২৮ নভেম্বর ২০১৮, ১৫:৫৭

আদর্শ শিক্ষক রাজনীতি বনাম প্রচলিত শিক্ষক রাজনীতি

অধ্যাপক এম এম আকাশ

অ্যারিস্টটল বলেছিলেন ‘ম্যান ইজ এ পলিটিকাল এনিমাল’। শিক্ষকরা নিশ্চয়ই মানুষ। মানুষ হিসেবে তাদেরও একটা রাজনীতিক আদর্শ থাকে। সেটাই স্বাভাবিক। আরো গুরুত্বপূর্ণ বিষয় হচ্ছে- যেহেতু তারা ভাবাদর্শ নির্মাণ করেন, বুদ্ধিবৃত্তিক জগতে কাজ করেন এবং নানা তত্ত্ব নিয়ে আলোচনা করেন, দেশ-দুনিয়ার খবর রাখেন সেহেতু তাদের দায়িত্ব হচ্ছে প্রত্যেকটা রাজনীতির অন্তর্গত বৃহত্তর যে দর্শন, যে ভিশন বা রুপকল্প সেটা চিহ্নিত করা ও নির্মাণ করতে সাহায্য করা। এইভাবে রাজনীতি নিছক ক্ষমতার লড়াই না হয়ে আদর্শের লড়াইয়ে পরিনত হয়। সুতরাং বাস্তব ইতিবাচক প্রয়োজন এবং ব্যক্তিগত সামাজিক অবস্থান- দু’দিক থেকেই শিক্ষক রাজনীতি খুবই স্বাভাবিক ব্যাপার।

তবে শিক্ষক রাজনীতির সক্রিয়তার মাত্রা কতটুকু হবে, তার চরিত্র কী রকম হবে- সেটা ব্যক্তি ভেদে বিভিন্ন হতে পারে। কিন্তু যেহেতু তারা বুদ্ধিবৃত্তিক শ্রমেই মূলত মনোনিবেশ করেন তাদের কাজকর্মের ধরণ হবে মূলত মানসিক কাজকর্ম। রাজনৈতিক মিছিল-মিটিং, ব্যারিকেডের যুদ্ধ, ঘাটে-মাঠে বক্তৃতা এবং ব্যাপক গনসংযোগ ইত্যাদিতে তাদের ‘কম্পারেটিভ এ্যাডভানটেজ’ বা তুলনামূলক সুবিধা কম। তাদের সুবিধা হচ্ছে টেবিল-টকে, সেমিনারে, তর্কবিতর্কে, মিডিয়াতে এবং সর্বোপরি বই-পুস্তক, মেনিফেস্টো রচনা, নির্বাচনী প্রকাশনা এগুলোতে। সুতরাং এই শ্রম-বিভাজনটিই স্বাভাবিক এবং সেটাই প্রচলিত শিক্ষক রাজনীতিতে অধিকাংশ রাজনীতি সচেতন শিক্ষকরা রক্ষা করে চলেন। তবে দুই জায়গাতেই ব্যতিক্রম আছে । অনেক রাজনীতিবিদ আছেন যারা আসলে ইনটেলিকচুয়াল এবং অনেক ইনটেলিকচুয়াল আছেন যারা প্রায়োগিক রাজনীতি করতে একটু বেশি পছন্দ করেন। সুতরাং আমরা একটা ছোট দল পাব যারা দু’ জায়গাতেই নিজের নিজের ডমিন ক্রস করে অন্য ডমিনে গিয়ে কাজ করতে পছন্দ করেন। আমি হয়তো সেরকম একটা টাইপের মধ্যেই পড়ব। কিন্তু যাই হোক মূলত যেটা গুরুত্বপূর্ণ বিষয় তা হচ্ছে শিক্ষকদের এই রাজনৈতিক দায়িত্ব পালনের সামাজিক ফলাফলগুলি কি হচ্ছে? এই দায়িত্ব পালন কি সমাজকে অগ্রসর করছে? নাকি সমাজকে পেছনের দিকে টেনে নিচ্ছে? এটা অনেকখানি নির্ভর করবে শিক্ষক রাজনীতির কনটেন্ট বা অন্তর্নিহিত উপাদানের উপর, শিক্ষক রাজনীতির ভিতরে আদর্শগত বা আদর্শ বহির্ভূত কোন উপাদানগুলো গুরুত্ব পাচ্ছে তার উপর।

এখন আমাদের দেশে যেটা হয়েছে সেটা হচ্ছে- শিক্ষক রাজনীতিতে বিভিন্ন বিদ্যমান সামাজিক শ্রেণীর জন্য ভাবাদর্শ নির্মাণ মোটেও গুরুত্ব পাচ্ছে না। কোনো দলের জন্য আদর্শগত অবস্থানের পক্ষে যুক্তি নির্মাণ সেটিও তেমন স্থান পাচ্ছে না। সবকিছু বাদ দিয়ে রাজনৈতিক তর্কবিতর্কে স্বচ্ছতা আনা, আলো আনা, কে কি ভুল করছে সেটা ব্যাখ্যা করে মিডিয়ার মাধ্যমে জনসমক্ষে প্রকাশ করা সেটিও ততোটা গুরুত্ব পাচ্ছে না। দুটি ভিন্ন জিনিস খুব গুরুত্ব পাচ্ছে। একটা হচ্ছে- তাদের ট্রেড ইউনিয়ন বা পেশাগত দাবীসমুহ অথবা আরো সংকীর্ন ক্ষমতা ও পদের লড়াই যেমন-আমার প্রোমোশন, আমাদের বেতন, আমাদের বাড়ি, আমাদের একটা টেলিফোন ভাতা, আমাদের ক্যাম্পাসে একটা কোয়ার্টার নির্মাণ, আমাকে বা আমার দলের লোককে ভিসি বানানো ইত্যাদি। এগুলোকে সবই আমি অন্যায় বলছি না । শিক্ষক হিসেবে বর্তমানে বাংলাদেশের শিক্ষকরা যে বেতন পাচ্ছেন সেটা খুবই কম এবং সেটা আমাদের দক্ষিণ এশীয় স্ট্যান্ডার্ডের তুলনায় অনেক কম। আমাদের পাশের দেশ ভারতের স্ট্যান্ডার্ডে এটি প্রায় অর্ধেক কম এবং এই কারণেই অনেক শিক্ষককেই বাধ্য হয়ে বাইরের কাজ করতে হচ্ছে।
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রসঙ্গেই আমি আলোচনাটি করছি, সকল শিক্ষককে নিয়ে আলোচনা করছি না-যদিও অন্যদের ক্ষেত্রেও কথাগুলি হয়তো সত্য। যাই হোক যেহেতু ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষকদের আর্থিক আয় কম সেজন্য তাদের কেউ কেউ প্রাইভেট বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়াচ্ছেন। কেউ কেউ রিসার্চ, গবেষণা করছেন নিশ্চয়ই এটা করতে গেলেই সময় দিতে হয়। যে অনুপাতে সময় এখানে যায় সেই অনুপাতে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে সময় কমে। এই আর্থিক বাধ্য-বাধকতা না থাকলে ভাল হতো। আমি শুনেছি জওহরলাল নেহেরু বিশ্ববিদ্যালয়ের একজন অধ্যাপক এক লাখ ৮০ হাজার রুপি বেতন পান বা অতো না পেলেও ১ লক্ষ রুপির উপরে বেতন পান। আমি ধারণা করি কলকাতাতেও ব্যাপারটা এরকমই! সুতরাং সে তুলনায় আমরা ২৫-২৬ বছর চাকরি করার পরেও অধের্কেরও কম পরিমাণ বেতন পাচ্ছি । সুতরাং বেতনের সুবন্দোবস্ত করে দেওয়া, গবেষণার সুবন্দোবস্ত করে দেওয়া, সেগুলো শিক্ষকদের ন্যায্য প্রাপ্য। কিন্তু দুর্ভাগ্যের বিষয় সেগুলো নিয়ে যতটা না আন্দোলন হচ্ছে তার চেয়ে বেশি আন্দোলন হচ্ছে ব্যক্তিগত পদোন্নতি, দলীয় লোককে বা অনুগত লোককে নির্দিষ্ট পদে নিয়োগ দেওয়া, ক্ষমতা দেওয়া ইত্যাদিকে কেন্দ্র করে অনেক বেশি টানাটানি এবং অনেক বেশি রাজনীতি হচ্ছে। অবশ্য ক্ষমতার ভাগাভাগিটা এখানে অনেকখানি ১৯৭৩’র অধ্যাদেশের কারণে নির্বাচনী ফলাফলের উপর নির্ভর করে এবং নির্বাচনী ফলাফলটা অবশেষে এখানে যে দলগুলো আছে সে দলগুলোর প্রতিদ্বন্দ্বিতার মাধ্যমে নির্ধারিত হয়। দলগুলো কিছুটা আদর্শের ভিত্তিতে নির্ধারিত আর কিছুটা সুবিধা বন্টনের ভিত্তিতে নির্ধারিত। দলের নেতারা ভোট বেশি পেতে চায়। সে জন্য তারা ভোটার রিক্রুট করাতে যেমন আগ্রহী তেমনি আবার তাদের একটা নির্দিষ্ট আদর্শ থাকে। সেই আদর্শের ভিত্তিতে একটা পার্থক্য থাকে। সেই পার্থক্য রক্ষার ক্ষেত্রেও তারা আগ্রহী থাকে।

এখন যে পরিমানে বিশ্ববিদ্যালয়গুলো সরকারের অধীন এবং সরকারের প্রভাবের মধ্যে চলে গেছে সেই পরিমাণে বিশ্ববিদ্যালয়ের ক্ষমতার কেন্দ্রগুলো সরকারের মুখাপেক্ষি হয়ে পড়েছে। যখন সরকারের মুখাপেক্ষিতা অটুট থাকে তখন ৭৩’র অধ্যাদেশের যে স্পিরিট তথা এখানকার কাজকর্মগুলো, এখানকার সিদ্ধান্তগুলো এখানকার শিক্ষকরাই গণতান্ত্রিকভাবে নিবেন, মেধার ভিত্তিতে নিবেন, সেটা আর রক্ষিত হয় না। এমনকি একই দল বা আদর্শের অনুসারীদের মধ্যেও পদ নিয়ে দ্বন্দ্ব শুরু হয়ে যায়, যার জের সর্বোচ্চ রাজনৈতিক হস্তক্ষেপ পর্যন্ত গড়ায়। শিক্ষক রাজনীতি তখন আর শিক্ষক রাজনীতি থাকে না, তা পরিণত হয় জাতীয় রাজনীতির অনুষঙ্গে।

বিশ্ববিদ্যালয়ের ভোটারদের ভিসি প্যানেল থেকে সর্বোচ্চ ভোট অনুযায়ী ভিসি নির্বাচনের ক্ষমতা যেহেতু ৭৩’র অধ্যাদেশে দেয়া হয়নি এবং একটি নির্ভরশীলতা আছে রাষ্ট্রপতির উপর সূতরাং এই বিশ্ববিদ্যালয়ের সর্বোচ্চ পদটিও আসলে রাজনৈতিক। তবে এটা ছাড়াও বিশ্ববিদ্যালয়ের অন্যান্য পোস্ট গুলো নিয়েও আমরাই নির্বাচন করি, শিক্ষক সমিতির যে নির্বাচন হয়, ক্লাবের যে নির্বাচন হয়, ডীনের যে নির্বাচন হয়, একাডেমিক পোস্টগুলোর যে নির্বাচন হয় এই নির্বাচনগুলো নিছক ক্ষমতার বন্টন নয়, এগুলি একধরনের শ্রমবিভাজনও বটে। এই কাজগুলো তো কাউকে না কাউকে করতে হবে সুতরাং ভাল যে অধিকাংশ লোক যাকে চাচ্ছে তাকে দিয়েই করানো হচ্ছে। নির্বাচনী পদ্ধতিতেই জায়গাগুলো যে পূরণ করানো হয় তার স্পিরিট বা পুর্বানুমান ছিল গণতান্ত্রিকভাবে যোগ্য লোককেই শিক্ষকরা ভোট দিবেন। আমাদের ৭৩’র অধ্যাদেশে বিভাগীয় চেয়ারম্যানের পদটা বাই-রোটেশনে পূরণ করা হয়, ফলে সকল সিনিয়র লোকরাই একে একে চেয়ারম্যান হওয়ার সুযোগ পান। যদিও সংকীর্ন দলবাজীর কারনে অনেকসময়ই এর ফল ভাল হচ্ছে না তবু আমি এই পদ্ধতি গুলোর বিরুদ্ধে বলবো না। গণতন্ত্রের সমস্যা কিছু থাকে কিন্তু তার সমাধান গনতন্ত্র কর্তন বা হরণ নয়, আরো পূর্ণ গণতন্ত্রের অনুশীলনই এসব ক্রটি ধীরে ধীরে দূর করতে পারে. এটাই ইতিহাসের শিক্ষা। এই পদ্ধতিগুলোর সাথে আমি আরো যোগ করবো যে ডাকসুর নির্বাচনও যদি হতো তাহলে পরে এটা আরো পূর্ণাঙ্গ হতো কারণ ছাত্ররাও ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের একটি গুরুত্বপূর্ণ ঐতিহ্যবাহী ‘‘স্টেকহোল্ডার” বা অংশীদার। তাদের মতও বিশ্ববিদ্যালয় পরিচালনায় গুরুত্বপূর্ণ। সিনেট, সিন্ডিকেট সব জায়গায় তাহলে আমরা গণতান্ত্রিক পদ্ধতিতে এগিয়ে যেতে পারতাম।

বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষকদের রাজনীতি:

বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষকদের রাজনীতিকে সাধারনভাবে দু’টি বড় কম্পার্টমেন্টে ভাগ করা যায়। যদি রাজনৈতিক মতাদর্শ এবং মতাদর্শ ভিত্তিক পার্থক্যকে এবং সংশ্লিষ্ট যুক্তিতর্ক আলোচনাকে আলাদা একটা কম্পার্টমেন্টে রেখে, আরেকটা কম্পার্টমেন্টে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের উন্নতি, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের মেরিট, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অগ্রগতিকে রাখা হতো এবং ভোটটা যদি দুই কম্পার্টমেন্টের ভিত্তিতে হতো তাহলে বিষয়টি অনেক ভারসাম্যপূর্ণ হতো। একটি বিবেচনা হতো বিশ্ববিদ্যালয়ের ‘মেরিটোক্র্যাসি’। আর আরেকটা বিবেচনা হতো রাজনৈতিক আদর্শ । আমি মুক্তিযুদ্ধের পক্ষে না মুক্তিযুদ্ধের বিপক্ষে বা আমি সমাজতন্ত্রের পক্ষে বা বিপক্ষে, এই ভিত্তিতেও ভোট দেয়া চলতে পারে আবার সংশ্লিষ্ট পদে কোন প্রার্থীর মেধা ও যোগ্যতা বেশী সেটাও বিবেচনায় আসতে পারে। তাহলে এইভাবে দু’টি মিলিয়ে যদি ভোটটা হতো তাহলে নির্বাচন হতো যুগপৎ আদর্শ ও মেরিট ভিত্তিক। তাহলে আমরা ৭৩’র অধ্যাদেশের মূল স্পিরিট সম্পূর্ণ অক্ষুন্ন রাখতে পারতাম। কিন্তু এখানে যেটা হয়ে যাচ্ছে, তা হচ্ছে প্রতিদ্বন্দ্বী দলগুলো একটা রাজনৈতিক দলের সঙ্গে প্রথমেই অন্ধভাবে জড়িত হচ্ছে। রাজনৈতিক আদর্শের মাধ্যমে যতোটা না হচ্ছে তার চেয়ে বেশি হচ্ছে, রাজনৈতিক স্বার্থকে অন্ধভাবে প্রমোট করতে সমর্থন দেয়ার জন্য। এইভাবে শিক্ষকদের দলের নেতৃত্ব বাইরের রাজনৈতিক কর্তাদের সমর্থনের উপর নির্ভরশীল হয়ে পড়ছে। তার পরে যখন নির্বাচনে সাধারণ শিক্ষকদের মুখোমুখি হচ্ছেন তখন তারা বলা শুরু করেছেন যে, আমার দলে আসলে এই সুবিধা পাবেন আমার কাছে আসলে এই সুবিধা পাবেন। তখন তারা ক্লায়েন্ট সৃষ্টি করছেন, সাহসী ন্যায়নিষ্ঠ শিক্ষক সৃষ্টি করছেন না। ভোটার সৃষ্টি করছেন। একাডেমিক বিবেচনায় উদার ঐকমত্য সৃষ্টি করছেন না। এখন বিদ্যমান এই সংস্কৃতির কথা আমরা সবাই জানি। এর ফলেই প্রত্যেক দলে “Bad Money is Driving Good Money Away” ! এই কারণেই শিক্ষক রাজনীতির ভাবমূর্তি বর্তমানে নেতিবাচক হয়ে গেছে।

শিক্ষক রাজনীতি বন্ধ করে দেওয়াটা কোনো সমাধান নয়। এটার সমাধান হচ্ছে শিক্ষক রাজনীতিতে প্রতিদ্বন্দ্বী দলগুলোকে সংকীর্ন দলীয়/ব্যক্তিগত লাভালাভের বিবেচনার উর্ধ্বে উঠে মনোনয়ন ও ভোট দিতে হবে। শিক্ষক যখন খাতা দেখেন তখন তিনি আদর্শগতভাবে শিবিরের বিরুদ্ধে বা জামায়াত ইসলামের বিরুদ্ধে হলেও ছাত্রদের মধ্যে কে শিবিরের অনুসারী তা দেখে নিশ্চয়ই কম নম্বর দেন না। শিক্ষক খাতাটাই দেখেন এবং খাতা দেখে যেটা সঠিক নম্বর সেটাই দেন। সুতরাং শিক্ষক রাজনীতির সাথে আমরা যারা জড়িত আছি, আমাদের উচিত হবে যথা শিগগির দলীয় সংকীর্ণতা পরিহার করে শিক্ষক নিয়োগ, শিক্ষার্থীদের ফলাফল ইত্যাদি ক্ষেত্রে মেধাকে প্রধান বিবেচনায় নিয়ে আসা। কেউ কেউ বলেন এগুলো হচ্ছে ৭৩’র অধ্যাদেশের কারণে। আমি তা মনে করি না। ৭৩’র অধ্যাদেশতো আমাদের শিক্ষার্থীর ফলাফল বিকৃত করতে নির্দেশ দেয়নি। ৭৩’র অধ্যাদেশ আমাদের বলেনি যে শিক্ষক নিয়োগের সময় তৃতীয় শ্রেণী-দ্বিতীয় শ্রেণীকে দলের লোক বলে প্রথম শ্রেণীর চেয়ে অধিক অগ্রাধিকার দিব। প্রথম শ্রেণীর ফার্স্ট ক্লাস ফার্স্টের চেয়ে ফার্স্ট ক্লাস থার্ডকে অগ্রাধিকার দিব কারণ সে আমার দলের লোক!

৭৩’র অধ্যাদেশ আমাদের কিছু ভোটের ক্ষমতা দিয়েছে। কিন্তু সেই ক্ষমতার অপব্যবহার করছি আমরা। সুতরাং ঐ ক্ষমতার অপব্যাবহার যাতে করতে না পারে সেজন্য কিছু পরিপূরক ধারা এ অধ্যাদেশের সাথে যুক্ত করা যেতে পারে। যাতে অধ্যাদেশের মূল স্পিরিট বা উদ্দেশ্য ব্যহত না হয়। সুতরাং ইতিবাচক সংস্কারের সুযোগ আছে। সেটাকে কেউ বলতে পারেন, ১৯৭৩ সালের অধ্যাদেশের সংস্কার। কেউ বলতে পারে সাপ্লিমেনটিং ১৯৭৩ অর্ডিন্যান্স। আর কেউ বলতে পারে মূলনীতি অক্ষুন্ন রেখে কিছু বিধি প্রণয়ন। আমাদের অভিজ্ঞতা থেকে আমাদের বসে আমাদেরই সেটা করতে হবে। সরকার, অন্যকোন দল বা বাইরের কোন দল এটা করতে পারবে না। গণতান্ত্রিকভাবে যদি এটা করতে হয় তাহলে ছাত্র প্রতিনিধি, শিক্ষক প্রতিনিধি, প্রশাসনিক কর্মচারীর প্রতিনিধি মিলে আগে একটা আত্মসমালোচনার সেশন করতে হবে। আমি প্রস্তাব রাখছি, আসুন আগে আমরা খোলা মনে একটা আত্মসমালোচনা করি এবং দেখি যে বাইরের লোকরা আমাদের বিরুদ্ধে কি কি অভিযোগ করছেন। কেন শিক্ষক রাজনীতিকে এতো কলুষিত বলে বাইরের লোকের কাছে মনে হচ্ছে। কেন তারা ছাত্র রাজনীতি, শিক্ষক রাজনীতি বন্ধ করতে বলছেন। তাদের কথাগুলো তাদের অভিযোগগুলো আগে আমরা মনোযোগ দিয়ে শুনবো। শিক্ষকরা ৯৫-৯৯ শতাংশই ভাল। আমার ধারনা সত্য অভিযোগগুলো তারা সবাই গ্রহণ করবেন। যে অল্পসংখ্যক খারাপ লোক এসব করছেন তাদেরকে আমরা কিভাবে ঠিক করতে পারি, কিভাবে আমরা এমন বিধি করতে পারি যে আামাদের মধ্যে থেকে তারা সে চেষ্টা করলেও সেটা করতে পারবে না, সেগুলো আমরা আলোচনা করে ঠিক করতে পারি। তারপর যদি প্রয়োজনীয় সংস্কারের পর সংশোধিত শিক্ষক রাজনীতি এবং সংশোধিত ছাত্র রাজনীতি নিয়ে অগ্রসর হই তাহলে আমাদের ছাত্র-শিক্ষক রাজনীতির হৃত গৌরব পুনরুদ্ধার সম্ভব।

জাতীয় রাজনীতির ক্ষেত্রে শিক্ষকদের আরও গুরুত্বপূর্ণ ভুমিকা পালন করা উচিত এবং সেটা অবশ্যই ভাবাদর্শ নির্মাণের ক্ষেত্রেই হবে। অর্থাৎ তাদের লেখা উচিত এবং যুক্তি ও আদর্শের ভিত্তিতে পক্ষ নেওয়া উচিত। মাঠে ঘাটে রাজনীতি করার দরকার নেই সকলের। কেউ কেউ থিওরীটিকাল জায়গা থেকেও চর্চা করতে পারেন ও মূল্যবান অবদান রাখতে পারেন। এসব গণতান্ত্রিক অধিকার ও স্বাধীনতা আমাদেরকে ৭৩’র অধ্যাদেশ দিয়েছে। কিন্তু তাই বলে আমরা জাতীয় নির্বাচনে প্রতিদ্বন্দ্বীতা পারব না। সেটা করতে হলে আমাদের পদত্যাগ করে পেশা বদলাতে হবে। নিশ্চয়ই আমার মূল দায়িত্ব হল পড়ালেখা শেখানো, শিক্ষকতা করা। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়কে এগিয়ে নেয়া। শিক্ষক হিসেবে অবশ্য করণীয় কাজগুলো করা। তার সঙ্গে আমি জাতীয় রাজনীতির ক্ষেত্রে ইনটেলেকচুয়াল অবদান যেটার খুব ঘাটতি সেই অবদানটা রাখতে পারি। সেটার জন্য মিটিং-মিছিল করতে হবে না। এই কাজগুলো মূলত আমরা কলমের মাধ্যমে আমাদের লেখনীর মাধ্যমে করে থাকি। শিক্ষকরা রাজনীতি করুক রাজনৈতিক আদর্শের ভিত্তিতে। শিক্ষকরা রাজনীতি করবে না তাদের সংকীর্ণ সুযোগ-সুবিধার জন্যে। সেটাইতো শিক্ষকদের কাছে আমাদের কাম্য। শিক্ষকরা এরকম রাজনীতি করুক যেন তার নিজের দল যদি ভুল করে এবং তার বিরোধী দল যদি সঠিক একটি যুক্তি উপস্থাপন করে তখন নিজের দলের কথা না ভেবে সে যেন সত্যকে মেনে নেয়। সর্বদাই শিক্ষক যেন থাকেন ন্যায়ের পক্ষে। শিক্ষকদের আমি দার্শনিক শাসক (Philosopher King) হতে বলছি না, তবে তারা রাজনীতি সচেতন দার্শনিক হবেন- সেটাই কাম্য।

লেখক: অধ্যাপক, অর্থনীতি বিভাগ, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়।