শিক্ষকের স্বপ্ন ও স্বাধীনতা
শিক্ষকরা সমাজের সেই শক্তি, যারা প্রজন্মের পর প্রজন্মকে আলোকিত করার দায়িত্ব পালন করেন। তাঁদের ভূমিকা শুধু শিক্ষাদানের মধ্যেই সীমাবদ্ধ নয়। তারা শিখিয়ে থাকেন কীভাবে জীবনকে যথার্থভাবে উপলব্ধি করতে হয় এবং ব্যাখ্যা করতে হয়।
আন্তর্জাতিক শ্রম সংস্থা (ILO) এবং জাতিসংঘ শিক্ষা, বিজ্ঞান ও সংস্কৃতি সংস্থার (UNESCO) সুপারিশক্রমে ১৯৯৪ সাল থেকে প্রতিবছর ৫ অক্টোবর বিশ্ব শিক্ষক দিবস পালিত হয়। এই দিবসটির মাধ্যমে শিক্ষকদের সম্মান, অবস্থান, তাঁদের অসীম ত্যাগ এবং শিক্ষক সংশ্লিষ্ট প্রভৃতি বিষয়গুলির স্বীকৃতি দেওয়া হয়।
একজন সচেতন মানুষের শিক্ষক হওয়ার পেছনে থাকে দৃঢ় আদর্শ এবং তা অনুসরণের প্রত্যয়। মানবিক গুনাবলী সমৃদ্ধ প্রত্যেক শিক্ষকেরই স্বপ্ন থাকে একটি উন্নত সমাজ গড়ে তোলা, যেখানে মূল্যবোধ, মানবিকতা, জ্ঞানচর্চা এবং সৃজনশীলতা থাকবে সবার আগে। একজন শিক্ষক তাঁর শিক্ষার্থীদের শুধু পাঠ্যপুস্তকের জ্ঞানের মধ্যেই সীমাবদ্ধ রাখেন না, বরং তাঁদের মধ্যে আত্মবিশ্বাস, সৃজনশীলতা, এবং দায়িত্ববোধ জাগিয়ে তোলেন।
তিনি স্বপ্ন দেখেন এমন একটি প্রজন্ম গড়ে তোলার, যারা সমাজের পরিবর্তন ঘটাতে সক্ষম এবং ভবিষ্যতের পৃথিবীকে সকল শ্রেণি, পেশা এবং মতামলম্বীর মানুষের জন্য নিরাপদ করে এগিয়ে নিতে পারে। শিক্ষকের স্বপ্ন শুধু ব্যক্তিগত নয়, এটি একটি বৃহৎ সামাজিক লক্ষ্য নিয়ে গড়ে ওঠে। একজন শিক্ষক প্রতিটি শিক্ষার্থীকে আলাদাভাবে মূল্যায়ন করেন এবং তাঁর দক্ষতা ও সামর্থ্য অনুযায়ী শিক্ষার্থীদের বিকাশের চেষ্টা করেন। এটি একটি বিশাল দায়িত্ব, এবং এর পেছনে থাকে অপরিসীম শ্রম ও মমতা।
তবে বিভিন্ন পরিস্থিতিতে কিছু প্রশ্ন বারংবার প্রাসঙ্গিক হয়ে ওঠে আর সেগুলি হচ্ছে শিক্ষকরা কতটা স্বাধীনভাবে তাঁদের দায়িত্ব পালন করতে পারেন? শিক্ষা প্রতিষ্ঠানগুলোতে শিক্ষকদের মতপ্রকাশের স্বাধীনতা, শিক্ষাদানের পদ্ধতি, এবং শিক্ষাক্রমের বিষয়ে মতামত দেওয়ার সুযোগ কেমন? শিক্ষার মান উন্নয়নে শিক্ষকের স্বাধীনতা একটি গুরুত্বপূর্ণ উপাদান। শিক্ষকেরা তাঁদের সৃজনশীলতা ও জ্ঞান অনুযায়ী পাঠদান করতে না পারলে শিক্ষাব্যবস্থা গদবাঁধা এবং বৈচিত্রহীন হয়ে পড়তে পারে।
শিক্ষাদানের ক্ষেত্রে স্বাধীনতা বলতে বোঝায় একজন শিক্ষককে বাধ্যতামূলক নিয়ম বা গণ্ডির মধ্যে আবদ্ধ না করে তাঁর জ্ঞান ও অভিজ্ঞতার ওপর আস্থা রাখা। বিভিন্ন দেশেই দেখা যায়, শিক্ষাক্ষেত্রে শিক্ষকদের পাঠদানের বিষয়টি নিয়ন্ত্রণের জন্য নির্দিষ্ট নীতিমালা নির্ধারণ করে দেয়া হয়। যা ক্ষেত্রবিশেষে সংকীর্ণ এবং এর ফলশ্রুতিতে একজন সৃজনশীল শিক্ষকের সৃজনশীলতা এবং তাঁর শিক্ষার্থীদের মানসিক বিকাশ বাধাগ্রস্ত হতে পারে।
বস্তুত, শিক্ষা একটি চলমান প্রক্রিয়া, যেখানে শিক্ষকের যৌক্তিক স্বাধীনতা থাকলেই নতুন কিছু শেখানো এবং শেখার সুযোগ সৃষ্টি হয়। কেবলমাত্র বিদ্যা চর্চায় স্বাধীনতা থাকলেই শিক্ষকরা শিক্ষার্থীদের মনোজগতে প্রবেশ করতে পারেন এবং তাঁদের অন্তর্নিহিত প্রতিভা বিকাশের সুযোগ পান।
বিশ্ব পরিমন্ডলে শিক্ষকরা তাঁদের কর্মস্থলে এবং সমাজে স্বীকৃতি পেলেও অনেক সময় তাঁদের পেশাগত স্বাধীনতা বাধাগ্রস্ত হয়। সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষগুলোর শিক্ষানীতি, প্রশাসনিক কাঠামো, অভিভাবকদের প্রত্যাশা—এসবের সঙ্গে শিক্ষকদের খাপ খাইয়ে চলতে হয়। এছাড়া অনেক ক্ষেত্রে পাঠ্যক্রমে অযৌক্তিক পরিবর্তনের কারণে শিক্ষকদের স্বতঃস্ফূর্ততা হারিয়ে যায়। এর ফলে তাঁরা বাধ্য হয়ে একটি পূর্ব নির্ধারিত ধাঁচে শিক্ষাদান করেন, যেখানে সৃজনশীলতা এবং মানসিক বিকাশের সুযোগ হ্রাস পাওয়ার আশংকা থাকে।
তাছাড়া, তৃতীয় বিশ্বের দেশগুলোতে শিক্ষকদের পেশাগত নিরাপত্তা ও সম্মানজনক পারিশ্রমিকের অভাব রয়েছে যার মধ্যে বাংলাদেশ অন্যতম। এই ধরনের সমস্যাগুলো শিক্ষকদের আত্মবিশ্বাসকে কমিয়ে দেয় এবং তাঁদের স্বপ্ন পূরণের পথে বড় অন্তরায় হয়ে দাঁড়ায়। শিক্ষার মান উন্নত করতে শিক্ষকদের স্বাধীনতা, পেশাগত নিরাপত্তা এবং সম্মানজনক পারিশ্রমিক নিশ্চিত করা জরুরি।
যদি শিক্ষকদের স্বাধীনভাবে তাঁদের দায়িত্ব পালনের সুযোগ দেওয়া হয়, তাহলে শিক্ষাব্যবস্থায় ব্যাপক পরিবর্তন আনা সম্ভব। প্রতিটি শিক্ষকের নিজস্ব চিন্তাভাবনা এবং অভিজ্ঞতা থাকে, যা শিক্ষার্থীদের জন্য মূল্যবান। তাই তাঁদের স্বপ্ন ও সৃজনশীলতাকে গুরুত্ব দেওয়া উচিৎ।
বিভিন্ন আন্তর্জাতিক গবেষণায় দেখা গেছে, যেখানে শিক্ষকদের স্বাধীনভাবে শিক্ষাদানের সুযোগ দেওয়া হয়েছে, সেখানে শিক্ষার্থীদের মান, সৃজনশীলতা এবং পরবর্তীতে কর্ম দক্ষতা বৃদ্ধি পেয়েছে। সম্পর্ক বিবেচনায় শিক্ষক-শিক্ষার্থীর সম্পর্কটি একটি মৌলিক এবং ধারাবাহিক বিষয়। সেই ধারাবাহিকতায় একজন আদর্শ শিক্ষক যদি স্বাধীনভাবে শিক্ষাদানের কৌশল নির্ধারণ করতে পারেন, তবে তিনি শিক্ষার্থীদের মানসিক ও সামাজিক বিকাশে আরও গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখতে পারবেন যা প্রজন্ম থেকে প্রজন্মে প্রবাহমান থাকবে।
শিক্ষকদের স্বপ্ন এবং স্বাধীনতা একটি দেশ ও জাতির অগ্রসর হবার জন্য অপরিহার্য বিষয়। তাঁদের স্বপ্নের সফল বাস্তবায়নের জন্য প্রয়োজন সঠিক শিক্ষার পরিবেশ এবং যথাযথ স্বাধীনতা তথাপি শিক্ষায়তন গুলোতে যাতে সঠিক মানুষ শিক্ষক হিসেবে যুক্ত হতে পারে সেটিও শিক্ষা সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষগুলোর জন্য বড় দায়। শিক্ষা একটি সৃজনশীল প্রক্রিয়া, যা শিক্ষকের স্বাধীনতার মাধ্যমে আরও উন্নত ও অর্থবহ হয় এবং সমন্বিতভাবে শিক্ষকদের এই স্বাধীনতা ও স্বপ্নের স্বীকৃতি দেওয়া উচিৎ, যাতে তাঁরা নিজেদের নৈতিকতা, আদর্শ, সৃজনশীলতা ও শ্রমের উপর ভিত্তি করে নিজ নিজ সমাজের জন্য আলোকিত প্রজন্ম এবং বৈশ্বিক নাগরিক গড়ে তুলতে পারেন।
লেখক, শিক্ষক, ব্যবসায় প্রশাসন বিভাগ রবীন্দ্র মৈত্রী বিশ্ববিদ্যালয়।