২৫ সেপ্টেম্বর ২০২৪, ১৩:১৯

ভয় কীভাবে ফ্যাসিবাদ ও কর্তৃত্ববাদের জন্ম দেয়

  © প্রতীকী ছবি

ফেসবুকে কম সময় থাকার চেষ্টা করি। কিন্তু ফেসবুক ঢুকলেই বিভিন্ন গ্রুপ এবং মানুষজনের হাউকাউ শুনলে কেমন জানি লাগে। এক প্রকারের যুদ্ধ যুদ্ধ ভাব। মনে হয় কমান্ডারের আদেশের অপেক্ষায় আছে, যে কোন মুহূর্তে যুদ্ধ ছড়িয়ে পড়বে। কে কাকে ল্যাং মারবে, কে কত কুতথ্য ছড়াতে পারে, কে কাকে ডিহিউমানাইজ করতে পারে, এসব হচ্ছে এখনকার ফেসবুক-এর আলোচনা।

কেউ নিজের পরিচয় নতুন করে প্রকাশ করছেন, তা নিয়ে অস্তিত্ব সংকটে আবার কেউ কেউ ভয়ে আতঙ্কে ফেসবুক কাঁপাচ্ছে। কেউ আবার তথাকথিত বিপ্লব বেহাত হওয়ার আশঙ্কায় দিন গুজরান করছে। সব মিলিয়ে এক অন্য রকম অবস্থা। আজকের এই এলাকায়, ফেসবুকে মানুষ এরকম কথাবার্তা কেন বলছে তা বলার চেষ্টা করব। 

আমরা অনেক কিছু দেখে ভয় পাই। বাঘ, সিংহ, মৃত্যু থেকে শুরু করে মানুষকে কিংবা ডিবি হাওন আঙ্কেলকে। কিন্তু আমরা কি কখনো ভেবে দেখেছি, ভয় কীভাবে একটা রাষ্ট্রের অস্তিত্ব কে নাড়িয়ে দিতে পারে? গণতন্ত্রকে নষ্ট করে কর্তৃত্ববাদ এবং ফ্যাসিবাদ কে ক্ষমতায় বসিয়ে দেই? 

তারা যখন দেখলো গ্রামীণ দরিদ্র জনগোষ্ঠী গণতন্ত্রের মাধ্যমে রাজনৈতিকভাবে শক্তিশালী হচ্ছে, তখন তারা এই পরিবর্তনের ভয়ে গণতন্ত্রের বিরুদ্ধে দাঁড়িয়ে যায়।

বিষয়টি খুবই গুরুত্বপূর্ণ, কারণ এর সাথে আমাদের জীবন-জীবিকাসহ অন্যান্য বিষয় জড়িত। গণতন্ত্রের মাধ্যমে একদল (এলিট) জনগোষ্ঠীর রাজনৈতিক ও সামাজিক ক্ষমতা হ্রাস পেতে শুরু করলে, তারা ভীত হয়ে পড়ে এবং গণতন্ত্রের নিয়মগুলোকে মানতে অস্বীকৃতি জানায়। এই ভয়টি মূলত তাদের সামাজিক, অর্থনৈতিক ও রাজনৈতিক অবস্থান হারানোর ভয় থেকে উদ্ভূত হয়। 

বিশেষত যখন দেশের দরিদ্র জনগোষ্ঠী, যারা এতদিন রাজনৈতিকভাবে গুরুত্বহীন ছিল, তারা গণতান্ত্রিক প্রক্রিয়ায় ক্ষমতায় আসতে শুরু করে, তখন প্রতিষ্ঠিত মধ্যবিত্ত ও এলিট শ্রেণিরা নিজেদের ক্ষমতা ও প্রভাব হারানোর আশঙ্কায় পড়ে যায়।
দেখা যায়, যারা আগে গণতন্ত্রের পক্ষে ছিল, তারা যখন দেখলো গ্রামীণ দরিদ্র জনগোষ্ঠী গণতন্ত্রের মাধ্যমে রাজনৈতিকভাবে শক্তিশালী হচ্ছে, তখন তারা এই পরিবর্তনের ভয়ে গণতন্ত্রের বিরুদ্ধে দাঁড়িয়ে যায়। তারা গণতান্ত্রিক প্রক্রিয়া থেকে দূরে সরে গিয়ে সামরিক শাসন এবং কর্তৃত্ববাদী শাসনের পক্ষে সমর্থন দিতে শুরু করে, কারণ তারা মনে করেছিল যে, এই ধরনের শাসন তাদের সামাজিক ও রাজনৈতিক ক্ষমতা রক্ষা করতে পারবে।

এই ভয় শুধু রাজনৈতিক ক্ষমতা হারানোর নয়, বরং সামাজিক শ্রেণি ও স্ট্যাটাস হারানোরও। যখন এক শ্রেণির মানুষ গণতন্ত্রের মাধ্যমে ক্ষমতা লাভ করে এবং অন্য শ্রেণির মানুষ তাদের সামাজিক ও অর্থনৈতিক প্রভাব হারানোর ভয় পায়, তখন তারা গণতন্ত্রের নিয়ম-কানুনকে অস্বীকার করে কর্তৃত্ববাদকে সমর্থন করতে প্রস্তুত হয়। 

প্রমাণ হিসেবে থাইল্যান্ডের কথা বলা যায় এখানে। থাই ডেমোক্র্যাটিক পার্টি, যারা একসময় নিজেদের গণতন্ত্রের ধারক-বাহক হিসেবে প্রতিষ্ঠিত করেছিল, কীভাবে ভয়ের কারণে কর্তৃত্ববাদকে সমর্থন করতে বাধ্য হলো তা থাইল্যান্ডের সাম্প্রতিক রাজনৈতিক ইতিহাস থেকে বোঝা যায়।

২০১৩-২০১৪ সালে থাই ডেমোক্র্যাটিক দল এবং তাদের সমর্থকরা গণতন্ত্রের পরিবর্তে সামরিক শাসন ও কর্তৃত্ববাদকে সমর্থন করতে শুরু করে। তারা মনে করে যে, সামরিক বাহিনী ও শক্তিশালী নেতৃত্ব তাদের সামাজিক অবস্থান এবং পুরোনো রাজনৈতিক কাঠামোকে রক্ষা করতে পারবে।

থাই ডেমোক্র্যাটস দলের মূল ভিত্তি ছিল শহুরে মধ্যবিত্ত শ্রেণি, বিশেষত ব্যাংকক ও দক্ষিণ থাইল্যান্ডের ভোটাররা। তবে, তারা কখনোই উত্তর ও গ্রামীণ অঞ্চলের দরিদ্র কৃষক ও নিম্নবিত্ত জনগোষ্ঠীর প্রতি আকৃষ্ট হতে পারেনি। এক সময়, এই বিভাজন খুব একটা গুরুত্বপূর্ণ ছিল না কারণ গ্রামের ভোটাররা তেমন রাজনৈতিক প্রভাবশালী ছিল না এবং তাদের ভোট প্রায়শই কিনে নেওয়া যেতো। 

কিন্তু ১৯৯৭ সালের এশীয় অর্থনৈতিক সংকটের পরে রাজনৈতিক প্রেক্ষাপটে বড় পরিবর্তন ঘটে। ব্যবসায়ী টাইকুন থাকসিন শিনাওয়াত্রা এবং তার দল "থাই রাখ থাই" দিয়ে দরিদ্র জনগোষ্ঠীর কাছে পৌঁছাতে সক্ষম হন এবং তাদের জন্য স্বাস্থ্যসেবা, ঋণ মওকুফসহ বিভিন্ন নীতি গ্রহণ করেন। এর ফলে থাকসিন বিশাল ভোটব্যাংক তৈরি করতে সক্ষম হন।

মধ্যবিত্ত শ্রেণির ভয়ের উত্থান

২০০১ থেকে ২০১১ সালের মধ্যে থাই ডেমোক্র্যাটিক দল টানা পাঁচটি নির্বাচনে পরাজিত হয়। তাদের শহুরে মধ্যবিত্ত বুঝতে পারে যে, তারা আর নির্বাচনী প্রতিযোগিতায় টিকে থাকতে পারছে না। কারণ গ্রামীণ দরিদ্র জনগোষ্ঠী, যারা একসময় অবহেলিত ছিল, এখন নির্বাচনী প্রক্রিয়ায় প্রধান ভূমিকা পালন করছে এবং এই পরিবর্তন তাদের ক্ষমতা ও সামাজিক অবস্থানকে চ্যালেঞ্জ করছে। ধনী ও শিক্ষিত ব্যাংকক এলিট শ্রেণি নিজেকে সংখ্যালঘু মনে করতে শুরু করে এবং গণতন্ত্র তাদের আর উপকারে আসছে না বলে মনে করে।

সমাজে স্থান হারানোর ভয়

শুধু রাজনৈতিক ক্ষমতা নয়, বরং সামাজিক ও অর্থনৈতিক অবস্থান হারানোর ভয় ডেমোক্র্যাটিক পার্টির সমর্থকদের মধ্যে গভীরভাবে প্রোথিত ছিল। গ্রামীণ দরিদ্র জনগোষ্ঠীর আয় বৃদ্ধি পায় এবং তারা সামাজিকভাবে দৃঢ় হয়ে ওঠে। ফলে শহুরে মধ্যবিত্ত ও এলিট শ্রেণিরা নিজেদের অবস্থানকে রক্ষার জন্য এক ধরনের প্রতিরক্ষামূলক অবস্থানে চলে যায়। তারা মনে করতে শুরু করে যে, গ্রামের দরিদ্র জনগোষ্ঠী গণতন্ত্রকে ভুল ভাবে ব্যবহার করছে, এবং তাদের দাবি-দাওয়াকে "লোভী" বলে মনে করে।

কর্তৃত্ববাদকে সমর্থন

এই ভয়ের কারণে, ২০১৩-২০১৪ সালে থাই ডেমোক্র্যাটিক দল এবং তাদের সমর্থকরা গণতন্ত্রের পরিবর্তে সামরিক শাসন ও কর্তৃত্ববাদকে সমর্থন করতে শুরু করে। তারা মনে করে যে, সামরিক বাহিনী ও শক্তিশালী নেতৃত্ব তাদের সামাজিক অবস্থান এবং পুরোনো রাজনৈতিক কাঠামোকে রক্ষা করতে পারবে। গণতন্ত্রে বারবার হেরে গিয়ে এবং নিজস্ব রাজনৈতিক প্রভাব হারিয়ে, তারা সামরিক অভ্যুত্থানের মাধ্যমে ক্ষমতায় ফেরার চেষ্টা করে এবং নির্বাচনের পরিবর্তে শাসনব্যবস্থার বিকল্প পথে হাঁটে। ২০১৪ সালে থাইল্যান্ডের প্রথম নারী প্রধানমন্ত্রী, ইংলাক সিনাওয়াত্রাকে ক্ষমতাচ্যুত করে। অথচ ইংলাক সিনাওয়াত্রা গণতান্ত্রিকভাবে নির্বাচিত প্রধানমন্ত্রী ছিলেন। 

ফলাফল

থাই ডেমোক্র্যাটিক দল এবং তাদের সমর্থকদের ভয় মূলত ছিল তাদের রাজনৈতিক ও সামাজিক ক্ষমতা হারানোর। যখন তারা দেখলো যে গণতন্ত্র তাদের বিরুদ্ধে কাজ করছে এবং গ্রামীণ দরিদ্র জনগোষ্ঠী ক্ষমতায় আসছে, তখন তারা গণতন্ত্রের প্রতি তাদের আনুগত্য ছেড়ে সামরিক শাসনকে সমর্থন করতে শুরু করে। ফলে যা হবার তাই হল। থাইল্যান্ডে সেনা শাসন শুরু হয় এবং ……বাকিটা বুঝে নিন! 

আমার ধারণা, ‘ভয়’ বাংলাদেশের মানুষের মনের মধ্যে গভীরভাবে ঢুকে গেছে। ভয় হলো ক্ষমতা হারানোর ভয়, ক্ষমতা না পাওয়ার ভয়, সামাজিকভাবে স্ট্যাটাস না পাওয়ার ভয়, অর্থনৈতিকভাবে চুরি-চামারি ও দুর্নীতি না করতে পারার ভয়, সাংস্কৃতিকভাবে নিজেদের পরিচয় হারানোর ভয়। ফলে, ভয় থেকে বাঁচতে গিয়ে তারা যেকোনো কিছু করতে পারে, হাত মেলাতে পারে এমন লোকের সাথে যে কিনা কর্তৃত্ববাদে এবং ফ্যাসিবাদে শক্তভাবে বিশ্বাস করে। যদি এই অবস্থা হয়, তাহলে বলা যায় বাংলাদেশের ভবিষ্যৎ অন্ধকার।

লেখক: মো. আকমাল হোসাঈন, প্রভাষক, রাষ্ট্রবিজ্ঞান বিভাগ, জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয়।