২০ সেপ্টেম্বর ২০২৪, ১৪:৫৬

চীনে বাংলা ভাষা ও সংস্কৃতিতে উচ্চশিক্ষার চাহিদা পূরণে সরকারের করণীয়

ড. এ.বি.এম.রেজাউল করিম ফকির  © টিডিসি ফটো

বিশ্বায়ন প্রক্রিয়ায় বিশ্বের দেশসমূহের মধ্যকার পারস্পরিক সংজ্ঞাপন ও যোগাযোগ বৃদ্ধি পাচ্ছে। সে কারণে বিশ্বের নানা দেশে বিদেশি ভাষার শিক্ষা ও গবেষণা কার্যক্রম প্রসারিত হচ্ছে। অনেক দেশে বিদেশি ভাষা হিসেবে বাংলা ভাষার শিক্ষা ও গবেষণা শুরু হয়েছে ও তার ব্যাপ্তি বৃদ্ধি পাচ্ছে। যে সব দেশে বিদেশি ভাষা হিসেবে বাংলা ভাষার শিক্ষা ও গবেষণা বৃদ্ধি পাচ্ছে, চীন তার মধ্যে অন্যতম। 

চীনে গত এক দশকে ৪টি বিশ্ববিদ্যালয়ে বাংলা ভাষা ও সংস্কৃতি বিষয়ে স্নাতক (সম্মান) শিক্ষা কার্যক্রম চালু হয়েছে। এ বিশ্ববিদ্যালয়গুলো হলো: 

১) চীন সাংজ্ঞাপনিক বিশ্ববিদ্যালয় (Zhōngguó Chuánméi Dàxué), 

২) বেইজিং বিদেশি ভাষা বিশ্ববিদ্যালয় (Běijīng Wàiguóyǔ Dàxué), 

৩) গুয়াংজু বিদেশ বিদ্যা ও বৈদেশিক বাণিজ্য বিশ্ববিদ্যালয় (Guǎngdōng wàiyǔ wàimào dàxué)  

৪) ইউনান জাতিসত্তা বিশ্ববিদ্যালয় (Yúnnán mínzú dàxué)। 

এছাড়া ইউনান বিশ্ববিদ্যালয়ে (Yúnnán dàxué) বাংলা ভাষায় নন ডিগ্রি শিক্ষা কার্যক্রম চালু আছে। 

এসব বিশ্ববিদ্যালয়ের বাংলা বিভাগের সাথে আধুনিক ভাষা ইনস্টিটিউটের বিদ্যায়তনিক যোগাযোগ চলছে এবং আধুনিক ভাষা ইনস্টিটিউট নিজস্ব সামর্থ্য অনুযায়ী এসব বিশ্ববিদ্যালয়ের চাহিদা পূরণে সচেষ্ট রয়েছে। কিন্তু সাম্প্রতিককালে প্রথম ৩টি বিশ্ববিদ্যালয়ের সাথে শিক্ষা ও গবেষণা সহযোগিতা সহায়ক সমঝোতা স্মারক স্বাক্ষরিত হয়েছে এবং ইউনান জাতিসত্তা বিশ্ববিদ্যালয়ের (Yúnnán mínzú dàxué) সাথে সমঝোতা স্মারক সাক্ষরের প্রক্রিয়া চলছে।

আরও পড়ুন: কলেজিয়েট বিশ্ববিদ্যালয় হলে বহুগুণে বাড়বে সাত কলেজের শিক্ষার মান 

এসব বিশ্ববিদ্যালয়ের সাথে বিদ্যায়তনিক যোগাযোগ প্রতিষ্ঠার পর থেকে, এসব বিশ্ববিদ্যালয়ের কর্তৃপক্ষ শিক্ষা ও গবেষণায় সহযোগিতার অনুরোধ জানিয়ে যোগাযোগ করে চলেছে। যে সব বিষয়ে এসব বিশ্ববিদ্যালয় সহযোগিতা চেয়ে চিঠি লিখেছে তা হলো নিম্নরূপ:

১) চার বছর মেয়াদি বাংলা ভাষা ও সংস্কৃতি বিষয়ে স্নাতক (সম্মান) শিক্ষাকার্যক্রমের ৩য় বর্ষ আধুনিক ভাষা ইনস্টিটিউটে সম্পাদনের সুযোগ রেখে যৌথ স্নাতক ডিগ্রি শিক্ষাকার্যক্রম চালু করণ।

২) চীনা বিশ্ববিদ্যালয়ে স্নাতক সম্পন্নকারী শিক্ষার্থীদের জন্য বাংলা ভাষা ও সংস্কৃতিতে স্নাতকোত্তর শিক্ষা কার্যক্রম চালু করণ।

৩) চীনা বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীদের জন্য বাংলা ভাষা ও সংস্কৃতিতে স্বল্পমেয়াদি গ্রীষ্মকালীন ও শীতকালীন শিক্ষা কার্যক্রম চালু করণ।

৪) চীনা বিশ্ববিদ্যালয়ে কর্মরত চীনা শিক্ষকদের জন্য বিদেশি ভাষা হিসেবে বাংলা ভাষা শিক্ষাদান বিষয়ে শিক্ষক প্রশিক্ষণ কোর্স পরিচালনা।

৫) চীনা বিশ্ববিদ্যালয়ে কর্মরত চীনা শিক্ষক ও শিক্ষার্থীদের অংশগ্রহণে বাংলা ভাষা ও সংস্কৃতি বিষয়ে সেমিনার ও সম্মেলন আয়োজন।

৬) চীনা বিশ্ববিদ্যালয় ও ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের মধ্যকার শিক্ষক ও শিক্ষার্থী বিনিময়ের সুযোগ সৃষ্টি।

৭) চীনা বিশ্ববিদ্যালয় ও ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের উদ্যোগে যৌথ গবেষণা পরিচালনা।

৮) চীনা বিশ্ববিদ্যালয়ে অধ্যয়নরত বাংলা ভাষা ও সংস্কৃতি বিষয়ের শিক্ষার্থী ও ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে অধ্যয়নরত চীনা ভাষা ও সংস্কৃতি বিষয়ের শিক্ষার্থীদের মধ্যে পাঠ অনুশীলন অংশীদারিত্বের সুযোগ সৃষ্টি।

৯) চীনা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে আগত শিক্ষক ও শিক্ষার্থীদের জন্য পর্যাপ্ত আবাসনের ব্যবস্থা করণ।

১০) আধুনিক ভাষা ইনস্টিটিউটের শ্রেণিকক্ষে বিদেশিদের বিদেশি ভাষা হিসাবে বাংলা ভাষা পাঠদানের ভিডিও ধারণ এবং তা এসব বিশ্ববিদ্যালয়ে প্রেরণ।

১১) বিদেশি ভাষা হিসাবে বাংলা ভাষার পাঠ্যপুস্তকের তালিকা সরবরাহ গণপ্রজাতন্ত্রী চীনে প্রতিষ্ঠিত বিশ্ববিদ্যালয়গুলো বিদেশি ভাষা হিসাবে বাংলা ভাষা শিক্ষা ও গবেষণার বিষয়ে উক্ত চাহিদাগুলো জানিয়ে যোগাযোগ করছে বিধায় আমরা বিদেশি ভাষা হিসাবে বাংলা ভাষা শিক্ষা ও গবেষণা কার্যক্রমের প্রতিবন্ধকতাগুলো কী সে সম্পর্কে অবগত হয়েছি। কিন্তু বিশ্বের অন্যান্য দেশের বিশ্ববিদ্যালয় বিদেশি ভাষা হিসাবে বাংলা ভাষা শিক্ষা ও গবেষণা কার্যক্রম পরিচালনায় কী কী প্রতিবন্ধকতা মোকাবেলা করছে তা আধুনিক ভাষা ইনস্টিটিউট অবহিত নয়।

তবে গণপ্রজাতন্ত্রী চীনের বিশ্ববিদ্যালয়গুলো থেকে বিদেশি ভাষা হিসাবে বাংলা ভাষা শিক্ষা ও গবেষণা পরিচালনায় চাহিদা মোতাবেক সহযোগিতা প্রদানের মতো প্রস্তুতি আধুনিক ভাষা ইনস্টিটিউট নেই। কারণ এসব চাহিদা পরিপূরণে প্রয়োজনীয় আধুনিক ভাষা ইনস্টিটিউটের প্রশাসন, ব্যবস্থাপনা, আর্থিক সংগতি ও অবকাঠামো নেই।

কারণ আধুনিক ভাষা ইনস্টিটিউট এর সৃষ্টি লগ্নে যেসব সক্ষমতা নিয়ে বাংলা ভাষা শিক্ষা ও গবেষণা পরিচালনা করছে, সেই সক্ষমতাই এখনও বজায় রয়েছে। বিশ্বায়নের প্রক্রিয়ায় সারাবিশ্বে বাংলা ভাষা শিক্ষা ও গবেষণা কার্যক্রম বৃদ্ধি পেলেও, আধুনিক ভাষা ইনস্টিটিউটের যুগোপযোগী উন্নয়ন গ্রহণ করা হয়নি। আধুনিক ভাষা ইনস্টিটিউটকে বিশ্বায়নের সাথে খাপ খাওয়ানো মতো অবস্থায় বিদেশি ভাষা হিসাবে বাংলা ভাষা শিক্ষা কার্যক্রমকে উন্নীত করার দায়িত্ব মূলত আধুনিক ভাষা ইনস্টিটিউট কর্তৃপক্ষের।

কিন্তু যুগোপযোগী সক্ষমতা অর্জনে যে মহাপরিকল্পনা প্রয়োজন তা প্রণয়ন ও বাস্তবায়নের ক্ষমতা আধুনিক ভাষা ইনস্টিটিউটের নেই। কারণ এই মহাপরিকল্পনা হবে ব্যাপক ভিত্তিক। এই মহাপরিকল্পনায় অন্তর্ভুক্ত থাকবে আধুনিক ভাষা ইনস্টিটিউটের প্রশাসন, ব্যবস্থাপনা, আর্থিক সংগতি ও অবকাঠামোগত উন্নয়নের রূপকল্প। 

কাজেই প্রস্তাবিত মহাপরিকল্পনা ব্যাপ্তি চিন্তা করলে, তা প্রণয়ন ও বাস্তবায়নের দায় বর্তায় ঊর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষের উপর। সে হিসাবে এই মহাপরিকল্পনার দায় বর্তায় ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের কেন্দ্রীয় কর্তৃপক্ষের। কিন্তু এর সার্বিক দায় ও দায়িত্ব বর্তায় বাংলাদেশ সরকারের শিক্ষা মন্ত্রণালয়ের উপর। 

বস্তুত: বিশ্বায়নের ফলশ্রুতিতে বিশ্বজুড়ে বিভিন্ন বিশ্ববিদ্যালয়ে বিদেশি ভাষা হিসাবে বাংলা ভাষার শিক্ষা ও গবেষণা প্রবৃদ্ধ হচ্ছে। কাজেই বিদেশিদের উদ্যোগে বিদেশে গৃহীত বিদেশি ভাষা হিসাবে বাংলা ভাষার শিক্ষা ও গবেষণা কার্যক্রমের উন্নয়নে সহযোগিতা করা প্রত্যেক বাংলা ভাষাভাষীর নৈতিক ও সামাজিক দায়িত্ব। 

এই দায়িত্ব শুধু ব্যক্তি পর্যায়ে নয় বরং দায়িত্ব রয়েছে প্রতিটি জাতীয়তাবাদী সামাজিক-সাংস্কৃতিক সংগঠনের, প্রতিষ্ঠানের ও সরকারের। এই দায়দায়িত্ব এড়িয়ে গেলে আমাদের মাতৃভাষা, জাতীয় ভাষা ও রাষ্ট্র ভাষা বাংলা বিশ্বায়নের সাথে তাল মিলিয়ে এগিয়ে যেতে পারবে না। নানান ভাষার সাথে প্রতিযোগিতায় হেরে গিয়ে বিশ্বায়নের ভাষা হিসেবে এর গুরুত্ব হারিয়ে যাবে।

লেখক: অধ্যাপক, আধুনিক ভাষা ইনস্টিটিউট, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়