ক্ষমতা নয়, বিপ্লবকে টিকিয়ে রাখাই জামায়াতের প্রধান লক্ষ্য হওয়া উচিত

রেজাউল ইসলাম
রেজাউল ইসলাম

৫ আগস্টের গণ-অভ্যুত্থানের পরে শেখ হাসিনা উত্তর বাংলাদেশে একটি কথা অনেকের মুখে খুব জোরালোভাবে ধ্বনিত হচ্ছে। সেটা হলো বাংলাদেশ জামায়াতে ইসলামী এই পরিবর্তিত পরিস্থিতিতে বাংলাদেশের অন্যতম জনপ্রিয় দল এবং ইসলামি সমমনা দলগুলোর সঙ্গে জোট গঠন সাপেক্ষে তারা আগামী নির্বাচনে ক্ষমতার মসনদেও চলে আসতে পারে।

জামায়াত অবশ্য বিগত দিনগুলোতে তাদের সংগঠনের ইতিহাসের সবচেয়ে কঠিন লড়াইগুলোতে মাঠে টিকে থেকেই এ সম্ভবনা তৈরি করতে সক্ষম হয়েছে। এজন্য বিজ্ঞজনদের কাছ থেকে তারা এমন চমকপ্রদ প্রশংসা লাভ করতেই পারে। 

তবে এমনও কিছু বিজ্ঞ মানুষ আছেন যারা মনে করছেন, এখনই ক্ষমতায় গেলে অনাগত দিনগুলোতে জামায়াতকে পূর্বের তুলনায় আরো বেশি শ্বাপদসংকুল পথ পাড়ি দিতে হতে পারে। এজন্য জামায়াতকে এই মুহূর্তে সিংহাসনে বসার উচ্চাকাঙ্ক্ষা পরিহার করতে হবে।

বাংলাদেশ জামায়াতে ইসলামী ১৯৭১ সালের মুক্তিযুদ্ধ পরবর্তী সময়গুলোর মধ্যে সবচেয়ে কঠিন সময় পার করেছে ২০০৯-২০২৪ সময়কালে। ষোল বছরের দীর্ঘ এই সময়ে বিগত আওয়ামী সরকার কর্তৃক এই দলটির বিরুদ্ধে এক পরিকল্পিত ধারাবাহিক অপপ্রচার চালিয়ে দেশে-বিদেশে দলটির ভাবমূর্তি ভীষণভাবে ক্ষুণ্ন করেছিল এবং সেই পরিকল্পিত অপপ্রচারের অংশ হিসেবেই তাদের শীর্ষ নেতাদের সবাইকে মানবতাবিরোধী অপরাধের অভিযোগে অভিযুক্ত করে ফাঁসিতে ঝুলিয়েছিল। 

ফাঁসিতে ঝোলানো এই নেতাদের মধ্যে ছিলেন জামায়াতের অন্যতম জনপ্রিয় মুখ, সাবেক নায়েবে আমির মতিউর রহমান নিজামী, দলের সেক্রেটারি জেনারেল আলী আহসান মোহাম্মদ মুজাহিদ, সহকারী সেক্রেটারি জেনারেল কাদের মোল্লা এবং মোহাম্মদ কামরুজ্জামান। আর একই অপরাধে আওয়ামী সরকারের জেলখানায় আমরণ কারান্তরীণ থেকে মৃত্যুবরণ করেছিলেন দলটির আধ্যাত্মিক গুরু এবং সাবেক নায়েবে আমির অধ্যাপক গোলাম আযম এবং দলটির আরেক সাবেক আমির এবং জনপ্রিয় ইসলামিক বক্তা আল্লামা দেলাওয়ার হোসাইন সাঈদী।

রাজনৈতিক দল হিসেবে একসাথে এতগুলো  মেধাবী, দূরদর্শী ও চৌকস নেতা হারানোর ঘটনা জামায়াতের মতো একটা ছোট দলের জন্য খুবই চ্যালেঞ্জিং ছিল। বলতে গেলে সে সময় বাংলাদেশ জামায়াতে ইসলামী এই দক্ষ, যোগ্য ও জনপ্রিয় মুখগুলোর উপরই বহুলাংশে নির্ভর করত। যারা সেসময় বাংলাদেশ জামায়াতে ইসলামীকে ভোট দিতেন, তারা মূলত তখন এই নেতাগুলোর জন্যই ভোট দিতেন। তারা ছিলেন এই দলটির লক্ষ লক্ষ নেতা-কর্মীদের কাছে বটবৃক্ষের মতো মহান। 

কিন্তু হঠাৎ একটি আকস্মিক ঝড়ে সব যেন লন্ডভন্ড হয়ে গেল। একের পর এক উপড়ে পড়তে থাকল এক একটি বৃহদাকার বটবৃক্ষ। নেতাকর্মীদের মাথার উপর থেকে সরে যেতে থাকল হিমশীতল ছায়া। একের পর এক মতাদর্শিক গুরু হারিয়ে নেতাকর্মীরা দিকভ্রান্ত হয়ে পড়লেন। এর সাথে দলটির মাথার উপরে যোগ হলো যুদ্ধাপরাধ ও মানবতাবিরোধী অপরাধের মতো ঘৃণ্য কলঙ্ক। দেশের বিভিন্ন প্রান্তে তাদেরকে রাজাকার, আলবদর, আল শামস, একাত্তরের ঘাতক বলে গালি দিতে থাকা হলো। এভাবে আস্তে আস্তে দলটি দেশের মূলধারার রাজনীতি থেকে ব্রাত্য হয়ে পড়ল। এতে করে দলটির অনেক নেতা-কর্মী তাদের আদর্শিক কর্মস্পৃহা হারাতে লাগলেন।

এ তো গেল জামায়াতের অভ্যন্তরীণ সংকটের কথা। তার বাহ্যিক সংকটটা হয়ে উঠল আরো কঠিন। যুদ্ধাপরাধ ও মানবতাবিরোধী অপরাধের অভিযোগে শীর্ষ নেতারা যখন পর্যুদস্ত এবং দল যখন কোনঠাসা হয়ে পড়ল, তখন এ থেকে উত্তরণের একমাত্র পথ হয়ে উঠল শেখ হাসিনার হাত থেকে গণতন্ত্রকে ফিরিয়ে আনার আবরণে বিএনপির সাথে রাজপথে যুগপৎ আন্দোলন গড়ে তোলা। ২০১৪ সালের জাতীয় নির্বাচন তত্ত্বাবধায়ক সরকারের অধীনে আয়োজন করার দাবিতে রাজপথে অনড় থেকে কয়েক মাস একাধারে আন্দোলন চালিয়ে গেল। 

আন্দোলোনটি ছিল সরকার ও বিরোধীদল উভয় পক্ষের তরফ থেকে অত্যন্ত রক্তক্ষয়ী। শেখ হাসিনার সরকার বিরোধীদলের রাজপথের এই লাগাতার অবরোধ, হরতালকে দেশ ও বিদেশে নাশকতা, সহিংসতা ও আগুন সন্ত্রাস হিসেবে প্রচার করতে লাগল। যেহেতু আগেই তাদেরকে বহির্বিশ্বে যুদ্ধাপরাধী ও মানবতাবিরোধী রাজনৈতিক দল হিসেবে পরিচিত করে দেওয়া হয়েছিল, সেহেতু জামায়াতের নামে সরকার কর্তৃক প্রচার হওয়া এই নাশকতা ও আগুন সন্ত্রাসের অভিযোগ ইউরোপ, আমেরিকা ও ভারতের কাছে হালে পানি পেল।

শুধু তাই নয়, শেখ হাসিনার সরকার আগেই জামায়াতকে অন্যান্য কট্টরপন্থী ইসলামি দল যেমন: হেফাজতে ইসলাম, হিজবুত তাহরীর, হিজবুত তাওহীদ ইত্যাদি দলের সাথে মিশিয়ে একটা ইসলামি সন্ত্রাসবাদী দল হিসেবে বহির্বিশ্বের কাছে প্রতিষ্ঠিত করতে সক্ষম হয়েছিল। শেখ হাসিনার সরকার বিদেশীদের কাছে এ ধারণাটি প্রতিষ্ঠা করতে পেরেছিল ২০১৩ সালে সংঘটিত হেফাজতে ইসলামের শাপলা চত্বর অবরোধের ঘটনা দিয়ে।

৫ মের সেই আলোচিত ঘটনাকে সরকার নিজের মতো করে সাজিয়ে, গুছিয়ে, বিকৃত করে ইসলামি মৌলবাদীদের সন্ত্রাসী কর্মকাণ্ড হিসেবে দেখিয়েছিল। তারা টুপি-দাঁড়ি ওয়ালা আলেমদের লাঠিসোঁটা হাতে রাস্তাঘাট অবরোধ ও ভাংচুরের স্থিরচিত্র ও ভিডিও ফুটেজ পশ্চিমাদের দেখিয়ে তাদেরকে বুঝিয়েছিল যে, বাংলাদেশে ইসলামপন্থী দল মানেই তারা এসব সন্ত্রাসী কর্মকাণ্ডে লিপ্ত।

সেসময় হেফাজতের আলোচিত তেরো দফাকে তারা মধ্যযুগীয় রাষ্ট্রব্যবস্থার প্রতীক হিসেবে প্রচার করেছিল।এ ই তেরো দফার আলোকেই তারা অভিযোগ করেছিল যে, এই ইসলামপন্থীরা নারীদেরকে আবার চার দেয়ালের মধ্যে ঢুকাতে চায়, দেশে শরিয়া আইন চালু করে ভিন্ন মতাবলম্বীদের নির্মূল করতে চায়, ভিন্ন ধর্মের মানুষকে দেশের দ্বিতীয় শ্রেণির নাগরিক বানাতে চায়, দেশের প্রগতিশীল চিন্তাচেতনা ও শিল্প-সংস্কৃতিকে নির্মূল করতে চায় ইত্যাদি।

দেশের সকল ইসলামপন্থী গোষ্ঠীকে এমন নেতিবাচকভাবে চিত্রায়িত করার মধ্যে দিয়েই শেখ হাসিনার সরকার বারবার বহির্বিশ্বের সমর্থন নিয়ে বিতর্কিত নির্বাচন করে ক্ষমতায় আসছিল। সর্বশেষ ২০২৪ সালের ৭ জানুয়ারির নির্বাচনও ছিল এমন একতরফা বিতর্কিত নির্বাচন। তবুও ইসলামপন্থীরা এর প্রতিবাদে মাঠে নামতে পারছিল না। মাঠে নামলেই যে সেই একই কায়দায় টুপি-দাঁড়ি ওয়ালাদের ইসলামি সন্ত্রাসবাদ হিসেবে কলঙ্কিত করা হবে! 

কিন্তু শেখ হাসিনার সরকারের শেষ রক্ষা হলো না। দীর্ঘদিনের জামায়াত-শিবির 'ব্লেম গেম' আর 'ইসলামি সন্ত্রাসবাদের' তকমা দিয়ে জামায়াত-শিবির আর ইসলামপন্থীদের দমিয়ে রাখতে সক্ষম হলেও শেখ হাসিনার পতন হলো দেশের সাধারণ ছাত্রদের হাতে। স্বৈরাচারের তকমা নিয়ে উল্টো তারা নিজেরাই দেশ ছেড়ে পালিয়ে গেল।

এখন প্রশ্ন হচ্ছে, আওয়ামী লীগ দেশ ছেড়ে পালিয়ে গেলেও কি তারা চুপ করে বসে আছে? উত্তর হলো 'না'। তারা গত ষোলটি বছর যেভাবে জামায়াত-শিবির আর ইসলামি সন্ত্রাসবাদের 'ব্লেম গেম' খেলে দেশি-বিদেশি সবার চোখে ধুলো দিয়ে দেশ শাসন করেছে, এখনও ঠিক একই 'ব্লেম গেম' এর উপরে ভর করে তারা রাজনীতিতে ফিরতে চায়। কিন্তু সেটা কীভাবে? এটা তারা এখন করতে চায় বিপ্লব পরবর্তী বাংলাদেশে জামায়াত-শিবির ও ইসলামপন্থীদেরকে রাজনীতিতে কৌশলগতভাবে সমর্থনের মধ্যে দিয়ে। তারা এখন বিদেশে বসে ছক কষে জামায়াতে ইসলামী বা সমমনা ইসলামি দলগুলোকে ক্ষমতায় আনতে চায়। কারণ আওয়ামী লীগের অনুপস্থিতিতে বাংলাদেশে ইসলামপন্থীরা ক্ষমতায় এলেই তারা পশ্চিমাদের দেখাতে পারবে যে, আওয়ামী লীগ নেই বলেই দেশটা আজ পাকিস্তানের মতো জঙ্গি দেশে পরিণত হলো। 

আওয়ামী লীগ নেই বলেই দেশটা আজ কট্টরপন্থী ইসলামি মৌলবাদীদের খপ্পরে পড়ল। আওয়ামী লীগ নেই বলেই দেশে আজ বৃহত্তর জন পরিসরে নারীদের চলাফেরা সীমিত হয়ে গেল ইত্যাদি। এই আশঙ্কাকে সত্য প্রমাণ করে ইতোমধ্যেই ভারত সরকার বাংলাদেশ জামায়াতে ইসলামীর সাথে সম্পর্ক উন্নয়ন করে এক সাথে কাজ করার ঘোষণা দিয়েছে।

কিন্তু পরিতাপের বিষয় হলো, বাংলাদেশ জামায়াতে ইসলামী আওয়ামী লীগের পাতা এই ফাঁদটা ধরতে ব্যর্থ হচ্ছে। আওয়ামী লীগই যে ভারত সরকারকে মাঠে নামিয়ে দিয়েছে বাংলাদেশের আসন্ন জাতীয় নির্বাচনে জামায়াতকে জয়ী করে তাদের পরিকল্পিত ফাঁদে ফেলতে -এটাও তারা বুঝতে পারছে না। তারা মনে করছে একবার ক্ষমতায় আসতে পারলেই দেশটাকে তারা ইসলামি প্রজাতন্ত্র হিসেবে প্রতিষ্ঠিত করে ফেলবেন। 

কিন্তু আওয়ামী লীগ আর ভারত যে এই বাংলাদেশকে একটি ইসলামি প্রজাতন্ত্র হিসেবে প্রতিষ্ঠিত করার জন্য জামায়াতকে সমর্থন করছে না, বরং জামায়াতকে ক্ষমতায় এনে আরও একবার ইসলামি সন্ত্রাসবাদের তকমা দিয়ে দেশটাকে চিরদিনের জন্য নিজেদের করায়ত্তে নিতে চায় সেই ধোঁকার জায়গাটি জামায়াত ধরতে পারছে না। এই ইস্যুতে জামায়াতের নীতিনির্ধারকদের উচিত মিসরের মুসলিম ব্রাদারহুডের মুহাম্মদ মুরসির সেই ভয়ঙ্কর পরিণতির কথা স্মরণ করা। 

দেশের এমন ক্রান্তিকালে ক্ষমতার সিংহাসনে বসার চেয়ে বেশি গুরুত্বপূর্ণ হচ্ছে হাজারো জীবনের বিনিময়ে অর্জিত জুলাই বিপ্লবকে স্থায়ীভাবে ধরে রাখার জন্য বিপ্লবের সকল অংশীজনকে সাথে নিয়ে বৃহত্তর জাতীয় ঐক্য গড়ে তোলা। আর সেই জাতীয় ঐক্যের ভিত্তিতে সর্বদলীয় সরকার গঠন করে দীর্ঘমেয়াদে দেশ পরিচালনা করা। এতে আবু সাঈদদের রক্ত দিয়ে অর্জিত বিপ্লব হাজারো ষড়যন্ত্র সত্ত্বেও টিকে থাকবে। কিন্তু ভারত ও আওয়ামী লীগের টোপে পড়ে বিপ্লবের অন্য অংশীজনের সাথে দূরত্ব তৈরি করে বাংলাদেশ জামায়াতে ইসলামীর মধ্যে যদি ক্ষমতার খায়েশ তৈরি হয়, তবে খুব দ্রুতই জুলাই বিপ্লবটি বিপ্লবীদের হাত ছাড়া হয়ে যাবে।

লেখক: রেজাউল ইসলাম, রাজনীতি বিশ্লেষক 


সর্বশেষ সংবাদ