আমরা কেন ‘রতন টাটা’ হতে পারি না?
বোম্বের পাঁচ তারকা হোটেল তাজ এর সি লাউঞ্জে দু’জনের জন্য একটি টেবিল চাইলেন অশীতিপর এক শিল্পপতি। এ লাউঞ্জের জানালা খুললেই ভেতরে প্রবেশ করে আরব সাগরের নির্মল বাতাস। বয়সের ভারে কিছুটা ন্যুব্জ, তবে চোখে-মুখে আভিজাত্যের আলোকরেখা সুস্পষ্ট। ‘কোন টেবিল এ মুহূর্তে খালি নেই। এখানে আপনার নাম লিখে দিন। টেবিল খালি হলে আপনাকে ডাকা হবে।’ এই বলে ওয়েট্রেস বুড়ো ভদ্রলোকের দিকে তার নোটবুক ঠেলে দিলেন।
নোটবুকে নাম লিখেই লাউঞ্জের করিডোরের পথ ধরলেন আগন্তুক ভদ্রলোক। তাজের চেয়ারম্যান স্বয়ং টেবিল চাইছেন, এটা জানাজানি হয়ে গেলে কর্তব্যরত ওয়েট্রেস কোন অতিথিকে অন্যায়ভাবে তুলে তাঁকে বসবার সুযোগ করে দিতে পারেন, সে আশংকায় ভদ্রলোক নিঃশব্দে কর্মীটির চোখের আড়াল হলেন।
এই হলেন রতন টাটা। গত ৯ অক্টোবর অনন্তকালের পথে যাত্রা করলেন তিনি। ৮৬ বছর বয়সের এক পরিতৃপ্ত পূর্ণাঙ্গ জীবন কাটিয়েছেন রতন টাটা। ভারতের সবচেয়ে পুরোনো ও ঐতিহ্যবাহী শিল্প সাম্রাজ্য টাটা শিল্পগোষ্টীর এমিরেটাস চেয়ারম্যান। ২০২২ সালে ১২৮ বিলিয়ন রেভিনিও অর্জন করা টাটা শিল্পগোষ্ঠীর মুনাফার কিছুই নিজের জন্য নেননি এর কর্ণধার। বরং এ মুনাফার একটা বড় অংশ কোম্পানীর অন্যতম অংশীজন, তাঁর কর্মী বাহিনীকে বিলিয়ে দিয়েছেন অকাতরে।
আমেরিকার কুলীন বিশ্ববিদ্যালয়গুলোর একটি কর্ণেল বিশ্ববিদ্যালয়ের স্হাপত্যকলার গ্র্যাজুয়েট তিনি। ৫৪ বছর বয়সে যখন তিনি টাটার কর্ণধার হন, তখন ভারতের অর্থমন্ত্রী ড. মনমোহন সিং দেশটির রাষ্ট্রীয় খাতের আধিপত্য ভেঙে দিয়ে উদারীকরনের বন্ধুর পথে চলা শুরু করেছেন। ঠিক এ সময়ে বেসরকারি খাতের উদ্যোক্তারা সিপিআই, সিপিএম ইত্যাদি রাজনৈতিক দলের সমালোচনার বাক্যবাণে জর্জরিত হচ্ছেন। ঠিক এ সময়ে দুস্তর পারাপারে দুলতে থাকা কান্ডারীবিহীন টাটার দায়িত্বভার গ্রহন করলেন রতন টাটা।
উদারীকরন নীতির সুযোগ নিয়ে কেবল ভারতে নয়, ইরান, তুরান, আফ্রিকায় নিলেন বড় বড় প্রকল্প। ভারতের সীমানা ছাড়িয়ে ছড়িয়ে পড়লে রতন টাটার নাম। তাঁর যোগ্য নেতৃত্বে টাটার বেচা-বিক্রি বেড়েছে ৪০ গুণ, মুনাফা বেড়েছে ৫০ গুণ। এ অর্জনের জন্য তিনি না করেছেন স্টেট ব্যাংক অব ইন্ডিয়ার আমানতকারীদের লুট; না তাঁর কুনজর ছিলে কোনো ব্যাংকে গচ্ছিত সোনার ভল্টের দিকে।
রতন টাটা ব্যবসায়িক সাফল্যের জন্য নয়, তিনি মানুষর মাঝে বেঁচে থাকবেন তাঁর জনহিতকর কাজের জন্য। ভারতবর্ষে তাঁর দানের কথা নাইবা বললাম; বহির্জগতে তাঁর দানের ছোট একটি ফিরিশ্তি দিই। ১) অস্ট্রেলিয়ার ইউনিভার্সিটি অব নিউজ সাউথ ওয়েলসের প্রকৌশল অনুষদ হয়েছে তাঁর দানে; ২) ক্যালিফোর্নিয়া ইউনিভার্সিটির সান ডিয়েগো ক্যাম্পাসের জন্য দান করেছেন ৭০ মিলিয়ন মার্কিন ডলার; ৩) কর্ণেল বিশ্ববিদ্যালয়ে ভারতীয় ছাত্রদের পড়বার জন্য ২৮ মিলিয়ন ডলার দিয়েছেন তিনি; ৪) হার্ভার্ড বিজনেস স্কুলে টাটা হল নির্মাণের জন্য দিয়েছেন ৫০ মিলিয়ন ডলার।
ব্যক্তিগত জীবনে তিনি ছিলেন চিরকুমার। মার্কিন মুল্লুকে পড়ার সময় এক স্বর্ণকেশী তরুণীকে পছন্দ হয়েছিল তাঁর। পরিবারের কাছে তা প্রকাশও করেছিলেন তিনি। মাতৃস্নেহে বড় করা দাদিমার বেজার মুখ দেখে এ পথে আর হাঁটেননি কখনো। নিজের পরিবার ছিল না বলে হাপিত্যেশ করেননি তিনি। দুঃস্হ মানুষের মাঝে তিনি খুঁজে পেয়েছিলেন নিজের পরিবার।
আরো পড়ুন: জেনে নিন রতন টাটা সম্পর্কে অজানা ১০ তথ্য
একবার এক বন্ধু তার কাছে প্রতিবন্ধী স্কুলের ছাত্রদের জন্য কিছু হুইল চেয়ার চাইলেন। রতন টাটা ওই সামান্য দান করেই ক্ষান্ত হলেন না; তিনি স্বয়ং হুইল চেয়ার প্রদান অনুষ্ঠানে উপস্থিত থেকে স্কুলের বাচ্চাদের সঙ্গ দিলেন। তিনি মাথা নুইয়ে প্রত্যেক ছাত্রের সঙ্গে হ্যান্ডশেক করছেন। হঠাৎ একটি বালক তাঁর ট্রাউজার টেনে ধরে বললে, ‘একটু নীচু হয়ে বসবে তুমি? আমি তোমার মুখখানা চিনে নিতে চাই। যাতে স্বর্গোদ্যানে দেখা হলে তোমাকে ঠিক চিনে নিতে পারি।’
বিদায় রতন টাটা। আমি জানি না ওই প্রতিবন্ধী বালকের নিঃশর্ত প্রার্থনায় তোমার ভাগ্যে স্বর্গ জুটবে কিনা। তুমি ছিলে পারসিক ধর্মের অনুসারী। তোমার ধর্মের শাস্ত্রজ্ঞরাই তা ভাল বলতে পারবে। তবে পৃথিবীর সেরা পরোপকারীদের (Philanthropist) তালিকায় তোমাকে আমি জন ডি রকফেলার, ও হেনরি ফোর্ডের ওপরেই রাখব।
লেখক: অধ্যাপক, একাউন্টিং বিভাগ, চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয় এবং
সাবেক উপাচার্য, স্টেট ইউনিভার্সিটি অফ বাংলাদেশ