তরুণ-তরুণীদের প্রতি খোলা চিঠি
প্রিয় তরুণ তরুণী,
আমার বড় মেয়ের বয়স ২১। আমার নিজের বয়স ৪৬।
ঠিক আমার বয়স যখন ১৮/১৯ তখন থেকে আমি চাকরি করি। শুধু চাকরিই যে করি তা নয়, মিরপুরের ছোট্ট বাসার পুরো পরিবারের অর্থনৈতিক দায়িত্ব আমি নিজের কাঁধে তুলে নিই। আমার বেতনের টাকা থেকে বাড়িভাড়া, বাজার খরচ চালাতে হতো।সেই ১৯ বছর বয়স থেকে আমি একদিনের জন্যও বেকার ছিলাম না। মাঝখানে দুইবার আমার চাকরি জীবনে ছেদ পড়েছে। চাকরি চলে গিয়েছিলো। সে সময় আমি চাকরি খোঁজার পাশাপাশি নিজে নিজে কিছু করার চেষ্টা করেছি। আমার কোনো বেকারত্বই এক মাসের বেশি স্থায়ী হয়নি।
লেখালেখি, টিভি নাটক বানানো, অনলাইনে প্রোডাক্ট বেচা, ডিজিটাল মার্কেটিং, ভয়েস আর্টিস্ট, সাংবাদিকতা, টক শো, রেডিও শো, এনজিওতে খ্যাপ, আইটি কোম্পানিতে চাকরি , এমনকি ফ্রিল্যান্সিং ও করেছি।
আমার চিন্তা ছিলো একটাই। সংসারকে চালিয়ে নিতে হবে।
কাজেই আমার অভিজ্ঞতাকে তোমার গুরুত্ব দিতে পারো।
আমার ২১ বছর বয়সী মেয়েকে আমি যেসব উপদেশ দিই, সেগুলোই তোমাদের বলছি। দেশের এই পরিস্থিতিতে এই পরামর্শগুলো খুবই গুরুত্বপূর্ণ বলে আমি মনে করি।
প্রথম কথা, কাউকে হিরো বানিও না। পৃথিবীতে বিশুদ্ধ হিরো খুবই কমই আছেন। আর দেশের হিরোদের কথা নাই বা বললাম। কাউকে হিরো বানিও না। কাউকে জিরোও বানিও না। বরং নিজে হিরো হও। নিজেকে হিরো ভাবতে শেখো। তোমার জীবনে একমাত্র হিরো তুমিই। তোমার আর কোনো হিরো, গুরু, বস- ইত্যাদির দরকার নাই। তুমি তোমার ফ্যামিলির হিরো হও। তুমি তোমার ভাই বোনের হিরো হও। তুমি তোমার বাবা মায়ের হিরো হও। তুমি তোমার প্রেমিক প্রেমিকার হিরো হও। আপাতত এইটুকু তোমার লক্ষ্য হওয়া উচিত।
দ্বিতীয় কথা, তুমি বাস্তবতা মাইনা নাও। বাস্তবতা খুবই কঠিন। তুমি যে এই দেশে জন্মাইছো, সেই জন্মের সার্টিফিকেট পেতে হলে, তোমাকে ঘুষ দিতে হয়। জন্মসূত্রে পাসপোর্ট, এনআইডি কার্ড, ভোটার কার্ড পাওয়া তোমার জন্মগত অধিকার । কিন্তু এই তিনটি জিনিসের জন্য তোমাকে কোনো না কোনো ফর্মেটে ঘুষ দিতে হয়। এমনকি তুমি যেদিন মারা যাবে, তোমার ডেথ সার্টিফিকেটের জন্য, কবরস্থানে এক টুকরো মাটির জন্য তোমার ফ্যামিলিকেও ঘুষ দিতে হবে। এই বাস্তবতা সব সময় মাথায় রেখো।
তৃতীয় কথা, তোমার জন্য কোনো সুযোগ নাই। মিছিলে হয়তো তুমি ছিলে, হয়তো তুমি গুলি খেয়েছো, হয়তো তোমার ফ্যামিলির কেউ মারা গেছে। তোমার সকল আত্মত্যাগের মূল্য জিরো। সেটা ৭১ এ হোক আর ২৪ শে হোক। দিন শেষে তুমি মিছিলের একটি সংখ্যা মাত্র। রাজা আসবেন, রাজা যাবেন। আবার নতুন রাজা আসবেন। তুমি সেই প্রজাই রয়ে যাবে। তোমার জন্য হাতে করে কেউ এক প্লেট সুযোগ নিয়ে আসবে না। তোমার সুযোগ তোমাকেই তৈরি করতে হবে।
আরও পড়ুন: ইসরায়েলে হামলার পর জাতিসংঘ নিরাপত্তা পরিষদের জরুরি বৈঠক
এখন তুমি ভাবো, কীভাবে সেই সুযোগ তুমি তৈরি করতে পারো। তুমি ভাবো, ভাই এন্ড সিস্টার, তুমি ঠান্ডা মাথায় ভাবো। কীভাবে তুমি তোমার সুযোগ তৈরি করবে। মনে রাখবা, ''এমন সুযোগ'' তোমাকে তৈরি করতে হবে, যে সুযোগ অন্যের দয়ার উপর নির্ভরশীল না। সেটা নির্ভর করে তোমার ক্ষমতা আর হিম্মতের উপর। যে সুযোগ অন্য মানুষ তোমাকে দেবে, সেই সুযোগ স্থায়ী কিছু না। কাজেই কাউকে বলতে যেও না, বস একটা চান্স দ্যান, ফাটায় দিমু।
কেউ তোমাকে চান্স দেবে না। তোমাকে নিজের চান্স নিজেই তৈরি করে নিতে হবে। এ বিষয়ে পরবর্তীতে আরও ডিটেইলসে কথা বলবো। মনে করিয়ে দিও।
চতুর্থ কথা। মাস্টারমাইন্ড না, মাস্টার হও। পৃথিবীতে মাস্টারমাইন্ড বলে কিছু নেই। প্রাণীজগতের মধ্যে মানুষ একমাত্র প্রভু বা গুরু খোঁজে। এটা তার বিনোদনের অংশ। কেউ এক মাস্টারমাইন্ড আছে, এটা ভেবে মানুষ আনন্দ পায়। এর কারণ মানুষের নিজের উপর আত্মবিশ্বাস কম। মানুষ নিজের রক্ত ঢেলে সরকার ফেলে দেয়। এত বড় ঘটনা ঘটানোর পরও তার আত্মবিশ্বাস গড়ে উঠে না। সে ভাবে, নিশ্চয়ই এর পিছনে কোনো মাস্টারমাইন্ড ছিলো। নইলে কি আর এত সহজে সব হতো!
মাস্টারামাউন্ড একটা ভুয়া কনসেপ্ট। এই ভুয়া কনসেপ্ট ইচ্ছা করে তৈরি করা হয়। কিছু বুদ্ধিমান মানুষ এই কাজটি করেন। কেন করেন? যাতে পাবলিক নিজেদেরকে বেশি শক্তিশালী না ভাবেন। পাবলিক যাতে মনে করে, মাস্টারমাইন্ড ছাড়া তারা অচল, তারা ক্ষমতাহীন। কাজেই কাউকে মাস্টারমাইন্ড মানার দরকার নেই। বরং নিজে মাস্টার হও। যেকোনো একটা সাবজেক্টে মাস্টার হও।
ধরো, তুমি বাংলায় গুছিয়ে লিখতে পারো। অতএব তুমি বাংলায় মাস্টার। তুমি গুছিয়ে কথা বলতে পারো, তুমি কথনে মাস্টার। কিংবা তুমি গিটার বাজাতে পারো, তুমি গিটের মাস্টার। যে কাজই হোক, সেই কাজেই সর্বোচ্চ উৎকৃষ্ট হও। সর্বোচ্চ। যাতে তোমাকে সবাই সেই সাবজেক্টে মাস্টার বলে।
আরও পড়ুন: বশেমুরবিপ্রবিতে শ্রমিক হত্যার প্রতিবাদে মানববন্ধন
পঞ্চম কথা। যেকোনো ভাবেই হোক, ইংরেজি শেখো। তোমার বয়স যদি ২১ হয়, তাহলে এখনো যথেষ্ট সময় আছে ইংরেজি শেখার। ইংরেজিতে দক্ষ হবার। তুমি প্রাণপণ চেষ্টা করলে এক বছরের মধ্যে ইংরেজিতে শিখতে পারবে। তোমরা ছোট ছোট গ্রুপ করো। এবং প্রতিজ্ঞা করো, যে গ্রুপে তোমরা সব সময় ইংরেজিতে কথা বলবা। গ্রামারের চিন্তা ভুলে যাও। গ্রামার এমনিতেই চলে আসবে। তুমি শুধু প্র্যাকটিস করতে থাকো। ইংরেজি পত্রিকা পড়ো। ইংরেজি মুভি দেখো। এখন থেকে মনে মনে যা কিছু ভাববা, ইংরেজিতে ভাবো।
তুমি যদি ইংরেজিতে বস হও, তাহলে ধরে নিবা, সারা পৃথিবীর দরজা তোমার জন্য ৫০% খোলা হয়ে গেছে।
ষষ্ঠ কথা, তোমার নিজের মতামত বানাতে শেখো। আমি জানি, এই কথাটা উইয়ার্ড শোনাচ্ছে। নিজের মতামত বানানো আবার কী। উদাহরণ দিই। ধরো, তোমার চারপাশের এলিট লোকজন বলছে, পথের পাঁচালি খুবই ভালো সিনেমা। এবং বেদের মেয়ে জোসনা একটি খারাপ সিনেমা। লোকলজ্জার ভয়ে, বা এলিট শ্রেণীতে বিলং করার জন্য তুমিও বলা শুরু করলা, পথের পাঁচালি একটি কালজয়ী চলচ্চিত্র। না, এটা কোরো না। তোমার যদি বেদের মেয়ে জোসনা ভালো লাগে, তুমি যুক্তি দিয়ে দ্বিধাহীন কন্ঠে বলবে, ভাই আমার বেদের মেয়েকে ভালো লাগে। পিরিয়ড। সাহিত্যের ক্ষেত্রেও একই কথা। রবীন্দ্রনাথে চাইতে যদি কাসেম বিন আবু বকর পড়তে ভালো লাগে, পড়বা। এবং গিল্টি ফিলিংস ছাড়াই পড়বা।
আরও পড়ুন: ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে ৭টি ভাষা কোর্সে ভর্তি
সপ্তমত। কোনো কিছুকে খারিজ করে দিও না। ধরো, কেউ তোমাকে বললো, রবীন্দ্রনাথ পইড়ো না। ও ফালতু। তোমার এ কথা শোনার দরকার নাই। যতক্ষণ তুমি রবীন্দ্রনাথ না পড়ছো, ততক্ষণ তুমি বুঝতে পারবে না- রবীন্দ্রনাথ ফালতু কিনা। আগে পড়ো। রবীন্দ্রনাথ পড়ো, হুমায়ূন পড়ো, আরিফ পড়ো। তারপর তুমি সিদ্ধান্ত নাও। পরের মুখে কখনো ঝাল খাবে না।
অষ্টমত। তোমার দুটি হাত চোখের সামনে মেলে ধরো। এবং ধ্যান করো। এই দুটি হাত দিয়ে এই পৃথিবীর জন্য, তোমার জন্য, তোমার বাবা মার জন্য কতকিছু করা সম্ভব। তোমার এই দুটি হাত দিয়ে তুমি তোমার বাবা মার পা টিপে দিতে পারো। ট্রাস্ট মি, বাকি জীবন গর্ববোধ করবে যে, নিজের হাতে বাবা মার সেবা করেছে। এই দুটি হাত দিয়ে একটা গাছ লাগালে, বছর না পেরোতেই সেই গাছ বড়ো হয়ে যাবে। এই দুটি হাত মানবজীবনের শ্রেষ্ঠ নিয়ামত। প্রতিদিন অন্তত একবার ভাববা, এই শ্রেষ্ঠ নিয়ামতকে তুমি ঠিকভাবে কাজে লাগাচ্ছো কিনা।
ভালো থেকো।
আবার কথা হবে।
নোট: ফেসবুক থেকে সংগৃহীত