ইতিহাসের বাঁক বদলে দেওয়া ৭ নভেম্বর ও বাংলাদেশি জাতীয়তাবাদ
বাংলাদেশের রাজনৈতিক ইতিহাসে ৭ নভেম্বর এক বিশেষ দিন। ১৯৭৫ সালের এই দিনে গভীর রাজনৈতিক সংকটে নিমজ্জিত বাংলাদেশ-এর উত্তরণ ঘটেছিল। কাঁধে কাঁধ মিলিয়ে এককাতারে দাঁড়িয়েছিল সিপাহী-জনতা। বিজয় লাভ করেছিল সিপাহী-জনতার বিপ্লব। যে বিজয় বাংলাদেশের ইতিহাসের প্রচলিত বাঁক বদলে দিয়ে সৃষ্টি করেছিল নতুন রাজনৈতিক পথ।
পাকিস্তানের শাসকগোষ্ঠীর অব্যাহত নির্যাতন-বৈষম্য থেকে মুক্তিতে লক্ষ লক্ষ মানুষ বিনাবাক্যে স্বাধীনতা যুদ্ধে ঝাঁপিয়ে পড়েছিল। গণতন্ত্র, সাম্য ও মানবাধিকার প্রতিষ্ঠা করায় ছিল তাদের মূল স্পৃহা। কিন্তু স্বাধীনতার অল্প দুয়েক বছরের মধ্যেই মোহভঙ্গ ঘটে। দেখা গেল, যে ভোটাধিকারের জন্য দেশ স্বাধীন হলো, সেই ভোটাধিকার কেড়ে নিয়ে প্রতিষ্ঠা করা হল এক দলীয় শাসন - বাকশাল।
একদলীয় শাসনের আট মাসেই ঘটে গেল শেখ মুজিবুর রহমান হত্যাকাণ্ড। এই হত্যাকাণ্ডের পরের তিন মাস ছিল চরম অনিশ্চয়তার এক সময়। সামরিক ক্যু ও পাল্টা ক্যু এভাবে চলতে গিয়ে হাজির হয় ৭ নভেম্বর। সিপাহী-জনতার এক অভূতপূর্ব মেলবন্ধনে রাজনীতির মঞ্চে হাজির হন জিয়াউর রহমান। তারপর শুরু হয় রাষ্ট্রপতি জিয়াউর রহমানের শাসন। যে শাসনের মূল ভিত্তি হিসেবে আবির্ভূত ও প্রতিষ্ঠিত হয় - বাংলাদেশি জাতীয়তাবাদ।
বাঙালি জাতীয়তাবাদের পরিবর্তে বাংলাদেশি জাতীয়তাবাদ রাজনৈতিক মতবাদ হিসেবে খুব অল্প সময়ে জনপ্রিয়তা লাভ করে। জিয়াউর রহমানের বাংলাদেশি জাতীয়তাবাদকে সাধারণ মানুষ মুক্তির প্রকৃত স্পৃহা হিসেবে গ্রহণ করে নেয়। জাতিবাদী ও নাগরিক জাতীয়তাবাদ নামে বহুল পরিচিত দুই ধারণা থেকে বের হয়ে এসে নতুন দর্শন 'বাংলাদেশি জাতীয়তাবাদ' হয়ে উঠে নতুন ঐক্যের প্রতীক। মওলানা ভাসানী ও আবুল মনসুর আহমদের আলোচনা ও লেখায় "বাংলাদেশি জাতীয়তাবাদ"-এর উল্লেখ পাওয়া গেলেও তা সুস্পষ্ট ছিল না। মূলত ৭ নভেম্বরের পর রাজনৈতিক, অর্থনৈতিক ও সামাজিক কর্মকাণ্ডের মাধ্যমে জিয়াউর রহমান বাংলাদেশি জাতীয়তাবাদের প্রয়োগ করেন। তাই বলা যায় ৭ নভেম্বরের দার্শনিক উৎপাদন হচ্ছে - বাংলাদেশি জাতীয়তাবাদ।
আমার কাছে জিয়াউর রহমানের প্রজ্ঞার চূড়ান্ত দৃষ্টান্ত মনে হয়, বাংলাদেশি জাতীয়তাবাদ ধারণাকে প্রতিষ্ঠা করা। কারণ উনিশ শতকের মাঝামাঝি সময় থেকে জাতিবাদী জাতীয়তাবাদের আবেদন কমে যেতে শুরু করেছিল। জাতিবাদী জাতীয়তাবাদের বিকল্প হিসেবে নাগরিক জাতীয়তাবাদের যে বিকাশ ঘটেছিল তাও বিংশ শতকের মাঝামাঝিতে দুর্বল হয়ে পড়ে। তারপর থেকে পৃথিবীর বিভিন্ন দেশের রাজনীতির প্রপঞ্চে রাষ্ট্রীয় জাতীয়তাবাদ শক্তিশালী হয়ে উঠে। দেশে দেশে ভূখণ্ডভিত্তিক জাতীয়তাবাদের নেতারা জনগণের ত্রাতা হিসেবে আবির্ভূত হয়। যেমন বিপর্যস্ত ফ্রান্সের রাজনৈতিক মর্যাদা সংরক্ষণে আবির্ভাব হয়েছিল জেনারেল দ্য গল-এর; মিসরের উত্থানের জন্য প্রয়োজন হয়েছিল জামাল নাসেরের। তেমনি ৭ নভেম্বরের ক্রান্তিকালে বাংলাদেশের দরকার ছিল একজন জাতীয়তাবাদী নেতার। জিয়াউর রহমান সেই বাস্তবতা অনুধাবনে সক্ষম হয়েছিলেন। তাই তিনি প্রতিষ্ঠা করলেন রাষ্ট্রীয় জাতীয়তাবাদের বাংলা ভার্সন - বাংলাদেশি জাতীয়তাবাদ।
তিনি এই ধারণার ব্যাখ্যা দিতে গিয়ে ‘বাংলাদেশি জাতীয়তাবাদ’ শীর্ষক নিবন্ধে লিখেন, ‘বাংলাদেশি জাতীয়তাবাদের মোটামুটি সাতটি মৌলিক বিবেচ্য বিষয় রয়েছে। তা হচ্ছে, (১) বাংলাদেশের ভূমি অর্থাৎ আন্তর্জাতিক সীমারেখার মধ্যবর্তী আমাদের ভৌগোলিক ও রাজনৈতিক এলাকা; (২) ধর্ম ও গোত্র নির্বিশেষে দেশের জনগণ; (৩) আমাদের ভাষা বাংলা ভাষা; (৪) আমাদের সংস্কৃতি-জনগণের আশা আকাঙ্ক্ষা, উদ্দীপনা ও আন্তরিকতার ধারক ও বাহক আমাদের নিজস্ব কৃষ্টি ও সংস্কৃতি; (৫) দুশো বছর উপনিবেশ থাকার প্রেক্ষাপটে বিশেষ অর্থনৈতিক বিবেচনার বৈপ্লবিক দিক; (৬) আমাদের ধর্ম- প্রতিটি নারী ও পুরুষের অবাধে তাদের নিজ নিজ ধর্মীয় অনুশাসন ও রীতিনীতি পালনের পূর্ণ স্বাধীনতা; (৭) ১৯৭১ সালের স্বাধীনতা যুদ্ধ।" জাতীয়তাবাদী দর্শনের ব্যাখ্যা দিতে গিয়ে তিনি বলেন, "ভাষা-ধর্মের কোনো ফুলকে অস্বীকার করব না, কিন্তু ধর্ম, ভাষা, সাহিত্য-সংস্কৃতি ইতিহাস, ভূগোল, অর্থনীতি, ভাষা বিদ্রোহ এবং স্বাধীনতাযুদ্ধের বিভিন্ন ফুল নিয়ে যে তোড়া বেঁধেছি- এতে সব ফুল আছে- এটিই বাংলাদেশি জাতীয়তাবাদ। বাঙালি জাতীয়তাবাদের সাথে এর কোনো বিরোধ নেই; কিন্তু এটি শুধু আংশিক সংজ্ঞা। তাই আমরা বাংলাদেশি জাতীয়তাবাদের পুরো সংজ্ঞায় পরিচিত হতে চাই, একটি ফুল নয়, এবার একটি ফুলের তোড়া চাই।" 'বাংলাদেশি জাতীয়তাবাদ’ প্রবন্ধে তিনি স্পষ্টভাবে বলেন, বাংলাদেশি জাতীয়তাবাদ একদিকে যেমন ধর্মভিত্তিক নয়, তেমনি আবার ধর্ম-বিমুখও নয়। এই জাতীয়তাবাদ আবার প্রত্যেকের ধর্মীয় বিশ্বাস ও ধর্মীয় অধিকার নিশ্চিত করবে।
স্বাধীন বাংলাদেশর ৫৪ বছরের বাস্তবতায় এটাই সত্য, আধুনিক বাংলাদেশের মূল ভিত্তি এখনো বাংলাদেশি জাতীয়তাবাদ। এই নীতিতে থেকে জিয়াউর রহমান দেশের রাজনৈতিক, সামাজিক, অর্থনৈতিক ক্ষেত্রসহ যাবতীয় ক্ষেত্রে অবদান রেখেছেন তা অন্য শাসকরা কল্পনাও করেননি। ফলে তিনি হয়ে উঠেছিলেন একজন সফল রাষ্ট্রনায়ক। বাংলাদেশি জাতীয়তাবাদের পূর্ণাঙ্গ চর্চায় তিনি তাত্ত্বিক ও প্রায়োগিক কার্যক্রমের পাশাপাশি আইনগত বৈধতার খাতিরে সংবিধানের পঞ্চম সংশোধনীর মধ্য দিয়ে ৬ নম্বর ধারায় (২) উপধারায় যুক্ত করেছিলেন, বাংলাদেশের নাগরিকগণ বাংলাদেশি বলিয়া পরিচিত হইবেন। এ সংশোধনের মধ্য দিয়ে বহু অবাঙালি ও আদিবাসী বাংলাদেশেরই মানুষ বলে স্বীকৃতি পায়। এ প্রসঙ্গে রাষ্ট্রবিজ্ঞানী প্রফেসর ড. এমাজউদ্দীন আহমদ তার এক প্রবন্ধে লিখেন, "বাংলাদেশে বহুসংখ্যক বিভিন্ন মতের ও ধর্মের জাতিগোষ্ঠী বাস করে। তাদের সংস্কৃতি ও জীবনযাত্রার মাত্রা ও ধরন বিভিন্ন। তাই জিয়া মনে করেন যে, শুধুমাত্র ভাষা বা সংস্কৃতির ভিত্তিতে নয়, বরং ভূখণ্ডের ভিত্তিতেই জাতীয়তাবাদকে গ্রহণ করা উচিত।"
পরিশেষ বলা যায়, শহীদ জিয়াউর রহমানের ‘বাংলাদেশি জাতীয়তাবাদ’ একটি যুগান্তকারী ধারণা। জাতিরাষ্ট্র হিসেবে বাংলাদেশের টিকে থাকাও নির্ভর করে এই জাতীয়তাবাদের ওপর। সমৃদ্ধির পথে এগিয়ে যেতেও মূল চালিকা শক্তি হিসেবে বাংলাদেশি জাতীয়তাবাদের বিকল্প নেই। এই রাজনৈতিক দর্শনই আমাদের দক্ষিণ এশিয়াতে স্বাতন্ত্র্য প্রদান করেছে। এজন্য বাংলাদেশের টিকে থাকা ও সমৃদ্ধিতে 'বাংলাদেশি জাতীয়তাবাদ'-এর চর্চা ও প্রয়োগ অধিক প্রয়োজন। সেই চর্চার আয়োজন ব্যক্তিগত ও জাতীয় পর্যায় থেকে শুরু হোক- জাতীয় বিপ্লব ও সংহতি দিবসে এই প্রত্যাশা রইলো।
লেখক: শিক্ষক ও গবেষক