শুভ প্রবারণা পূর্ণিমা ও ঐতিহ্যবাহী উৎসব
শুভ প্রবারণা পূর্ণিমা। আজ বৌদ্ধদের অন্যতম দ্বিতীয় ধর্মীয় উৎসব এ পূর্ণিমাটি। সারা বাংলাদেশে বৌদ্ধধর্মাবলম্বীরা নানা উৎসাহ, উদ্দীপনায় এবং ধর্মীয় আমেজে প্রবারণা পূর্ণিমা পালন করছেন। সংস্কৃত 'প্রবারণা' পালিতে 'পবারণা' শব্দটির বিশেষ অর্থ রয়েছে। প্রবারণা শব্দের অর্থ হলো নিমন্ত্রণ, আহ্বান, মিনতি, অনুরোধ, নিষেধ, ত্যাগ, শেষ, সমাপ্তি, ভিক্ষুদের বর্ষাযাপনের শেষ বা পরিসমাপ্তি, বর্ষাবাস ত্যাগ, বর্ষাবাস ত্যাগের কার্য অথবা শিষ্টাচার বিধি। 'প্র’উপসর্গের সাথে ‘বারণ’ শব্দযোগে প্রবারণা অর্থাৎ প্রকৃষ্টভাবে অকুশল কর্ম করা বারণ।
মহাবর্গ গ্রন্থে উল্লেখ আছে, ভগবান বুদ্ধ যখন শ্রাবস্তীর জেতবনে ছিলেন, কোশল থেকে ভিক্ষুরা এসেছিলেন বর্ষাবাসের শেষ করার পর বুদ্ধের সাথে সাক্ষাৎ করতে। বুদ্ধ তাদের জিজ্ঞেস করেছিলেন বর্ষাবাস কিভাবে উদযাপন করেছে, তারা উত্তর না দিয়ে মৌন সম্মতি জ্ঞাপন করেন। ভিক্ষুদের অবস্থা দেখে বুদ্ধ বলেন, “ভিক্ষুগণ, তোমাদের এ আচরণ প্রশংসাযোগ্য নহে। ভিক্ষুসংঘ এক স্থানে বাস করতে গেলে বহু বাদ-বিসংবাদ হওয়া অস্বাভাবিক নহে।
বর্ষাবাস সমাপ্তির পর তোমরা একত্রিত হয়ে প্রবারণা করবে। পরস্পর পরস্পরের দোষ-ত্রুটির জন্য ক্ষমা প্রার্থনা করবে এবং পরস্পরকে সত্যিকারভাবে বরণ করে নিবে। তোমার যেমন দোষ-ত্রুটি থাকা অস্বাভাবিক নহে, সেরূপ অন্যের দোষ-ত্রুটি থাকাও স্বাভাবিক। এক স্থানে থাকবার সময় পরস্পর পরস্পরকে অনুশাসন বা ক্ষেত্র বিশেষ বারণ করলে উভয়ের মঙ্গল হয়। শাসন পরিশুদ্ধ হয়।" বুদ্ধের এ উক্তি দ্বারা প্রতীয়মান হয়, মানুষ মাত্রই ভুল করে এবং ক্ষমা পরম ধর্ম এবং বুদ্ধ সময় থেকেই প্রবারণা পূর্ণিমা উদযাপন হয়ে আসছে।
বৌদ্ধ বিহারে দুইভাগে অনুষ্ঠানটি আয়োজন করে থাকেন। দিনের শুরুতে ধর্মীয় রীতিনীতি, সভা-আলোচনা করেন বৌদ্ধ ভিক্ষুরা। তখন গৃহী, বৌদ্ধ উপাসক-উপাসিকাবৃন্দরা বিহারে পরিষ্কার ও পরিপাটির সহিত আসেন। শীল পালন, বুদ্ধপূজাসহ ত্রিশরণ, মঙ্গলসূত্র পাঠ, সংঘদান, অতিথি আপ্যায়ন এবং দেশ-জাতি-বিশ্ব শান্তি প্রতিষ্ঠার জন্য সমবেত প্রার্থনার আয়োজন করা হয়। অন্যদিকে বিহারে বিকেলবেলায় জাতি-ধর্ম-নির্বিশেষে সকলের জন্য সামাজিক ও সাংস্কৃতিক উৎসবে কীর্তনসহ সন্ধ্যায় ফানুস উড়ানো হয়। ফলে প্রবারণা পূর্নিমাটি সার্বজনীন উৎসবে পরিণত হয়।
প্রবারণা উপলক্ষ্যে বিহারকে নান্দনিক আলোকে সজ্জিত করা হয় অপরদিকে গৃহীরাও নিজের বাসা-বাড়িতে পরিষ্কার পরিচ্ছন্ন করে সজ্জিত করে। বাংলাদেশে প্রতিবছর উৎসবটি জাঁকজমকপূর্ণ আয়োজনে পালিত হয় শুধুমাত্র কোভিড-১৯ (২০২০ ও ২০২১) এ সীমিত পরিসরে আয়োজন করা হয়েছে। এবার পার্বত্য চট্টগ্রামে পরিস্থিতি বিবেচনা করে সীমিত পরিসরে প্রবারণা পূর্ণিমা উদযাপন করছেন। এছাড়াও এবার অনেক বিহারে ফানুস ওড়াবেন না এরকম সিদ্ধান্ত নেয়া হয়েছে।
উৎসবটিতে ধর্মীয় রীতি-নীতির কারণে নিয়মিত আয়োজন হলেও আমরা বিভিন্ন উৎসবে ফানুস উড়ানোকে কেন্দ্র করে পরিবেশের নানা ক্ষতিও দেখতে পাই। সেই সকল বিহারের প্রবারণা উৎসব কমিটির এই পরিকল্পনাকে সাধুবাদ জানানো যায়। পূর্ণিমাকে কেন্দ্র করে বিহার কর্তৃক স্মরনীকা প্রকাশ করে, পত্র-পত্রিকায় উৎসবের গুরুত্বপূর্ণ দিক তুলে ধরে এবং টেলিভিশন ও বেতারে আলোচনা অনুষ্ঠানে আয়োজন করে থাকে।
প্রতিটি উৎসবের ইতিহাস ও ঐতিহ্য রয়েছে। তেমনি প্রবারণা উৎসবের ইতিহাস সম-সাময়িককালের পরিবেশের জন্য গুরুত্বপূর্ণ। মহামতি বুদ্ধ বর্ষাব্রতের (বর্ষার তিন মাস) পর প্রবারণান্তে ৬০ জন অর্হৎ ভিক্ষুকে দেব-দানবের ধর্ম প্রচার ও কল্যাণের জন্য নির্দেশ প্রদান করেন: “ভিক্ষুগণ আত্মহিত ও পরহিতের জন্য, বহুজনের হিতের ও সুখের জন্য আদি-মধ্য-অন্তে কল্যাণকর ধর্ম দিকে দিকে প্রচার কর।”স্নেহময়ী মাতৃদেবীকে নির্বাণ পথ প্রদর্শান্তে তাবতিংস স্বর্গ হতে সাংকাশ্য নগরে অবতরণ ও নানাবিধ ঋদ্ধি প্রদর্শন এবং ভিক্ষুগণের ত্রৈমাসিক বর্ষাব্রত সমাপ্তি ঘটে।
বিশ্ব পরিবেশ সংরক্ষণ ও পরিবেশের ভারসাম্য রক্ষায় যা জনগণের হিত কামনার জন্য মূলত মহাকারুণিক বুদ্ধ আষাঢ়ি পূর্ণিমার তিথিতে ভিক্ষু-ভিক্ষুণীদের তিন মাস বর্ষাব্রত পালনের জন্য নিজ বৌদ্ধ মন্দিরে অবস্থান করার বিধান করেছিলেন। এভাবেই আষাঢ়ি পূর্ণিমা থেকে শ্রাবণী পূর্ণিমা হয়ে মধু পূর্ণিমা বা ভাদ্র পূর্ণিমা তারপরই আজকের প্রবারণা পূর্ণিমা। এই বিশেষ ক'টি লাইন বিশ্লেষণ করলে মহামানব গৌতম বুদ্ধের দূর দৃষ্টিতার প্রমাণ পাওয়া যায়। এ তিন মাস বর্ষা থাকে, প্রকৃতিতে ছোট ছোট প্রাণী ও উদ্ভিদের জন্ম হয় পরিবেশের ভারসাম্য রক্ষা জন্য। যদি জনসমাগম হয় তাহলে তাদের ইকোসিস্টেম ধ্বংস হয়।
এছাড়া বর্ষাতে বৃষ্টিতে ভিক্ষুদের জনদুর্ভোগ কমাতে ও জলবায়ুর পরিবর্তনে বৃষ্টির সাথে বজ্রপাত ঘটে ফলে ভিক্ষুদের নানা সমস্যার কথা তথা উদ্ভিদ ও প্রাণীর জীবনরক্ষার জন্যই বুদ্ধ প্রবারণার পূর্ণিমার সিদ্ধান্ত নিয়েছিলেন। সুতরাং বুদ্ধ দেশিত প্রবারণা উৎসবে দিনেই শপথ নেই পরিবেশের ক্ষতি হোক এরকম কোন কাজ আমরা না করি ও বেশি করে গাছ লাগাই পরিবেশের ভারসাম্য রক্ষা করি।
মহামানব গৌতম বুদ্ধ মানবতা, অহিংসা, ক্ষমাশীলতা, পরোপকারিতা, ন্যায়বিচার, পারস্পরিক মর্যাদাবোধ, দায়িত্বশীলতা, বৈষম্যহীনতা, মৌলিক অধিকার এবং সম্প্রীতি প্রতিষ্ঠায় নিরলস ভাবে কাজ করেছেন। তাই বুদ্ধকেই 'সাম্যনীতির' প্রবক্তা বলা হয়। চলুন বুদ্ধের এই সাম্যনীতি প্রয়োগ করে একটি সুন্দর পৃথিবী আগামী প্রজন্মকে উপহার দেই। সর্বোপরি কারুণিক বুদ্ধ তাঁর প্রচারিত ধম্ম বা সত্যকে (A true way of life) জানার জন্য একটি মুক্ত দলিল দিয়ে গেছেন মানবজাতিকে।
অঙ্গুত্তরনিকায়ের কালাম সূত্রে বর্ণনা করা আছে: ‘শোনা কথায় বিশ্বাস করিও না। বংশপরম্পরায় প্রচলিত বলে বিশ্বাস করিও না। সর্বসাধারণে এটা বলছে বলে বিশ্বাস করিও না। ধর্মগ্রন্থে লিখিত আছে বলে বিশ্বাস করিও না। গুরুজন বা বয়োজ্যেষ্ঠরা বলছে বলে বিশ্বাস করিও না। কারো ব্যক্তিত্বের প্রভাবে অভিভূত হয়ে বিশ্বাস করিও না। তর্কের চাতুর্যে বিশ্বাস করিও না। নিজের মতের সাথে মিল আছে বলে বিশ্বাস করিও না। দেখতে সত্য বলে মনে হয় এ কারণে বিশ্বাস করিও না। এমনকি আমি বুদ্ধ বলছি বলে যে বিশ্বাস করতে হবে তা নয়। নিজের বিচার বুদ্ধি, বিচক্ষণতা প্রয়োগ করে যদি দেখতে পাও- এগুলো যুক্তির সাথে মিলে এবং নিজের ও সকলের জন্য মঙ্গলজনক, কল্যাণকর, তাহলে গ্রহণ করবে এবং সেই অনুযায়ী জীবন যাপন করবে।’
লেখক: প্রভাষক, পালি এন্ড বুদ্ধিস্ট স্টাডিজ বিভাগ, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়