প্রাণভরা তারুণ্য কেন মৃত্যুকে বেছে নিচ্ছে?
সড়ক দুর্ঘটনা, লঞ্চ ডুবি, জাহাজ ডুবিতে প্রাণহানির ঘটনা প্রায়ই ঘটছে। ক্রসফায়ার, পুলিশের সাথে বন্দুক যুদ্ধে সহজ-সরল, নিরপরাধ মানুষ মরছে প্রায় প্রতিদিন। নিত্য রোজকার ঘটনায় পরিণত হয়েছে এসব মৃত্যু। তাজা প্রাণের রক্ত জীবিত মানুষগুলোকে আর অবাক করে না। তবে গত এক মাসে দেশের বিভিন্ন প্রান্তের স্বেচ্ছায় মৃত্যু বা আত্মহত্যার বেশ কয়েকটি ঘটনা ঘটেছে। এক সপ্তাহের ব্যবধানে আত্মহত্যা করেছে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের তিন শিক্ষার্থী। রোগের মতো ছড়িয়ে পড়ছে এমন অস্বাভাবিক মৃত্যু। তরুণদের এত এত আত্মহত্যা ভাবিয়ে তুলেছে দেশের সব মহলের মানুষকে। বিভিন্ন দিক থেকে প্রশ্ন শুনা যাচ্ছে কেন এমন আত্মঘাতী হচ্ছে তরুণরা।
যেকোন রোগের কিছু পূর্ব লক্ষণ বা সিমটম থাকে। যেসব সিমটম একটু একটু করে বড় হতে থাকে, দুর্বল করে দেয় প্রতিরোধ ক্ষমতা। এক পর্যায়ে রোগের প্রাদুর্ভাব দেখা দেয়। আত্মহত্যাও এক ধরনের ব্যাধি। অনেক কারণ ও ঘটনা একটি আত্মহত্যার জন্ম দেয়। আজ থেকে ১২০ বছর আগে আত্মহত্যার কারণ খুঁজে বই লিখেছেন সমাজবিজ্ঞানী ইমেই ডুরখেইম। সেই বইয়ে তিনি লিখেছেন-আত্মহত্যার পেছনে শুধুমাত্র ব্যক্তির মেজাজের ভারসাম্যহীনতাই দায়ী নয়। এর জন্য বিভিন্ন সামাজিক ঘটনাও দায়ী।
তিনি সমাজে বিভিন্ন সময় ঘটে যাওয়া আত্মহত্যার ঘটনাগুলোকে চার ভাগে ভাগ করেছেন। এনোমিক সুইসাইড, অলট্রুস্টিক, ইগোস্টিক এবং ফ্যাটালিস্টিক সুইসাইড। তিনি আত্মহত্যার পেছনে লিঙ্গ, বিবাহ, ধর্ম, বসবাসের অবস্থান, অর্থনৈতিক অবস্থা, সামাজিক নৈরাজ্যকে সামনে আনেন। সামাজিক সম্পর্ক দুর্বল হতে থাকলে, অর্থনৈতিক ও রাজনৈতিক অস্থিরতার কারণে সমাজে দ্রুত ও চরম পরিবর্তন ঘটলে মানুষ এনোমিক সুইসাইডের পথ বেছে নেয়। শুধু তাই নয়, চরম সামাজিক নিপীড়ন ও নিয়ন্ত্রণের কারণে মানুষ এই ধরনের পরিস্থিতির সাথে লড়াইয়ের মানসিকতা হারিয়ে আত্মাহুতি দিয়ে থাকে।
বাংলাদেশের বর্তমান আর্থ-সামাজিক ও রাজনৈতিক পরিস্থিতি গভীরভাবে বিশ্লেষণ করলে ডুরখেইমের দেয়া তত্ত্বের সাথে শতভাগের চেয়ে বেশি মিল পাওয়া যাবে। সামাজিক, রাজনৈতিক ও অর্থনৈতিক দিক থেকে চরম নৈরাজ্য আর বিভাজনে বিভক্ত আমাদের সমাজ। মত ও আদর্শের কারণে বিভেদ, পারস্পরিক স্বার্থের কারণে বিভেদ। দূরত্ব বাড়ছে আঞ্চলিকতার ভিত্তিতেও।
গত কয়েকদিনে আত্মহত্যার কারণে যতগুলো প্রাণ ঝরে গেছে তাদের প্রায় সবাই তরুণ ও এক একটি সম্ভাবনাময় প্রাণ। কেউ বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র, কেউ ছাত্রত্ব শেষ করে কর্মজীবনে প্রবেশের সুযোগ খুঁজে ফিরছিলেন। কিন্তু ভুল নকশায় গড়া সমাজ এসব সম্ভাবনাময় প্রাণগুলোকে বেঁচে থাকার স্বপ্ন দেখাতে পারেনি। দিতে পারেনি নিরাপদ আশ্রয়ের আশ্বাস। বরং সমাজকে বারবার আপন করে নিতে গিয়ে বারবার বিতাড়িত হতে হয়েছে। শেষ পর্যন্ত বিতাড়িত হওয়ার গ্লানি সইতে না পেরে চিরতরে চলে যাওয়াই শ্রেয় মনে করেছে লড়াইয়ে দুর্বল সেসব প্রাণ।
বিভিন্ন গবেষণায় দেখা যায়, বাংলাদেশের তরুণদের আত্মহত্যার অন্যতম প্রধান কারণ বেকারত্ব। বাংলাদেশে এখন পর্যন্ত শিক্ষার প্রধান লক্ষ্য চাকরি খুঁজে পাওয়া। সন্তান লেখাপড়া শেষ করলে প্রতিটি বাবা-মা চায় ছেলে চাকরি করুক, সংসারের হাল ধরুক। অনার্স মাস্টার্স পাস করার পরে বছরের পর বছর বেকার থাকা তরুণদের জন্য খুবই যন্ত্রণার এবং অপমানের। তারা সবসময় একটি হীনমন্যতায় ভুগতে থাকেন। অবমূল্যায়ন ও অবহেলার পাত্রে পরিণত হন পরিবার, সমাজ ও আত্মীয়স্বজনের কাছে। বেকারত্বের গ্লানি মুছে দিতে কেউ কেউ অপরাধ জগতে ঢুকে পড়েন। আবার সামর্থ্য অনুযায়ী কেউ কর্মসংস্থানের খোঁজে বিদেশ পাড়ি দেন। আর যারা দুটোর কোনটাই পারেন না, তারা নিজের বেঁচে থাকাকে তুচ্ছ মনে করেন।
সম্প্রতি এশীয় প্রশান্ত মহাসাগরীয় অঞ্চলের ২৮টি দেশের বেকারত্ব, তরুণদের কর্মসংস্থান, নিষ্ক্রিয় তরুণের হার, আনুষ্ঠানিক-অনানুষ্ঠানিক কর্মসংস্থান ও কর্মসন্তুষ্টি নিয়ে প্রতিবেদন প্রকাশ করেছে আন্তর্জাতিক শ্রম সংস্থা (আইএলও)। এতে বাংলাদেশের তরুণদের বেকারত্বের হার সাত বছরে দ্বিগুণ হয়েছে বলে উল্লেখ করা হয়। দেশে নিষ্ক্রিয় তরুণদের হার ২৭ দশমিক ৪ শতাংশ। আইএলওর প্রতিবেদন অনুযায়ী, বাংলাদেশে দেড় যুগ আগে ২০০০ সালে সার্বিক বেকারত্বের হার ছিল ৩ দশমিক ৩ শতাংশ। ২০১০ সালে তা ৩ দশমিক ৪ শতাংশে দাঁড়ায়। ২০১৩, ২০১৬ ও ২০১৭ সালের হিসাবে এই হার একই থাকে (৪ দশমিক ৪ শতাংশ)। বাংলাদেশে পুরুষের ক্ষেত্রে বেকারত্ব ৩ দশমিক ৩ শতাংশ ও নারীর ক্ষেত্রে ১২ দশমিক ৮ শতাংশ।
ক্ষমতাসীন সরকারের দাবি ‘আমরা অনেক ক্ষেত্রেই উন্নতি করেছি’, কিন্তু কেন সেই উন্নয়ন–প্রক্রিয়ায় তরুণদের কাজে লাগানো যাচ্ছে না, সে ব্যাপারে নীতিনির্ধারকেরা একেবারেই উদাসীন বলে মনে হচ্ছে। সাম্প্রতিক সময়ের এসব অস্বাভাবিক মৃত্যুর জন্য কারণ হতে পারে রাষ্ট্রের পক্ষপাত দুষ্টু আচরণ। রাষ্ট্রযন্ত্রের চোখে দেশের সকল নাগরিক সমান হবে, এটাই সংবিধান স্বীকৃত। কিন্তু বাংলাদেশে রাষ্ট্রযন্ত্র একটি পক্ষকে অগ্রাধিকার দিচ্ছে। আরেকটি পক্ষকে পিছনে ঠেলে দিচ্ছে, অধিকার হনন করছে।
গত কয়েক বছরে সরকারি বিশ্ববিদ্যালয়, বিভিন্ন মন্ত্রণালয় এবং অন্যান্য সংস্থার জনবল নিয়োগে অপেক্ষাকৃত যোগ্য প্রার্থীকে বঞ্চিত করে কম যোগ্য প্রার্থীকে নিয়োগের শত শত নজির রয়েছে। রাজনৈতিক মত পার্থক্যের কারণে বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক হওয়ার সব যোগ্যতায় অসাধারণ হওয়ার পরেও বারবার ভাইভা বোর্ড থেকে ফিরিয়ে দেয়া হচ্ছে সেরা প্রার্থীদের। অযোগ্য প্রার্থীকে নিয়োগ দেয়া হচ্ছে। দেশে বর্তমানে সম্মানজনক সরকারি চাকরির শীর্ষে রয়েছে বিসিএস ক্যাডারভুক্ত বিভিন্ন পদের চাকরি। বিজ্ঞপ্তি প্রকাশের পর থেকে ভাইভা পর্যন্ত প্রতিটি বিসিএস পরীক্ষার প্রক্রিয়া শেষ হতে দেড় থেকে দুই বছরর সময় লেগে যায়। কোন চাকরিপ্রার্থী যখন প্রাথমিক বাছাই পর্ব থেকে শুরু করে সব ধাপ পার করার পর মৌখিক পরীক্ষায় কেবল, মত, আদর্শ ও পথের কারণে বাদ পড়ে যান, তা যে কতটা বেদনার যে বাদ পড়ে সেই বোঝে। অতি ধৈর্যশীল না হলে এমন অনিয়ম সহ্য করে ফের চেষ্টা করার মতো মানসিক শক্তিশালী লোক পাওয়া দুরহ।
আত্মহত্যার কারণ হতে পারে বিচারহীনতার পরিবেশ। ছেলে-মেয়ে উভয়েই সাধারণভাবে এসব পরিস্থিতির শিকার। তবে সাধারণ এসব শোষণ, নিপীড়নের পরেও নারীরা বিশেষভাবে নির্যাতিত ও নিগৃহীত নয়। স্কুল, কলেজ, বিশ্ববিদ্যালয় কোথাও নিরাপদ নয় নারীরা। দুষ্ট পথচারী থেকে শুরু করে পিতৃতুল্য বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষকের কাছেও নিরাপত্তাহীন মেয়ে শিক্ষার্থীরা। শিক্ষকের হাতে লাঞ্ছিত হয়েও মুখ বুজে তা সহ্য করতে হয় ছাত্রীদের। শিক্ষকের ক্ষমতার দাপটে চুপসে যায় প্রতিবাদ। ভেঙ্গে চুরমার হয়ে যায় বড় হওয়ার, সমাজ বদলে দেয়ার স্বপ্ন। চুপসে যাওয়া প্রতিবাদ নীরবে আত্মাহুতিতে বিদ্রোহের বিলাসিতা খুঁজে পায়।
তিউনিসিয়ার জেসমিন বিপ্লব এবং মিশর, সিরিয়া ও ইয়েমেনের আরব বিপ্লবের কথা নিশ্চয়ই আমাদের মনে আছে। পুলিশের দুর্নীতি ও দুর্ব্যবহারের প্রতিবাদে আত্মাহুতি দিয়েছিলেন তিউনিসিয়ার ফল বিক্রেতা মোহাম্মদ বোয়াজিজি। আত্মাহুতি’র মাধ্যমে করা সেই প্রতিবাদের ঢেউ উপচে পড়ে আলজেরিয়া, জর্ডান, মিশর ও ইয়েমেনে। বাংলাদেশে গত কয়েকদিন ধরে যেসব অনাকাঙ্ক্ষিত মৃত্যুর ঘটনা ঘটেছে, এগুলোকে শুধুই আত্মহত্যা বললে ভুল হবে। এসব মৃত্যুও সমাজের এক একটি অনিয়ম, অন্যায়ের প্রতিবাদ। যদিও প্রতিবাদের এই পথ আমি সমর্থন করিনা। কিন্তু যে কারণে, যাদের কারণে এসব সম্ভাবনাময়ই প্রদীপ অকালে নিভে গেল তারা কি তা নিজেদের শুধরেছে, তারা কি শুধরাবে না?
লেখক: সাংবাদিক