২৫ নভেম্বর ২০১৮, ১২:০২

আমাকেও শুনুন: মায়ের উপর বাবার নির্যাতন নিয়ে লিখলেন ঢাবির প্রাক্তন ছাত্রী

প্রতীকী ছবি

একদিন সন্ধ্যারাতে নানির ঘরে পড়তে বসেছি আমি। জোরে আওয়াজ করে পড়ার অভ্যাস ছিল আমার। পাশেই নানি ছোট ভাইকে নিয়ে খাটলায় (দড়ি দিয়ে তৈরি একধরনের ছোট খাট) শুয়ে নিত্যদিনের মত সুরা ইয়াসিন, আর-রহমানসহ যা যা মুখস্থ ছিল তাই গুণগুণ করে তিলাওয়াত করে চলেছেন।

সেসব শব্দকে ছাপিয়ে হঠাৎই একটা গোঙানির শব্দ ক্রমশ কানে স্পষ্ট হলো আমার, কয়েক সেকেন্ডের মধ্যেই লাফ দিয়ে দরজা পেরিয়ে আম্মুর ঘরের সামনে এসে দাঁড়ালাম আমি। নানিও পিছে পিছে পৌঁছে গেলেন সেখানে। দরজা খুলে আমার বাপ বেরিয়ে হতবিহ্বলভাবে আমাদের দিকে তাকালেন। আমরা চিৎকার করে উঠলাম।

তাকে পাশে ঠেলে ভেতরে ঢুকে দেখলাম আমার মা মাথার ঠিক নিচে ঘাড়ে হাত দিয়ে গোঙাচ্ছেন। আমাদের আর বুঝতে বাকি রইলো না কি ঘটেছে। তাকে ধরে কোনোরকমে বারান্দায় বের করে আনলাম, চৌকিতে শোয়ালাম। তেল মালিশ আর পানি ঢালাসহ যা যা আমার নানির বুদ্ধিতে ঐ মুহূর্তে কুলিয়েছে তিনি তাই করে যাচ্ছিলেন, আমি পা-হাত মালিশ করে যাচ্ছি আর কান্না করছি।

একসময় আম্মু প্রায় সেন্সলেস হয়ে গেলেন। আমার বাবা ছুটলেন ডাক্তারের কাছে। ডাক্তার এলেন, ব্যথার ইনজেকশন দিলেন, ওষুধ ও মলমও দিয়ে গেলেন। ব্যথার কারণ হিসেবে মিথ্যে বলা হল ডাক্তারকে, তবে তিনি ঠিকই বুঝেছিলেন সত্যিটা।

এমন অসংখ্য ঘটনাবহুল শৈশব কাটিয়েছি আমি। আমার মা আজও তার শরীরে সেসব নির্যাতনের চিহ্ন বয়ে বেড়াচ্ছেন। বাবা বাড়িতে ফিরলেই তটস্থ থাকতাম আমি, আম্মুকে তার কাছে একা ঘুমাতে যেতে দেখলে বুকের মধ্যে অজানা আশংকা কাজ করত। হ্যাঁ, এমন অনেক রাত কেটেছে আমি আধো আধো ঘুমে ছটফট করেছি, কোথাও কোনো শব্দ হলেই দৌড়ে আম্মুর ঘরের দরজার সামনে গিয়ে দাঁড়াতাম এই ভেবে না জানি আমার মাকে আঘাত করা হচ্ছে। শিউর না হয়ে বিছানায় ফিরতে পারতাম না।

নিজে আয় করা সত্ত্বেও আমার মা কখনো খরচের সিদ্ধান্তটা নিজে নিতে পারতেন না। সন্তানের পড়ার খরচ, সংসারের খরচ এবং অন্যান্য অপরিহার্য খরচগুলো ম্যাচ করতে গিয়ে তাকে সবসময় হিমশিম খেতে হত। বাবার চাপিয়ে দেয়া লোনের বোঝা আজীবন টানার সাথে সাথে তার উপর আরো ছিল টাকার নির্যাতন।

বড় সন্তান এবং মা-ঘেঁষা হওয়ার কারণেই আম্মুর উপর চলতে থাকা নির্যাতনের পুরোটার আমি প্রত্যক্ষদর্শী। আমি আজীবন আমার বাবাকে ঘেন্না করে এসেছি। মাঝে মাঝে আম্মুর উপর খুব রাগ হত আমার, নিজে স্বাবলম্বী হওয়ার পরেও কেন তিনি এসব অত্যাচার বারবার বারবার সহ্য করে যেতেন!

আমার মা এই নির্যাতনকে বরাবরই তার ভাগ্য বলে মেনে নিতে চাইতেন; চাইতেন দিনশেষে তার সন্তানদের বাবা ডাকার মানুষটা থাকুক। মেয়ের বিয়ে দেওয়ার সময় বাবাকে খুঁজলে যেন তিনি লজ্জায় না পড়েন। আর তাই সমস্ত জুলুম আর নির্যাতনকে মেনে নেওয়ার মধ্যেই তিনি সমাধান খুঁজতেন।

বড় হওয়ার পরেও যখন আমি দেখলাম এসব নির্যাতন থামছে না, তখন নিজের উপরেই রাগ হত আমার। অনেকবার আমি নিজে আমার বাবার সাথে কথা বলার চেষ্টা করেছি, লাভ হয়নি। তার আচরণটা এমন ছিল যে, "আমি তোর বাপ, আর তুই দিবি আমাকে জ্ঞান?"

তাই শেষমেশ আমি আমার মাকেই বুঝালাম। এমন অসম্মানের সম্পর্ক থেকে বেরিয়ে এসে স্বাধীনভাবে শ্বাস নিতে উদ্বুদ্ধ করলাম। আমার মা একসময় তাই করলেন। বাবার সাথে কাগজী সমস্ত সম্পর্ক ছিন্ন করে আর্থিক স্বাধীনতা আনলেন পরিবারে। কিন্তু আমি স্পষ্ট টের পাই, মানসিক স্বাধীনতা তিনি এখনো পাননি। তবে আমি আশাবাদী, একদিন সেটাও পেয়ে যাবেন তিনি।

এই গল্পটা শুধুই আমার পরিবারের নয়। আমাদের আশেপাশে এমন অসংখ্য ঘটনা হরহামেশাই ঘটে প্রতিদিন। আমার শৈশব-কৈশোরজুড়ে এমন ভুরি ভুরি ঘটনা নিয়ত ঘটতে দেখেছি আমি, এখনো দেখছি। আমরা সামনে এগিয়ে চলতে বিশ্বাসী, তাই এই ঘটনাগুলো ঘটলেও উপেক্ষা করি আর জীবনের অংশ হিসেবে মেনে নিই। আর অন্যের জীবনে নাক গলানোটা আমরা যুক্তিসংগতও মনে করি না। তাই আমি নিজে যখন কোনো সহিংসতার শিকার হই, তখন অন্যরাও এড়িয়ে চলে। ফলত, লিঙ্গভিত্তিক নির্যাতনের সংখ্যাটা কমেনি এখনো।

লিঙ্গভিত্তিক সহিংসতার সঠিক ব্যাখ্যা কি আমরা জানি? শুধুমাত্র আপনার সমাজের ঠিক করে দেওয়া জেন্ডার আইডেন্টিটির (যা নির্ভর করে আপনার বায়োলজিকাল/সেক্সুয়াল আইডেন্টিটির উপর) কারণে আপনি শারীরিক, মানসিক, অর্থনৈতিক কিংবা যৌন সহিংসতার শিকার হলে সেটিকে বলা হয় লিঙ্গভিত্তিক সহিংসতা।

যদিও লিঙ্গভিত্তিক সহিংসতা যে কেবল নারীর সাথেই ঘটে থাকে তা নয়, এর শিকার হতে পারেন পুরুষরাও। তবে তুলনামূলক কম। জাতিসংঘের হিসাবে, বিশ্বে প্রতি ৩ জনে ১ জন নারী শারীরিক কিংবা যৌন নির্যাতনের শিকার হন। আর ২০১২ সাল পর্যন্ত প্রতি ২ জনে ১ জন নারী তার পার্টনার বা পরিবার কর্তৃক খুন হন। পুরুষের ক্ষেত্রে এই সংখ্যাটা প্রতি ২০ জনে ১ জন। আর তাই আমরা ধরে নিই, লিঙ্গভিত্তিক সহিংসতা মানে হচ্ছে নারীর প্রতি সহিংসতা।

মোটা দাগে লিঙ্গভিত্তিক সহিংসতার পেছনে তিনটি বিষয়কে দায়ী মনে করা হয়। প্রথমত, লিঙ্গ বৈষম্য; দ্বিতীয়ত, ক্ষমতার অপব্যবহার; এবং সর্বশেষ ও সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ কারণ মানবাধিকারের প্রতি সম্মানের অভাব।
আর নারীর প্রতি যখন এই লিঙ্গভিত্তিক সহিংসতা হয় তখন এই কারণগুলোর পেছনে যে বিষয়টি মূলত ইন্ধন দেয় তা হল 'প্যাট্রিয়ার্কি বা পিতৃতন্ত্র'।

নারীর প্রতি সহিংসতা বিষয়ে বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরোর (বিবিএস) ২০১৫ সালের জরিপে দেখা যায়, গড়ে প্রায় ৮০ শতাংশ নারী কোনো না কোনোভাবে জীবনে একবার নির্যাতনের শিকার হয়েছেন। এর মধ্যে পারিবারিক নির্যাতনের শিকার হয়েছেন প্রায় ৫০ শতাংশ নারী এবং অর্থনৈতিক নির্যাতনের শিকার ১১ শতাংশের বেশি নারী।

সামাজিকভাবে নারীর মর্যাদা এবং সম্পদে নারীর অধিকার তুলনামূলকভাবে কিছুটা বৃদ্ধি পেলেও বাংলাদেশে নারী নির্যাতনের হার কমেনি, বরং বেড়েছে। নতুন রূপে নতুন ব্যাখ্যা দিয়ে লিঙ্গভিত্তিক নির্যাতন হয়ে চলেছে প্রতিনিয়ত। এখন তো আরো ভয়াবহ আকারের নির্যাতন হয়, প্রযুক্তির ব্যবহার নারীর সম্মানকে করেছে আরো বিপদাপন্ন। অসুস্থ-অপ্রকৃতিস্থ মানুষরা বেছে নিচ্ছে সেসব উপায়।

যদিও বর্তমানে অর্থনৈতিক মুক্তি দিয়েছে নারীকে সিদ্ধান্ত নেওয়ার ক্ষমতা; শিক্ষা ও জীবনবোধে সচেতন পরিবর্তন আসায় নারীরা আত্মসম্মানের সাথে বেঁচে থাকাকে প্রাধান্য দিতে শিখেছেন। কিন্তু শারীরিক, মানসিক, পারিবারিক কিংবা যৌন সহিংসতার হার কি সেই তুলনায় কমেছে?

গত একবছর ধরে #মিটু আন্দোলনে অনেক নারীই তাদের সাথে ঘটে যাওয়া যৌন সহিংসহার বিরুদ্ধে মুখ খুলেছেন যাতে আগামীর নারী সন্তানদের জন্য তারা নিশ্চিত করতে পারেন একটি সুন্দর ও সুস্থ পৃথিবী যেখানে থাকবেনা কোনো ভয় বা সহিংসতা। তাদের স্যালুট জানাই আমি। শুধু যৌন সহিংসতাই নয়, আমি মনে করি মুখ খুলতে হবে নিজের সাথে ঘটে যাওয়া ও প্রত্যক্ষ করা অন্য সহিংসতাগুলো নিয়েও।

নারী নির্যাতন কোনো ব্যক্তিগত কিংবা পারিবারিক সমস্যা নয়, এটি একটি সামাজিক ব্যধি। সামাজিক আন্দোলন ব্যতীত এই সমস্যার বীজ সমূলে উৎপাটন সম্ভব নয়। আর তাই বিশ্বজুড়েই ২৫ নভেম্বর থেকে ১০ ডিসেম্বর- এই ১৬ দিন ‘আন্তর্জাতিক নারী নির্যাতন প্রতিরোধ পক্ষ’ হিসেবে নারীর প্রতি সহিংসতা প্রতিরোধে বিভিন্ন কর্মসূচি পালন করা হয়ে থাকে সামাজিক সচেতনতা বৃদ্ধির পাশাপাশি নারীর প্রতি লিঙ্গভিত্তিক সহিংসতা বন্ধে সামাজিক আন্দোলন গড়ে তুলার লক্ষ্যে।

১৯৯৩ সালে জাতিসংঘের সাধারণ সভায় ‘নারীর প্রতি সহিংসতা নির্মূল’ করার ঘোষণা দেয়। এরপর থেকে প্রতিবছর ২৫ নভেম্বর ‘আন্তর্জাতিক নারীর প্রতি সহিংসতা প্রতিরোধ দিবস’ হিসেবে বিশ্বব্যাপী পালন করা হয়। এবারের প্রতিপাদ্য বিষয় অরেঞ্জ দ্য ওয়ার্ল্ড #হিয়ারমিটু (Orange The World #HearMeToo), যার মাধ্যমে ১৬ কার্যদিবসের বিভিন্ন কর্মসূচি পালন করা শুরু হবে, ১০ ডিসেম্বর আন্তর্জাতিক মানবাধিকার দিবসে এই ক্যাম্পেইন শেষ হবে।

খেয়াল রাখা জরুরি, লিঙ্গভিত্তিক সহিংসতা যে কেবল নারীর ক্ষেত্রেই ঘটে তা নয় কিন্তু, আপনার আশেপাশের পুরুষটিও হয়ে থাকতে পারে এর শিকার, তাকেও শুনুন। মানুষ হিসেবে প্রতিটি মানুষের আত্মমর্যাদা প্রতিষ্ঠা পাক, বন্ধ হোক নারীর প্রতি সকল সহিংসতা, জয় হোক মানবতার।ৎ

লেখক: ঢাকা বিশ্ববিদ্যারয়ের প্রাক্তন ছাত্রী

কর্মকর্তা, ড্যানচার্চ এইড বাংলাদেশ।