকের সামনে থেকে মিছিল নিয়ে গেছে আওয়ামী লীগের কর্মীরা জিরো পয়েন্টের উদ্দেশ্যে। বিএনপি, পুলিশ আর আর শিবিরের কর্মীদের বাধা। ধাওয়া, পালটা ধাওয়া।’ আওয়ামী লীগের পোস্টে কোথাও বলা হয়নি ট্রাম্পের অনুসারীরা মিছিল করেছে। তবে ফেসবুকে অনেকে মন্তব্য করেন, ফেসবকু ছাড়া কোথাও আওয়ামী লীগকে দেখা যায়নি। ছাত্র- জনতা মনে করে আওয়ামী লীগের দালালদের মিছিল মানুষ ঘৃণাভরে প্রত্যাখান করেছে।

বাংলাদেশে আওয়ামী লীগের বাইরের যেকোনো সরকারের বিরুদ্ধে ভারতের কিছু গণমাধ্যমের নেতিবাচক প্রতিবেদন প্রকাশের নজির রয়েছে। বাংলাদেশের নতুন সরকার গঠন, দেশের রাজনৈতিক পরিস্থিতি ও সংখ্যালঘু সম্প্রদায় নিয়ে বেশ কিছু বিভ্রান্তিকর সংবাদ ওই গণমাধ্যমগুলো ইতিমধ্যে প্রচার করেছে।

ভারতীয় গণমাধ্যমে এমন খবরের পর পুলিশের পক্ষ থেকে বলা হয়, বাংলাদেশে যুক্তরাষ্ট্রের নির্বাচিত প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্পের সমর্থকদের গ্রেফতার বা দমন অভিযানের কোনো ঘটনা ঘটেনি। তবে রাজধানীতে নাশকতামূলক কর্মকান্ডের পরিকল্পনার অভিযোগে রবিবার (১০ নভেম্বর) দেশে গণহত্যা, দুর্নীতি ও অর্থ পাচারের অভিযোগে আওয়ামী লীগের কয়েক ডজন নেতাকর্মী ও সদস্যদের ঢাকা থেকে গ্রেফতার করা হয়েছে।

এ ব্যাপারে বাংলাদেশের অর্ন্তবর্তী সরকারের প্রধান উপদেষ্টার প্রেস উইংয়ের ফ্যাক্টচেকিং ফেসবুক পেজে দেওয়া এক পোস্টে বলা হয়েছে, যুক্তরাষ্ট্রের নির্বাচিত প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্পের সমর্থকদের গ্রেফতার বা দমন অভিযানের কোনো ঘটনা বাংলাদেশে ঘটেনি। আগস্টে অভূতপূর্ব বিপ্লবে শেখ হাসিনা ক্ষমতাচ্যুত হওয়ার পর থেকে কিছু ভারতীয় সংবাদপত্র শিক্ষার্থীদের নেতৃত্বাধীন গণ-অভ্যুত্থান সম্পর্কে আক্রমণাত্মকভাবে ভুল তথ্য প্রচার করছে। তারা বিপ্লবোত্তর দিনগুলোতে সংখ্যালঘুদের বিরুদ্ধে সহিংসতার ঘটনাগুলোকে ব্যাপকভাবে অতিরঞ্জিত করেছে। আওয়ামী লীগ-সমর্থকদের গ্রেপ্তারের ঘটনাও তারা একইভাবে অতিরঞ্জিত করেছে।

বাংলাদেশে আওয়ামী লীগের বাইরের যেকোনো সরকারের বিরুদ্ধে ভারতের কিছু গণমাধ্যমের নেতিবাচক প্রতিবেদন প্রকাশের নজির রয়েছে। বাংলাদেশের নতুন সরকার গঠন, দেশের রাজনৈতিক পরিস্থিতি ও সংখ্যালঘু সম্প্রদায় নিয়ে বেশ কিছু বিভ্রান্তিকর সংবাদ ওই গণমাধ্যমগুলো ইতিমধ্যে প্রচার করেছে। এরজন্য একদিকে ওই গণমাধ্যমগুলোর সাংবাদিকদের সঠিক ও বিশ্বাসযোগ্য তথ্যের ঘাটতি ছিল ধরে নেওয়া যায়।  অন্যদিকে রাজনৈতিক বা কৌশলগত স্বার্থকেও সামনে রেখে প্রতিবেশী দেশ নিয়ে ওই গণমাধ্যমগুলো অতিরঞ্জিত সংবাদ প্রকাশ করছে বলে মনে করা হচ্ছে। আগামীতেও যে এ ধরনের মিথ্যা ও বানোয়াট খবর প্রকাশের প্রবণতা চলতে থাকবে তা অনুমেয়। সরকারকে এগুলো মোকাবিলায় কৌশল ঠিক করা জরুরি। 

লেখক : সংবাদকর্মী 


সর্বশেষ সংবাদ