আন্দোলনের শক্তি ও আন্দোলনের দূর্বলতা
ছাত্র-জনতার আন্দোলনের মধ্য দিয়ে স্বৈরাচার সরকারের পতনের মধ্য দিয়ে স্মরণাতীতকালেরর সবচেয়ে সফল আন্দোলন দেখেছে বাংলাদেশ। এ আন্দোলনে শামিল হয়েছেন বাংলাদেশের কৃষক-শ্রমিক-ছাত্র-জনতাসহ সর্বস্তরের সাধারণ মানুষ। এ আন্দোলনের সবচেয়ে বড় শক্তি তার সর্বজনীনতা। তবে আন্দোলন সফল বলা হবে তখনই, যখন তার ফসল দীর্ঘমেয়াদি হয়। কাজেই এ আন্দোলন সফল হয়েছে বলে এখনই আত্মতুষ্টির সুযোগ নেই। এর ব্যর্থতা বা দুর্বলতার দিকগুলোও যথাযথভাবে উপলব্ধি করা প্রয়োজন।
জুলাই-আগস্টের এ গণঅভ্যুত্থানের একটি বড় বৈশিষ্ট্য হলো সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমের প্রতি নির্ভরশীলতা। জুলাইয়ের প্রথম দিন থেকে শুরু হওয়া এ আন্দোলনের ইস্যুগুলোর পালাবদল হয়েছে খুব অল্প সময়ের মধ্যে। পরিবর্তিত সে ইস্যুগুলোকে ধারণ করে মানুষ আবার খাপ খাইয়ে নিয়েছে। দ্রুততম সময়ের মধ্যে মানুষ পুনরায় জড়ো হয়েছে, নতুন করে কর্মপন্থা নির্ধারণ করেছে। ইন্টারনেট ব্যবহারকারী তরুণদের সংখ্যার আধিক্যের কারণে আন্দোলনের প্রথমদিকে জড়ো হওয়া মানুষদের মাঝে তরুণদের উপস্থিতি ছিল সিংহভাগ। সামাজিক মাধ্যম বা টেলিভিশন মিডিয়ার মাধ্যমে আন্দোলনের খবর ছড়িয়ে পড়ার সাথে সাথে ইস্যুর ধরণ বুঝে বহু শ্রেণি ও বয়সের লোকেরা পরবর্তীতে আন্দোলনে শামিল হয়েছে।
এ আন্দোলনের শক্তিমত্তার একটি বড় জায়গা ছিল তথ্যের প্রবাহ। রাষ্ট্র বা সরকার যখন গণমাধ্যমের টুঁটি চেপে ধরে তখন এগিয়ে আসে সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমগুলো। সিটিজেন জার্নালিজম এই আন্দোলনে প্রকৃতপক্ষে আপামর জনসাধারণের সাংবাদিকতা হয়ে উঠে। দেশের যেকোনো প্রান্তে আন্দোলনরত ছাত্র-জনতার উপর কোনোপ্রকার বলপ্রয়োগ অথবা নির্যাতন খবর খুব দ্রুততম সময়ের মধ্যেই ছড়িয়ে পড়ে। ভিডিও জার্নালিজমের অবদানের পাশাপাশি মুক্তভাবে কাজ করা ভিডিওতে পারদর্শী মানুষেরা নানা চুম্বক অংশ তুলে এনেছেন খুব আকর্ষণীয়ভাবে। সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমের ইতিবাচক ব্যবহার দেশব্যাপী গণসচেতনতা এবং রাজনৈতিক অধিকারবোধের সূচনা ঘটিয়েছে। ইতঃপূর্বে বাংলাদেশে ধাপে ধাপে আন্দোলন দাঁড় করানোর যে চেষ্টা ছিল তাকে ঠিক ব্যর্থ বলা যায় না। বিভিন্ন ইস্যুতে লোকজন একত্র করা, তাদেরকে সঠিক প্রক্রিয়ায় উদ্বুদ্ধ করা, হামলা-মামলার ভয়ের প্রতিকূলতায় দিনের পর দিন টিকে থাকা এ সাধারণ প্যাটার্ন তাদেরকে দীর্ঘমেয়াদে প্রশিক্ষিত করেছে।
গত ১৫ বছরের দীর্ঘ এ সময়ে আন্দোলন না দাঁড়ানোর আরেকটি বড় দুর্বলতা ছিল- যথাযথ নেতৃত্ব দাঁড় করাতে না পারা। মানুষকে অধিকার ও কর্তব্যবোধের চেতনায় উদ্বুদ্ধ করতে যে পরিমাণ ক্যারিশম্যাটিক নেতৃত্বের প্রয়োজন, তা গড়ে উঠতে পারেনি। বিপরীতে অ্যাপলিটিকাল বা রাজনীতিবিমুখ তরুণের সংখ্যা বৃদ্ধি পেয়েছে। আন্দোলনে সাধারণ মানুষকে জড়ো করতে গিয়ে যে যোগাযোগ বা সাংগঠনিক চর্চার প্রয়োজন পড়ে তা যথেষ্ট নয়। ১৮ এর কোটা আন্দোলনের পর নূরুল হক নূরের মতো নেতৃত্ব উঠে আসলেও দীর্ঘমেয়াদে রাষ্ট্রীয় শক্তির সামনে দাঁড়িয়ে থাকতে পারেনি। দ্বিতীয় ধাপে আন্দোলনের একটি বড় দুর্বলতা হলো, সুবিধাভোগীদের উপস্থিতি। তারা বিভিন্ন ইস্যুতে জড়ো হলেও ততক্ষণই টিকে থাকে যতক্ষণ তাদের সুবিধাপ্রাপ্তির নিশ্চয়তা থাকে। এমনটাই ঘটেছে এবারের বৈষম্যবিরোধী আন্দোলনের পর। দেশের বিভিন্ন প্রান্তে ‘সমন্বয়ক’ পরিচয়ে আন্দোলনের ক্রেডিট ভাগাভাগি করতে আসা জনগোষ্ঠীর সামনে এ আন্দোলনের বিশাল অর্জন যেন ম্লান হয়ে পড়ে।
সামাজিক মাধ্যম নির্ভর আন্দোলনের ব্যক্তিক পর্যায়ে সংযোগ কম থাকায় আন্দোলন প্রাথমিকভাবে অভাবনীয় সাফল্য পাওয়ার পরও সময়ের ধারাবাহিকতায় আন্দোলন দুর্বল হতে শুরু করে। আন্দোলনের এ সময়কালকে তিনভাগে ভাগ করা যায়- প্রারম্ভিক বা ইস্যুর সূচনা, ইস্যুর চূড়ান্ত অবস্থা ও ধীরে ধীরে স্তিমিত হয়ে পরিসমাপ্তি। এ আন্দোলন অধিকাংশ ক্ষেত্রেই স্বল্পমেয়াদি। দীর্ঘমেয়াদে সফলতা লাভের চেষ্টা না থাকলে; অল্পতেই তুষ্ট হয়ে গেলে একটা বড় আন্দোলনও ব্যর্থতায় পর্যবসিত হতে বাধ্য। ফলশ্রুতিতে আন্দোলনে একসময় দেখা দেয় নির্জীবতা। ধীরে ধীরে আন্দোলনের মূল স্পিরিট হারাতে শুরু করে। সাম্প্রতিক আন্দোলনের শক্তিমত্তার সবচেয়ে বড় জায়গা ছিল সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে ‘পিক মোমেন্টাম’ বা চূড়ান্ত সময়ে দেশের অধিকাংশ মানুষকে একই সাথে অংশীদার করতে পারা। নিম্নশ্রেণির শ্রমজীবী মানুষরা ফেসবুক, টিকটক ও অন্যান্য মাধ্যমে এখানে অংশীদার হয়েছেন। চূড়ান্ত অবস্থা আঁচ করতে পেরেই সরকারের পক্ষ থেকে ইন্টারনেট বন্ধ করে দেয়ার ঘোষণা আসে।
আন্দোলনের শক্তিমত্তার আরেকটি বৈশিষ্ট্য হলো বিপুল সংখ্যক লোকের সন্তোষজনক উপস্থিতি। এর আগেও বিএনপি বা জামায়াত যখন বিভিন্ন ইস্যুতে রাস্তায় নেমেছে তখন নিজেদের কর্মীদের ক্রমহ্রাসমান উপস্থিতি তাদের ধীরে ধীরে হতাশার দিকে ঠেলে দিয়েছিলো। সর্বশেষ আন্দোলনে মানুষের বিপুল ও স্বতঃস্ফূর্ত উপস্থিতি মানসিক শক্তি যোগাতে সহায়ক ভূমিকা পালন করে। চারপাশে তাকালেই যেন দেখা যায় বিপুল জনস্রোত। এ আত্মবিশ্বাস থেকে আন্দোলনের সফলতার ব্যাপারে আশু ইঙ্গিত পাওয়া গিয়েছিল।
আন্দোলনের দুর্বলতার দিকগুলো সামনে আসতে থাকে মূলত শেষের দিকে। বিপুলসংখ্যক মানুষকে এক পাটাতনের নিয়ে আসার পর তাদের কাছে আন্দোলনের কার্যকর রোডম্যাপ পৌঁছে দেয়া জরুরি। অন্যথায় অংশগ্রহণকারীদের যোগ্যতার পার্থক্যের কারণে আন্দোলনের প্রকৃত লক্ষ্যমাত্রাও তাদের কাছে ভিন্ন ভিন্ন রূপে প্রকাশ পায়। একই সাথে স্বার্থান্বেষী মহল নিজেদের উদ্দেশ্য হাসিলে তৎপর হলেই পতনের ষোলকলা পূর্ণ হয়। বিভিন্ন লাভজনক পদে নিয়োগের মাধ্যমে নেতৃত্বকে সহজে দুর্বল করে দেয়া সম্ভব। নিজেদের মধ্যে নেতৃত্বের লড়াই সংকটকে আরো ঘনীভূত করে। এ পর্যায়ে গিয়ে আন্দোলন তার সর্বজনীনতা হারায়। আন্দোলনকে প্রকৃত অর্থে সফলতার দ্বারপ্রান্তে পৌঁছে দিতে তাই দুর্বল দিকগুলোর মূল্যায়ন জরুরি। সাময়িক সফলতায় আত্মতুষ্টিতে না ভুগে অভীষ্ট লক্ষ্যপানে এগিয়ে যাওয়াই হতে পারে একমাত্র সমাধান।
লেখক: সাংবাদিক ও শিক্ষার্থী, জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়