প্রাথমিক শিক্ষার উন্নয়নে কিছু প্রস্তাব
স্বাধীনতার পর সরকারি কর্মচারীর স্বীকৃতি পেয়ে দেশের প্রাথমিক শিক্ষক সমাজ গর্বিত। যখন রাস্তাঘাট, বাড়িঘর, ব্যাংক- সবকিছুতেই যুদ্ধের ক্ষত স্পষ্ট, তখন সীমাহীন অভাবের মাঝেও বঙ্গবন্ধু সোনার বাংলা গড়ে তোলার স্বপ্ন দেখতেন। দূরদৃষ্টিসম্পন্ন এ মহান নেতা সোনার বাংলা গড়ার লক্ষ্যে ভাবলেন কৃষক, শ্রমিক, মেহনতি মানুষের সন্তানদের শিক্ষার সুযোগের কথা।
পাকিস্তান আমলে প্রাথমিকের শিক্ষকরা সামান্য বেতন পেতেন। সাধারণ মানুষের সন্তানদের শিক্ষার সুযোগ ও প্রাথমিক শিক্ষকদের দুঃখ-দুদর্শা মোচনের জন্য ১৯৭৩ সালে প্রাথমিক শিক্ষা জাতীয়করণ করে প্রায় দেড় লাখ শিক্ষককে সরকারি কোষাগার থেকে বেতন প্রদানে বঙ্গবন্ধুর দুঃসাহসী পদক্ষেপ গ্রহণের বিষয়টি চিন্তা করে আজও আমরা বিস্মিত হই।
বঙ্গবন্ধুর শাহাদতবরণের পর প্রাথমিক শিক্ষা তথা প্রাথমিক শিক্ষকদের ওপর নেমে আসে ঘোর অমানিশা। বঙ্গবন্ধুর জাতীয়করণের পদক্ষেপকে ধ্বংসের জন্য ১৯৮০ সালে ঢাকা মহানগরীর প্রাথমিক শিক্ষা ঢাকা পৌরসভা ও সারা দেশের প্রাথমিক বিদ্যালয় গ্রাম সরকারের কাছে ন্যস্ত করে জাতীয় সংসদে দুটি আইন পাস করা হয়।
১৯৮০ সালে ঢাকা মহানগরীতে ২৭ দিন এবং ১৯৮১ সালে দেশব্যাপী ৩ মাস ১০ দিন প্রাথমিক বিদ্যালয়ে ধর্মঘট পালিত হয়। এতে আইন ২টি বাতিল করা হয়। স্বাধীনতার পর পর প্রাথমিকের শিক্ষার্থীরা বিনামূল্যে পাঠ্যপুস্তক, দুধ, ছাতু, পেন্সিল, খাতা পেত আর শিক্ষকরা ন্যায্যমূল্যে কাপড় পেয়েছেন। বিদ্যালয়গুলো পেয়েছে রেডক্রস থেকে টিন, সংস্কার ও নির্মাণে আর্থিক সহযোগিতা। ৭৫-এর ১৫ আগস্টের পর সব কর্মকাণ্ড থমকে দাঁড়াল। শিক্ষার্থীদের সব সহযোগিতা বন্ধ করে শুধু অর্ধেক নতুন আর অর্ধেক পুরনো বই দেয়া হতো। বছরের পর বছর পুরনো বই দেয়ার ফলে বইয়ের পাতার অস্তিত্ব খুঁজে পাওয়া যেত না।
২০০৯ সালে থেকে প্রাক-প্রাথমিক ও ইবতেদায়ি থেকে নবম শ্রেণী পর্যন্ত আকর্ষণীয় রঙের বই সব শিক্ষার্থীকে ১ জানুয়ারি থেকে বিনামূল্যে প্রদান করা হচ্ছে। ২০০৯ সালের আগে কিন্ডারগার্টেনসহ বেসরকারি ও মাদ্রাসায় বিনামূল্যে বই দেয়া হতো না। প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা ২০১৩ সালে ২৬ হাজার ১৯৩টি বেসরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয় জাতীয়করণ করেন। প্রাথমিক বিদ্যালয় ছাড়াও তিনি উচ্চবিদ্যালয় ও কলেজ জাতীয়করণ করে চলেছেন। ২০১৪ সালে প্রধান শিক্ষকদের ২য় শ্রেণীর মর্যাদা প্রদান করা হয়।
আগে প্রাথমিক বিদ্যালয় রক্ষণাবেক্ষণের জন্য কোনো জনবল ছিল না। বর্তমানে সরকারের আমলে ৩৭ হাজার প্রাথমিক বিদ্যালয়ে দফতরি কাম নৈশপ্রহরী নিয়োগ করা হয়েছে।
২০১০ সালে থেকে প্রতিটি উপজেলায় কমপক্ষে ২টি বিদ্যালয়ে ৮ম শ্রেণী পর্যন্ত পাঠদান চলছে। বিষয়ভিত্তিক প্রশিক্ষণ ও এক বছরের সিইন.এড প্রশিক্ষণ কোর্সের পরিবর্তে দেড় বছরের ডিপ.ইন. এড কোর্স চালুর মাধ্যমে উন্নত পাঠদানের উদ্যোগ গ্রহণ করা হয়েছে। বর্তমান সরকারের আমলে প্রাথমিক বিদ্যালয়ে আকর্ষণীয় ও মনোরম পরিবেশে প্রাক-প্রাথমিক শ্রেণী চালু হয়েছে। ৩৭ হাজার প্রাক-প্রাথমিক শিক্ষককে পাঠদানের প্রশিক্ষণ দেয়া হয়েছে।
আশা করা যায়, অবশিষ্ট বিদ্যালয়গুলোয় শিগগিরই প্রাক-প্রাথমিকের শিক্ষক নিয়োগ করা হবে। শিক্ষক সংকট নিরসনে বর্তমান সরকারের আমলে লক্ষাধিক শিক্ষক নিয়োগসহ সবচেয়ে বড় চ্যালেঞ্জ শিক্ষার্থীদের বিদ্যালয়ে ধরে রাখার জন্য উপবৃত্তি চালু করা হয়েছে। বর্তমানে শতাধিক উপজেলায় শিক্ষার্থীদের মাঝে পুষ্টিসমৃদ্ধ বিস্কুট বিতরণ করা হচ্ছে। প্রধানমন্ত্রী পাঠের পাশাপাশি খেলাধুলা, সাংস্কৃতিক কর্মকাণ্ডসহ নানা সহপাঠ্য কার্যক্রমে সর্বদা উদ্বুদ্ধ করে যাচ্ছেন। শিশুদের শারীরিক ও মানসিক বিকাশ সাধনে প্রতিটি বিদ্যালয়ে খেলাধুলা ও সাংস্কৃতিক প্রতিযোগিতার আয়োজন করা হচ্ছে। এছাড়া জাতীয় পর্যায়ে প্রতিযোগিতায় অংশগ্রহণের সুযোগ সৃষ্টির জন্য আর্থিক অনুদানের ব্যবস্থা করা হয়েছে।
২০১১ সাল থেকে প্রতিবছর স্কুল পর্যায় থেকে জাতীয় পর্যায়ে বঙ্গবন্ধু ও বঙ্গমাতা ফুটবল টুর্নামেন্ট অনুষ্ঠিত হচ্ছে। মেয়েরা আজ ক্রীড়া প্রতিযোগিতায় বিশ্বে তাদের প্রতিভার স্বাক্ষর রেখে চলেছে। বিদ্যালয়বিহীন এলাকার ১৫০০ সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয় স্থাপন করা হয়েছে। PEDP-4 এর আওতায় ২৬ হাজার প্রাথমিক বিদ্যালয় নির্মাণ করা হয়েছে। ঢাকা শহরের বিদ্যালয়গুলোর সৌন্দর্য বৃদ্ধি ও অবকাঠামো উন্নয়নে ১২০০ কোটি টাকার প্রকল্পসহ দেশব্যাপী প্রাথমিক শিক্ষা উন্নয়নে ব্যাপক প্রকল্প গ্রহণ করা হচ্ছে। বেশ কিছু বিদ্যালয়ে সুপেয় পানির জন্য গভীর নলকূপ বসানো হয়েছে। বিদ্যালয় পর্যায়ে স্লিপ ফান্ডের বরাদ্দ ৪০ হাজার টাকার স্থলে ১ লাখ টাকা করা হয়েছে।
প্রতিবছরই প্রাথমিক বিদ্যালয়ে বড় ধরনের মেরামত কাজ করা হচ্ছে। শিক্ষার্থীদের ডিজিটাল শিক্ষায় দক্ষ করে গড়ে তুলতে ল্যাপটপ, মাল্টিমিডিয়াসহ ইন্টারনেট ডিভাইস চালু করা হয়েছে। সরকারের শিক্ষা ক্ষেত্রে বিশাল অর্জনের মাঝেও মানসম্মত প্রাথমিক শিক্ষা বাস্তবায়নে কতিপয় চ্যালেঞ্জ আজও বিদ্যমান। চ্যালেঞ্জগুলো হল :
১. সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের সময়সূচির সঙ্গে বেসরকারি ও সরকারি উচ্চ বিদ্যালয়ের সময়সূচির ব্যবধান অনেক। বিকালে শিক্ষার্থীদের খেলাধুলা বা বিনোদনের সুযোগ কমে যায়। ফলে অভিভাবকরা তাদের সন্তানদের সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ে পড়াতে আগ্রহী হচ্ছে না। সরকারের নানা ধরনের সুযোগ-সুবিধা থাকা সত্ত্বেও সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ে শিক্ষার্থীর সংখ্যা হ্রাস পাচ্ছে। সব ধরনের শিশুশিক্ষা প্রতিষ্ঠানে অভিন্ন সময়সূচি বাস্তবায়নের মাধ্যমে শিশুবান্ধব সময়সূচি বাস্তবায়ন করা সম্ভব।
২. প্রাথমিকের সহকারী ও প্রধান শিক্ষকের মাঝে, সরাসরি নিয়োগপ্রাপ্ত ও পদোন্নতিপ্রাপ্ত প্রধান শিক্ষকের মাঝেও বিশাল বেতনবৈষম্য বিদ্যমান। প্রধান শিক্ষকের ২য় শ্রেণীর স্কেল দশম ও সহকারী শিক্ষকের ১১তম গ্রেডে বেতন স্কেল উন্নীত করে বৈষম্য দূর করা সম্ভব।
৩. প্রাথমিক শিক্ষকদের বাৎসরিক ছুটি সরকারি কর্মচারীদের ছুটির চেয়ে কম। তাই প্রাথমিক শিক্ষকদের ননভ্যাকেশনাল কর্মচারী ঘোষণা করা হোক।
৪. সব মন্ত্রণালয়ে নিজস্ব ক্যাডার সার্ভিস থাকলেও কেবল নেই প্রাথমিক শিক্ষা মন্ত্রণালয়ে। মেধাবীদের শিক্ষকতা পেশায় আকৃষ্ট করার জন্য সহকারী শিক্ষক থেকে সরাসরি ১০০ ভাগ সর্বোচ্চ পদ পর্যন্ত পদোন্নতি ও নিজস্ব ক্যাডার সার্ভিস প্রয়োজন। প্রাথমিক বিদ্যালয়ে ৬০ ভাগ মহিলা শিক্ষক বিধায় এ পদোন্নতি নারীর ক্ষমতায়নে সহায়ক হবে।
৫. কাজের সুবিধার্থে প্রতিটি প্রাথমিক বিদ্যালয়ে অফিস সহকারী কাম কম্পিউটার অপারেটর নিয়োগ করা প্রয়োজন।
৬. প্রাথমিক শিক্ষকরা থার্ড ও সেকেন্ড ক্লাস কর্মচারী। সব স্তরের শিক্ষককে ১ম শ্রেণীর মর্যাদা দেয়া হোক।
৭. জাতীয় দিবসসহ বিশেষ দিবসে বিদ্যালয় খোলা রেখে আগামী প্রজন্মকে দেশের ইতিহাস-ঐতিহ্য সম্পর্কে ধারণা দেয়া প্রয়োজন। ওই দিবসগুলোর ছুটি গ্রীষ্মের ছুটির সঙ্গে সমন্বয় করা হোক। সরকারি কর্মচারীদের মতো ৩ বছর পর পর শ্রান্তি বিনোদন ভাতা প্রদান করা হোক।
৮. কিন্ডারগার্টেন বিদ্যালয়কে সহজ শর্তে রেজিস্ট্রেশন করে সরকারি নিয়ন্ত্রণে এনে শিশুশিক্ষার বৈষম্য দূর করা দরকার।
৯. দফতরি কাম প্রহরীদেরও রাজস্ব খাতে আনা দরকার।
লেখক: আহ্বায়ক, বঙ্গবন্ধু প্রাথমিক শিক্ষা ও গবেষণা পরিষদ এবং প্রাথমিক শিক্ষক অধিকার সুরক্ষা ফোরাম।